বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

বাজেট ২০২৩-২৪: একটি তাৎক্ষণিক পর্যালোচনা

এম এ খালেক
এম এ খালেক
প্রকাশিত
এম এ খালেক
প্রকাশিত : ৩ জুন, ২০২৩ ০৯:৫৯

একাদশ জাতীয় সংসদের সর্বশেষ বাজেট অধিবেশনে গত ১ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি হচ্ছে সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট। এই বাজেট বাস্তবায়নকালেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কাজেই এবারের বাজেট নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এটি হচ্ছে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উপস্থাপিত পঞ্চম জাতীয় বাজেট এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট। এর মধ্যে ৫২টি পূর্ণাঙ্গ বাজেট এবং একটি ছিল খণ্ডিত বা আংশিক সময়ের জন্য বাজেট। এর মধ্যে আজকে যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে সেটিসহ আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বিভিন্ন সময় সর্বাধিক ২৫টি বাজেট উপস্থাপন করছে। বিএনপি আমলে বিভিন্ন সময় মোট ১৭টি বাজেট উপস্থাপন করা হয়। আর সেনাশাসক এরশাদ আমলে মোট ৯টি বাজেট প্রণীত হয়। বাংলাদেশে সর্বাধিক ১২টি করে বাজেট প্রণয়ন করেন বিএনপি-দলীয় অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ও আওয়ামী লীগ-দলীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য প্রথম বাজেট প্রণয়ন করেছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট বর্তমানে বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে, তার আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের জন্য যে বাজেট আজ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সার্বিক আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রস্তাবিত বাজেট চরিত্রগত দিক থেকে সম্প্রসারণমূলক বাজেট। বাজেটে রাজস্বপ্রাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশের মতো। মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে রাজস্ব আসবে ৪ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করার জন্য আগামী বাজেট বাস্তবায়নকালে বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে ৪৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের যে অবস্থা তাতে বাড়তি ৪৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা বেশ কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। উল্লেখ্য, অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা কম হয়েছে। কাজেই আগামী অর্থবছরের জন্য এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা সংশয় প্রকাশ করছেন। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত সূত্র থেকে সরকার ঋণ গ্রহণ করবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যাবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জন্য যে বাজেট প্রস্তাবনা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা এমন একসময় প্রণয়ন করা হয়েছে যখন বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা বিরাজ করছে। এখনো বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার শুরু হয়নি। তবে যেকোনো সময় মন্দা দেখা দিতে পারে। নানা ধরনের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখনো তিন বছর ধরে চলা করোনা অতিমারির প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর মধ্যে ২০২২ সালের সূচনালগ্নে শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যে এতটা দীর্ঘমেয়াদি হবে, তা অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননি। বিশ্ব অর্থনীতির জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব হয়েছে অতি ভয়ংকর। ফলে এক দেশের অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হলে তার প্রভাব অন্য দেশের ওপরও পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পড়েছে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও প্রচণ্ডভাবে পড়েছে। অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকই নিম্নমুখী রয়েছে। অর্থবছরের সমাপ্ত হওয়া ১০ মাসের অর্থনীতির যে চিত্র তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। একমাত্র রেমিট্যান্স ও পণ্য রপ্তানি খাতের আয় কিছুটা ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় সব খাতের অবস্থাই এখন অত্যন্ত খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। কথায় বলে, উচ্চ রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অবস্থা। এমনকি তুলনামূলক কম স্ফীত রিজার্ভ এবং ব্যক্তি খাতে উচ্চমাত্রায় বিনিয়োগও কাম্য হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগবিহীন রিজার্ভ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যক্তিবিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ উভয়ই নিম্নমুখী রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার ছিল ২৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। পরবর্তী তিন অর্থবছরে এটি ছিল যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ ও ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়ানো না গেলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পেতে পেতে গত মে মাসে ৩ হাজার ১৭ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে। অথচ জুলাই, ২০২২-এ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৯৫৯ কোটি ডলার। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিসংখ্যান প্রদান করে আইএমএফ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা তার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের যে পরিমাণ প্রদর্শন করে তার মধ্যে রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ডে দেয়া ৭ বিলিয়ন ডলারকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু যে অর্থ আমার হাতে নেই তাকে কোনোভাবেই রিজার্ভ অর্থ হিসেবে প্রদর্শনের সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কমার কারণে সরকারকে তার উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হচ্ছে। সরকার যদি ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করে, তাহলে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক-ঋণপ্রবাহ নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। বিনিয়োগ কার্যক্রম ব্যাহত হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকার ব্যাংকিংব্যবস্থা থেকে ৭৯ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) সরকারের ব্যাংকঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে সরকার ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকাসহ অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে মোট ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করবে। চলমান মুদ্রানীতিতে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ। গত আগস্টে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ শিল্প ব্যবহার্য ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমেছে ৫৬ শতাংশ। আর মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে ৩১ শতাংশ। কাঁচামাল আমদানি কমেছে ১৪ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ শিল্প খাতে এক ধরনের স্থবিরতা রিরাজ করছে। কিন্তু ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণের প্রবৃদ্ধি সেই হারে কমছে না। তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তি খাতে ব্যাংকঋণ নিয়ে একটি মহল অন্যত্র প্রবাহিত করছে। এমনকি বিদেশে পাচার করছে বলে অনেকেই মনে করেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি। আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এপ্রিলে এসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো, এমনকি ভারতও তাদের উচ্চমাত্রার মূল্যস্ফীতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুব একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারছে না। এই অবস্থায় আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গত এক বছরে অন্তত তিনবার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ, এখন তা ৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু পলিসি রেট বাড়ানোর এই উদ্যোগ বাজারে অর্থ সরবরাহ কমানোর ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ালেও ব্যাংকঋণের সুদের আপার ক্যাপ (৯ শতাংশ) প্রত্যাহার করেনি। ফলে ব্যাংকঋণ গ্রহণ করা এখন আরও সহজ এবং সস্তা হয়েছে।

আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার খুব একটা উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয় না। কারণ বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে বেশ উচ্চমাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সাময়িক হিসাব অনুসারে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কমিয়ে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে সাড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তবে এই মুহূর্তে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাজেটে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্পমূল্যে খাবার জোগানসহ নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিধি বাড়ানো হয়েছে।

নিকট-অতীতে কখনোই সরকার রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে তেমন একটা সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি। তাই রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৫৯ শতাংশ। অথচ নেপালের মতো দেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও হচ্ছে ২৩ শতাংশ। কাজেই আমাদের এ ব্যাপারে দৃষ্টি দিতে হবে। আগামী অর্থবছরে ট্যাক্স আদায় বৃদ্ধির জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেয়া হলেও এই সুযোগ কেউ গ্রহণ করেননি। তাই আগামী অর্থবছরে এই সুযোগ আর থাকছে না। এটি খুব ভালো একটি উদ্যোগ। কারণ পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ দিলেও খুব বেশিসংখ্যক মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ করেনি। এ ছাড়া টাকা পাচারকারীদের শাস্তিদানের পরিবর্তে সামান্য ট্যাক্স প্রদানের বিনিময়ে অবৈধ অর্থ দেশে ফেরত আনতে দেয়াটা নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, করমুক্ত আয় পুরুষদের ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৪ লাখ টাকা করার কথা বলা হয়েছে। আগামী অর্থবছর থেকেই সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হবে। যারা টিআইএনধারী, তারা রিটার্ন দাখিল করলেই ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যানেজার, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

বিষয়:

উন্নয়নশীল দেশের বাজেট প্রণয়ন সব সময় চ্যালেঞ্জিং

আপডেটেড ১৫ মে, ২০২৪ ১১:১২
ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ

জাতীয় বাজেট আসছে। আগামী জুনের শুরুর দিকে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হবে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাজেট প্রণয়ন সব সময়ই বেশ চ্যালেঞ্জিং। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে তো বার্ষিক বাজেট তৈরি করতেই হয়। আমরা জানি ব্যক্তিপর্যায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিকপর্যায়ে বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে। বাজেট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বছরের সম্ভাব্য আয়- ব্যয়ের খতিয়ান। তবে জাতীয় বাজেট এবং ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের ক্ষেত্রে আয় বুঝে খাতওয়ারি ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে চাইলেই আয় বাড়ানো যায় না। আর জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নির্ধারণ করে আয়ের পরিমাণ এবং খাত নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। তবে সরকারের আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকলেও সব সময় তা যৌক্তিকভাবে বাড়ানো সম্ভব হয় না। জনগণের ওপর বর্ধিতহারে করারোপ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। অনেক সময় যাদের কর দেওয়ার তারা নানা ছুতোয় কর দেন না এবং আদায় করও যায় না। বর্তমান সরকার গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।

