শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সাক্ষাৎকার

রিজার্ভ নিয়ে নেতিবাচক চিন্তার সুযোগ নেই

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
এম এ খালেক
প্রকাশিত
এম এ খালেক
প্রকাশিত : ১৬ মার্চ, ২০২৩ ০৮:৫৭

বীর মুক্তিযোদ্ধা, অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ পল্লি কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন ও ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ছাড়াও তিনি উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দেশের মূল্যস্ফীতি, গ্রামীণ অর্থনীতি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভসহ নানা বিষয়ে অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক-এর মুখোমুখি হয়েছেন।

এম এ খালেক: বিশ্বব্যাপী যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে তার কারণ কি এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির প্রভাব কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব বলে মনে করেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: বিশ্বব্যাপী যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে প্রাথমিক দুটো কারণকে আমরা দায়ী করতে পারি। এর মধ্যে একটি হচ্ছে করোনা অতিমারির প্রভাব। করোনা অতিমারির কারণে বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। মানুষের আয় কমে গেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা একই বিষয় লক্ষ করি। করোনার কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে। মানুষের আয়রোজগার কমে গেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

করোনার প্রভাব কমে আসায় বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ঠিক সেই পর্যায়ে শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়। করোনা অতিমারির সংক্রমণ থেকে বিশ্ব যখন পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় ছিল ঠিক তখনই শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ব অর্থনীতিকে আবারও সংকটে ফেলে দেয়। এই যুদ্ধের ফলে বিভিন্ন দেশে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর জের এখনো বিশ্বকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

এম এ খালেক: চলতি অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কেমন হতে পারে বলে মনে করেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: করোনা অতিমারির পর আমাদের এখানে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া খুব ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৪ শতাংশের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে প্রাথমিক হিসাবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে তা ৭ দশমিক ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি বিকাশমান অর্থনীতি ৭ দশমিক ১০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যেকোনো বিচারেই উল্লেখের দাবি রাখে। করোনা শুরু ওয়ার আগে এক বছর আমরা ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিলাম। কাজেই আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার প্রায় করোনার পূর্বাবস্থায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আবারও আমরা পিছিয়ে পড়েছি। চলতি অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে প্রাক্কলন আছে তা অর্জন করা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে উন্নয়ন সহযোগীরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে তা খুব একটা খারাপ নয়।

এম এ খালেক: গ্রামীণ অর্থনীতির যে নীরব রূপান্তর চলছে সে সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: আমাদের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। সরকার গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য বিশেষ দৃষ্টি দিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশমান ধারায় প্রবহমান রয়েছে। আগামীতেও বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সন্তোষজনক অবস্থায় থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে একধরনের নীরব রূপান্তর প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম থেকেই যুবক শ্রেণি কর্মসংস্থানের জন্য বিদেশে যাচ্ছে। তারা দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। তাদের পাঠানো অর্থে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। একসময় যারা গ্রামে দরিদ্র পরিবার হিসেবে পরিচিত ছিল আজ তাদের অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে। শহরের সুবিধাদি এখন গ্রামীণ জনপদেও পাওয়া যাচ্ছে। সরকার শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়ার যে পরিকল্পনা করেছে তা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমাদের পণ্য রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে পণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আসে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। রেমিট্যান্সও ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। ২০০৭-২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলে আমি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, অর্থনৈতিক মন্দার সময় বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়বে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে উন্নত দেশের ভোক্তাগণ দামি পোশাকের পরিবর্তে তুলনামূলক স্বল্প মূল্যের তৈরি পোশাক ক্রয় করে। বাংলাদেশ তুলনামূলক কম দামি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। কাজেই বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমবে না। এবারও ঠিক সে কথাই আমি বলব। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে। রেমিট্যান্স বিনিয়োগে খুব একটা আসছে না। এগুলো মূলত ভোগ ব্যয়ে খরচ করা হয়। ভোগ ব্যয়ে খরচ বাড়লে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কাজেই এরও একটি ইতিবাচক দিক আছে। আমি মনে করি, চলতি অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করেছে তার কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে সত্যি কিন্তু অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অগ্রগতি আমাদের আশান্বিত করে।

এম এ খালেক: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে নেতিবাচক কথা শোনা যায়। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে মাঝেমধ্যেই নেতিবাচক কথা শোনা যায়। বলা হয়, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রিজার্ভ কমার অনেকগুলো কারণ আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বেড়েছে। ফলে রিজার্ভ ব্যয় হচ্ছে বেশি। কিন্তু রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যয় করলেও রিজার্ভে নতুন করে অর্থ যোগ হচ্ছে। কাজেই রিজার্ভ নিয়ে নেতিবাচক চিন্তার তেমন কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। প্রবাসী আয়, রপ্তানি আয় ইত্যাদি যাতে বৈধ পথে আসে সে ব্যাপারে সরকার নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে। রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে আসছে বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। সরকার নানাভাবে চেষ্টা করছে রেমিট্যান্স যাতে বৈধ পথে দেশে আসে। পণ্য রপ্তানি আয় বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তার সুফল আমরা পেতে শুরু করেছি। ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ আমদানি ব্যয় হয়েছিল সাড়ে ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বছর শেষে সেটা ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে। কাজেই আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমেছে। আগামীতে আমদানি ব্যয় আরও হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমাদানি ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, এটা অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে কোনোক্রমেই যেন ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি না কমে। এসব পণ্যের আমদানি কমলে দেশে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হবে, যা শেষ পর্যন্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট করে দারিদ্র্যবিমোচন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করবে। অপ্রয়োজনীয় অথবা কম প্রয়োজনীয় অথবা আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদনের সুযোগ আছে সেসব পণ্য আমদানি কমানো যেতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে সমস্যা কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এবং অনেক ক্ষেত্রেই সফলতা অর্জিত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় আমি মনে করি, ২০২৩ সাল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যতটা খারাপ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল তা হবে না।

এম এ খালেক: আপনি রেমিট্যান্সের কথা বললেন। গত অর্থবছরে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমতুল্য রেমিট্যান্স অবৈধ পথে দেশে এসেছে বলে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ বিদেশে গেছে কর্মসংস্থানের জন্য। সব দেশেই যে উন্নয়নমূলক বন্ধ হয়ে গেছে অথবা কমেছে তা কিন্তু নয়। অনেক দেশে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই হচ্ছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির প্রধান গন্তব্য। সেখানে উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে। যারা বিদেশে চাকরি করেন তারা কঠোর পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন। তারা যদি ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে কার্ব মার্কেটে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে বেশি অর্থ পান তাহলে অনেকের মধ্যেই কার্ব মার্কেটে মুদ্রা বিনিময় করবেন। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে তিন-চারটি রেট কার্যকর রয়েছে। মুদ্রা বাজারে তিন-চারটি বিনিময় হার থাকা উচিত নয়। আমি মনে করি,এ ক্ষেত্রে সমন্বয় করে দেয়া উচিত। কার্ব মার্কেটের বিনিময় হার বেশি হতে পারে, তবে তা কোনোভাবেই এক বা দুই টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। অনেকেই মনে করেন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। যদি অন্য কিছু বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারও বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত। কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণ করব, আবার কিছু বিষয় বাজারের ওপর ছেড়ে দেব, এটা ভালো ফল দেবে না। মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। সেই সীমার বাইরে চলে গেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সব ক্ষেত্রে এবং সবার জন্য সমান হওয়া উচিত। এর চেয়েও খারাপ হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে দেশ থেকে মুদ্রা পাচার। প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে প্রেরণ করা হচ্ছে। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিং এবং আমদানির ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হচ্ছে। এটা কঠোরভাবে রোধ করা প্রয়োজন। এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অর্থ পাচার অনেকটাই কমে আসত। আমাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের অভাব প্রতিনিয়তই বাড়ছে।

এম এ খালেক: বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পেয়েছে। এই ঋণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ছিল। ঋণের বিপরীতে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। বাংলাদেশের পক্ষে এই শর্তগুলো কতটা পরিপালন করা সম্ভব বলে মনে করেন?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: আইএমএফ ঋণদানের সময় বাংলাদেশকে যেসব শর্ত দিয়েছে তা পরিপালন করা কতটা সম্ভব তার চেয়ে আমি বলব, এর অধিকাংশ শর্তই বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেমন আইএমএফ ব্যাংকিং সেক্টরের সংস্কার ও খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলেছে। দুর্নীতি কমানোর কথা বলেছে। রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছে। এগুলো আমাদের অর্থনীতির স্বার্থেই করা প্রয়োজন। সর্বস্তরে সুশাসন নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এগুলো সরকারও বলছে। কিন্তু বললেও এগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি রোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়েছে। কাজেই এসব শর্ত এমনিতেও পালন করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই এসব সংস্কার সাধন করা প্রয়োজন। কিন্তু আগে করা হয়নি। এখন যদি আইএমএফের শর্তের কারণে সংস্কারগুলো করা হয় তাহলে সেটা ভালোই হবে। আইএমএফ যেসব শর্ত দিয়েছে তার কোনোটি মানা হচ্ছে। আবার কোনোটি মানা হচ্ছে । আইএমএফের সব শর্তই যে মানতে হবে তা নয়। যেমন কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোর কথা সম্ভবত বলা হয়নি। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানো হলে দেশের কৃষি সেক্টরের উন্নতি বিঘ্নিত হবে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস এগুলোর ওপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হলে তা ভালো হবে বলে মনে হয় না।

এম এ খালেক: সম্প্রতি ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণের সুদের সর্বোচ্চ সীমা কিছুটা বাড়িয়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে সুদের আপার ক্যাপ প্রত্যাহার করা হয়নি। এই অবস্থায় নীতি সুদ হার বাড়িয়ে কি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার নির্ধারণ করে দেয়াটা কোনোভাবেই যৌক্তিক বলে মনে হয় না। কোনো কোনো খাতে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার প্রত্যাহার করা হবে। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা বহাল রাখা হবে- এটা কাম্য নয়। কিছু স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করার জন্যই সম্ভবত এটা করা হচ্ছে। যারা ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণ করেন তাদের যে সুদ প্রদান করা হচ্ছে তা মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে কম। ফলে তারা আমানত সংরক্ষণের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন না। সাধারণভাবে আমানতের ওপর প্রদেয় সর্বোচ্চ সুদের হার প্রত্যাহার করা হলে সাধারণভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হারও প্রত্যাহার করা উচিত ছিল।

এম এ খালেক: আমাদের দেশের একটি সাধারণ প্রবণতা হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগের বছর দেশ থেকে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। আগামী নির্বাচনের আগে এ বছর কি অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে?

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ: অর্থ পাচার তো চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছরই বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে। এখন তো হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। মাঝেমধ্যেই পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় অর্থ পাচারের। নির্বাচনের বছরে অনেকেই অর্থ পাচার করে থাকেন। তারা অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের নিরাপত্তা দিতেই এটা করে থাকেন। আসলে নির্বাচনের সঙ্গে অর্থ পাচারের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থ পাচার এমনিতেই হচ্ছে। দিন দিন তা বেড়ে যাচ্ছে।


১৭ মে: বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা দিন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোঃ শাহিনুর রহমান

বাংলাদেশের চলমান ইতিহাসে ১৯৮১’র ১৭ মে বঙ্গকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরশাসকেরা স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনরায় যেভাবে উল্টোরথে চড়িয়ে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন ফিরে না এলে আর কোনোদিন নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যের সোজা পথে ফিরে আসা বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো কি না সে-ব্যাপারে গভীর সন্দেহের অবকাশ আছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর সামান্য আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ এ ইতিহাস পুরোনো প্রজন্মের অনেকের জানা থাকলেও এ ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন, যার ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাকি সদস্যরা এবং সম্প্রসারিত পরিবারের অনেক সদস্যও সেদিন শিকার হন শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের এক নৃশংসতম রাজনৈতিক গণহত্যাকাণ্ডের।

এ হত্যাকাণ্ডের পর জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং এ আবেদন অনুমোদিত হয় ২৪ আগস্ট। জার্মানির ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জননেত্রী শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, তাদের দুই শিশুসন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানাকে ১৯৭৫-এর ২৫ আগস্ট সকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

দিল্লিতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে গিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বামী বাংলাদেশের ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১—টানা প্রায় ছয় বছর দিল্লিতে তাদের নির্বাসিত জীবন কাটানোর সময় আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে এবং দেশ ও দলের এক গভীরতম সঙ্কটলগ্নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজি করানোর অভিপ্রায় নিয়ে। এদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তৎকালীন যুবনেতা আমির হোসেন আমু প্রমুখ।

এর পর ১৯৮১’র ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সম্মেলনের এক সপ্তাহ পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি আবদুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ, এম. কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ ঢাকা থেকে দিল্লিতে যান, এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পর পর কয়েকটি বৈঠকে বসে নেত্রীকে দেশে ফিরতে রাজি করান এবং ফেরার পরবর্তী কর্মপন্থার খসড়া পরিকল্পনা করেন।

দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথ থেকে জোর করে বিচ্যুত করা জাতিকে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধু-তনয়ার প্রয়োজনের গভীরতা তারা সেদিন নেত্রীকে বোঝাতে পেরেছিলেন। দেশ, জাতি আর দলের সেই ভয়াবহ সঙ্কটকালে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দেশে ফিরতে সম্মত হন।

দিল্লিতে দুই শিশুসন্তান জয় আর পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফেরেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক আবহের মতো সেদিনকার আবহাওয়াও ছিল তীব্র ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে বইছিল ঝোড়ো বাতাস, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়বাদল অগ্রাহ্য করে সেদিন লক্ষ লক্ষ লোক জমা হয়েছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

সেদিন বিকেল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জননেত্রী শেখ হাসিনা পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে চরাচর মুখরিত হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কণ্ঠে সমস্বরে ঘোষিত হয়-- ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে, লক্ষ ভাই বেঁচে আছে’; ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’...।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন জনতার উদ্দেশ্যে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।... সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসি নি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

দেশে ফিরে যেসব অঙ্গীকার নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন তার মধ্যে ছিল: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্বৈরতন্ত্রের চিরঅবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠা। এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কখনো পিছু হটেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা।

দেশে ফেরার পর শুরু হয় সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, যা চলে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাকে তার পথ থেকে একতিলও টলাতে পারে নি। বাংলার মানুষের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বার বার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার জনগণ তার বৈপ্লবিক ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ভূষিত করেছে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ অভিধায়।

দেশে ফেরার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার অপূর্ণ স্বপ্নকে সম্পূর্ণতা দেয়ার পথে সকল বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে পুরোপুরি প্রস্তুত বলে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হতে হয়।’ মহান নেত্রী তার জীবন দিয়ে তার এ উক্তিকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে ঘাতকেরা তার ওপর একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। বার বার তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করেন নি। বঙ্গকন্যার অদম্য সাহস আমাদেরকে প্রাণিত ও প্রণোদিত করে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সংগ্রামে আরো সাহসী হয়ে ওঠায়। মৃত্যুঞ্জয়ী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ সত্যিই এক মহৎ প্রেরণার নাম।

১৯৮১ থেকে ২০২৪-- সুদীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আর অঙ্গীকারের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য ক্রমপরিস্ফূট হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা যদি সেদিন ফিরে না আসতেন, কবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী, উগ্র সাম্প্রদায়িক, সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের আগ্রাসন থেকে জাতি কোনোদিন মুক্তি পেতো কিনা সন্দেহ। জাতির পিতা আর তার স্বপ্নের হন্তারকেরা জাতিকে যে-উল্টোরথে চড়িয়ে এক কৃষ্ণবিবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনাই তার চুয়াল্লিশ বছরব্যাপী সংগ্রাম আর সরকার পরিছালিনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিনিময়ে সেই উল্টোরথকে উন্নয়ন ও প্রগতির আলোকাভিমুখী সোজা পথে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে জননেত্রী শেখ হাসিনা যেসব কথা বলেছিলেন, যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, সেগুলোকে সত্যে পরিণত করেছেন কঠোর নিষ্ঠা আর একাগ্র প্রচেষ্টায়। পঁচাত্তরপরবর্তী প্রবল প্রতিকূল সময়ে বিরুদ্ধস্রোতে কুটোর মতো ভাসমান ও ভগ্নপ্রায় আওয়ামী লীগ তার সময়োপযোগী বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই আজ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অনেক বেশি সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আর ২০০৯ থেকে চলতি ২০২৪ পর্যন্ত মোট কুড়ি বছর প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব সর্বোচ্চ যোগ্যতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। ২০২৩-এ জনগণের নিরঙ্কুশ রায় নিয়ে টানা চতুর্থবার এবং সব মিলিয়ে পঞ্চমবার ক্ষমতায় আসার সূত্রে এ দফায় তাকে আমরা আরও চার বছর সরকার-প্রধান হিসেবে পাচ্ছি, এটা জাতির জন্যে এক বিরাট পাওয়া। আগামীতে আবারো আমরা তাকে নির্বাচিত করবো এবং আজীবন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, এটাই আমাদের আশা।

এ ছাড়া ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি জাতীয় সংসদে একজন সংগ্রামী বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকাও পালন করেছেন। বঙ্গকন্যার হাত ধরে তার দল ও দেশ আজ প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের দুঃসহ স্মৃতিকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বসভায় সমুন্নত শিরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার গত ৪৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অর্জিত মাইল ফলকগুলো হলো: সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এবং জাতির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশকে তিনিই আজ খাদ্যে সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর করে তুলতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন তথা রায় কার্যকর করিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের এক নতুন পথের অভিযাত্রী। তারই দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের চোখে ‘উন্নয়নের আইকন’ হয়ে উঠেছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কথিত বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’-এ ।

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রখর দূরদৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলে দেশের এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন, লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা, কৃষি দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার মাধ্যমে পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বাস্তবায়িত হয়েছে পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো রেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি টানেল প্রভৃতি মেগা-প্রকল্পগুলো এবং বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর প্রভৃতি আরও কিছু মেগা-প্রকল্প।

প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতক চক্রের হাতে পড়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়া একটি দেশ ও জাতিকে আবার নিজের সুস্থ সবল দৃঢ় পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন অনাপোষ ও স্থিতপ্রতিজ্ঞ বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন একটি সম্মানজনক পরিচিতি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে তারই কারণে। তিনি আজ জাতীয় নেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন।
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ‘মানবতার জননী’, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আজ অনেকটাই বাস্তবে পরিণত করেছে তার সুযোগ্য কন্যার গতিশীল নেতৃত্ব। আর এসব সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র তিনি ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে আসার যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন বলেই। আর সেকারণেই ১৭ মে দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা হয়ে গেছে।

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, ফোকলোরিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


হিজড়া সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত এক জনগোষ্ঠীর নাম ‘হিজড়া’। হিজড়া বলতে সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তলিঙ্গ, উভয়লিঙ্গ, তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরিত নারী-পুরুষদের বোঝানো হয়। তারা পূর্ণাঙ্গ পুরুষ নয়, আবার পূর্ণাঙ্গ মহিলাও নয়। দৈহিক বা জিনগত পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী জন্মগতভাবে কোনো অবস্থানের ব্যক্তিরাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’। আরবিতে হিজড়াদের বলা হয় ‘খুনছা’। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে, ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে তারা হিজড়া হিসেবে পরিচিত। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত কৃতবীর্যের পুত্র অর্জুনও ছিলেন হিজড়া, যার অপর নাম বৃহন্নলা। যেকোনো দেশে যেকোনো পরিবারে হিজড়া সন্তানের জন্ম হতে পারে। অনাদর ও অবহেলায় বড় হলে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে হিজড়াদের দলে ভিড়ে যায়। বিশ্বের ট্রান্সজেন্ডারদের ৪০ শতাংশ বিষণ্নতায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অথচ তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।

পথচারীদের বেশিরভাগ সময় উত্ত্যক্ত করে জোরপূর্বক টাকা আদায় করে বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি রুটে চলাচলকারী বাস সমুহে দুইজন করে হিজড়া উঠে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে চাঁদাবাজি করে থাকে যা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে, এদের আচরণে কোমলমতি শিশুদের এ মহিলা যাত্রীদের সামনে পুরুষ সদস্যদের বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়।

দীর্ঘকাল ধরে তারা এরা অবহেলিত, অনাদৃত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত। সমাজের সদস্যদের মনের অন্ধকার ও ব্যাধিগ্রস্ত মানসিকতার কারণে এ জনগোষ্ঠী নিজেদের বিচ্ছিন্নভাবে। তাচ্ছিল্য, উপহাস ও সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা যৌনব্যবসা, ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ পরিণত বয়সে অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের চিকিৎসা ও দেখভালের জন্য কোনো আপনজন বা নিকট আত্মীয় থাকে না। এদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে এনে সম্মানজনক জীবিকার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রথম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাদিয়া আখতার পিংকি। তিনি মনে করেন, ‘হিজড়ারাও মানুষ। তাদের হেয় চোখে দেখার কিছু নেই।’ তিনি নিজে তাই সব মানুষের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। আর এলাকার মানুষ চাইলে আরো বড় দায়িত্ব নিতে চান ভবিষ্যতে। নানা সামাজিক প্রতিকূলতা তাকে পার হতে হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরও তাকে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। পিংকি বলেন, ‘যারা আমাকে কটূক্তি করেছেন তাদের আমি এড়িয়ে চলিনি। তাদের কাছে গিয়ে বলেছি, আমিও তো তোমাদের মতো মানুষ।’ তারা আমার কথা তখন শুনেছেন। আমাকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পিংকি বলেন, সবার সঙ্গে মিশে তাদের মন জয় করেছি।

বাংলাদেশে হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পেতে বিড়ম্বনা ও জটিলতা রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো আইনেই স্পষ্ট কিছু বলা নেই। হিজড়া জনগোষ্ঠী যেন মা-বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ পান, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয় মুসলিম শরিয়াহ আইন এবং সংবিধানের আলোকে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। শরিয়াহ আইনে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীও মানুষ। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক মানবিক আচরণ করতে হবে। লৈঙ্গিক বৈকল্যের কারণে কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়া কোনোক্রমে উচিত হবে না। সমাজের একটি অংশকে অন্ধকারে রেখে আমরা আলোর সন্ধান করতে পারি না। তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত ও কর্মমুখী শিক্ষা ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে তারাও অবদান রাখতে পারবে এবং মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এখন সহজ হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান , গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি এনজিও এবং সেবা সংস্থাগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়ে আসতে পারে।

লেখক: গবেষক, পরিবেশকর্মী


প্রত্যাবর্তন শেখ হাসিনার: পূর্ণতা স্বদেশের

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোস্তফা কামাল

১৯৮১ সালের ১৭ মের আগ পর্যন্ত আরেকটি তারিখ ছিল স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। সেটি ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে এ তারিখটিতে স্বাধীন দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর মা-বাবাসহ স্বজনহারা মুজিবকন্যার একাশির ১৭ মে স্বদেশ ফেরার আরেক প্রেক্ষিত। তবে ভিন্ন ভিন্ন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাঝেই দেশের ও ইতিহাসের পরিপূর্ণতা, ছিল অনেক বেদনা। সঙ্গে আবেগ-আনন্দাশ্রু। পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডির সময় বিদেশ থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দুই বোনের আর্থিক সম্বল বলতে ছিল কেবল ২৫ ডলার। স্বামীর জার্মান ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ২৫ আগস্ট স্বামী, বোন ও দুই সন্তানসহ দিল্লিতে পৌঁছান শেখ হাসিনা। ভারতে তখন জরুরি অবস্থা, দুই সপ্তাহ দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে থাকার পর ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষাৎ পান তারা। ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে দুজন নিরাপত্তাকর্মীসহ তাদের থাকার নতুন ঠিকানা হয় ইন্ডিয়া গেট সংলগ্ন পান্ডারা পার্ক, সি-ব্লক ফ্ল্যাটে। ১ অক্টোবর ’৭৫ সালে এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে পরমাণু শক্তি বিভাগে স্বল্প বেতনে ফেলোশিপ দেয় ভারত সরকার। লন্ডনপ্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে বিয়ের পর ১৯৭৬ সালের ২৪ জুলাই শেখ রেহানা লন্ডন চলে যান।

দেশের রাজনীতিতে তখন ভিন্ন পরিস্থিতি। মুশতাক-সায়েম ইত্যাদি পর্ব শেষে রাষ্ট্রক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। আর আওয়ামী লীগ অনেকটা নেতৃত্বহীন, কয়েকভাগে ব্যাকেট বন্ধী। নৌকা কাণ্ডারিহীন। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে দলের শীর্ষ কয়েক নেতার উপলব্ধিতে আসে দল রক্ষা করতে গেলে দরকার বঙ্গবন্ধুর রক্তের অধিকার। তাদের ওই সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের পর ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই সম্মেলনে শেখ হাসিনা শুধু দলটির সভানেত্রীই হলেন না, ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটিকে। এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৬ মে পুতুলকে নিয়ে রওনা দিয়ে কলকাতা হয়ে ১৭ মে ফেরেন নিজ মাতৃভূমিতে। তথ্য-সাবুদে দেখা যায়, তাকে বহন করা ইন্ডিয়া বোয়িং এয়ারলাইন্সের কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে নামে বিকাল সাড়ে ৪টায়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সেদিন বাতাস ছিল বেশ গতিময়। সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। তাকে বরণ করতে সেই বিরূপ আবহাওয়ার মাঝেই প্রায় ১৫ লাখ মানুষ জড় হয় শেরেবাংলা নগর হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত।

