বেগম রোকেয়া তার নিজের লেখা প্রবন্ধ ‘নার্স নেলী’তে লিখেছেন, ‘আমাদের অবস্থা সচ্ছল ছিল-আমরা পরম সুখে খাইয়া পরিয়া গা-ভরা গহনায় সাজিয়া থাকিতাম। আমাদের এ নিবিড় অরণ্যবেষ্টিত বাড়ীর তুলনা কোথায়? সাড়ে তিনশত বিঘা লা-খেরাজ জমির মাঝখানে কেবল আমাদের এই সুবৃহৎ বাড়ী। বাড়ীর চতুর্দিকে ঘোর বন, তাহাতে বাঘ, শূকর, শৃগাল- সবই আছে।’
তাই রোকেয়ার পরিবারের সাড়ে ৩০০ বিঘা জমির বিষয়ে কারও আর দ্বিমত থাকার কথা নয়। বেগম রোকেয়ার বাবা জহির উদ্দিন আবু আলী হায়দার সাবের পায়রাবন্দের শেষ জমিদার ছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি মারা যান। আর তখন থেকেই দখল হতে শুরু করে তাদের জমিগুলো। এমনকি তার পারিবারিক কবরটিও প্রভাবশালীদের দখলে। তাই ক্ষোভ আর দুঃখ রয়েছে রোকেয়ার পরিবার, স্বজন এবং অনুরাগীদের।
এসব জমি উদ্ধারে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে ২০১২ সালের ২২ মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি মির্জা হুসাইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব, রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট ১৩ ব্যক্তিকে বাদী করা হয়।
ওই বছরের ৮ এপ্রিল রিটের শুনানি শেষে রোকেয়ার জমিগুলো কোথায় ও কী অবস্থায় আছে, তা জানাতে চার সপ্তাহের রুল জারি করেন আদালত।
এরপর ওই বছরের ১৯ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন শাখা-১-এর সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ আবু সাঈদ মোল্লা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংসকে একটি চিঠি দেন। তাতে ওই রিট পিটিশনের ওপর দফাওয়ারি জবাব প্রস্তুতপূর্বক হাইকোর্ট বিভাগে দাখিলের ক্ষেত্রে সময় প্রার্থনা করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়।
এদিকে হাইকোর্টে রিট পিটিশনের পর ২০১২ সালের ২ মে পায়রাবন্দ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম প্রধান মিঠাপুকুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর বেগম রোকেয়ার পৈতৃক সম্পত্তির বিবরণসংবলিত একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন। তাতে বেগম রোকেয়ার ওয়ারিশদের নামে সিএস রেকর্ড অনুযায়ী মোট ১৬ দশমিক ৬০ একর জমির বিবরণ দেয়া হয়। বাকি জমির কোনো হদিস নেই।
অন্যদিকে পায়রাবন্দ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম প্রধান ওই বছরের ১২ মে আরেকটি প্রতিবেদন জমা দেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর। তাতে দেখানো হয়, ৬ দশমিক ৭৯ একর জমিতে বেগম রোকেয়ার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিকেন্দ্র, স্মৃতিস্তম্ভ, ডাকবাংলোসহ নয়টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
এর মধ্যে বেগম রোকেয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৪ শতক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১ একর, ৩৩ শতক (৫০ শতকে এক বিঘা) জমির ওপর ডাকবাংলো, ৩০ শতক জমির ওপর স্মৃতিফলক, ৩ দশমিক ১৫ একর জমি নিয়ে স্মৃতিকেন্দ্র, বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ৬০ শতক, ৪২ শতক জমির ওপর বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, নারী কল্যাণ সংস্থার নামে ৩৩ শতক, স্মৃতিস্তম্ভ ৪২ শতক এবং ৫৮ শতক জমিতে কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে।
বেগম রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের জমিগুলো দখল হয়ে যায়। ১৯৪০ সালে ভূমি রেকর্ডের সময় রোকেয়ার চার ভাইবোন বেঁচে ছিলেন। আইন অনুযায়ী তাদের নামে জমিগুলো রেকর্ড হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়নি। এ ক্ষেত্রে তৎকালীন অসাধু কিছু ভূমি কর্মকর্তা জড়িত বলে আমরা মনে করি। এসব জমি উদ্ধারে একটি মামলা হয়েছে, কিন্তু অগ্রগতি নেই। কারণ সরকারপক্ষ চূড়ান্ত শুনানিতে এগিয়ে আসছে না।’
বেগম রোকেয়ার ভাই মসিহুজ্জামান সাবেরের মেয়ে পায়রাবন্দ বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষিকা রণজিনা সাবের বলেন, ‘রোকেয়া পরিবারের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রায় সাড়ে ৩০০ বিঘা জমি অন্যরা ভোগদখল করে খাচ্ছে। জমিগুলো উদ্ধার করে সরকার সংরক্ষণ করতে পারে। সরকার চাইলেই দ্রুত জমিগুলো উদ্ধার হবে।’
এসব জমির কিছু অংশ আবাদ করেন কামরুজ্জামান জাহাঙ্গির চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জমিগুলো আমাদের দাদির নামে রেজিস্ট্রি। ’৪০, ’৬২ তারই নামে রেকর্ড আছে। তাহলে জমি রোকেয়ার হইল কেমনে? এখনো মামলার কাগজ পাই নাই। পাইলে আমরাও আদালতে লড়ব।’
আতাউর রহমান লেলিন নামে আরেকজন বলেন, ‘মামলা হয়েছে কি না জানি না। এগুলো আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি।’
রংপুর জেলা প্রশাসক (সদ্য বিদায়ী) আসিব আহসান জানান, ‘বেগম রোকেয়ার যেসব সম্পত্তি রয়েছে তার মামলার কাগজ, ভুলভাবে রেকর্ড হওয়াসহ যেসব বিষয় উঠেছে, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি।’
রিটকারী আইনজীবী মঞ্জিল মোরসেদ দৈনিক বাংলাকে বলেন, ‘বেগম রোকেয়ার যে সম্পত্তি আছে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য আমরা একটি রিট করেছিলাম। কোর্টের একটি আদেশ ছিল, সে বিষয়ে তারা সময় চেয়ে আবেদন করেছিল। চূড়ান্ত শুনানি এখনো হয়নি। মুলতবি আছে। সরকার এ ব্যাপারে কোনো জবাব দেয়নি।’
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দের খোর্দ্দ মুরাদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। তার মা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। বাংলাদেশে নারীশিক্ষার অগ্রদূত এই মহীয়সী নারী ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মারা যান।