আগামী অর্থ বছরের জন্য প্রণীত বাজেটে অতীতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরের (২০০২৩-২০২৪) জন্য বাস্তবায়নাধীন জাতীয় বাজেটে যেসব অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলা হয়েছিল নানা কারণেই তা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব হবে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি। চলতি অর্থ বছরের জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, তা হবে সাড়ে পাঁচ বা ছয় শতাংশ। কেন এমন হচ্ছে? অর্থনীতিতে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতের কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার কার্যকর পদক্ষেপ বাজেট থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি। মূল্যস্ফীতি একটি জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সমস্যা, যা নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। আর ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।

আগামী অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের হার খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ (২০২২-২৩)। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলোতেই কর-জিডিপির অনুপাত অনেক বেশি। যেমন- নেপালে তা ১৮/১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ (২০২২-২৩)। পৃথিবীতে যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। চেয়ে খারাপ হলেও কর-জিডিপির অনুপাত সেই দেশে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ (২০২১)। অন্যদিকে বাংলাদেশে ধনী হওয়ার হার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কিন্তু সঠিক মাত্রায় কর প্রদান না করা। নানাভাবে তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ রকমটি চলতে থাকলে সরকারকে বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হবে।

অতি মাত্রায় ঋণ নির্ভর হয়ে পড়া একটি দেশের জন্য কোনোক্রমেই লাভজনক নয়। এখনো আমরা ঋণের ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছি, কিন্তু এটা কত দিন থাকবে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে মোট জিডিপির ২১ শতাংশের মতো। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের হার প্রায় সমপরিমাণ। অর্থাৎ বিদেশি এবং অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট ঋণের হার হচ্ছে জিডিপির ৪২ শতাংশের মতো। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী জিডিপির ১২৯ শতাংশ (২০২২)। আর জাপানের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ২৬৩ শতাংশ (২০২৩) এবং ভারতে ৮৬ শতাংশ (২০২২-২৩)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে ঋণ না। সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে আসে। সেই ঋণের অর্থ ব্যবহারের দায়িত্ব যাদের হাতে থাকে তারা অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তা ব্যবহার করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধান্ধাবাজির মাধ্যমে। আমাদের সমস্যা জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাতে নয়। সমস্যা হচ্ছে গৃহীত ঋণের সব অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পের সুফল যতটা পাওয়ার কথা ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। বাজেটে বিভিন্ন খাতে ও প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে যথাসময়ে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাত হিসেবে বাজেট বরাদ্দ ধীরে ধীরে কমছে। চলতি বছরে তা ২ শতাংশের কম। শিক্ষা অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজের জন্য ব্যয়িত হচ্ছে। ফলে খুবই কম। বলা হয়, যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে থাতে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে তাঁর বেশির ভাগই শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণার কাজে অর্থ বরাদ্দ থাকছে খুবই কম। বলা হয় যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই অনুপাত কম হলেও টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষা খাত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে শুধু ব্যজের অঙ্ক কিছু বাড়লেই চলবে না, জিডিপির অনুপাতও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন; কিন্তু অনেক সময় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না, শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর এবং পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বরাদ্দ ও সঠিক ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন।

আগামী জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থানের ওপর ব্যাপক মাত্রায় জোর দিতে হবে। করোনাকালিন অবস্থায় অনেকেই তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এ ছাড়া শ্রম বাজারে নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার অতীতের মতো আগামী বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দ দেবে বলে আশা করা যায়। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অংশ হিসেবেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।

বর্তমান সময়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার এখন জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ ব্যয় করছে। সরকার পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখছি। জটিলতা সৃষ্টি করবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের আরও ব্যয় বাড়াতে হবে, যা অগ্রাধিকার নির্ধারণ এই খাতে ব্যয় ও কার্যক্রম বাড়ানো না হলে আগামীতে আগামী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও করে প্রকল্প গ্রহণ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।