শেরেবাংলা নগরের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যার ভাষণের কয়েকটি লাইন ছিল এমন- ‘সব হারিয়ে আজ আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ ... ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে জনগণের সামনে আসিনি। আমি আপনাদের বোন, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেদিন শেখ হাসিনার আরও উচ্চারণ ছিল, ‘সব হারিয়ে আজ আমি এসেছি বাংলায়। এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। আমার আজ হারানোর কিছুই নেই।’ আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। শেখ হাসিনা বলেন, ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। বড় আবেগময় শেখ হাসিনার সেই ভাষণ। আর প্রত্যাবর্তন ছিল দেশ- দলের জন্য সময়ের দাবি। তা অনেকটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘যাত্রী আমি ওরে। পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে’-র মতো। শেখ হাসিনাকে কেউ ধরে রাখতে পারেনি। পারছেও না। একাশিতে দেশে ফেরার পর অবিরাম কেবল এগোচ্ছেন তিনি। বিভক্ত দলকে একই করেননি। দীর্ঘ একুশ বছরের লড়াই-সংগ্রাম শেষে ছিয়াশিতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন। এরপর ২০০৯ থেকে আছেন টানা চারবার। যা কারো কাছে বিস্ময়ের । কারো কাছে ঈর্ষার। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হওয়ার। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে সাহস- প্রজ্ঞায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে তিনি কেবলই আগোয়ান-ধাবমান। তা কোনো ম্যাজিক বা মন্ত্র পাঠে নয়। তা সম্ভব হয়েছে সাহস আর চেতনায়।

বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনা সরাসরি গিয়েছিলেন তাদের বাড়ি ৩২ নম্বর ধানমন্ডি যেখানে ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে ৬ বছর আগে বাবা-মাসহ পরিবারের সব আপনজনকে হারিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। তখন ৩২ নম্বরের সামনের রাস্তাতে বসেই বুকফাটা আর্তনাদে সবার জন্য দোয়া করেছিলেন, আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছিলেন। ওই সময়টায় গণমাধ্যম আজকের মতো বিস্তৃত ছিল না। আর গণমাধ্যম মানে পত্রিকা। এর মাঝেও শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। তখনকার আলোচিত সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’ এ লেখা হয়, ‘ইন্দিরার নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে।’ সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’ এ ঘটনায় ভারতীয় পত্রিকায় ‘খুশির জোয়ার’ দেখেছে। ‘হলিডে’ তে লেখা হয়, ‘তার দেশে ফেরার ব্যাপারটি ঢাকা ও দিল্লি কর্তৃপক্ষের মধ্যকার এক চুক্তি অনুসারে বহু আগেই স্থির করা হয়।’ শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে পরদিন ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় লেখা হয় ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামে লিখে- রাজধানী ঢাকা ১৭ মে মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। শ্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে।

দলকে এবং দেশকে এ অভিযাত্রায় আনতে অনেক লড়াই-সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই, হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার আগের ছয়টা বছর তার দুঃসহ যন্ত্রণা এখনো অনেকের ধারণা-কল্পনার বাইরে। রওনা হওয়ার কয়েকদিন আগে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে শেখ হাসিনা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১১ মে ৮১ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, তিনি নিহত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত নন; এমন কী যে সরকারের মোকাবিলা করবেন তার শক্তিকে তিনি বাধা বলে গণ্য করবেন না। ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ ভারত থেকে ফেরার সময় দিল্লি বিমানবন্দরে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছ-বছরের প্রবাস জীবনে আমার প্রতি যে মমতা ও ভালোবাসা দেখানো হয়েছে, তার জন্য আমি ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।’ সেই ঝুঁকির মাঝেই যে তার দেশে ফেরা, ফেরার পর বেঁচে থাকা, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ক্ষমতা, সেই ক্ষমতায় টিকে থাকা- সে কথা তিনি নিজ মুখেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সে সময়ে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে শেখ রেহানার এক স্মৃতিচারণে রয়েছে- ‘কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ঘাতকরা যদি আবার সক্রিয় হয়ে তাদের আরাধ্য কাজ শেষ করতে তৎপর হয়ে ওঠে? আমি ঠিক করলাম জয় আর পুতুলকে আমি সেই মৃত্যুপুরীতে যেতে দেব না। ওদের লন্ডনে নিয়ে আসব। ঠিক তখনই পুতুলের পক্স হলো। এদিকে দিল্লিতে আমার তিন সপ্তাহ থাকার কথা। কিন্তু বিশ্রীভাবে হাত পুড়ে যাওয়ায় প্রায় দু’মাস তখন চলে গেছে। আমার অফিসের ছুটি ও আর বাড়ানো যাচ্ছিল না। তাই কেবল জয়কে নিয়ে আমি লন্ডন ফিরলাম।’

আজকের বাস্তবতায় ভাবা যায় দুই বোনসহ পরিবারটির দুঃসহ সেই কষ্টের দিনাতিপাতের কথা? বাস্তব ও কঠিন এ পথে দেশে ফিরে বারবার মৃত্যুর মুখে পড়ছেন শেখ হাসিনা। এ পর্যন্ত তিনি ২০-২১ বার শত্রুপক্ষের হত্যা চেষ্টার সম্মুখীন হয়েছেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিনটি তাই কেবল একটি তারিখ নয়, ইতিহাসের বাঁক ঘুরানো ঘটনা। এর মাঝে শুধু তার দল নয়, রাজনীতির মাঠের আরও অনেকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে। কথা দেওয়া, কথা রাখার পথে ডানবাম না তাকানোর চর্চা বঙ্গবন্ধুর ছিল। সেই শিক্ষা শেখ হাসিনাও নিয়েছেন। ওয়াদা বা অঙ্গীকার অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বিচার শুরু করেন তিনি। ওই আমলেই ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের আদালত কর্তৃক ঘোষিত বিচারের রায়ে প্রকাশ্য ফায়ারিং স্কোয়াডে ১৫ জন ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুলভোটে জিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। কারও কাছে হার না মানার এ বৈশিষ্ট্যেই এগিয়ে চলছেন তিনি। যা কেবল স্থানিক বা জাতীয় রাজনীতিতে নয়, বিশ্ব দরবারেও আলোচিত অভিযাত্রায় শামিল করেছে। বিশ্ব নেতৃত্বে এখন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শেখ হাসিনার। আর সেখানে শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন


বঙ্গবন্ধুকন্যা না ফিরলে কেমন হতো বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

১৯৮১ সালের ১৭ মে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরবেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষের কাছে এটা যেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ৯ বছর আগে তারা যেমন প্রতিক্ষায় ছিলেন, তেমনি ৯ বছর পরও তারা প্রতিক্ষায়। তবে এবারের প্রতিক্ষা অনেক ভয়ের। ভয়টাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু নাম এ দেশে নিতে দেওয়া হয় না। তার ছবি কোথাও টাঙ্গাতে দেওয়া হয় না। তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার আইন (ইনডেমনিটি) করে বন্ধ করা হয়েছে। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে পুরস্কার স্বরূপ চাকরি দিয়ে পাঠানো হয়েছে। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর চলছে দমন-পীড়ন। প্রায় ৬২ হাজার আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৪৩ জনকে বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। বিচারবহির্ভূতভাবে অন্তত ৩০০০ সেনাসদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা হত্যা ও গুম করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ’৭২-এর ঘাতক দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৫২ জন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিল। জামায়াতে ইসলাম জিয়ার সমর্থনে চলছে। দেশে গণতন্ত্র উধাও। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সেনা শাসন চলছে।

সেই সময়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আলোকবর্তিকা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে প্রিয় জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা; দীর্ঘ ৬ বছরের নির্বাসন শেষে, নিজের ছেলে জয় (সজিব ওয়াজেদ জয়) ও মেয়ে পুতুলকে (সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) বোন রেহানার (শেখ রেহানা) কাছে রেখে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে। এ দিন ঢাকায় বয়ে যাচ্ছিল কালবৈশাখী, ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়া। তাতে কী! শেখ হাসিনা আসবেন তাই কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগর লক্ষপ্রাণ মুজিবপ্রেমীর ভিড়। বিকাল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। সেদিন রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে সেদিন সারা দেশের মানুষের গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকা। বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগণবিদারী স্লোগান; স্বাধীনতার অমর স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে আমরা আছি তোমার সঙ্গে’। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক যখন মালা পরিয়ে দেন তাকে, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কান্না করছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার পরনে ছিল সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি।

কুর্মিটোলা থেকে শেখ হাসিনার শেরেবাংলা নগরে এসে পৌঁছাতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেদিনের গগণবিদারী মেঘ গর্জন, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল। আর বৃষ্টির পানি মিশে গিয়েছিল বাঙালির চোখের আনন্দঅশ্রুতে। শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্থিত প্রায় ১৫ লাখ মানুষের হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসার জবাবে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ একবার ভেবে দেখুন: ১৯৭৫ সালের আগস্টের সেই ভয়াল রাতের কথা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। বঙ্গমাতা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল কেউ বাদ গেল না। যদি সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে না থাকতেন? যদি সেদিন তারা ৩২ নম্বরে থাকতেন তাহলে কী হতো? নিশ্চিতভাবেই ওই ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের চরম নিষ্পত্তি ঘটতে পারত; বেঁচে গেলে সেটি অলৌকিকই হতো। অথবা শেখ হাসিনা যদি কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরে না আসতেন। যদি অভিমানে থেকে যেতেন নিরাপদ দূরত্বে। তাহলে আমরা বর্তমান যে বাংলাদেশকে দেখি সেই বাংলাদেশ কেমন হতো? আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থা আজ কোথায় থাকত? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ যেভাবে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে তারইবা উত্তরণ ঘটত কী? এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর একটাই- শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার কারণেই আজ গণতন্ত্রের মুক্তি মিলেছে, উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রার পথে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ২০২২ সালে বলেন, ‘১৯৮১ সালে ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রয়োদশ জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের এক দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই থেকে দলের এবং দেশের হাল ধরে আছেন। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতায় না থেকেও মানুষের মুক্তির জন্য তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি বারবার বলেন, তার আর হারানোর কিছু নেই। তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন বাংলাদেশ পথ হারাবে না।

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন হয়, বিজয় হয় গণতন্ত্রের। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এ সময় পাহাড়ি-বাঙালি দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে পার্বত্য শান্তিচুক্তি এবং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি সই হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে এবং জনগণের কল্যাণে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে তার সাহসিকতা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, দারিদ্র্যবিমোচন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে মানবিক নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি এমন অসংখ্য দৃশ্যমান কার্যক্রম আজ মহিমান্বিত করেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চার দশকের বেশি সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি। নানা চড়াই-উৎড়াই, কারাবরণ, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াসহ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের ফলেই আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রেখে পাঁচ বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে এবং বর্তমানে টানা চতুর্থবার ক্ষমতাসীন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এই সময়ের শাসন আমলেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলেই বাংলাদেশ স্বল্পন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ উন্নত বাংলাদেশ হবার পথে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে বদ্ধপরিকর। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে পিতার মতোই অবিচল, দৃঢ় ও সাহসী শেখ হাসিনা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের কল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। ‘রূপকল্প ২০২১’ এর মধ্যম আয়ের বাংলাদেশকে ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু-কন্যা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দেশের উন্নয়নে এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন শতবর্ষব্যাপী কর্মসূচি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০।

জাতির পতিা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজারো প্রচেষ্টা, ত্যাগ তিতিক্ষার পর দেশের রাজনীতিতে একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে নেতৃত্বে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দেশের রত্ন নয়, তিনি বিশ্বরত্ন। তিনি বাঙালি জাতির চেতনার প্রতীক। আমাদের অহংকার। যার অপ্রতিরোধ্য পথ চলায় বাংলাদেশ আজ ছুটে চলছে উন্নয়নের মহাসড়কে। শেখ হাসিনা মানেই উন্নয়নের জয়জয়কার। বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক। আমাদের সবার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দলে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে বেশ কয়েকবার মরণ আঘাত চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শুধু তাকে নয় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। এরপর ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন। ডিজিটাল বিপ্লব ঘটানোই এই সরকারের লক্ষ্য ছিল না, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল মূল লক্ষ্য। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের করে। এরপর ১১ জানুয়ারি (নির্বাচন হয় ৭ জানুয়ারি) ২০২৪ শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের (মোট ৫ বার) মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

শেখ হাসিনা যদি না ফিরতেন তাহলে কেমন হতো বাংলাদেশ? বাংলাদেশে কী আজও সেনাশাসন থাকত? গণতন্ত্রের কী মুক্তি মিলত? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কখনো বিচার হতো? জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার হতো? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো? দেশে যে এত উন্নয়ন তা কী হতো? এই যে বাংলাদেশে এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, এই যে ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার রাস্তা, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, ডিজিটাল ও স্মার্ট শব্দ, ২৪ ঘণ্টা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎÑএসব ঘটনা কী ঘটত? তবে একটি জিনিস নিশ্চিতই ঘটত। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা ক্ষমতায় থাকত। ২০০১ সালে জিয়া প্রতিষ্ঠিত দলের মাধ্যমে তাদের গাড়িতে আমরা জাতীয় পতাকা দেখেছি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু থাকত না। সংবিধানের চারটি মূলনীতি থাকত না। অসাম্প্রদায়িক দেশ থাকত না। হয়তো বদলে যেত জাতীয় সঙ্গীত। বদলে যেত মানুষের গায়ের পোশাক। উৎসবের রকম। মোড়ে মোড়ে হয়তো সেনাবহিনী থাকত। বাংলাদেশ এসব দেখার জন্য স্বাধীন হয়নি। আজ (মে ১৭) প্রধানমন্ত্রী-জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। আমরা বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই এ জন্য যে, বাংলাদেশের আজ যা কিছু অর্জন সেই অর্জন তার হাত ধরেই। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)

