ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে আছে ১৫ বছর বয়সী মৃত মেয়ে ইরমাকের হাত। তার হাত ধরে নির্বাক হয়ে বসে আছেন বাবা মেসুত হানসার। কিন্তু উদ্ধারকারীদের দেখা নেই। এ দৃশ্য তুরস্কের খাহরামানমারাস এলাকার। এই একটি ছবিই তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞ আর তারপরের মানবিক বিপর্যয়ের অবস্থা তুলে ধরতে যথেষ্ট।
একদিকে ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর শীতকালীন ঝড়ে আক্রান্ত অনেক এলাকায় পৌঁছাতে পারছেন না উদ্ধারকর্মীরা। এর সঙ্গে বড় দুই ভূমিকম্পের পর দফায় দফায় পরাঘাত পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে। এরই মধ্যে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় হতবিহ্বল হয়ে পড়েছে অনেক এলাকার মানুষ।
তুরস্কের সানলিউরফা শহরের বাসিন্দা ৪২ বছর বয়সী ইমাম চাগলার বলেন, ‘আমরা আমাদের ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকি। ভবনটি চারতলা। ভয়ে বাসায় ফিরতে পারছি না। ওই ভবন নিরাপদ নয়।’ তিনি বলেন, ‘একটা হোটেল গতকাল (সোমবার) সন্ধ্যায় কেবল আমাদের স্যুপ খেতে দিয়েছিল। পুরো রাত কেটেছে না খেয়ে। আমরা সবাই খুব ক্ষুধার্ত।’
পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে একই এলাকার বাসিন্দা ফিলিজ সিফসির জন্য। তিনি সোমবার সন্ধ্যায় হিল্টন হোটেলের বিতরণ করা স্যুপ সংগ্রহ করতে পারেননি। তার ও তার তিন সন্তানের পুরো রাত কেটেছে দানাপানি ছাড়া। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে কম্বল ছাড়া আমাদের আর কোনো সম্বল নেই।’
সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের বাসিন্দা মাহমুদ আল-আলি বলেন, ‘আমার শাশুড়ি, শ্বশুর আর দুই শ্যালক ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন। শীত আর বৃষ্টি উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে এখানে বসে আছি উদ্ধারকারীদের অপেক্ষায়।’
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় জান্দাইরিস এলাকার বাসিন্দা আলি বাত্তাল একটি ধ্বংসস্তূপ দেখিয়ে বলেন, ‘আমার পুরো পরিবার ওটার নিচে। আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার জামাতা…তাদের বের করার কেউ নেই।’ ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধের পুরো চেহারা রক্তমাথা। শীত থেকে বাঁচতে একটা চাদর পরেছিলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাদের গলা শুনতে পাচ্ছি। আমি জানি, তারা বেঁচে আছে। কিন্তু তাদের উদ্ধার করার মতো কেউ নেই।’
বিবিসি জানায়, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়া অনেকেই সাংবাদিকসহ পরিচিতদের অডিও, ভিপিও ও খুদেবার্তা পাঠিয়ে উদ্ধার করার আকুতি জানাচ্ছেন।
সর্বশেষ তথ্য বলছে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রাণহানি ৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তুরস্কে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে বলেছে, ভয়াবহ এই ভূমিকম্পের কারণে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এদিকে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ার দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ।
প্রাণহানি ৬ হাজার ছাড়াল
গত সোমবার ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে ৭ দশমিক ৮ ও ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এই দুই ভূমিকম্পের পর শক্তিশালী কয়েকটি পরাঘাতসহ আরও কয়েকবার কেঁপে উঠেছে দেশ দুটি। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় প্রাণহানি ৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা ২০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, সংস্থাটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ভূমিকম্পে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তুরস্ক জানিয়েছে, ভূমিকম্পে দেশটির সাত প্রদেশের ৩ হাজারের মতো ভবন ধসে পড়েছে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালও রয়েছে। মাল্টায়া প্রদেশে ১৩ শতকের বিখ্যাত একটি মসজিদ আংশিক ধসে পড়েছে। গাজিয়ানটেপ এলাকায় ২ হাজার ২০০ বছর আগে রোমান সেনাদের নির্মিত একটি কেল্লাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশটির আলেপ্পো, লাতাকিয়া, হামা ও তার্তুস প্রদেশ ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে তুরস্কের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘শীতকালীন ঝড় পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে। ভূমিকম্পে এমনিতেই বেশ কিছু সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শীতকালীন ঝড়ে আরও কিছু সড়কে যান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধারকারীরা যেতেই পারছেন না। বৃষ্টি আর তুষার থেকে বাঁচতে বহু মানুষ মসজিদ, বিদ্যালয়, বাসস্ট্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস জানান, সময়ের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে এখন। আহত ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসাসেবা দিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার জরুরি চিকিৎসাসেবা দলকে সক্রিয় করেছে।
এদিকে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকো বলেছে, তুরস্ক ও সিরিয়ায় বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত দুটি এলাকা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর একটি সিরিয়ার প্রাচীনতম শহর আলেপ্পো। অপরটি তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় দুর্গ নগরী দিয়ারবাকির। ইউনেসকোর আশঙ্কা, বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত আরও তিনটি এলাকায়ও ভূমিকম্পের প্রভাব পড়ে থাকতে পারে। সংস্থাটি তুরস্ক ও সিরিয়াকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে।
তুরস্কে জরুরি অবস্থা জারি
ভয়াবহ ভূমিকম্পের পরিপ্রেক্ষিতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান গতকাল মঙ্গলবার দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ১০ প্রদেশে তিন মাসের জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। ওই প্রদেশগুলোই ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে এরদোয়ান জানান, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় তার সরকার ৫০ হাজারের বেশি সহায়তা-কর্মী পাঠাবে। পাশাপাশি ৫৩০ কোটি মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তারও ব্যবস্থা করবে।
তুরস্ক-সিরিয়ার পাশে পুরো বিশ্ব
বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পুরো বিশ্ব ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ চিকিৎসা সহায়তা ও উদ্ধারকর্মী পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘জাতিসংঘ দল ঘটনাস্থলে কাজ শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ব্যবস্থাপনা কমিশনার জ্যানেজ লেনারসিচ গতকাল বলেছেন, এই জোটের ১৯ দেশের সমন্বয়ে গঠিত ২৭টি উদ্ধার ও চিকিৎসা দল তুরস্কে যাবে। এই দলে ১ হাজার ১৫০ জন সদস্য ও ৭০টি উদ্ধারকারী কুকুর থাকবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানান, তুরস্ককে উদ্ধারকাজে সহায়তা দিতে তার দেশ খুব দ্রুত উদ্ধারকারী দল পাঠাবে। চীন বলেছে, তাদের উদ্ধারকারী দল এরই মধ্যে তুরস্কে কাজ শুরু করে দিয়েছে। তুরস্ককে তারা ৫৯ লাখ মার্কিন ডলারের জরুরি সহায়তা দেবে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেছেন, তারা বিশেষজ্ঞ উদ্ধারকর্মীসহ ৭৬ জনের একটি দল পাঠাচ্ছে। পাশাপাশি জরুরি চিকিৎসা সহায়তা দিতে চিকিৎসক দলও পাঠানো হচ্ছে।
এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, সিরিয়ায় এরই মধ্যে ৩০০ জন রুশ সেনা কাজও শুরু করে দিয়েছে। ভারতও উদ্ধারকারী ও চিকিৎসক দল পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এ ছাড়া জার্মানি, ইউক্রেন, গ্রিস, ইসরায়েল, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, জাপানসহ আরও কয়েকটি দেশ পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ দুর্যোগের ভয়াবহতা কাটাতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।
তুরস্ক হলো বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি। এর আগে ১৯৩৯ সালে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় এরজিনচান প্রদেশে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৩৩ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৯৯৯ সালে দেশটির দাচে অঞ্চলে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন, বড় ভূমিকম্পে যেকোনো দিন ইস্তাম্বুল শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটতে পারে। এই মেগাপলিসে ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষের বসবাস।
১৯৮/সি, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮
©দৈনিক বাংলা