আগামী অর্থ বছবের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টার পাশাপাশি বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি যদি কমিয়ে এনে সহনীয় পর্যায়ে নামানো না যায় তাহলে জনগণের মনে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এখানে বড় চ্যালেঞ্জ দুষ্টচক্র (সিন্ডিকেট)। অনেক সময় দেখা যায় সরকারের ভালো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ মাঠপর্যায়ে গিয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহল বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। উচ্চমূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি ব্রেট বাড়ানো হয়েছে এবং ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েছে; কিন্তু দেশে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ রকম পদক্ষেপ কাজ করেছে; কিন্তু বাংলাদেশে এই উদ্যোগ সঠিকভাবে কাজ করছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এমন উদ্যোগ কাজ করেছে এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত শ্রীলঙ্কায় এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে উচ্চমূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই উদ্যোগ কাজ করেনি। কেন কাজ করল না তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান দুষ্টচক্র এসব উদ্যোগকে কাজ করতে দিচ্ছে না বলে আমি মনে করি। এই দুষ্টচক্রগুলোর হোতাদের অনেকেই পরিচিত। কিন্তু তাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা সব সময় তৎপর থাকছে, জবাবদিহি মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।

মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া উচিত কি না তা নিয়ে অনেকেই। প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। এটি একটি জটিল প্রশ্ন বটে। আমি মনে করি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এখনই বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই বলছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারিত করে রাখার কারণে রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। যদি বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হতো তাহলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বেশি আসত। আমি এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নই রেমিট্যান্স তো প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো- যে সংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশে যাচ্ছে কর্মসংস্থান উপলক্ষে রেমিট্যান্স সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ থেকে উপার্জন করার জন্য বিদেশে যাচ্ছে কারা? গ্রামীণ দরিদ্র এবং অদক্ষ ব্যক্তিরাই মূলত 'বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাচ্ছেন। তারা বিদেশে গিয়ে ভালো কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ বেকার থাকছেন। ফলে যে সংখ্যক মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে কম। হয়তো হুন্ডি যারা করে তাদের মধ্যে থেকে কিছু মানুষ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হতে পারে, কিন্তু কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গেলে সেই প্রবণতা বাস্তবে রূপ লাভ নাও করতে পারে।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে মূল্যস্ফীতি অনেক বৃদ্ধি পাবে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। কিছু দিন আগেও বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক বিনিময় হার চালু ছিল। এখন তা সঠিকভাবেই একক বিনিময় হারে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। এটা বন্ধ করতে হবে। গৃহীত প্রকল্প যাতে নির্ধারিত সময়ে এবং ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এর বাতায় ঘটলে যারা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস

বিষয়:

পরীক্ষার ফল, মিষ্টি ও মৃত্যুর অনুক্রম

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১৬:৫৬
সজীব সরকার

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত রোববার। মুদ্রিত, সম্প্রচার ও অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বরাবরের মতোই এবারও প্রাধান্য পেয়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের খবর। এর পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে সর্বোচ্চ পাস, সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ এবং সবচেয়ে বেশি ফেল করা বা খারাপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর খবর।

এসব খবরের, মোটা দাগে, দুটি দিক থাকে:

এক. জিপিএ-৫ পেয়ে উল্লসিত কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আনন্দের খবর; দুই. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে অর্থাৎ ফেল করে কিছু শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর।

এবারও, একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের উল্লাসের খবর দেখা গেছে, তেমনি জানা গেছে পরীক্ষায় ফেল করে বা জিপিএ-৫ না পেয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর। সামনের দিনগুলোতে এমন খবর আরও পাওয়া যাবে হয়তো।

জিপিএ-৫ পাওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের ব্যাপার; তবে, এ নিয়ে প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে, তা কখনোই কাম্য নয়। গণমাধ্যমগুলোও যেভাবে এসব পাবলিক পরীক্ষার ফল সম্পর্কিত খবর প্রচার করে, তাতে এ প্রতিযোগিতা আরও গতি পায়। এমন সাংবাদিকতা মোটেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না।