বিষয়:

মশামাছির মুখপোড়া 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

আবহমান গ্রামবাংলা হাজারো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক হয়ে আজও টিকে আছে স্মৃতি জাগানিয়া হয়ে। নানা ধরনের পূজা, পার্বণ, আচার, পালন করত ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সংস্কার, আচার, লোকাচার যাই বলিনা কেন, তখনকার লোকজন তা মানত। সংস্কৃতি মানেই একটি জাতি বা গোষ্ঠীর যাপিতজীবন চারণ। দুর্গা পুজোতে পাড়ার হিন্দু লোকজন চাঁদা ধরে প্রতিমা গড়তেন। কোনো জাতির আয়না হয়ে সমুজ্জ্বল থাকে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কার্তিকের শেষে ভোলা সংক্রান্তি যা ভোলাভুলি উৎসব বা মশামাছির মুখ পোড়া নামে পূজা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পালন করা হতো। হিন্দু মুসলমান সবাই পালন করত এটা। বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ধরে রাখার বয়স প্রায় দুই হাজার বছরের মূলে প্রোথিত। বঙ্গ বা বাংলা ছিল সম্পদে প্রাচুর্যে ভরপুর এক জনপদ। ফলে বারবার আঘাত এসেছে, যুদ্ধ হয়েছে, শত বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতিকে শুকুনের মতো খামছে ধরেছে ঔপনিবেশিক শাসন। আঘাত করেছে বর্গীরা। বিভিন্ন জাতির বসবাস হয়ে শংকর জাতির বারোয়ারি উপদ্রব সইতে হয়েছে চোখ বুঁজে। বারো মাসে তেরো পার্বণে একটি হলো মশামাছির মুখপোড়া বা ভোলাভুলি পূজা। খড়-বাঁশ দিয়ে তৈরি ভোলার প্রতিকৃতি বানিয়ে তাতে মশামাছি রেখে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কেউ সেটা উঁচু করে ধরে দৌড়ে যেত আর চিৎকার করে বলত,

‘ভালা আইয়ে বুড়া যা, মশা-মাছির মুখ পোড়া যা।’

বাড়িতে ঠাট্টা সম্পর্কীয় ভাবী, বেয়াই, দাদা, দাদি, বেয়াইনরা কলাগাছের ডাগ্গোয়া কেটে পিছন থেকে পিঠে বারি দিয়ে বলত,

‘ভোলা ছাড় ভুলি ছাড়, বার মাইয়া পিছা ছাড়’। কেউ কেউ বাঁশের নতুন কুলা পিঠে পিটাইয়া দৌড়ানো দিত। বলত,

‘মশা মাছি বাইর অ, টাকা-পয়সা ঘর ল, জঞ্জাল সব দূর হ’।

সবাই মিলে কাঁচা তেঁতুল পেড়ে এই আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া হতো। খড়, দড়ি, শোলা, কাপড়, কলাগাছের ডাগ্গোয়া, প্রয়োজন পড়ত এই কাজে। জনমনে ধারণা ছিল, খড়ের আগুনে এবং কলাগাছের ও কুলা দিয়া পিটিয়ে ঘর বা সংসারের যাবতীয় বদ বা খারাপি দূর হয়ে যাবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মাসব্যাপী পূজা করত। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোকজন কার্তিক মাসে প্রতিদিন সকালে স্নান করে দেবতাকে ভোগ দিত। বাড়িতে মাইক বাজিয়ে গান হতো, লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, কাগজ, ত্রিকোণাকৃতি করে কেটে পাটের সুতলীতে আঁটা দিয়ে লাগিয়ে বাড়ি-ঘর সাজাত মানুষ। কার্তিক পূজা করা হতো এ মাসেই। মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। পুজোতে প্রসাদ দেয়, আতপ চাল ভিজিয়ে তাতে কলা মাখিয়ে। সাথে আখ টুকরা করে কেটে দেওয়া হতো। ঢোল, খঞ্জনি, কাঁসা বাজিয়ে কীর্তন গাইত পূজারী ও তার লোকজন। অন্যরা সাথে কোরাস গাইত। মেহমান, মেয়ে নাইওর আসত বাবার বাড়িতে। আজকের প্রজন্ম ইন্টারনেট মোবাইলে বুঁদ হয়ে সামাজিকতা ভুলে গেছে। গুছিয়ে কথাই বলতে জানে না। সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে তাদের জ্ঞান খুব নগণ্য। বিভিন্ন সামাজিক আচার, মশামাছির মুখপোড়া কিংবা ভোলাভুলির পূজা কি তা জানেই না। দল বেঁধে খড়ের মূর্তি বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে হৈ-হুল্লোড় করার মানুষ নেই আর। সেই মন-মানসিকতা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। বাঙালির গ্রামীণ ঐতিহ্যের ইতিহাস হাজার বছরের লালিত স্বপ্নমোড়ানো ইতিহাস। যা যুগ যুগ ধরে, কাল থেকে মহাকাল রচনা করে যাবে নীরবে নিভৃতে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক

বিষয়:

গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। কলেজে পড়ার সময় যা ছিল মুখে মুখে এবং বিশ্বাসে, আজ তা-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের লেখা। আপনি ইচ্ছেমতো লিখবেন, মুছবেন, আঁকবেন, মুছবেন আর সুর করে বলবেন ‘কুমির, তোমার জলে নেমেছি; পারলে আমায় ধরে দেখাও।’ অথবা গম্ভীর গলার হুঙ্কারÑ ‘ক্যাচ মি, ইফ ইউ ক্যান’। এটি আজকের দিনে হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের গল্প। এখন মনে হয় প্রজা যে তন্ত্র নির্মাণ করেছে, সেই তন্ত্রের চালিকাশক্তি কি প্রকৃতই প্রজার হাতে থাকে? নাকি এ তন্ত্রে প্রজার প্রেরিত প্রতিনিধি আর শাসক দল এক দুরূহ অন্তরালে নিজেদের ঢেকে রাখে যাকে সবাই দেখতে পায় না; শুধু কোনো অজ্ঞাত নির্দেশ বা কোনো অলীক সম্মোহনে রথের চাকাগুলো অবিরাম ঘুরতে থাকে, যার সামনে হুজুর মাই-বাপ বলে হাঁটু মুড়ে বসা ছাড়া প্রজার আর কোনো গতি নেই।

ধরুন, আপনার পাড়ায় একজন কুঁড়েঘরে থাকে। হঠাৎ এক দিন দেখলেন, বাড়িটা প্রাসাদ হয়ে গেল। তার আগে থেকেই আপনি দেখছিলেন, লোকটি শাসক দলের সঙ্গে ওঠাবসা করছে, নেতার পিছনে হাত কচলাচ্ছে, তার মোটরবাইক হচ্ছেÑ এক দিন সে জনপ্রশাসক হলো কিংবা জনপ্রতিনিধি হলো। আপনার ফুটপাত বাঁধানো হলো, কলে পানি এল, রাস্তায় বাতি জ্বলল, আর তার বাড়িটা হঠাৎ প্রাসাদ হয়ে গেল। আপনি খোঁজ নিলেন। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের কর্তাব্যক্তিটির বেতন, পরিবারের আয়, খরচ সবকিছু মিলিয়েও আপনি হিসাব মেলাতে পারলেন না; কিন্তু এ অবস্থায় আপনি কী করবেন? আপনার কী মনে হবে মাস্টারমশাই তো বটেই, কারও কিছু করার নেই। আপনি বড়জোর, সবকিছু ম্যাজিক স্লেটে লিখে রাখতে পারেন; কিন্তু ম্যাজিক স্লেটের ওই লেখা দেখে আপনার পোষা বিড়ালটাও কিন্তু ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হেসে উঠবে। বাকি সবাই বলবে, মাস্টার মশাই এবং আপনি দুজনেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন। আপনি বলতে থাকবেন, স্লেটে সব লেখা আছে; কিন্তু সময়মতো দেখলেন, সেই ম্যাজিক স্লেটটিও ফাঁকা। শয়তান বেড়ালটা থাবা দিয়ে ম্যাজিক বাটনটা টিপে দিয়ে স্লেটটি ফাঁকা করে দিয়েছে ততক্ষণে। আপনার রাগ হলে কোনো লাভ নেই; কেননা এমন ঘটনা এখন থেকে আপনার জীবনে ঘটতেই থাকবে, আর ঘটতেই থাকবে। যেমন কিছু লোক জেলে যাবে, কিছু লোক জেলে যাবে না বিদেশে যাবে। যেমন কিছু লোক বিদেশেই থাকবে, জেলে যাবে না। আরও শুনতে চান? ঠিক আছে, না-হয় আরও একটু বলি। আপনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখলেন, একটা লোককে অনেকে মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে। আপনি দৌড়ে গেলেন সেখানে; কিন্তু গায়ের জোরে পারবেন না ওদের সঙ্গে। পরে যখন পুলিশ আপনাকে ডাকবে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে, আপনি চিনতে পারবেন কারা মেরেছিল লোকটিকে; কিন্তু পুলিশসহ কেউ আপনাকে মানবে না। গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটাই যে রাস্তার প্রধান গুণ্ডা ছিল, সে আপনি বললেই হলো? প্রমাণ কোথায়? গোলাপি শার্ট তো কত মানুষই পরে। যতসব ভুল-ভাল কথাবার্তা। আপনি মাথা নিচু করে থানা থেকে বেরিয়ে আসবেন। আপনি ওই মাস্টার মশাইয়ের মতো কিছুই দেখেননি অথবা যা দেখেছেন, তা আপনি আসলে দেখছেন না। অতএব হে পাঠক, হে মহামান্য পাঠকÑআপনারা এতক্ষণ যা পড়লেন, এই এতগুলো শব্দ আসলে আপনারা পড়েননি; একটা সাদা পাতা দেখেছেন শুধু। আর ভেবেছেন, এগুলো আপনি পড়েছেন। পাড়ার লোকটার প্রাসাদোপম বাড়ির জন্য, ওই গোলাপি শার্ট পরা লোকটার বিরুদ্ধে লেখার জন্য যদি কখনো আমার দিকে কেউ আঙুল তোলে, আমি কিন্তু বলব যে লেখে, সে আমি নই। সে ম্যাজিক স্লেটের ম্যাজিক লেখক- অন্য কেউ।

লজ্জার মতো অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের মতো ভয়ও সমাজে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমার যদি মনে হয়, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে অপরাধবোধে ভুগব কিংবা কলঙ্কের ভয়ে সারাক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকব, তাহলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে আমি বহুবার ভাবব। অন্যদিকে, সমাজে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত আমাদের অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয় কমায়। সমাজের অধিকাংশ লোক দুর্নীতিতে যুক্ত না থাকলে দুর্নীতিতে না জড়ানোটাই তখন সমাজের আদর্শ হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে কেউ সামান্য দুর্নীতিতে যুক্ত হলেই সে অপরাধবোধে ভোগে, কলঙ্কের ভয়ে থাকে। কিন্তু সমাজে যদি সবাই দুর্নীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে দুর্নীতিটাই ‘আদর্শ আচরণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে যায়। সেই দুর্নীতিতে আর অপরাধবোধ থাকে না, কলঙ্কের ভয় থাকে না। তখন দুর্নীতিতে এমনিতেই জড়িয়ে পড়ার মানসিক জরিমানার অঙ্কটা কমতে থাকে। এক সময় দুর্নীতি হয়ে পড়ে ‘স্বাভাবিক’। এমন সমাজব্যবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াটাই মানুষের পক্ষে হয়ে ওঠে যুক্তিযুক্ত। অন্তত এমন যুক্তিই দাঁড় করিয়ে ফেলে দুর্নীতিগ্রস্তরা। খুব প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন হলো- এমন সমাজ হয়ে গেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উত্তরটা কারও জানা থাকে না সেই বাস্তবতায়। তবে এর মাঝখানে যেটা সবার জানা আছে তা হলো, সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্দরে যে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে সেটা ক্রমাগত অস্বীকার করলে কিংবা সমাজের স্বাভাবিক আচরণ বলে মেনে নিলে সেই দুর্নীতি থেকে বেরোনো যাবে না কোনোদিনই।

মাস্টার মশাই, এত কথাই বা কেন বলতে যাবেন? আমাকেও তেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কী দায় এত আমার কিংবা মাস্টার মশাইয়ের? যখন অন্যরা চোখ বুঁজে আছে, তখন বাপু তোমার এত বাড়বাড়ন্ত কেন? তুমি কী দেখছ না- চারদিকে কী ঘটছে? পাঁচ বছর পর পর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে সরকারের সরে আসার উদ্যোগ ইতোমধ্যেই গোচরীভূত হয়েছে। নতুন আইন হয়ে যাওয়ার পথে সরকার হাঁটছে, যেখানে পাঁচ বছর পর

