টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌরুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের সংঘাত চলছে অনেক দিন ধরেই। গত দুই মাসে এই সংঘর্ষ আরও বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সীমান্তের এ-পারে বাংলাদেশেও। মিয়ানমার বাহিনী একাধিকবার আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, গোলাগুলিতে প্রাণ ঝরেছে। এই অবস্থার মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত এল।
যদিও জেলা প্রশাসন বলছে নাফ নদীতে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়ায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলেছে, সাগর উত্তাল থাকার পাশাপাশি কালবৈশাখীর শঙ্কা থাকায় দুর্ঘটনা এড়াতে প্রতি বছর এপ্রিল থেকে সেপেটম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন ও সেন্ট মার্টিন-কক্সবাজার রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এবার টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধের এই সময়কাল বৃদ্ধির পেছনে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে সংঘর্ষ একটি বড় কারণ। নাফ নদীর নাব্যতা সংকটও আরেকটি কারণ।
টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে যাত্রী নিয়ে মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষে সেন্ট মার্টিন যাতায়াত করে আটটি জাহাজ। এর মধ্যে দুটি এসি ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন। দুই ঘণ্টায় টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন পৌঁছায় এসব জাহাজ। এ ছাড়া কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ও চট্টগ্রাম থেকে এমভি বে-ওয়ান সেন্ট মার্টিন যাতায়াত করে। বিলাসবহুল এসব জাহাজে স্বস্তি থাকলেও টানা ৮-১০ ঘণ্টা থাকতে হয় সাগরে।
প্রায় দুই মাস ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল, গোলাগুলিসহ নানা ভারী অস্ত্রের আওয়াজে এ-পারে বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু ও বাইশপারী এলাকার মানুষ দিন কাটাচ্ছেন আতঙ্কে। গোলার আওয়াজ উখিয়া-টেকনাফের সীমান্ত এলাকায়ও শোনা যায়।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড় থেকে ছোড়া মর্টার শেল বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে পড়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার বেশ কয়েকবার আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে। সর্বশেষ গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে তুমব্রুর কোনারপাড়া সীমান্তে শূন্যরেখায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। আহত হন রোহিঙ্গা শিশুসহ পাঁচজন। একই দিন দুপুরে এই সীমান্তের হেডম্যানপাড়ায় মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন বাংলাদেশি এক যুবক।
এর আগে গত ২৮ আগস্ট তুমব্রু উত্তরপাড়ায় একটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। সে দিনই সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানকে চক্কর দিতে দেখা যায়। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি গোলা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় এসে পড়ে। সেগুলো অবিস্ফোরিত থাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এর তিন দিন পর পুনরায় ওই সীমান্তে ভারী অস্ত্র থেকে গোলা ছোড়ার শব্দ ভেসে আসে। এসব ঘটনায় চারবার ঢাকায় মিয়ানমারের কূটনীতিককে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকেও বিষয়টি তুলেছে মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে গিয়ে বিভিন্ন বৈঠকেও রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলেছেন। এর পরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। যদিও গত কয়েক দিন সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির আওয়াজ অনেকখানি কমে গেছে। তবে স্থানীয়দের আশঙ্কা, যেকোনো সময় বেড়ে যেতে পারে সীমান্তের ওপারের সংঘর্ষ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক সূত্র বলেছে, টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন নৌরুটে জাহাজগুলো নাফ নদী দিয়ে মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষে যাতায়াত করে। সীমান্তের ওপারে সংঘাত চলায় কর্তৃপক্ষ অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি নাফ নদীর নাব্যতা সংকটের বিষয়টিও আছে।
তবে টেকনাফ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা এরফানুর হক দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের নির্দেশে টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নৌপথের সমস্যার কারণে পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে।’
আর কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘নাফ নদীতে নাব্যতা সংকট তৈরি হয়েছে। এতে জাহাজ চলাচলের পথ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবোচরে আটকা পড়লে পর্যটকদের ঝুঁকি থাকে। নাব্যতা কেটে গেল হয়তো আবার জাহাজ চলাচল শুরুর সিদ্ধান্ত হতে পারে।’
মিয়ানমার পরিস্থিতির কারণে এমন সিদ্ধান্ত কি না জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘তাদের অভ্যন্তরে যা হচ্ছে, তার সঙ্গে তো এসবের সম্পৃক্ততা নেয়। আমরাও সজাগ আছি। নাব্যতার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে এমন সিদ্ধান্ত।’
অবশ্য বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন বলছেন অন্য কথা। গত শনিবার কক্সবাজারে পর্যটন মেলার অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিনে যে হারে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে তা পর্যটনের সঙ্গে যায় না। এগুলো বন্ধের জন্য কাজ চলছে। সবকিছু বিবেচনায় রেখে আপাতত টেকনাফ ঘাট থেকে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া জাহাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। কবে নাগাদ টেকনাফ ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়বে তা পরে জানানো হবে।
পর্যটন ব্যবসায় ধসের আশঙ্কা
এদিকে টেকনাফ- সেন্ট মার্টিন নৌরুটে জাহাজ চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্তে লোকসানের আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, নৌপথে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। আর কক্সবাজার কিংবা চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে সেন্ট মার্টিন পৌঁছাতে সময় লাগে সাত থেকে আট ঘণ্টা। দীর্ঘসময় সমুদ্রভ্রমণে আগ্রহী নন অনেক পর্যটক। কাজেই সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে পর্যটকরা সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হবেন। এতে পর্যটন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সেন্ট মার্টিনের হোটেল ব্যবসায়ী নেতা রিদুয়ানুল হক বলেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার থেকে দুটি জাহাজ চলে। এসব জাহাজে অনেকে আসতে চায় না। কারণ সাত ঘণ্টার বেশি সময় জাহাজে থাকতে হয়। সে জায়গায় টেকনাফ থেকে চলে সাত-আটটা জাহাজ। অনেক মানুষ এ রুটে চলাচল করতে স্বস্তিবোধ করে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তের ফলে আগামী শীত মৌসুমে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটকরা হয়তো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে। ফলে ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়বে, সরকার রাজস্ব হারাবে।’
আরেক ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সামনের মৌসুমে ব্যবসার লক্ষ্যে প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় জাহাজ চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা কক্সবাজার থেকে জাহাজ পরিচালনা করবেন, তারা এ সুযোগটা কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করার চেষ্টা করবেন।’
সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘টেকনাফ থেকে জাহাজ না আসলে মালামল আনতে খরচ বেশি হবে। সে ক্ষেত্রে খাবার বা অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও বাড়তে পারে। তা ছাড়া আমরা এ মৌসুমের ওপর নির্ভরশীল। বড় লোকসান হবে আমাদের।’
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘শীত মৌসুমে পর্যটনের ওপর নির্ভর করে বাকি দিন পার করে সেন্ট মার্টিনের মানুষ। টেকনাফ থেকে জাহাজ বন্ধ হলে বড় লোকসানে পড়বেন এ দ্বীপের বাসিন্দারা। যদিও এখনো চূড়ান্তভাবে আমাদের জানানো হয়নি। তার পরও প্রশাসনের সঙ্গে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।’