জিপিএ-এর স্কোর তথা ‘ভালো রেজাল্ট’ সবসময় শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনের নিশ্চয়তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগবঞ্চিত কিন্তু স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই, জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন’। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক - সবার মধ্যেই এ বোধোদয় ঘটা দরকার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনটি ভালো বা মন্দ- তা নির্ণয় করা হয় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার হার কতো - এ বিচারে। স্কুল-কলেজগুলোর বিজ্ঞাপনেও এসব তথ্যই গুরুত্ব পায়। কোচিং সেন্টারগুলোও জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দেয়; অনেকের বিজ্ঞাপনে থাকে বিষয়ভিত্তিক ‘এ প্লাস’ বা জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার ‘লিখিত গ্যারান্টি’ বা ‘বিফলে মূল্য ফেরত’-এর শর্ত। কিন্তু, পড়াশোনার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে বিদ্যা অর্জন, জ্ঞান অর্জন- সে গ্যারান্টি কোথায়? বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে কুসংস্কারমুক্ত উদার মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা, সে নিশ্চয়তা কোথায়?

পরীক্ষার ফল ভালো হওয়া তথা জিপিএ-এর স্কোর বেশি থাকা মানেই ওই শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞানার্জন হয়েছে- এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তেমনি, পরীক্ষার ফল খারাপ হলেই যে ওই শিক্ষার্থী নিরেট মূর্খ- সে কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা আরজ আলী মাতুব্বর কতো ক্লাস পড়েছেন আর তাদের পরীক্ষার ফল কেমন ছিলো - এমন প্রশ্ন অবান্তর নয় কি? বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে কার বা কতোজনের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল ঘেঁটে তাদের মূল্যায়ন করা হয়?

তাহলে, এভাবে কেবল পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলনির্ভর মূল্যায়ন একটি একমুখী, অবৈজ্ঞানিক, অপর্যাপ্ত ও অসার পদ্ধতি। বরং, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যদি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানার্জনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সার্বিকভাবে যদি শিক্ষার্থীবান্ধব একটি কাঠামো গড়ে তোলা যায়, তাহলে পরীক্ষার তথাকথিত ‘ফল’ বা জিপিএ-এর স্কোর অনিবার্যভাবে ‘ভালো’ই হওয়ার কথা।

চাকরিদাতাদের একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, দেশের নামকরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে পাস করে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইন্টারভিউ বোর্ডে অত্যন্ত হতাশাজনক পারফর্ম করছে। তাহলে, মোটা স্কোর-অলা এসব সার্টিফিকেটের মূল্য কী? গণমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন সময় প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ‘নামকরা’ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, বিজয় দিবস, জাতীয় দিবস বা শহীদ দিবস - এমন ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচিত নয়; এসব বিষয়ে তারা তেমন কিছুই জানে না বা বলতে পারে না। তাহলে, প্রতিবছর গণমাধ্যমগুলোই বা কেন জিপিএ-নির্ভর এমন ফল বিশ্লেষণে গা ভাসাচ্ছে?

আমাদের মধ্যে অনেকেরই বিবেচনায় এটি নেই যে বুদ্ধিমত্তা, মেধা বা জ্ঞানের ধরন আলাদা। গান গাইতে না পারায় আইনস্টাইনকে যেমন 'মূর্খ' বলা অবিচার, তেমনি পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক না হওয়ার দায়ে লতা মঙ্গেশকরকে 'অপদার্থ' বলাও অযৌক্তিক। আইনস্টাইন, বিটোফেন, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, মাইকেল ফেলপস, শচীন টেন্ডুলকার, সাকিব আল হাসান, রোনালদো বা লিওনেল মেসি - কে জ্ঞানী, আর কে মূর্খ? পরীক্ষার ফল দিয়ে তাদের বিচার করা সম্ভব কি?