পর আর ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে না। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জবাবদিহি থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার রাস্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে। দুর্নীতিকে সুরক্ষিত ও উৎসাহিত করার এর চেয়ে ভালো পন্থা আর কি-বা হতে পারে। আপনি যা-ই ভাবেন, যেভাবেই ভাবেন ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পর পর সম্পত্তি বিবরণের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে সংশোধন সংসদে আসছে শিগগিরই। সংশোধনী আনার পক্ষের যুক্তি তো অকাট্য। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়া যাবে। সরাসরি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কেন এ বিপদের মধ্যে ফেলা! আপনি যতই বলবেন, এ সংশোধনী আনা হলে এতে অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসাহিত হবে দুর্নীতি করতে। যারা এখনো সাধু হওয়ার স্বপ্নে আছে, তারাও অচিরেই ভুল পাল্টে অধিক সংখ্যার মানুষের কাতারে যোগ দেবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান নেই। বাঃ! দারুণ ব্যাপার। নির্ভয়ে দুর্নীতি করুন, নির্ভয়ে অবৈধ সম্পদ বাড়িয়ে চলুন- ভয়ের চিহ্ন নেই, কেউ আর পিছুটানে আটকে যাবেন না। স্বদম্ভে এগিয়ে যাও তুমি দুর্নীতি। ম্যাজিক স্লেটে যা লেখা হচ্ছে, মুছে দিয়ে এগিয়ে যাও স্বদর্পে। গোলাপি শার্ট পরে ধুলো দেওয়া মানুষটির মতো এগিয়ে চলো হে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেউ দেখছে না তোমাদের। দেখলেও ওদের দেখায় বিশ্বাস করে কে? বিবরণী দিয়ে আটকে যেও না। সংশোধনী পাস করিয়ে নাও জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে। তারপর মাণিকজোড় হয়ে চলো একসঙ্গে, একপথে।

লেখক: কলামিস্ট


সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের জন্য তরুণদের দক্ষ করে তোলা জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন থেকে তরুণ যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তরুণদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার কারণে এ বিষয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই তরুণদের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে নিজেকে প্রস্তুত করতে আহ্বান জানান। কোনোমতে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পড়াশোনা না করে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার আহ্বানও প্রধানমন্ত্রী অসংখ্যবার জানিয়েছেন; কিন্তু আমাদের দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী সেদিকে মোটেও মনোযোগ দিচ্ছে না। এমনকি অসংখ্য তরুণ যারা পড়াশোনা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে হতাশ এবং উদাসীন রয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২৩ জরিপে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই আছেন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে নেই। বাংলাদেশের ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার তিনগুণেরও বেশি মেয়েদের ক্ষেত্রে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার শতকার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিপরীতে ছেলেদের এই হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছেলে। মেয়েদের বাল্যবিয়ে, দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা কিংবা মূল্যস্ফীতির কারণেই তরুণদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ পাওয়া যায়।

গত ১১ মে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নাটোরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো তরুণ-তরুণী আর কর্মহীন ও বেকার থাকবে না। যদি আমরা তাদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।’ যৌক্তিকভাবেই এখন যোগ্যতা এবং দক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তরুণদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দেশ একধাপ এগিয়ে যাবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নানাভাবে দক্ষ করে তুলতে উদ্যোগ এবং উৎসাহ থাকলেও তারা নিজেদের দক্ষ করে তুলতে একধাপ পিছিয়ে রয়েছে। তারা শুধুই চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমেছে; কিন্তু নিজেদের কীভাবে দক্ষ করে দেশের উন্নয়নের ধারক হওয়া যায়- সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করে না বললেই চলে।

গত ১৪ মে গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের অর্থায়নে বাংলাদেশসহ চার দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রতি বছর প্রো-ফেলোস কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ চলছে। ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সি ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবসার উদ্যোক্তা, স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তারা এ ফেলোশিপের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ধরনের ফেলোশিপের মাধ্যমে বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে বসে যারা কাজ করছেন, তাদের অনেক সম্ভাবনা আছে। যারা বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন, তাদের জন্য এই ফেলোশিপ ভীষণ কার্যকর হতে পারে; কিন্তু এর জন্য নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হবে।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। আমরা জানি, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। দেশের অভ্যন্তরেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তির বৃদ্ধির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করার বিষয়ে সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপের বিষয়টিও ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ কর্মরত রয়েছেন। যাদের ৮৮ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্থাৎ প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীর কাজের প্রশিক্ষণ নেই। আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, ফিজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স, কনটেস্ট ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো মাথায় প্রবেশ করাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশে অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু করা, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প। বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন ও মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।

তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কী করণীয়, সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকলেও ফলপ্রসূভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা এবং উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা সম্ভব না হলে দেশের জন্য আশানুরূপ উন্নয়ন সফলতা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ যুবগোষ্ঠী। বাংলাদেশে তরুণরা সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যুবশক্তিকে যথাযথভাবে জনশক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়নি। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত যুবক প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া।

আমরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি; কিন্তু কীভাবে সেই উন্নয়ন হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। দেশের তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে, দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ এই তরুণগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুততর এবং টেকসই করা সম্ভব। আর এ জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের কার্যকর অনুকূল পরিবেশ নেই। অন্যদিকে সরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, এটি ঠিক; কিন্তু সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে দুর্নীতির হার বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যদি আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে অবশ্যই যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আন্তরিক দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


ক্রলিং পেগ মুদ্রাস্ফীতি রোধ, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের জন্যও ইতিবাচক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কী? যার মাধ্যমে বাড়ল ডলারের দাম। একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ডলারের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন ১১০ টাকায় থাকা ডলারের অফিসিয়াল দাম একদিনে ১১৭ টাকায় উন্নীত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি একটি সার্কুলার জা‌রি করে এ দাম ঘোষণা করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ক্রলিং পেগ হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভোজ্য তেল, মসুর ডাল ও চিনি-পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্য আমদানি করতে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। সাধারণত ডলারের দাম যখন বেড়ে যায়, দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। আবার ডলারের দাম কমে গেলে সে অনুযায়ী পণ্যের দাম কমে যায়। গত দুই বছরে বাজারে ডলারের প্রকৃত যে রেট ছিল, সেই তুলনায় অফিসিয়াল রেট ছিল ভিন্ন। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর আগেও রেমিট্যান্স ও আমদানি বাবদ ডলারমূল্য নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকায়। অথচ অধিকাংশ ব্যাংককে রেমিট্যান্স কিনতে হয়েছে ১১৫-১১৬ টাকার বেশি দামে। ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে লোকসানে ডলার বিক্রি করেনি। তারা এরচেয়ে ১-২ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমদানি এলসি নিষ্পত্তিতে ১২০ টাকা বেশি ডলারের দর নিয়েছে। বিনিময় হার অস্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে থাকলে কোনো দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ এখন এই পরিস্থিতির মধ্যেই আছে।

নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করছে, এটাই প্রকৃত মার্কেট রেট। তবে নতুন করে এই রেট বাড়ানো হলে তখন পণ্যমূল্য বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা হয়েছে। আমদানিকারকরা এখন যেকোনো ব্যাংক থেকে নির্ধারিত দামে ডলার পেতে পারবেন। নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম বাড়েনি। উল্টো গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় দাম কম রয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে অবস্থায় আছে, তা যে কোনো সময় বিপদের কারণ না হতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকদিন ধরেই কৃত্রিমভাবে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বাজারের ওপর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। শুধু অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই সরকার বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার পরোক্ষভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল।

ক্রলিং পেগ পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি হচ্ছে এ রকম এ ব্যবস্থায় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি করিডর সৃষ্টি করা হবে। সেই করিডরের ভেতওে থেকে ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক শিডিউল ব্যাংকের জন্য ডলারের বিনিময় হার

বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ মুহূর্তে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে, তাহলে ডলারের বিপরীতে টাকা যে অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে তা কমে আসবে। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেও আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে-এ ধারণা সত্য নয়। কারণ, বর্তমানে আমদানিকারকদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদামতো ডলার কিনতে না পেরে কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে ডলার সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা পূরণ করছেন।

কাজেই ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেই যে বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে, তা নয়। যদি ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণেই স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কেন বাড়ছে? স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ নয়। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি দায়ী।

বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর যে পরিমাণ পণ্য ভোগ করে, এর মাত্র ২৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং বাজারজাত করা হয়। তাহলে এসব পণ্যের মূল্য যখন তখন বাড়ে কেন? দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একক বৃহত্তম খাত হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবার ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছে এ খাত থেকে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকসামগ্রী রপ্তানি করে অর্জিত হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলারের মতো।

এ খাতটি আমদানিনির্ভর বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। এ খাত থেকে যে অর্থ আয় হয়, তার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ কাজ করেন।

বাংলাদেশের প্রকৌশলী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ কর্মীরা বিদেশে গিয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে দক্ষ লোকবল তৈরির চেয়ে দক্ষ জনশক্তি আমদানির প্রতি বেশি ঝোঁক লক্ষ করা যায়। দীর্ঘ মেয়াদে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যেহেতু বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসজাত ১২২টি পণ্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করে এসব পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে। এর উদ্দেশ্য ছিল লেনদেনের ভারসাম্যকে অনুকূল অবস্থায় নিয়ে আসা। দেখা গেল, আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে।

আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকে পরিকল্পিতভাবে ঢেলে সাজানো দরকার। যাতে এ খাতের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। এ খাতে যে অর্থ আয় হয় তার প্রায় শতভাগই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। এছাড়া প্রায় দেড় কোটি মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এ খাত। কিন্তু এ খাতটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। গত বছর ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গিয়েছে কর্মসংস্থানের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি খাতে আয় করেছে ২৩ বিলিয়ন ডলার।

তাহলে বাংলাদেশিরা কি পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ দেশে প্রেরণ করেনি? তারা অবশ্যই দেশে অর্থ পাঠিয়েছে। কিন্তু তা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে প্রেরণ করা হলে প্রতি ডলারে গড়ে ১২ থেকে ১৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। এজন্য ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রবাসী আয়ের ওপর দেওয়া নগদ আর্থিক প্রণোদনা বহাল রাখা যেতে পারে। তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে অর্থ দেশে প্রেরণে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার আগে এই পদ্ধতি চালুকে কার্যকরী একটি পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন বেসরকারি ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট। ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ টাকার নিচে বা ওপরে ডলারের কেনাবেচা করতে পারছে। তবে এই দরের চেয়ে খুব বেশি কম বা বেশি দামে ডলারের লেনদেন করা যাবে না। প্রতিদিন কত দামে ডলার কেনাবেচা করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটা জানিয়ে দিতে হবে। এছাড়া ক্রলিং পদ্ধতি চালুর ফলে চলমান ডলার-সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করেন এই ব্যাংকার।

এদিকে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতদিন ডলার পাওয়া নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছিল এবং দাম তুলনামূলক কম ছিল। এখন ডলারের দাম একবারে ৭ টাকা বাড়ানোর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, বাড়বে পণ্যের দাম। একই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। ফলে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলার কেনাবেচা হবে। এ পদ্ধতিতে সম্প্রতি ডলারের রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। মুদ্রানীতিতে একই সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। ক্রলিং পেগ হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা, যা জাতীয় মুদ্রা বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে (ব্যান্ড) ওঠানামা করতে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যান্ডের বাইরে চলে যাওয়া থেকে বিনিময় হার রাখতে চেষ্টা করে।

চীন, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া এবং বতসোয়ানা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন কয়েকটি দেশ। পেমেন্টের ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা প্রচারের জন্য তারা এই সিস্টেমটি বেছে নেয়। এবং কখনও কখনও তারা রপ্তানি বাজারে দেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বাড়াতে পর্যায়ক্রমে বিনিময় হার সামঞ্জস্য করে। মূল্যস্ফীতি হলো স্বতন্ত্র পণ্য ও পরিষেবার দাম বৃদ্ধি। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। যেমন ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচ, বর্ধিত চাহিদা বা সরকারিনীতি। বাজারে যদি কোনো পণ্য ও সেবার চাহিদা বেড়ে যায় এবং সে অনুযায়ী সরবরাহ না থাকে, তখন দাম বেড়ে যায়। আবার কোনো জিনিস তৈরি করতে যে সামগ্রী প্রয়োজন তার দাম বাড়লেও মূল পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে একটি দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে পণ্য ও সেবা সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকলেও দামে এর প্রভাব পড়ে।

মুদ্রানীতিতে ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ ও সরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ। বেসরকারি উৎপাদনশীল খাতে ঋণ কমে গেলে উৎপাদন কার্য কমে যাবে; ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারি খাতে তো ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, 'ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম বাড়লেও এর জেরে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রকৃত বিনিময় হার বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। তাদের মতে, ডলারের অফিসিয়াল দাম ১১০ টাকা হলেও খোলাখুলিভাবে ১১৮-১২০ টাকা বা তারও বেশি দামে বেচাকেনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবধান কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে ডলারের গড় দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এরচেয়ে ১ টাকা কম বা বেশি রাখা যাবে ডলারের দাম।

ক্রলিং পেগ চালুর ফলে আমদানি ব্যয় খুব বেশি বা বাড়বে না। বরং ডলারের দামের এই সমন্বয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেটকে ঘিরে অনিশ্চয়তায় থাকা আমদানিকারকরা এই অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় স্বস্তি পাবেন। এছাড়াও আমদানিকৃত পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা সহজ হবে। উল্টো ডলারের ভালো দাম পাওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক


