সিলেটের একটি রিসোর্টে বেড়াতে যাওয়া ৮ তরুণ-তরুণীকে আটকে বিয়ে দেওয়ার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। স্থানীয় এলাকাবাসী রিসোর্টে হামলা চালিয়ে এই তরুণ-তরুণীদের আটক করে বিয়ে দেন। এ সময় পুলিশও উপস্থিত ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার দুপুরে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম এলাকার রিজেন্ট পার্ক অ্যান্ড রিসোর্টে হামলা চালায় স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্ত। এ সময় তারা রিসোর্টে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। রিসোর্টের বিভিন্ন কক্ষে অবস্থান করা ১২ তরুণ-তরুণীকে আটক করে তারা। পরে কাজী ডেকে এনে তাদের মধ্যে ৮ জনকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।
এভাবে আটকে বিয়ে দেওয়ার ঘটনায় আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে উল্লেখ করে সিলেট মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শিরিন আক্তার আজ সোমবার বলেন, ‘এটা খুবই বাজে কাজ হয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক তরুণ-তরুণীরা নিজেদের ইচ্ছায় ঘুরতে যেতেই পারেন। ঘুরতে গিয়ে তারা যদি কোনো খারাপ কাজ বা অসামাজিক কাজ করে থাকে তবে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে আদালতে প্রেরণ করবে। কিন্তু তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া খুবই খারাপ কাজ হয়েছে। এলাকাবাসীকে এই অধিকার কে দিয়েছে?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা এই রিসোর্ট থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করতেন। এ ছাড়া পুলিশকেও চাঁদা দিতে হতো। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর বিএনপির একাধিক গ্রুপ রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে চাঁদা দাবি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দাবিকৃত চাঁদা না পেয়ে তাদেরই একটি গ্রুপ স্থানীয় জনতাকে উসকে দেওয়ায় রোববারের হামলা চালায় বলে জানা যায়।
আট তরুণ-তরুণীর বিয়ে পড়ান সিলাম ইউনিয়নের কাজী আব্দুল বারী। তিনি বলেন, এলাকাবাসী ছেলেমেয়েদের আটক করে আমাকে খবর দেন। আমি এসে এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে চার ছেলে ও চার মেয়ের বিয়ে পড়াই। এ সময় তাদের অভিভাবকরাও উপস্থিত ছিলেন। তিনটি বিয়ের দেনমোহর ১০ লাখ, আরেকটির দেনমোহর ১২ লাখ টাকা।
কাজী বলেন, বিয়ের সময় স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতাও উপস্থিত ছিলেন।
রিসোর্টে হামলা ও তরুণ-তরুণীদের বিয়ে পড়ানোর সময় উপস্থিত ছিলেন ঘটনাস্থলে থাকা জাতীয়তাবাদী কৃষক দল সিলেট জেলার সদস্য সচিব তাজরুল ইসলাম তাজুল। তিনি সিলাম এলাকার বাসিন্দা।
ঘটনা সম্পর্কে তাজুল বলেন, অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে ছেলেমেয়েদের আটকের পর তাদের অভিভাবকদের খবর দেওয়া হয়। পরে অভিভাবক ও ছেলেমেয়েদের সম্মতিতেই ৮ জনের বিয়ে পড়ানো হয়। বাকি ৮ জনের অভিভাবক পরে সামাজিকভাবে বিয়ের আয়োজন করার প্রতিশ্রুতি দিলে পুলিশ মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়। বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জোর করা হয়নি।
চাঁদা দাবির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এরকম কিছু আমি শুনিনি। তবে এই রিসোর্টে অসামাজিক কার্যকলাপ নিয়ে এলাকাবাসী অনেক দিন থেকেই বিরক্ত।
তাজুল বলেন, অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ শুনে রোববার রিসোর্টে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। আমরা চেষ্টা করেছি, যাতে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। এ জন্য রিসোর্টের গেট বন্ধ করেছিলাম। কিন্তু অনেকে দেয়াল টপকে ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় রিসোর্টে হালকা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
পুলিশ মুচলেকা নিয়ে ৮ তরুণ-তরুণীকে অভিভাবকদের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে- বিএনপি নেতা এমনটি দাবি করলেও পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) সাইফুল ইসলাম বলেন, বিয়ে দেওয়া বা মুচলেকা দিয়ে ছাড়ার বিষয়ে পুলিশ কিছু জানে না। রিসোর্টে হামলার খবরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। এ সময় এলাকার মুরব্বিরা বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিলে পুলিশ সেখান থেকে চলে আসে।
তবে মোগলাবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জনতা কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে আটক করেছে এমন খবর শুনে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। কিন্তু স্থানীয়রা পরিবারের কাছে তাদের হস্তান্তর করেছেন বলে শুনেছি। তবে আমি বার বার তাদেরকে বলেছি আটককৃতদের আমাদের জিম্মায় দিয়ে দেন। আমরা প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক তাদের অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করব। কিন্তু স্থানীয়রা তা শুনেননি।
এ ব্যাপারে রিজেন্ট পার্ক রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হেলাল আহমদ বলেন, আমাদের রিসোর্টে পুলিশের নির্দেশনা মোতাবেক ভোটার আইডি কার্ড নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে বিশ্রাম নিতে দেওয়া হয়। রোববারও ছেলে এবং মেয়েরা আলাদাভাবে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ভোটার আইডি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করেছেন। হঠাৎ করে একদল যুবক রিসোর্টে ঢুকে ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। তারা আসবাবপত্রে অগ্নিসংযোগও করে। ম্যানেজারের রুম থেকে ছেলেমেয়েদের ভোটার আইডি কার্ডের কপি ছিঁড়ে ফেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়। তারা ছেলেমেয়েদের আটক করে রিসোর্টের চাবি নিয়ে নেয়। এরপর আটককৃতদের তারা বিয়ে দিয়েছেন বলে শুনেছি।
তিনি বলেন, হামলায় রিসোর্টের ৩০-৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এদিকে, এই ঘটনার পর রিসোর্টটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।