চাঁদপুরের হাইমচরে মেঘনা নদীতে সারবহনকারী এমভি আল বাখেরা জাহাজে ৭ জন খুনের ঘটনায় তদন্তের ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কর্নেল মুনীম ফেরদৌস।
এ ঘটনায় আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফান (২৬) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি সুকানির সঙ্গে ইঞ্জিন রুমে কাজ করতেন। গতকাল মঙ্গলবার বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১১।
তার কাছ থেকে ১টি হ্যান্ড গ্লাভস, ১টি লোটো ব্যাগ, ঘুমের ঔষধের খালি পাতা, নিহতদের ব্যবহৃত ৫টি ও আকাশের নিজের ২টিসহ ৭টি মোবাইল ফোন এবং বিভিন্ন জায়গায় রক্ত মাখানো নীল রংয়ের ১টি জিন্স প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
কর্নেল মুনীম ফেরদৌস জানান, দীর্ঘ ৮ মাস ধরে বেতন ভাতা না পাওয়া ও দুর্ব্যবহারের ক্ষোভ থেকে গ্রেপ্তার আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফান প্রথমে জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করেন। পরে ধরা পড়ার ভয়ে একে একে সবাইকে কুপিয়ে হত্যা করেন তিনি।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বরাতে তিনি জানান, আকাশ প্রায় ৮ মাস ধরে এমভি-আল বাখেরা জাহাজে চাকরি করছে। জাহাজের কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময় মতো পেতো না এবং বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার একাই ভোগ করতেন বলে জানিয়েছেন গ্রেপ্তার আকাশ।
আকাশ আরও জানায়, জাহাজের মাস্টার সব কর্মচারীর উপর বিনা কারণে রাগারাগি করতো এবং কারোর উপর নাখোশ হলে তাকে কোন বিচার বিবেচনা ছাড়াই জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতো। এমনকি তাদের বকেয়া বেতনও দিতো না। এ বিষয়ে গ্রেপ্তার আকাশ জাহাজের সবাইকে প্রতিবাদ করতে বললে কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতো না। মাস্টারের এসব কার্যকলাপের কারণে আকাশের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই ক্ষোভ থেকে তাকে উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি।
গত ১৮ ডিসেম্বর জাহাজের বাজার করার জন্য ইরফান পাবনার একটি বাজারে নেমেছিলেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি সেখান থেকে তিন পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রাখেন। এছাড়া যে চাইনিজ কুড়াল দিয়ে সবাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সেটি নিরাপত্তার জন্য আগেই জাহাজে রাখা ছিল। আগের দিন রাতের খাবার রান্নার সময় আকাশ জাহাজের বাবুর্চির অগোচরে খাবারের মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। সুকানি জুয়েল এবং গ্রেপ্তার আকাশ ছাড়া সবাই রাতের খাবার খেয়ে নিজেদের কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত ২টার দিকে সাহারা বিকন এলাকায় আরও ৮-১০টি জাহাজের সঙ্গে সুকানি জুয়েল এবং গ্রেপ্তার আকাশ তাদের জাহাজটি নোঙ্গর করেন। পরবর্তীতে সুকানি জুয়েল রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আকাশ রাত ৩টার দিকে প্রথমে মাস্টার কিবরিয়াকে চাইনিজ কোড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। ঘটনা যাতে জানাজানি না হয় সে জন্য তিনি একে একে সবাইকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন।
পরবর্তীতে আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সব জাহাজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলে আকাশ নিজে জাহাজ চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে মাঝিরচর নামক এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়লে পাশ দিয়ে যাওয়া ট্রলারে বাজার করার কথা বলে উঠে পালিয়ে যান। তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে বাগেরহাটে চিতলমারি এলাকায় আত্মগোপনে চলে যান।
এর আগে গত সোমবার চাঁদপুরের মেঘনা নদীর হাইমচর এলাকায় সারবাহী জাহাজ এমভি আল-বাখেরা থেকে ৫ জনকে মৃত ও ৩ জনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে ২ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
এমভি-আল বাখেরা জাহাজে খুন হওয়া ব্যক্তিরা হলেন, কিবরিয়া (৫৬), সবুজ (২৭), সজীবুল ইসলাম (২৯), মাজেদুল ইসলাম মজিব (১৬), আমিনুর মুন্সি (৪২), সালাউদ্দিন মিয়া (৪১), ও রানা। আর জুয়েল নামে একজন গুরুতর জখম হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।
এদিকে এমভি আল বাখেরা জাহাজে ৭ জন খুনের ঘটনায় জাহাজের মালিক মাহাবুব মুর্শেদ মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় মামলা করেন। অজ্ঞাতনামা ডাকাত দলকে মামলায় আসামি করা হয়।
ইতোমধ্যে জাহাজে হতাহতের ঘটনা তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদা কমিটি করা হয়েছে। আর খুন ও ডাকাতির অভিযোগে ১০ জনকে আসামি করে মঙ্গলবার রাতে মামলা করেন মালিকপক্ষের মাহাবুব মুর্শেদ।
প্রসঙ্গত, মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের জাহাজ এমভি আল বাখেরা গত রোববার সকাল ৮টার দিকে চট্টগ্রামের কাফকো সার কারখানার ঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে। পরে কোম্পানির মালিক শিপন জাহাজে ফোন করে কাউকে পায়নি। এতে সন্দেহ হলে মালিকপক্ষ জাহাজের অবস্থান এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে কোম্পানির অন্য জাহাজ মুগনি-৩ কে যোগাযোগ করতে বলে। মুগনি-৩ জাহাজটি মাওয়া থেকে যাওয়ার সময় ঘটনাস্থলে এম ভি আল বাখেরা জাহাজটিকে ইঞ্জিন বন্ধ অবস্থায় দেখতে পায়। পরে তারা জাহাজে উঠে সবাইকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল দেন। খবর পেয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে নিহত ও আহতদের উদ্ধার করে।