উন্নয়নশীল দেশের বাজেট প্রণয়ন সব সময় চ্যালেঞ্জিং

আপডেটেড ১৫ মে, ২০২৪ ১১:১২
ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ

জাতীয় বাজেট আসছে। আগামী জুনের শুরুর দিকে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হবে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাজেট প্রণয়ন সব সময়ই বেশ চ্যালেঞ্জিং। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে তো বার্ষিক বাজেট তৈরি করতেই হয়। আমরা জানি ব্যক্তিপর্যায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিকপর্যায়ে বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে। বাজেট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বছরের সম্ভাব্য আয়- ব্যয়ের খতিয়ান। তবে জাতীয় বাজেট এবং ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের ক্ষেত্রে আয় বুঝে খাতওয়ারি ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে চাইলেই আয় বাড়ানো যায় না। আর জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নির্ধারণ করে আয়ের পরিমাণ এবং খাত নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। তবে সরকারের আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকলেও সব সময় তা যৌক্তিকভাবে বাড়ানো সম্ভব হয় না। জনগণের ওপর বর্ধিতহারে করারোপ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। অনেক সময় যাদের কর দেওয়ার তারা নানা ছুতোয় কর দেন না এবং আদায় করও যায় না। বর্তমান সরকার গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।

আগামী অর্থ বছরের জন্য প্রণীত বাজেটে অতীতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরের (২০০২৩-২০২৪) জন্য বাস্তবায়নাধীন জাতীয় বাজেটে যেসব অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলা হয়েছিল নানা কারণেই তা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব হবে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি। চলতি অর্থ বছরের জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, তা হবে সাড়ে পাঁচ বা ছয় শতাংশ। কেন এমন হচ্ছে? অর্থনীতিতে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতের কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার কার্যকর পদক্ষেপ বাজেট থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি। মূল্যস্ফীতি একটি জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সমস্যা, যা নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। আর ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।

আগামী অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের হার খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ (২০২২-২৩)। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলোতেই কর-জিডিপির অনুপাত অনেক বেশি। যেমন- নেপালে তা ১৮/১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ (২০২২-২৩)। পৃথিবীতে যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। চেয়ে খারাপ হলেও কর-জিডিপির অনুপাত সেই দেশে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ (২০২১)। অন্যদিকে বাংলাদেশে ধনী হওয়ার হার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কিন্তু সঠিক মাত্রায় কর প্রদান না করা। নানাভাবে তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ রকমটি চলতে থাকলে সরকারকে বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হবে।

অতি মাত্রায় ঋণ নির্ভর হয়ে পড়া একটি দেশের জন্য কোনোক্রমেই লাভজনক নয়। এখনো আমরা ঋণের ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছি, কিন্তু এটা কত দিন থাকবে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে মোট জিডিপির ২১ শতাংশের মতো। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের হার প্রায় সমপরিমাণ। অর্থাৎ বিদেশি এবং অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট ঋণের হার হচ্ছে জিডিপির ৪২ শতাংশের মতো। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী জিডিপির ১২৯ শতাংশ (২০২২)। আর জাপানের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ২৬৩ শতাংশ (২০২৩) এবং ভারতে ৮৬ শতাংশ (২০২২-২৩)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে ঋণ না। সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে আসে। সেই ঋণের অর্থ ব্যবহারের দায়িত্ব যাদের হাতে থাকে তারা অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তা ব্যবহার করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধান্ধাবাজির মাধ্যমে। আমাদের সমস্যা জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাতে নয়। সমস্যা হচ্ছে গৃহীত ঋণের সব অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পের সুফল যতটা পাওয়ার কথা ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। বাজেটে বিভিন্ন খাতে ও প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে যথাসময়ে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাত হিসেবে বাজেট বরাদ্দ ধীরে ধীরে কমছে। চলতি বছরে তা ২ শতাংশের কম। শিক্ষা অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজের জন্য ব্যয়িত হচ্ছে। ফলে খুবই কম। বলা হয়, যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে থাতে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে তাঁর বেশির ভাগই শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণার কাজে অর্থ বরাদ্দ থাকছে খুবই কম। বলা হয় যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই অনুপাত কম হলেও টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষা খাত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে শুধু ব্যজের অঙ্ক কিছু বাড়লেই চলবে না, জিডিপির অনুপাতও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন; কিন্তু অনেক সময় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না, শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর এবং পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বরাদ্দ ও সঠিক ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন।

আগামী জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থানের ওপর ব্যাপক মাত্রায় জোর দিতে হবে। করোনাকালিন অবস্থায় অনেকেই তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এ ছাড়া শ্রম বাজারে নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার অতীতের মতো আগামী বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দ দেবে বলে আশা করা যায়। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অংশ হিসেবেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।

বর্তমান সময়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার এখন জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ ব্যয় করছে। সরকার পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখছি। জটিলতা সৃষ্টি করবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের আরও ব্যয় বাড়াতে হবে, যা অগ্রাধিকার নির্ধারণ এই খাতে ব্যয় ও কার্যক্রম বাড়ানো না হলে আগামীতে আগামী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও করে প্রকল্প গ্রহণ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।

আগামী অর্থ বছবের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টার পাশাপাশি বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি যদি কমিয়ে এনে সহনীয় পর্যায়ে নামানো না যায় তাহলে জনগণের মনে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এখানে বড় চ্যালেঞ্জ দুষ্টচক্র (সিন্ডিকেট)। অনেক সময় দেখা যায় সরকারের ভালো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ মাঠপর্যায়ে গিয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহল বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। উচ্চমূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি ব্রেট বাড়ানো হয়েছে এবং ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েছে; কিন্তু দেশে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ রকম পদক্ষেপ কাজ করেছে; কিন্তু বাংলাদেশে এই উদ্যোগ সঠিকভাবে কাজ করছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এমন উদ্যোগ কাজ করেছে এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত শ্রীলঙ্কায় এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে উচ্চমূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই উদ্যোগ কাজ করেনি। কেন কাজ করল না তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান দুষ্টচক্র এসব উদ্যোগকে কাজ করতে দিচ্ছে না বলে আমি মনে করি। এই দুষ্টচক্রগুলোর হোতাদের অনেকেই পরিচিত। কিন্তু তাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা সব সময় তৎপর থাকছে, জবাবদিহি মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।

মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া উচিত কি না তা নিয়ে অনেকেই। প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। এটি একটি জটিল প্রশ্ন বটে। আমি মনে করি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এখনই বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই বলছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারিত করে রাখার কারণে রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। যদি বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হতো তাহলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বেশি আসত। আমি এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নই রেমিট্যান্স তো প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো- যে সংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশে যাচ্ছে কর্মসংস্থান উপলক্ষে রেমিট্যান্স সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ থেকে উপার্জন করার জন্য বিদেশে যাচ্ছে কারা? গ্রামীণ দরিদ্র এবং অদক্ষ ব্যক্তিরাই মূলত 'বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাচ্ছেন। তারা বিদেশে গিয়ে ভালো কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ বেকার থাকছেন। ফলে যে সংখ্যক মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে কম। হয়তো হুন্ডি যারা করে তাদের মধ্যে থেকে কিছু মানুষ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হতে পারে, কিন্তু কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গেলে সেই প্রবণতা বাস্তবে রূপ লাভ নাও করতে পারে।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে মূল্যস্ফীতি অনেক বৃদ্ধি পাবে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। কিছু দিন আগেও বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক বিনিময় হার চালু ছিল। এখন তা সঠিকভাবেই একক বিনিময় হারে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। এটা বন্ধ করতে হবে। গৃহীত প্রকল্প যাতে নির্ধারিত সময়ে এবং ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এর বাতায় ঘটলে যারা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস

বিষয়:

পরীক্ষার ফল, মিষ্টি ও মৃত্যুর অনুক্রম

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১৬:৫৬
সজীব সরকার

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত রোববার। মুদ্রিত, সম্প্রচার ও অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বরাবরের মতোই এবারও প্রাধান্য পেয়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের খবর। এর পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে সর্বোচ্চ পাস, সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ এবং সবচেয়ে বেশি ফেল করা বা খারাপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর খবর।

এসব খবরের, মোটা দাগে, দুটি দিক থাকে:

এক. জিপিএ-৫ পেয়ে উল্লসিত কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আনন্দের খবর; দুই. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে অর্থাৎ ফেল করে কিছু শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর।

এবারও, একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের উল্লাসের খবর দেখা গেছে, তেমনি জানা গেছে পরীক্ষায় ফেল করে বা জিপিএ-৫ না পেয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর। সামনের দিনগুলোতে এমন খবর আরও পাওয়া যাবে হয়তো।

জিপিএ-৫ পাওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের ব্যাপার; তবে, এ নিয়ে প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে, তা কখনোই কাম্য নয়। গণমাধ্যমগুলোও যেভাবে এসব পাবলিক পরীক্ষার ফল সম্পর্কিত খবর প্রচার করে, তাতে এ প্রতিযোগিতা আরও গতি পায়। এমন সাংবাদিকতা মোটেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না।

জিপিএ-এর স্কোর তথা ‘ভালো রেজাল্ট’ সবসময় শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনের নিশ্চয়তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগবঞ্চিত কিন্তু স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই, জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন’। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক - সবার মধ্যেই এ বোধোদয় ঘটা দরকার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনটি ভালো বা মন্দ- তা নির্ণয় করা হয় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার হার কতো - এ বিচারে। স্কুল-কলেজগুলোর বিজ্ঞাপনেও এসব তথ্যই গুরুত্ব পায়। কোচিং সেন্টারগুলোও জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দেয়; অনেকের বিজ্ঞাপনে থাকে বিষয়ভিত্তিক ‘এ প্লাস’ বা জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার ‘লিখিত গ্যারান্টি’ বা ‘বিফলে মূল্য ফেরত’-এর শর্ত। কিন্তু, পড়াশোনার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে বিদ্যা অর্জন, জ্ঞান অর্জন- সে গ্যারান্টি কোথায়? বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে কুসংস্কারমুক্ত উদার মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা, সে নিশ্চয়তা কোথায়?

পরীক্ষার ফল ভালো হওয়া তথা জিপিএ-এর স্কোর বেশি থাকা মানেই ওই শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞানার্জন হয়েছে- এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তেমনি, পরীক্ষার ফল খারাপ হলেই যে ওই শিক্ষার্থী নিরেট মূর্খ- সে কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা আরজ আলী মাতুব্বর কতো ক্লাস পড়েছেন আর তাদের পরীক্ষার ফল কেমন ছিলো - এমন প্রশ্ন অবান্তর নয় কি? বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে কার বা কতোজনের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল ঘেঁটে তাদের মূল্যায়ন করা হয়?

তাহলে, এভাবে কেবল পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলনির্ভর মূল্যায়ন একটি একমুখী, অবৈজ্ঞানিক, অপর্যাপ্ত ও অসার পদ্ধতি। বরং, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যদি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানার্জনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সার্বিকভাবে যদি শিক্ষার্থীবান্ধব একটি কাঠামো গড়ে তোলা যায়, তাহলে পরীক্ষার তথাকথিত ‘ফল’ বা জিপিএ-এর স্কোর অনিবার্যভাবে ‘ভালো’ই হওয়ার কথা।

চাকরিদাতাদের একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, দেশের নামকরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে পাস করে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইন্টারভিউ বোর্ডে অত্যন্ত হতাশাজনক পারফর্ম করছে। তাহলে, মোটা স্কোর-অলা এসব সার্টিফিকেটের মূল্য কী? গণমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন সময় প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ‘নামকরা’ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, বিজয় দিবস, জাতীয় দিবস বা শহীদ দিবস - এমন ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচিত নয়; এসব বিষয়ে তারা তেমন কিছুই জানে না বা বলতে পারে না। তাহলে, প্রতিবছর গণমাধ্যমগুলোই বা কেন জিপিএ-নির্ভর এমন ফল বিশ্লেষণে গা ভাসাচ্ছে?

আমাদের মধ্যে অনেকেরই বিবেচনায় এটি নেই যে বুদ্ধিমত্তা, মেধা বা জ্ঞানের ধরন আলাদা। গান গাইতে না পারায় আইনস্টাইনকে যেমন 'মূর্খ' বলা অবিচার, তেমনি পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক না হওয়ার দায়ে লতা মঙ্গেশকরকে 'অপদার্থ' বলাও অযৌক্তিক। আইনস্টাইন, বিটোফেন, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, মাইকেল ফেলপস, শচীন টেন্ডুলকার, সাকিব আল হাসান, রোনালদো বা লিওনেল মেসি - কে জ্ঞানী, আর কে মূর্খ? পরীক্ষার ফল দিয়ে তাদের বিচার করা সম্ভব কি?

জ্ঞান, মেধা বা যোগ্যতার অনেকগুলো দিক রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তির শারীরিক-মানসিক দক্ষতা ভিন্ন। আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কার কোনদিকে সুপ্ত বা স্পষ্ট আগ্রহ ও যোগ্যতা বা দক্ষতা রয়েছে, তা বুঝে সে অনুযায়ীই শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা। নির্বিচারে সবাইকে জিপিএ-৫ পাওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক চাপে ফেললে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় বৈ কিছু নয়। পৃথিবীর সবাইকে বিজ্ঞানী বানানো যেমন অসম্ভব ও অযৌক্তিক, তেমনি সবাইকে এসএম সুলতান বা লতা মঙ্গেশকর বানাতে চাওয়াটাও ভুল। কার মধ্যে কী ধরনের মেধা রয়েছে, তা নির্ণয় করে তার মধ্যে ওই বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা তৈরি করে দেওয়াই হতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাহলেই শিক্ষার্থীরা একসময় নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হবে। সফলতাকে কেবল 'পরীক্ষায় ভালো ফলের' সীমায় সীমিত করে রাখলে তা ভুল হবে।

এবার ফল প্রকাশের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন; তিনি বলেছেন, যারা পরীক্ষায় খারাপ করেছে, তাদের মন এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, তাই তাদের যেন বকা-ঝকা করা না হয়। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এ নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সবার একমুখী অতি-প্রত্যাশার চাপ সামলাতে না পেরে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করলে এ দায় আসলে কার? নিজের সন্তান ভালো ফল করলে খুশি হতেও বাধা নেই, মিষ্টি বিতরণেও দোষ নেই; কিন্তু, যারা কোনো কারণে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি, তাদের এমন মানসিক চাপে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা ঠিক নয় যে তারা আত্মহত্যার মাধ্যমে ওই চাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বাধ্য হয়। তাদের তিরস্কার না করে বরং পাশে দাড়ানো উচিত যেন মনোবল না হারিয়ে বরং তারা নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার মতো ভরসা পায়। শিক্ষক ও অভিভাবকসহ গণমাধ্যমগুলোরও এ ব্যাপারে সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার।

অবৈজ্ঞানিক প্রতিযোগিতার এমন পরিবেশে শিশুদের শৈশব আমরা কেড়ে নিয়েছি; সেই সাত-সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাত অবধি কেবল ক্লাস-কোচিং-টিউটর। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ‘ভালো রেজাল্ট’ করানোর জন্য অন্যদের চেয়ে বেশিসংখ্যক টিউটর বা কোচিং ক্লাসের চাপে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন পিষ্ট হতে হচ্ছে। এমন প্রতিযোগিতা শুরু হয় একেবারে প্রাথমিক স্তরেই। তাদের খেলাধুলা, শরীরচর্চা বা বিনোদন কোথায়? ধরে-বেঁধে সবাইকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে? শিক্ষার্থীরা তো গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি নয় যে এক খোঁয়াড়ের সবগুলো একই চেহারার এবং একই বৈশিষ্ট্যের হতে হবে! এরা মানবসন্তান এবং প্রতিটি শিশু আলাদা; তাদেরকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়াটাই বরং যৌক্তিক নয় কি?

শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক সংস্কার দরকার, গতি দরকার- যেখানে চাকরির বাজারে যোগান দেওয়ার জন্য কেবল চাকুরে তৈরির দিকে মনোযোগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও সুপ্ত মেধা অন্বেষণে মনোযোগ থাকবে। এমন একটি ব্যবস্থা চাই, যেখানে পরীক্ষার ফলের ওপর অতিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত বিদ্যার্জনকে উৎসাহিত করা হবে। এতে সব ক্ষেত্রের জন্য দক্ষ কর্মী যেমন অনিবার্যভাবেই তৈরি হবে, তেমনি তাদের মধ্যেই পাওয়া যাবে সত্যিকার সুনাগরিক ও নৈতিক মানুষ; প্রকৃত-পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

লেখক: সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।

বিষয়:

বজ্রপাতে প্রাণহানি ও তালগাছ রোপণ

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১০:৫৬
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

এখন প্রায়শই শোনা যায় সারা দেশের কোনো না কোনো স্থানে আকস্মিক বজ্রপাতে লোকজন মারা যাচ্ছে। এগুলো এখন আর কোনো মৌসুম কিংবা ফর্মুলা কিংবা নিয়মনীতি মানছে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো আর কিছুই না, তা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগে দেখা যেত বছরে বজ্রপাত হতে দু-চারজনের মৃত্যুর খবর কালেভদ্রে পাওয়া গেলেও এখন ফি-বছর বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব রেকর্ড করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে দুর্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আমার এ অর্ধশতাধিক বয়সের অভিজ্ঞতায় এর আগে কখনো বজ্রপাতে এত মানুষের মৃত্যু হতে দেখিনি। বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে উষ্ণতা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, গাছ কাটা, নতুন নতুন গাছ রোপণ না করা, জলাশয় ভরাট, দ্রুত নগরায়ণ- ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জলবায়ু বায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ করছে। আর সে জন্যই বজ্রপাতসহ প্রকৃতিতে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই চলেছে। সেগুলোর একটিই হলো বজ্রপাতে মৃত্যু। সময়ের ব্যবধানে আজ তা মহামারি আকারে দেখা যাচ্ছে। বর্ষাকাল শুরু হলেই জনমনে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়।

তারপর আসছে কীভাবে এসব আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো- খালি মাঠে কিংবা রাস্তার পাশে এমনকি বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, পাহাড়-বন, খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর তীর প্রভৃতির পাড়ে কিংবা চারপাশে উন্মুক্ত স্থানে বেষ্টনী তৈরি করে উঁচু উঁচু গাছ লাগাতে হবে। সেসব গাছই থান্ডার অ্যারেস্টার (বজ্রপাত শোষক) হিসেবে কাজ করবে। তাতে গ্রামান্তরে বজ্রপাতের দরুন কৃষক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ মারা যাওয়া থেকে রেহাই পাবেন।

এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের দেশের পরিবেশবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি তার একটি বক্তৃতায় বলেছেন, সারা দেশে প্রতি বছর কমপক্ষে তিন কোটি তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি উঁচু গাছ রোপণ করতে হবে যাতে আমাদের দেশের কৃষক মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুবরণ না করেন। কারণ এ দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত উন্মুক্ত স্থানেই বেশি ঘটতে দেখা যায়। তাছাড়া শহরের সচেতন মানুষ তারা তাদের বাড়ি-ঘর বানানোর সময় আগেই পরিকল্পিতভাবে থান্ডার অ্যারেস্টার লাগিয়ে কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা শোনার পর দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, সংস্থা তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি গাছ লাগানো শুরু করে দিয়েছেন। এতে সম্পৃক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। তবে সবচেয়ে অগ্রগামী হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের সহযোগিতা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মাঠকর্মীসহ প্রশাসন ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা। আমি এমন একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব এখানে। ছড়া কবিতার কথায় আছে, ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। অর্থাৎ তালগাছ এক সময় সবগাছ থেকে উঁচুতে উঠে যায়।

তালগাছ সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। সেটি হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি তালগাছ রোপণ করে, সে ব্যক্তি সেই গাছের তাল খেয়ে মরতে পারে না’। তার মানে হলো তালগাছের বাড়-বাড়তি খুবই ধীরগতিতে ঘটে; কিন্তু কথাটি আসলে মোটেও ঠিক নয়। কারণ আমি নিজে আমার বাড়িতে ১৫ বছর বয়সে যে তালগাছ নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম এখন আমার ৫৩ বছর বয়সে এসে আরও ১০ বছর আগে থেকেই সেই গাছের তাল খেয়ে চলেছি। তার থেকে বড় বাস্তব উদাহরণ আর কি হতে পারে! অর্থাৎ তালগাছ লাগানোর ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই সেটা থেকে ফল খাওয়া যেতে পারে।

তালগাছ এখন আমরা যে শুধু বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্য লাগাব তাই নয়- এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার ও উচ্চ খাদ্যমান। যেমন তালের পাতা দিয়ে ঘরের মাদুর তৈরি করা হয়, তালের পিঠা, তালের রস থেকে নানারকম পিঠা, পায়েস তৈরি করা হয় যা আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। হিন্দু শাস্ত্রের কৃষ্টিতে আছে তাল নবমী, তালের রস ক্যানসার প্রতিরোধী, তালগাছ দিয়ে তৈরি হয় তালের নৌকা। তালপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, বিভিন্ন কুটির শিল্প, কাণ্ড দিয়ে বাড়িঘরের প্রয়োজনীয় কাঠ ও নৌকা তৈরি করা হয়। তালের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি এবং একপ্রকার চোলাই মদ তৈরি করা হয় যাকে সবাই ‘তাড়ি’ বলে চেনেন।

তা ছাড়া তাল অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তালের রসে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। তাল ভিটামিন-বি এবং ভিটামিন-এ এর আধার। তালে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে যা হাড় ও দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগ ভালো রাখতেও তালের জুড়ি নেই। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম তালে ৮৭ কিলোক্যালোরি খাদ্যশক্তি বিদ্যমান। এতে আরও রয়েছে, জলীয় অংশ- ৭৭.৫০ গ্রাম, আমিষ-০.৮ গ্রাম, চর্বি-০.১ গ্রাম, শর্করা ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ- ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম-২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস-৩০ মিলিগ্রিাম, আয়রন-১ মিলিগ্রাম, থায়ামিন-০.০৪ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাবিন-০.০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন-০.৩ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন নি-৫ মিলিগ্রাম ইত্যাদি।

বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে তালের আঁটি রোপণ। এমনি একটি মহতি উদ্যোগের সঙ্গে বিগত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত তালগাছ রোপণ কার্যক্রমে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সেদিন তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দীপক কুমার পালের নেতৃত্বে উপজেলার সবপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এ তালের আঁটি রোপণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। আমি এ কার্যক্রমে একটু বেশি আগ্রহ বোধ করেছি, কারণ একে তো আমি নিজেও একজন কৃষিবিদ আর সেই তালের আঁটিগুলো লাগানো হচ্ছে আমাদের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সহযোগী ছাড়াও সেখানকার বেশ কজন সংবাদকর্মীও উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই আশা করি সামনের কয়েক বছরেই তাল, সুপারি ও নারিকেলগাছ দিয়ে ভরে উঠবে সারা দেশের আনাচে-কানাচে, যাতে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দূরীভূত করা সম্ভব হবে।

বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি এখন রীতিমতো মহামারি আকারে দেখা দিচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাও ঠিক যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে বা বাইরে গিয়ে কোনো-কিছু করা সম্ভব নয়; কিন্তু সাময়িক ব্যবস্থাপনায় যদি সেগুলোকে কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয় তবেই মঙ্গল। আর বজ্রপাতের মতো একটি নিয়ন্ত্রণহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে যদি সামান্য কিছু তালগাছ রোপণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়- তবে তার থেকে ভালো কাজ আর কি হতে পারে! কাজেই আসুন প্রতি বছর আমাদের পারিপার্শে সবাই মিলে তালগাছ লাগাই এবং এর মাধ্যমে বজ্রপাতের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করি।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


তরুণ কর্মজীবী জনসংখ্যা কমছে ও বেকারত্ব বাড়ছে

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১১:১৪
ড. মিহির কুমার রায়

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। এখানকার তরুণ জনশক্তিকে দেখা হয় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হিসেবে। নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এ যুব শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ আদায় করে নিতে সক্ষম হবে; কিন্তু দেশে এখন তরুণ কর্মজীবীর (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি) সংখ্যা কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে দেশে তরুণ জনশক্তির সদস্যসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার। সে অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে দেশে যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত যুবকের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৪ লাখ ৬০ হাজার। এ ক্ষেত্রে মূলত পুরুষ শ্রমশক্তিই কমেছে সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের এ পরিসংখ্যান উদ্বিগ্ন করে তুলছে বিশেষজ্ঞদের। যুব শ্রমশক্তি সংকোচনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে জন্মহার কমার একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তা আগামীতেও অব্যাহত থাকতে দেখা যেতে পারে। তাছাড়া দেশে তরুণদের কাজের সুযোগও কম। অনেকে কাজ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণেও এমনটি হয়ে থাকতে পারে। তবে প্রবৃদ্ধি কমায় শিল্প খাতে তরুণ জনশক্তি সংকোচনের প্রভাব সেভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না।

