ভয়ংকর হয়ে উঠছে ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।’ অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে বীরদর্পে এলাকায় প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে কক্সবাজার টেকনাফের অপরাধীরা। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। নাজুক পরিস্থিতিতে একের পর এক অপহরণের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
স্থানীয়রা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কৃষক এবং বিভিন্ন পেশাজীবীরা কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। অন্য দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিরাও রাত হলে ভয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যান। গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের আটক করতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে অসাধু বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদের আশকারায় রোহিঙ্গারা গড়ে তুলেছে ‘অপহরণ সংগঠন’। চলছে বিদেশি পিস্তল, বিদেশি ইয়াবার রমরমা বাণিজ্য। এ ছাড়া বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, ধর্ষণ, মানবপাচার ও চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে অপরাধের রাজ্যে তৈরি করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
টেকনাফ সরকারি ডিগ্রি কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. আবু তাহের বলেন, ‘৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আসল কারণ হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে ৫ আগস্টের পর এক দল অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করে। ফের তারা দলবদ্ধভাবে অপরাধ কাজে জড়িয়ে পড়েছে। এদিকে শতাধিক তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী কারাগার থেকে ছাড়া পায়। কিছু বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদের আশকারায় রোহিঙ্গারা অপহরণ ও মানবপাচার করে যাচ্ছে। আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় এখনো জনমনে শঙ্কা কাজ করছে।’
মানবপাচার চক্রের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া বান্দরবান জেলার বাসিন্দা উলাচি মারমা জানান, গত ৫ ডিসেম্বর টেকনাফ ঘুরতে আসেন। অচেনা জায়গা হওয়ায় তিনি একটি টমটম রিকশায় ওঠেন। চালকের কাছে কোনো আবাসিক হোটেল আছে কি না জানতে চান তিনি। ভালো হোটেল নিয়ে যাচ্ছি বলে তাকে নিয়ে অটোরিকশা চালক রওনা দেন। একেক জায়গায় থেকে আরও তিন তরুণ ওঠেন ওই অটোরিকশায়। তখনো ঘুরতে আসা রাঙামাটির বাসিন্দা বুঝতে পারেননি যে, তিনি অপহৃত হয়েছেন। পরে তার থেকে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে কয়েকজন যুবকের হাতে তুলে দেন। সেই যুবকরা বড় অঙ্কের টাকা দাবি করছিল। আবার অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বলতে থাকে, মুক্তিপণ না দিলে মালয়েশিয়া পাচার করে দেবে। গত ১৪ ডিসেম্বর রাতে পুলিশ তাকে সাইফুল নামে এক ব্যক্তির বাড়ি থেকে উদ্ধার করে। সেদিন সাইফুলের বাড়ি থেকে শিশুসহ আরও ২৯ জনকে উদ্ধার করা হয়।
সম্প্রতি এক দিনের ব্যবধানে দুই সিএনজির চালকসহ আরও ৯ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর আগে গত সোমবার টেকনাফ বন বিভাগের পাহাড়ে কাজ করার সময় ১৮ জন রোহিঙ্গা শ্রমিককে অপহরণ করা হয়। এ নিয়ে মোট অপহৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৭-এ। পুলিশ, র্যাব ও এপিবিএন যৌথ অভিযান চালালেও এখনো কেউ উদ্ধার হয়নি।
অপহৃত বনকর্মী সাইফুল ইসলামের বাবা জুহুর আলম জানিয়েছেন, তার ছেলের মুক্তিপণ হিসেবে এক লাখ টাকাসহ অপহৃত ১৮ জনের জন্য মোট ১৮ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘টাকা দিতে না পারার কথা বললেই ছেলেকে মারধর করা হচ্ছে। এরপর নির্যাতনের বিষয়ে ছেলের মাকে ফোন দিয়ে জানানো হচ্ছে। র্যাব বা পুলিশ নিয়ে ঝামেলা করলে অপহৃতদের লাশ পাঠানোর হুমকিও দেওয়া হচ্ছে।’
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সদর ইউনিয়নে কয়েকটি পাহাড় আছে। এসব পাহাড়ে আস্তানা গড়েছে ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং বাঙ্গালি সন্ত্রাসী। তাদের অপহরণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু, ছেলেমেয়ে, স্কুলছাত্র এমনকি অটোরিকশাচালকরাও যেকোনো সময় অপহরণের শিকার হন। ফলে সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে সন্ধ্যার পর সন্তানদের ঘরের বাইরে যেতে দেন না। কেউ কেউ সন্তানদের বিশেষ পাহারায় বিদ্যালয়ে পাঠান। অপহরণের ঘটনায় থানায় জিডি ও অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
কক্সবাজারের জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, ‘গহিন পাহাড়ে এই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের সেখানে একক অভিযান চালানোর মতো সরঞ্জাম নেই। তাই আমরা যৌথ অভিযান চালানোর জন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছি। আশা করছি খুব দ্রুত আমরা একটি সফল অভিযান চালাতে পারব।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্য বলছে, গত এক বছরের বেশি সময়ে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৫৩ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে ৯৪ জন স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৯ জন রোহিঙ্গা নাগরিক।
টেকনাফ থানার তথ্যমতে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ২০টি। এসব মামলায় উদ্ধার ভিকটিম ৫৭ জন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপরণ মামলা ৪২, ভিকটিম উদ্ধার ৮১ জন। আসামির সংখ্যা অন্তত ৭০। এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২০ জনকে। মানবপাচার আইনের মামলা সাতটি ভিকটিম উদ্ধার ১৬৮ জন, আটক আসামি ১৬ জন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ইউপি সদস্য বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা দিনে ছদ্মবেশে বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করে। জানার চেষ্টা করে কাকে অপহরণ করলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে, সেভাবে টার্গেট করে অপহরণের ঘটনা ঘটায়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাহারছড়া ইউনিয়নের এক সদস্য বলেন, ‘অপহরণের ভয়ে আমার এলাকার লোকজন সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না। গত পাঁচ মাসে আমার এলাকায় অর্ধশতাধিক এমন ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন বেশিরভাগ।’
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী বলেন, তার ইউনিয়নের কম্বনিয়াপাড়া মহেশখালিয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, খারাংখালী, সাতঘড়িয়াপাড়া, রইক্ষ্যম এলাকায় অন্তত ৭০০ পরিবার অপহরণ আতঙ্কে ভুগছে। অতীতে এসব গ্রামের চারজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল।
টেকনাফ থানার ওসি গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা টাকার লোভে পড়ে অপহরণ করতেছে। আবার অপহরণ করে মুক্তিপণ না দিলে জোরপূর্বক মালয়েশিয়ায় পাচার করে দেয় অপহরণকারী চক্র। আমরা ইতোমধ্যে অনেককে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। আর বাকিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে। একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী এসব অপহরণের সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকও আছে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘অপহরণ এবং মানবপাচার কীভাবে বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে যৌথভাবে আমরা কাজ করব। পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশের চৌকি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’