কেউ ধান শুকাচ্ছেন, কোথাও চরছে গরু-ছাগল। পরিত্যক্ত মনে করে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চলে মাদকসেবীদের আড্ডা। কুমিল্লার অরক্ষিত অন্তত ৩৪টি বধ্যভূমির দৃশ্য এমন।
জেলায় বধ্যভূমির সংখ্যা ৫০টি। জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিসের তথ্যমতে, এর মধ্যে অন্তত ৩২টি বধ্যভূমিই অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এর আশপাশেও নেই কোনো বেষ্টনী।
৩২টির বাইরে আবুল কাশেম হৃদয়ের লেখা ‘অপারেশন কিল অ্যান্ড বার্ন’ বইয়ে সদর দক্ষিণ উপজেলার জগতপুর ও লাকসামের চিতোশি খেয়াঘাটে দুটি বধ্যভূমি সম্পর্কে জানা গেছে। সেগুলোর অবস্থাও বর্তমানে অরক্ষিত। একই দশা সদরের কোটেশ্বর ও কটকবাজারে সম্মুখযুদ্ধের দুটি স্মৃতিস্তম্ভের।
সম্প্রতি সরেজমিনে ৮টি ও স্থানীয়দের সহায়তায় ৫টি বধ্যভূমিতে খোঁজ নিয়ে অযত্ন-অবহেলার দৃশ্য দেখা গেছে। এগুলো জেলা সদরে ৩টি, সদর দক্ষিণে ৩, লাকসামে ২, চৌদ্দগ্রাম, চান্দিনা, মুরাদনগর, লাঙ্গলকোট ও মনোহরগঞ্জে একটি করে অরক্ষিত অবস্থায় আছে।
অরক্ষিত বধ্যভূমিগুলো নিয়ে আপেক্ষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের দাবি এগুলো সংরক্ষণে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক।
সদরের রসুলপুর বধ্যভূমিতে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে উপড়ে পড়া একটি গাছ এখনো সরানো হয়নি। স্থানীয়রা বধ্যভূমিতে ধান শুকাতে ব্যস্ত। নাম না প্রকাশের শর্তে স্থানীয় একজন বলেন, এখানে মাদকসেবীদের আড্ডা বসে প্রায়ই।
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার রসুলপুরে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাঁচ শতাধিক মুক্তিকামী মানুষকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। পরে তাদের গণকবর দেয়া হয়। ওই সময় বেঁচে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদ বলেন, গণকবরের বেহাল দশা দেখলে খুব কষ্ট হয়। সেই সময় তারা কয়েক বন্ধু মিলে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে হত্যা করেন। অস্ত্র কম থাকায় সেদিন অভিযান পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি। দূর থেকে দেখেছেন সারিতে দাঁড় করিয়ে নিরীহ মানুষের হত্যার দৃশ্য।
আবদুস সামাদ বলেন, হত্যার পর লাশগুলোর আধা কবর দেয়া হয়। রাতে শিয়াল-কুকুরের খাবারে পরিণত হয়েছিল তা। এমন স্থান ইতিহাসে স্থান পেলেও, বাস্তবে তার কোনো সংরক্ষণ নেই।
অরক্ষিত আরেকটি গণকবর কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার ধনঞ্জয় গ্রামে। এক বাড়ির ভেতর অন্তত ৩৫ জনকে ব্রাশ ফায়ার করে গণকবর দেয়া হয়। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করে দায় শেষ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয়রা জানান, বছরে একবারও কেউ এখানে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন না।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ৩২টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সেখানে ফলক উন্মোচন করা হয়েছে। বাকিগুলো সরকারি সহযোগিতা পেলে চিহ্নিত করা হবে। সংরক্ষণ ও সঠিক ইতিহাস তুলে না ধরার কারণে জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব বধ্যভূমির ইতিহাস ও স্মৃতির কথা অজানা রয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
মুক্তিযোদ্ধা অফিস ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার গণকবর ও বধ্যভূমির মধ্যে অন্যতম সদর উপজেলার রসুলপুর, রামমালা বধ্যভূমি, সদর দক্ষিণের জগতপুর, চৌদ্দগ্রামে বেতিয়ারা, নাঙ্গলকোট, দেবিদ্বার, লাকসামের বেলতলী ও কৃষ্ণপুরের ধনঞ্জয় বধ্যভূমি। অবহেলায়-অযত্নে পড়ে থাকা গণকবরগুলোর মধ্যে আরও আছে ময়নামতি, লাকসাম, মুদাফফরগঞ্জ, হারং, বেতিয়ারা কোটেশ্বরে।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট বধ্যভূমিতে বাঙালি অফিসার, সৈনিক, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, গৃহবধূ, মসজিদের ইমামদের হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। এখানে ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নির্যাতনের পর হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এ বধ্যভূমিতে মোট ১২টি গণসমাধি খনন করে সাত হাজার নরকঙ্কাল পাওয়া যায়।
কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে কেবিন বরাবর পূর্ব দিকে এ বধ্যভূমিটির অবস্থান। এখানে অন্তত ১০ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ মাটিচাপা দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বেতিয়ারা গণকবর। ১৯৭১ সালে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ৯ জন বীরযোদ্ধা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন। এখানে ওই ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে কবর দেয়া হয়। বেতিয়ারায় শহীদদের কবরটি এখন আগের জায়গায় নেই। মহাসড়কের চার লেনের কাজ হওয়ায় বেতিয়ারার শহীদদের সমাধিটি মহাসড়ক থেকে একটু পাশে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
নগরীর রামমালা এলাকায় অবস্থিত সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতর পুকুর পাড়ে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ চালায় তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইনস্টিটিউটের ভেতর আশ্রয় নেয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে তাদের হত্যা করে।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সফিউল আহমেদ বলেন, ‘বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। সর্বশেষ শহরের রামমালা বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ চলমান। সরকারি সহযোগিতা পেলে বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণ ও সীমানাপ্রাচীর দেয়া হবে।’
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, ‘গণকবর সংরক্ষণে যেসব কাজ করা দরকার সবই করা হবে।’