বিবিএসের জরিপের তথ্যমতে, ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের শেষ প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের শ্রমশক্তিতে যুবকের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার। সে হিসাবে গত প্রান্তিকে তিন মাসের ব্যবধানে যুবশক্তি কমেছে ৩ লাখ ৬০ হাজার।ব্যুরোর প্রতিবেদনে উঠে আসা লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে পুরুষ যুব জনশক্তি ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার। এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে পুরুষ জনশক্তি কমেছে ৯ লাখ ৮০ হাজার। আর গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে নারী যুবশক্তি ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার, যা এবার কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজারে। বহুমাত্রিক কারণে এমনটা হতে পারে বলে মনে করছেন জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শ্রমশক্তিতে নিযুক্ত লোকজনের অধিকাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাই মৌসুম পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় কাজ বেশি বা কম থাকে। তখন কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যায় পার্থক্য দেখা দেয়। আবার যথাযথ কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকে কাজের সন্ধানে বিদেশে চলে যান। কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্যও বিদেশে যান। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এমন স্থানান্তর বেশি দেখা যায়।জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ১৩ লাখ ৫৪ হাজার বাংলাদেশি। এ বছর এখন পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৩৭। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সুযোগ না থাকায় কর্মে যুক্ত হতে পারছেন না তরুণরা। বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে এত বেশিসংখ্যক যুবশক্তি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। এটা তথ্য সংগ্রহের কোনো ত্রুটির কারণেও হতে পারে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা বলেন, ‘তরুণরা যদি মনে করেন কাজ পাওয়া কঠিন বা চাকরি পাওয়া যাবে না, তাহলে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে কাজ নাও খুঁজতে পারেন। তখন ডিসকারেজড ওয়ার্কফোর্স হিসেবে তাদের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কারণ শ্রমশক্তিতে যুক্ত থাকতে হলে কাজ খোঁজার মধ্যে থাকতে হবে। এটাও তরুণ জনশক্তি হ্রাসের একটি কারণ হতে পারে। কর্মে যুক্ত তরুণদের বড় অংশই ঢাকায় কাজ করে। দেশের অন্য বিভাগে একইভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে তরুণদের বেকারত্বের কারণে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিতে পারছে না। দেশের আর্থিক ও জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়ে আসার পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতারা। তবে উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কমে আসার কারণে শিল্পখাত বিষয়টি এখনো সেভাবে অনুধাবন করতে পারছে না বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘তরুণরা শিল্প খাতের প্রধান শক্তি। এটা কমে গেলে শিল্পে প্রভাব পড়ার কথা; কিন্তু শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। গত নয় মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি। তাই শিল্প খাতে এখন শ্রমের চাহিদা নেই। বিবিএসের তথ্যে বেকার বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি না থাকায় এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। প্রবৃদ্ধি থাকলে হয়তো তরুণ শ্রমশক্তি কমে যাওয়ার ব্যথাটা অনুভব করত শিল্প খাত। আর সুদহার বৃদ্ধি ও গ্যাস সংকটের কারণে আগামীতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কি না সে বিষয়ে সন্দিহান আমি।’ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জন্মহার কমে যাওয়ায় দেশের তরুণ জনশক্তি কমে যাচ্ছে। এটা ক্রমাগত কমে আসবে। ২০৩৫-৩৬ সালের মধ্যে যুবকদের তুলনায় নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। আর তরুণদের ৩০ শতাংশ আবার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মে নেই। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাদের কোনো কিছুতে যুক্ত করতে পারিনি। ধীরে ধীরে যুবকের সংখ্যা কমে বেকারের চাপও কমে আসবে। বয়স্ক মানুষ বাড়বে। তাই কর্মক্ষম ও অভিজ্ঞদের কাজে লাগাতে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি যুক্ত করা যায়।’

বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। এর মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এ ছাড়া শ্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা মূলত শিক্ষার্থী, অসুস্থ, বয়স্ক, কাজে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মে অনিয়োজিত বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক ব্যক্তি।

এখন আসা যাক বেকারত্বের চিত্র যা এক ভয়াবহ বলে প্রতীয়মান হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়মানুসারে, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং গত এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়মানুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে। সেই হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে যা বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে বেকারের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের গড় বেকারের হারের চেয়ে কিছুটা বেশি। ২০২৩ সালের গড় বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এদিকে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, নারী বেকার কমেছে। বিবিএস হিসাব অনুসারে, গত মার্চ মাস শেষে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (মার্চ-জানুয়ারি) সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ১০ হাজার। অন্যদিকে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ হাজার নারী বেকার কমেছে। এখন নারী বেকারের সংখ্যা ৮ লাখ ৫০ হাজার। বিবিএস বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। তাদের মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এ ছাড়া শ্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা মূলত সাধারণ ছাত্র, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক নারী-পুরুষ, কাজ করতে অক্ষম ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং কর্মে নিয়োজিত নন বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক গৃহিণী। সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী কর্মসংস্থান বেশি কৃষিতে। বিবিএসের হিসাবে, জানুয়ারি-মার্চ মাস শেষে কৃষি খাতে কাজ করেন ৩ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার। শিল্প খাতে এ সংখ্যা ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার আর সেবা খাতে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার। গত ডিসেম্বর শেষে কৃষি খাতে ছিল ৩ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ, শিল্পে ১ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার আর সেবা খাতে ছিল ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার।

উচ্চশিক্ষিতরা মনমতো কাজ না পেলে নিজেদের বেকার হিসেবে পরিচয় দেন। যেমন স্নাতকোত্তর পাস করে ভালো চাকরির অপেক্ষা করছেন, এই সময় হয়তো টিউশনি করেন কিংবা অস্থায়ী চাকরি করছেন যেমন চিকিৎসকদের অনেকেই সম্মানীর বিনিময়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন অথচ জরিপের সময় তাদের অনেকেই নিজেদের বেকার হিসেবে গণ্য করেন। এ হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে। সপ্তাহে এক ঘণ্টার মজুরি এই মূল্যস্ফীতির যুগে জীবনধারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীও আছে। তারা শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণে নেই, আবার কাজের মধ্যেও নেই। বেকারত্ব নিয়ে বিবিএস যে সংখ্যা উল্লেখ করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ প্রতি বছর চার-পাঁচ লাখ তরুণ-তরুণী স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন। তাদের ৫০-৬০ শতাংশকে গড়ে দু-তিন বছর বেকার থাকতে হয়। সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্রতি বছর বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আরও উল্লেখ্য যে এক বছরের বেশি সময় ধরে অর্থনীতিতে এক ধরনের সংকট চলছে, ছোট-বড় সব ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকর্মী ছাঁটাই করছে এবং ছাঁটাই করা কর্মীদেরও বসে থাকতে হয় কিংবা আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি নিতে হয়। শিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি হবে এমন সম্ভাবনাও নেই। আবার কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ পরিবেশেও এক ধরনের স্থবিরতা আছে এবং বিনিয়োগ প্রস্তাবও ৩০ শতাংশের মতো কমে গেছে। এখন অর্থনীতিতে এক ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে, শোভন কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বাসাবাড়িতে নারীরা সংসারের নানা কাজ করেন; কিন্তু মজুরি পান না, এমন অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম কমে আসছে যেমন- ২০১০ সালে ৯১ লাখ নারী এমন মজুরহীন পারিবারিক কাজ করতেন। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৩১ লাখে নেমে এসেছে। এক যুগের ব্যবধানে এই সংখ্যা ৬০ লাখ কমেছে, যা শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ২০১০ সালে ১ কোটি ৭২ লাখ নারী শ্রমশক্তিতে ছিলেন যা এখন তা বেড়ে ২ কোটি ৫৮ লাখ হয়েছে। দেশে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয় মাত্র ১৫ দশমিক ১ শতাংশ, বাকি প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয়। যেখানে কোনো চাকরির নিশ্চয়তা নেই, কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না এবং যেকোনো সময় মালিকপক্ষ চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেয়। বিবিএস প্রণীত জরিপের ফলাফলগুলো আমাদের শ্রম বাজারের বিশ্লেষণের জন্য উপাদান যোগান দেবে। এর মাধ্যমে সরকারের নেওয়া কর্মসূচিগুলোর অগ্রগতিও পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এই জরিপে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলো শ্রম বাজার উন্নয়নের চিত্রের প্রতিফলন ঘটায়। এসব তথ্য নীতি-নির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক ও অন্যান্য ব্যবহারকারীরা ব্যবহার করতে পারবে। কার্যকর পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ জরিপের তথ্য।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি


তীব্র তাপপ্রবাহের স্মৃতি তালপাতার পাখা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে আর গরমের সময়ে সবার হাতে হাতে থাকত তালপাতার পাখা। সে তো ১৯৬০-এর দশকের কথা। তখন থাকতাম বলেশ্বর নদীতীরের ছোট্ট শহর পিরোজপুরে। সেই যুগে পিরোজপুরে ছিল না বিদ্যুৎ। তাহলে বৈদ্যুতিক পাখা আশা করা দুরাশা নয় কি!

তখন তো আমরা জানতাম না বিদ্যুৎ আর বৈদ্যুতিক পাখা দেখতে কেমন। বৈদ্যুতিক পাখা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের আলোচনা হতোই না। সবার মুখে মুখে ছিল তালপাতার পাখা। পড়ার সময়ে কিংবা ঘুমানোর সময় সবার হাতে হাতে ছিল তালপাতার পাখা। অতিরিক্ত গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তালপাতার পাখার বিকল্প ছিল না তখন।

আহারে আহারে কই গেল, কই গেল তালপাতার পাখা। প্রচণ্ড গরমে প্রাণ জুড়াতো তালপাতার পাখার হাওয়ায়। আবার ওই পাখা যাতে চটপট ভেঙে না যায় সে জন্য দাদি-নানি, মা-খালারা শাড়ির পাড় দিয়ে গোল করে ঢাকনা পরাতেন। পাখার গায়ে নানান কলকা ও ছবি আঁকা থাকত। মহিলা মহলে দুপুরের পান খাওয়ার সময় পাখার যেমন চাহিদা ছিল, তেমন আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসর শোনার সময়ে আমরা তালপাতার পাখা ব্যবহার করতাম বাতাস খাওয়ার আশায়। অনেক রমণীদের কাছে শোয়ার বিছানায় তালপাতার পাখা ছিল সতীনের মতো আরেক সঙ্গী। এই সতীনকে বড় সোহাগ করে স্বামীর হাতের পাশেই রাখতে হতো। গরমকালে তালপাতার পাখার চাহিদা ছিল অনেক বেশি। ধনী-গরিব সবার ঘরে ঘরে তালপাতার হাতপাখা দেখা যেত।

হাতপাখাকে কেন্দ্র করে গ্রাম-গঞ্জের প্রবাদবাক্য- রাতে পাখা করতে নেই। কারণ সে সময়ে গ্রামগঞ্জে বিদ্যুৎব্যবস্থা ছিল না, রেড়ির তেলে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপের আলোয় আমরা পড়াশোনা করতাম। পাখায় হাওয়া করলেই প্রদীপ নিভে যেত। রোদে চাষিরা যখন মাঠে কাজ করতেন, তার বউ মাঠে পান্তাভাত নিয়ে যেতেন, সঙ্গে নিতেন তালপাতার পাখার পাখা। মাঠে পাখা দিয়ে বাতাস করতেন। মাঠ-বিলে কৃষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে প্রচণ্ড গরম থেকে আরাম পেতে তালপাতার পাখার ফুরফুরে বাতাসে দেহ-মনে স্বস্তি পেতেন। তখন তালপাতার পাখার বিভিন্ন নাম ছিল, যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, পালংপোষ, মনসুন্দরী ইত্যাদি। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে, কবে সেই গ্রামে দেখেছি ঘরের মেঝেতে বসে চাষি ভাত খাওয়ার সময় তার বউ হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।

রাজা, বাদশাহ, জমিদার আমলে রাজসিংহাসনের দু’পাশে দুজন বড় বড় হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর ধীর লয়ে বাতাস করতেন। এ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বাড়িতে নতুন জামাই বা অতিথি এলে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা হতো। তালপাতার হাতপাখা গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক; কিন্তু এখন আর দেখা যায় না হাতপাখা তৈরির কারিগর। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বৈদ্যুতিক পাখার অহরহ ব্যবহারে তালপাতার পাখা বোনার চাহিদা প্রায় লুপ্ত হয়েছে। কালের স্রোতে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হাতপাখা আজ বিলুপ্তপ্রায়। আর গ্রাম থেকে উবে গেছে সারি সারি তালগাছ।

আজও খুব করে মনে পড়ে, পিরোজপুর শহরের বলেশ্বর নদীর তীরে ছিল লাইন ধরে শত শত তালগাছ। সেই তালগাছগুলো আজ কোথায়? বাংলাদেশ থেকে তালগাছ বিলুপ্ত হলে তালপাতার পাখা আসবে কোথা থেকে? তালপাতার পাখার চল উঠে গেছে, অথচ এক সময়ে গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েরা তালপাতার পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। দেশে এমনিতেই বেকারের অভাব নেই। সেই অবস্থায় তালগাছ কেটে কেটে উজাড় করে দিয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়াল কারা? তালগাছ ছিল, কিছু ছেলেমেয়েরা তালপাতার বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। এই জীবিকাকর্মীদের পেটের ওপর কে লাথি মারল- যারা তালগাছ কেটে উজাড় করেছে, তারা নয় কী? ইন্ধনদাতাই বা কারা?

হাতপাখা শিল্পও আজ শেষ। বেকারদের সংখ্যাও তাই আজ দিন দিন ভারী হচ্ছে। বিশাল নগরী ঢাকার দুই দুইটি এলাকার নাম তালতলা। একটি খিলগাঁওয়ের দিকে আর অন্যটি হলো আগারগাঁওয়ের কাছে। শত বছর আগে এই দুই জায়গায় ছিল তালগাছ আর তালগাছ। হাজার হাজার তালগাছ শহীদ করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। কোথাও তালগাছের দেখা নেই- তবু জায়গার নাম থেকে কেউ মুছে দিতে পারেনি ‘তালতলা’।

আমাদের বাংলাদেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তালগাছ লাগানোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে পারেন। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি তালরস সংগ্রহকারীদের জন্য এক বিমা-প্রকল্প ঘোষণা করতে পারেন। তাহলে অনেকেই তালগাছ লাগানো এবং এর চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আমাদের দেশে তালগাছকে নিয়ে সেভাবে চিন্তাভাবনা হয়নি- হতে দেখা বা শোনাও যাচ্ছে না। কৃষি দপ্তর আছে বলে জানি। বিষয়টি তাদের ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: চিঠিপত্র গবেষক ও পরিবেশবিদ


banner close