জ্ঞান, মেধা বা যোগ্যতার অনেকগুলো দিক রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তির শারীরিক-মানসিক দক্ষতা ভিন্ন। আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কার কোনদিকে সুপ্ত বা স্পষ্ট আগ্রহ ও যোগ্যতা বা দক্ষতা রয়েছে, তা বুঝে সে অনুযায়ীই শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা। নির্বিচারে সবাইকে জিপিএ-৫ পাওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক চাপে ফেললে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় বৈ কিছু নয়। পৃথিবীর সবাইকে বিজ্ঞানী বানানো যেমন অসম্ভব ও অযৌক্তিক, তেমনি সবাইকে এসএম সুলতান বা লতা মঙ্গেশকর বানাতে চাওয়াটাও ভুল। কার মধ্যে কী ধরনের মেধা রয়েছে, তা নির্ণয় করে তার মধ্যে ওই বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা তৈরি করে দেওয়াই হতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাহলেই শিক্ষার্থীরা একসময় নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হবে। সফলতাকে কেবল 'পরীক্ষায় ভালো ফলের' সীমায় সীমিত করে রাখলে তা ভুল হবে।

এবার ফল প্রকাশের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন; তিনি বলেছেন, যারা পরীক্ষায় খারাপ করেছে, তাদের মন এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, তাই তাদের যেন বকা-ঝকা করা না হয়। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এ নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সবার একমুখী অতি-প্রত্যাশার চাপ সামলাতে না পেরে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করলে এ দায় আসলে কার? নিজের সন্তান ভালো ফল করলে খুশি হতেও বাধা নেই, মিষ্টি বিতরণেও দোষ নেই; কিন্তু, যারা কোনো কারণে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি, তাদের এমন মানসিক চাপে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা ঠিক নয় যে তারা আত্মহত্যার মাধ্যমে ওই চাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বাধ্য হয়। তাদের তিরস্কার না করে বরং পাশে দাড়ানো উচিত যেন মনোবল না হারিয়ে বরং তারা নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার মতো ভরসা পায়। শিক্ষক ও অভিভাবকসহ গণমাধ্যমগুলোরও এ ব্যাপারে সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার।

অবৈজ্ঞানিক প্রতিযোগিতার এমন পরিবেশে শিশুদের শৈশব আমরা কেড়ে নিয়েছি; সেই সাত-সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাত অবধি কেবল ক্লাস-কোচিং-টিউটর। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ‘ভালো রেজাল্ট’ করানোর জন্য অন্যদের চেয়ে বেশিসংখ্যক টিউটর বা কোচিং ক্লাসের চাপে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন পিষ্ট হতে হচ্ছে। এমন প্রতিযোগিতা শুরু হয় একেবারে প্রাথমিক স্তরেই। তাদের খেলাধুলা, শরীরচর্চা বা বিনোদন কোথায়? ধরে-বেঁধে সবাইকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে? শিক্ষার্থীরা তো গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি নয় যে এক খোঁয়াড়ের সবগুলো একই চেহারার এবং একই বৈশিষ্ট্যের হতে হবে! এরা মানবসন্তান এবং প্রতিটি শিশু আলাদা; তাদেরকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়াটাই বরং যৌক্তিক নয় কি?

শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক সংস্কার দরকার, গতি দরকার- যেখানে চাকরির বাজারে যোগান দেওয়ার জন্য কেবল চাকুরে তৈরির দিকে মনোযোগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও সুপ্ত মেধা অন্বেষণে মনোযোগ থাকবে। এমন একটি ব্যবস্থা চাই, যেখানে পরীক্ষার ফলের ওপর অতিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত বিদ্যার্জনকে উৎসাহিত করা হবে। এতে সব ক্ষেত্রের জন্য দক্ষ কর্মী যেমন অনিবার্যভাবেই তৈরি হবে, তেমনি তাদের মধ্যেই পাওয়া যাবে সত্যিকার সুনাগরিক ও নৈতিক মানুষ; প্রকৃত-পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

লেখক: সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।

বিষয়:

বজ্রপাতে প্রাণহানি ও তালগাছ রোপণ

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১০:৫৬
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

