ছায়া সুনিবিড় গ্রাম ছিলোনীয়া। যার অবস্থান কুমিল্লার লালমাই উপজেলার উত্তর পেরুল ইউনিয়নে। কাকডাকা ভোরে ওই গ্রামের মানুষের ব্যস্ততা শুরু হয়। আর গোধূলি বেলায় রাঙা ধুলো উড়িয়ে রাখাল যখন গরুর পাল নিয়ে ঘরে ফেরে, তখন থেকে কমতে শুরু করে ব্যস্ততা।
ওই গ্রামের আড়াই শ পরিবারের পারিবারিক দুগ্ধ খামারে অন্তত তিন হাজার গাভি দুধ দেয়। প্রতিদিন ছয় হাজার লিটার দুধ বিক্রি করেন গ্রামবাসী। সকাল ৭টা থেকে দুধ সংগ্রহ শুরু হয়ে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত চলে। আবার বেলা ৩টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে দুধ সংগ্রহ ও বিক্রির কাজ। এর মাঝে রয়েছে গরুর জন্য ঘাস কাটা এবং সেগুলোর যত্ন। এভাবে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত সময় পার করেন ওই গ্রামের মানুষজন।
সরেজমিন ছিলোনীয়া গ্রামে প্রবেশ করতেই দুধের মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে লাগে। গ্রামের মানুষজন দুধ সংগ্রহ করে গ্রামের প্রবেশদ্বারে জমা করেন। সেখান থেকে পাইকাররা এসে দুধ নিয়ে গঞ্জে যান। বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করা হয় এসব দুধ।
ছিলোনীয়া গ্রামটি পাঁচটি পাড়ায় বিভক্ত। দক্ষিণ, মধ্যম, উত্তর, খিলপাড়া ও কামারকুয়া। সব পাড়াতেই সকাল ও বিকেলে দুধ নিতে আসেন পাইকাররা।
গ্রামের বড় খামারি মো. আবদুল আজিজ। দুই মেয়ে ও এক ছেলের জনক আবদুল আজিজ বলেন, ২০০৪ সালে তার বড় মেয়ের জন্ম হয়। মেয়ের জন্য দুধ দরকার। তাই একটি গাভি কেনেন। গাভিটি প্রতিদিন ছয় লিটার দুধ দিত। এক লিটার মেয়ের জন্য রেখে বাকি পাঁচ লিটার বিক্রি করতেন। সেই থেকে শুরু।
এখন আবদুল আজিজের খামারে ১৩৮টির মধ্যে ৭৮টি দুধেল গাভি। ৫৬টি গাভি গর্ভবতী। আগামী কয়েক মাসে গাভিগুলো বাচ্চা দেবে। খামারের গোবর দিয়েই তিনি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করেছেন। সেখান থেকে যে গ্যাস তৈরি হয়, সেটি খামারসহ নিজের ঘরের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন।
গাভির খাবারের জন্য তিনি ৭০০ শতক জমিতে ঘাসও লাগিয়েছেন। তার খামারের গরু থেকে ৭০০ লিটার দুধ পান। এ ছাড়া প্রতিবেশীদের থেকে আরও ৩০০ কেজি সংগ্রহ করেন। সেগুলো ৫৫ টাকা কেজি দরে পাইকারদের হাতে তুলে দেন। তা ছাড়া খামারের দুধ দিয়ে তিনি দই, মিষ্টিও তৈরি করেন। স্থানীয়ভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে এসব দই ও মিষ্টির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
আবদুল আজিজের সাফল্য দেখে এখন পুরো ছিলোনীয়া গ্রামে সবাই গরু পালনে মনোযোগ দিয়েছেন। গ্রামের মাঠে এখন সবাই ঘাস চাষ করে। ওই ঘাস দিয়েই চলে গাভির খাবার।
ছিলোনীয়া গ্রামের মিজানুর রহমান বাচ্চুও প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ লিটার দুধ বিক্রি করেন। নিজের খামারের ১০০ লিটার এবং প্রতিবেশী থেকে সংগ্রহ করে আরও ১৫০ লিটার।
ছিলোনীয়ার নাইমুল ইসলাম বলেন, দুই বছর ধরে তিনি গাভি পালন করছেন। তার খামারে ১৭টি গাভি আছে। প্রতিদিন তিনি ১৬০ লিটার দুধ পান। এই আয়ে পরিবার নিয়ে ভালো আছেন।
প্রতিদিন সকালে দুধ নিতে আসেন পাইকার মো. মীর হোসেন। তিনি জানান, তার মতো আরও বেশ কয়েকজন পাইকার ছিলোনীয়া থেকে দুধ সংগ্রহ করেন। লালমাই ও লাকসাম উপজেলার বিভিন্ন মিষ্টি ও দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরির প্রতিষ্ঠানে এসব দুধ সরবরাহ করেন। কেউ কেউ কুমিল্লা শহরের রসমালাইয়ের দোকান মাতৃভান্ডার ও শীতল ভান্ডারেও দুধ সরবরাহ করেন।
তবে গ্রামবাসীর আফসোস, এখানে কোনো দুধ সংরক্ষণাগার নেই। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যেদিন পাইকাররা আসতে পারেন না, সেদিন দুশ্চিন্তায় থাকেন গ্রামবাসী। তা ছাড়া দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকলেও প্রচুর দুধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই গ্রামবাসীর দাবি, সরকারিভাবে এখানে যেন একটি দুধ প্রক্রিয়াকরণ মেশিন স্থাপনের ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ছিলোনীয়া গ্রামের সরদার হাবিব উল্লাহ মাস্টার বলেন, হাজার হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয় এখানে। অথচ দুধ হিমায়িত করার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বিষয়টি আমলে নিলে এখানে দুগ্ধশিল্পের আরও বিকাশ হতো।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কুমিল্লায় ছোট-বড় ৫০ হাজার খামারি আছেন। তাদের মধ্যে ২ হাজার ১৪৬ জনের নিবন্ধন রয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় দুধ উৎপাদন হয়েছে সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন লিটার। সে হিসাবে আমরা প্রতিজনে ২১০ মিলিলিটার দুধ সরবরাহ করতে পেরেছি। আমাদের লক্ষ্য প্রতিজনে ২৫০ মিলিলিটার দুধ সরবরাহ করা। আশা করি, আগামী দুই বছরে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। তবে জেলায় খামারিদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ। আমরা সে বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছি।’
তিনি জানান, প্রাণিসম্পদের একটি বড় প্রজেক্ট হলো লাইফ অব ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট। সেই প্রজেক্টের আওতায় দুটি হাব তৈরি করা হবে। প্রতিটি হাবে এক দিনে ৩০-৪০ হাজার লিটার দুধ প্রসেস করা সম্ভব হবে। হাব দুটি চালু হলে দুধ সংরক্ষণের পাশাপাশি দুধের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে।