সিলেট বিভাগের হাওর এলাকার নতুন আতঙ্ক হয়ে উঠেছে বজ্রপাত। বৃষ্টির মৌসুমে হাওরে ঘনঘন ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। এতে বাড়ছে প্রাণহানি। কয়েক বছর ধরে এমনটি ঘটতে থাকলেও এই ঝুঁকি ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। এর মধ্যে গত দুই দিনে (রবি ও সোমবার) সিলেট বিভাগে বজ্রপাতে মারা গেছেন ছয়জন। বর্ষায় বজ্রপাতের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গত কয়েক বছর ধরেই হাওরে বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়ে চললেও বজ্রপাতের আগাম তথ্য হাওরবাসীর কাছে পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি অদ্যাবধি। বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হাওর এলাকায় কিছু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি উঠলেও এ ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা নেই প্রশাসনের। গত পাঁচ বছরে লক্ষাধিক তালবীজ রোপণ করে ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের চেষ্টা করা হয়েছে কেবল। তবে এই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। কেননা, বেশির ভাগ তালবীজ থেকেই চারা গজায়নি।
এ অবস্থায় বৃষ্টির মৌসুম শুরু হতেই সিলেটে বেড়ে গেছে বজ্রপাত আর প্রাণহানি। গত সোমবার সিলেটের কানাইঘাট, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বাহুবলে বজ্রপাতে মারা গেছেন তিনজন। তার আগের দিন রোববার সিলেটের গোয়াইনঘাট, মৌলভীবাজার সদর ও হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে বজ্রপাতে আরও তিনজন মারা যান।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম পিয়ার-রিভিউ জার্নাল হেলিয়নে ‘বাংলাদেশে বজ্রপাত পরিস্থিতির ওপর জিআইএস (জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম)-ভিত্তিক স্থানিক বিশ্লেষণ’ প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ প্রাণহানি বর্ষা-পূর্ববর্তী মৌসুম এবং বর্ষা ঋতুতে ঘটে, যার মধ্যে উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সিলেট) সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে আবহাওয়ার ধরন ও বৈশিষ্ট্য ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ এবং ঋতু পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটছে। এ কারণেই বজ্রপাত বাড়ছে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, বৈশাখ থেকে ঝড়বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ে। এ সময়টিই হাওরের সবচেয়ে ব্যস্ততম সময়। হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান তোলা হয় এই সময়ে। ফলে হাওরের কৃষকদের মাঠে যেতেই হয়। এতে প্রাণহানিও বাড়ে।
বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের ১০৫টি হাওর আছে সিলেট জেলায়। আর সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর আছে ১৩৫টি।
হাওর বেশি হওয়ায় দেশের সবচেয়ে বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাও সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ৮ বছরে বজ্রপাতে এ জেলায় অন্তত ১৫০ লোক মারা গেছেন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগে থাকলেও সুনামগঞ্জে নেই কোনো আবহাওয়া অফিস। এদিকে বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাওয়ায় ২০১৮ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে সিলেট আবহাওয়া অফিসেও স্থাপন করা হয় বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র ‘থান্ডারস্টর্ম ডিটেকটিভ সেন্সর’। এই যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিদিনই বজ্রপাতের পূর্বাভাস আসে। আবহাওয়া অফিস থেকে এই পূর্বাভাস প্রতিটি জেলার সরকারি অফিসগুলোতে ই-মেইলে পাঠানো হয়। তবে এই পূর্বাভাস মাঠপর্যায়ে প্রান্তিক মানুষের কাছে আর পৌঁছে না। কৃষকদের কাছে বজ্রপাতের পূর্বাভাস পাঠানোর এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেই।
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজিব বলেন, ২০১৬ সালের পর থেকে বজ্রপাতকে একটি দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। সাধারণত পাহাড়বেষ্টিত এলাকা ও খোলা জায়গায় বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে। এই হিসেবে সিলেট বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।
তিনি বলেন, ‘১২ ঘণ্টা আগে আমরা বজ্রপাতের পূর্বাভাস পাই। আমরা যে বজ্রপাত পূর্বাভাস সরকারি দপ্তরে পাঠাই, সেটি হাওরাঞ্চলের মানুষজনের কাছে পৌঁছাতে হবে। এটি স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদেরই করতে হবে। আগাম সতর্কবার্তা পেলে ওই সময় হাওরে কাজ করা থেকে তারা বিরত থাকতে পারবেন।’
বজ্রপাত আটকে দেবে তালগাছ, এই ধারণা থেকে কেবল সুনামগঞ্জ জেলায়ই ২০১৮ সালে ৩৪ হাজার ও চলতি বছরে ৮০ হাজার তালবীজ বিতরণ করা হয়। তবে স্থানীয়রা বলছেন, এই লক্ষাধিক বীজ থেকে হাজারখানেক চারাও গজায়নি।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ৫নং সরমঙ্গল ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান এহসান চৌধুরী বলেন, ‘২০১৭ সালে আমাদের কিছু তালবীজ দেওয়া হয় উপজেলা প্রশাসন থেকে। আমরা রোপণ করেছি কিন্তু গাছ হয়নি। সব বীজই নষ্ট হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘বজ্রপাতের কোনো পূর্বাভাস আমরা পাই না। তাই যখন দেখি আকাশের অবস্থা ভালো না তখন ইউপি সদস্যদের কল দিয়ে বলি তাদের এলাকায় কেউ যেন মাঠে না যায়।’
সুনামগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলায় ২০১৮ সালে তালবীজ বিতরণ করা হয়েছে। জেলা প্রসাশনের পক্ষ থেকে তালবীজ দেওয়া হলেও পরবর্তী সময় আর কোনো তদারকি করা হয়নি।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, ‘হাওরে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের দাবি জানাচ্ছি আমরা। যাতে কৃষকরা মাঠে কাজ করতে গেলে বজ্রবৃষ্টির সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে পারেন। এ ছাড়া হাওরে বজ্রপাত নিরোধক দণ্ড স্থাপন করা দরকার। এসব দাবি আমরা বিভিন্ন সময় জানিয়েছি। তবে মৌখিক আশ্বাস ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই পাইনি।’
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হাওর এলাকায় তালবীজ রোপণ ও বিতরণ করা হয়েছিল। তবে এটা অনেক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এখন গাছগুলোর কী অবস্থা তা জানা নেই। ইউএনওদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে জানাব।’