কক্সবাজার টেকনাফের আলোচিত জুবায়ের হত্যাকাণ্ড মামলার অধিক তদন্তের স্বার্থে চট্টগ্রাম ডিআইজি আহসান হাবিব পলাশ ও কক্সবাজার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহর কাছে আবেদন করেছে মামলার প্রধান আসামী স্থানীয় ইউপি সদস্য এনামুল হক এনাম।
আবেদনের প্রেক্ষিতে চট্রগ্রাম ডিআইজি রেঞ্জ থেকে ১২,৫৫৮ স্মারকমূল্যে আবেদনের বর্ণিত বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠি প্রদান করা হয় এবং মামলার আটক দুই আসামীর ১৬৪ ধারা জবানবন্দি ও পত্র-পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে মামলাটি কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা শাখায় হস্তান্তর করার নির্দেশ দেন বলে জানা গেছে। বর্তমানে জুবায়ের হত্যা মামলা কক্সবাজার জেলা ডিবির কাছে তদন্তাধিন রয়েছে বলে জানা গেছে ।
ঘটনায় জানা যায়, টেকনাফের নাজির পাড়ার বাসিন্দা জোবায়ের ও নজুমউদ্দিন। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। গত ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় রমজান মাসের ঠিক ইফতারের পর পাওনা টাকার জের ধরে নজুমদ্দিনের নেতৃত্ব ফিরোজ, কায়েস,মাসুদ,মাছনসহ বেশ কয়েকজন মিলে ফিল্মি স্টাইলে ঘরে ডুকে জুবায়েরকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে চট্রগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যায় জুবায়ের। সে দিনের ঘটনার আদ্যপান্ত জানিয়েছেন জুবায়ের পরিবারের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঘটনার দিনে নিহত জুবায়েরের মা, ভাই, ভাইয়ের ছেলে ও প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে মাত্র ৮০০ টাকার জন্য বন্ধুর গুলিতে বন্ধু নিহত এই শিরোনামে পুরো দেশের পত্রপত্রিকায় সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসে কে বা কারা জুবায়েরকে গুলি করে হত্যা করেছে। কিন্তু ঘটনার দুইদিন পরে নিহত জুবায়ের এর মা বাদী হয়ে ৮ জনের নাম উল্লেখ করে টেকনাফ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার নং ০২.জি আর ১৮০/২৪, মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্থানীয় ইউপি সদস্য এনামুল হককে প্রধান আসামী করা হয়।
ঘটনার পরপরই তৎকালীন টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসমান গণির নেতৃত্বে শুরু হয় পুলিশি অভিযান। জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অপরাধে ঘাতক নজুম উদ্দিনের আপন মামাতো ভাই মাসুদ এবং মো. হোছেনকে আটক করে টেকনাফ থানা পুলিশ। তাদের দুজনকে আদালতে সৌপর্দ করার পর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় মাসুদ ও হোছেন।
এদিকে আদালতের ১৬৪ ধারার জবানবন্দির দুটি নথি আসে এই প্রতিবেদকের কাছে। যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়, ২৯ মার্চ ইফতারের পর নজুমদ্দিন ও ফিরোজ মাসুদের বাড়িতে এসে মাসুদের চাচা কায়েসের সঙ্গে কথা বলে মাসুদের হাতে তুলে দেয় ধারালো অস্ত্র এবং নজুমদ্দিন ও ফিরোজের হাতে দুটি পিস্তল ছিলো বলে জবানবন্দি দেয় মাসুদ। এরপর কায়েস হাতে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। মাঝপথে যুক্ত হয় হোছনসহ মোট ৫ জন।
নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়, নিহত জুবায়েরের সঙ্গে কায়েসের পূর্ব শত্রুতা থাকায় প্রতিশোধ নিতে তাদের গন্তব্য জুবায়ের বাড়ির দিকে। এরপর ফিরোজ জুবায়ের বাড়ির সামনে ফাঁকা গুলি ছুড়ে। নজুমদ্দিন, কায়েস, ফিরোজ, হোছেন, জুবায়েরদের বাড়িতে ডুকে বেরিয়ে এসে নজুমদ্দিন বলে জুবায়েরকে শেষ করে দিয়েছি। মো. হোছনও আদালতে ১৬৪ জবানবন্দি দিয়ে হত্যাকাণ্ডে কতজন জড়িত ছিল স্বীকার করে এবং নজুম উদ্দিনের গুলিতে নিহত হয়েছে বলেও তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করে। জুবায়ের হত্যা মামলার পিছনের তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে বেড়িয়ে এলো আরও চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য।
একদিকে আলোচিত জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি কারা জড়িত তা নিয়ে আটক আসামীরা আদালতে দিয়েছিল ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধামে প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখেও উঠে এসেছিল কে বা কারা গুলি করে হত্যা করেছে জুবায়েরকে। এই ঘটনায় আলোচনায় না থাকা স্থানীয় ইউপি সদস্য এনামুল হককে করা হয় জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের ১নং আসামী। কিন্তু আদালতে দুই আসামীর ১৬৪ ধারা জবানবন্দি এবং সে দিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখেই ছিলো না এই ইউপি সদস্যের নাম। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর জুবায়ের হত্যা মামলার রহস্য।
নজুম উদ্দিনের গুলিতে নিহত জুবায়ের এর মা এবং মার্কিন হত্যাকারী ছিদ্দিকের আত্মীয় হয়। আত্মীয়তা নিশ্চিত করেন নাজির পাড়ার প্রবীন মুরব্বি আবুল কাসেম। কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। আবুল কাসেম জানান, জুবায়ের এর মা মাবিয়া খাতুন ও ছিদ্দিক তারা আপন মামাতো ফুপাতো ভাই বোন।
ছিদ্দিক ২০১৫ সালের আলোচিত মার্কিন হত্যার ৩ নাম্বার আসামী, নিহত আজিজুল হক মার্কিনের আপন ছোট ভাই এনাম মেম্বার, ছিদ্দিক ও এনাম মেম্বারের মধ্যে দীর্ঘদিনের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকায় জুবায়ের হত্যা মামলাতে অভিযুক্ত করেছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
টেকনাফ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উসমান গণির সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল ছিদ্দিকের। অভিযোগ আছে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে নিহত জুবায়ের এর মাকে রাজি করিয়ে এনাম মেম্বারসহ আরও কয়েকজন নিরপরাধ ব্যক্তিদের আসামী করেছে এই ছিদ্দিক।
মামলার প্রধান আসামী এনামুল হক এনাম জানান, ঘটনায় আমাকে পরিকল্পিতভাবে আসামী করা হয়েছে। ঘটনার পরে জোবায়ের এর মা-ভাই সবার জবানবন্দী ছিল অন্যরকম। সেখানে আমার কোন নাম ছিল না। আমাকে জড়ানো হয়নি। কিন্তু মামলায় এসে আমাকে প্রধান আসামী করা হয়েছে। আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত আশা করছি।
হাফেজ জসিম জানান, বর্তমান টেকনাফ থানা থেকে কক্সবাজার এসপির অধীনে উক্ত আলোচিত মামলার তদন্ত হওয়ায় অত্র এলাকার মানুষ প্রত্যাশা করছে নিহত জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার পাবে। হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটন হবে বলে আশা ব্যক্ত করেছেন অনেকেই।
এদিকে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ জানান, যেহেতেু হত্যাকাণ্ডটি আমি আসার আগে হয়েছে, তাই আমার এই বিষয়ে জানা নেই। যিনি মামলা তদন্তকারি কর্মকর্তা রয়েছেন তিনি জানতে পারবেন ।
গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তদন্তে থাকা কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জোবায়ের হত্যা মামলাটি ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা তদন্ত চলমান রেখেছি। মূল অপরাধিদের ছাড় দেওয়া হবে না।