এখন প্রায়শই শোনা যায় সারা দেশের কোনো না কোনো স্থানে আকস্মিক বজ্রপাতে লোকজন মারা যাচ্ছে। এগুলো এখন আর কোনো মৌসুম কিংবা ফর্মুলা কিংবা নিয়মনীতি মানছে না। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এগুলো আর কিছুই না, তা আসলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আগে দেখা যেত বছরে বজ্রপাত হতে দু-চারজনের মৃত্যুর খবর কালেভদ্রে পাওয়া গেলেও এখন ফি-বছর বিষয়টি মহামারি আকার ধারণ করছে। বিগত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছরই সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যুর হিসাব রেকর্ড করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য একটি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে ইতোমধ্যে সরকারের তরফ থেকে দুর্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আমার এ অর্ধশতাধিক বয়সের অভিজ্ঞতায় এর আগে কখনো বজ্রপাতে এত মানুষের মৃত্যু হতে দেখিনি। বর্তমানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে উষ্ণতা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, গাছ কাটা, নতুন নতুন গাছ রোপণ না করা, জলাশয় ভরাট, দ্রুত নগরায়ণ- ইত্যাদি নানাবিধ কারণে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং জলবায়ু বায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলে প্রকৃতি এমন বিরূপ আচরণ করছে। আর সে জন্যই বজ্রপাতসহ প্রকৃতিতে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই চলেছে। সেগুলোর একটিই হলো বজ্রপাতে মৃত্যু। সময়ের ব্যবধানে আজ তা মহামারি আকারে দেখা যাচ্ছে। বর্ষাকাল শুরু হলেই জনমনে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়।

তারপর আসছে কীভাবে এসব আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। এটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও অভিমত হলো- খালি মাঠে কিংবা রাস্তার পাশে এমনকি বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, পাহাড়-বন, খাল-বিল, নদ-নদী, সাগর তীর প্রভৃতির পাড়ে কিংবা চারপাশে উন্মুক্ত স্থানে বেষ্টনী তৈরি করে উঁচু উঁচু গাছ লাগাতে হবে। সেসব গাছই থান্ডার অ্যারেস্টার (বজ্রপাত শোষক) হিসেবে কাজ করবে। তাতে গ্রামান্তরে বজ্রপাতের দরুন কৃষক কিংবা খেটে খাওয়া মানুষ মারা যাওয়া থেকে রেহাই পাবেন।

এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে আমাদের দেশের পরিবেশবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি তার একটি বক্তৃতায় বলেছেন, সারা দেশে প্রতি বছর কমপক্ষে তিন কোটি তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি উঁচু গাছ রোপণ করতে হবে যাতে আমাদের দেশের কৃষক মাঠে কাজ করতে গিয়ে বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুবরণ না করেন। কারণ এ দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত উন্মুক্ত স্থানেই বেশি ঘটতে দেখা যায়। তাছাড়া শহরের সচেতন মানুষ তারা তাদের বাড়ি-ঘর বানানোর সময় আগেই পরিকল্পিতভাবে থান্ডার অ্যারেস্টার লাগিয়ে কিছুটা হলেও নিরাপদে থাকে।

প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা শোনার পর দেশজুড়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, সংস্থা তাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি গাছ লাগানো শুরু করে দিয়েছেন। এতে সম্পৃক্ত হয়েছে স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। তবে সবচেয়ে অগ্রগামী হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তাদের সহযোগিতা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মাঠকর্মীসহ প্রশাসন ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের কর্মীরা। আমি এমন একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করব এখানে। ছড়া কবিতার কথায় আছে, ‘তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে সবগাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে’। অর্থাৎ তালগাছ এক সময় সবগাছ থেকে উঁচুতে উঠে যায়।

তালগাছ সম্পর্কে গ্রামাঞ্চলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। সেটি হচ্ছে- ‘যে ব্যক্তি তালগাছ রোপণ করে, সে ব্যক্তি সেই গাছের তাল খেয়ে মরতে পারে না’। তার মানে হলো তালগাছের বাড়-বাড়তি খুবই ধীরগতিতে ঘটে; কিন্তু কথাটি আসলে মোটেও ঠিক নয়। কারণ আমি নিজে আমার বাড়িতে ১৫ বছর বয়সে যে তালগাছ নিজের হাতে লাগিয়েছিলাম এখন আমার ৫৩ বছর বয়সে এসে আরও ১০ বছর আগে থেকেই সেই গাছের তাল খেয়ে চলেছি। তার থেকে বড় বাস্তব উদাহরণ আর কি হতে পারে! অর্থাৎ তালগাছ লাগানোর ২৫-৩০ বছরের মধ্যেই সেটা থেকে ফল খাওয়া যেতে পারে।

তালগাছ এখন আমরা যে শুধু বজ্রপাত থেকে রক্ষা করার জন্য লাগাব তাই নয়- এর রয়েছে বহুমুখী ব্যবহার ও উচ্চ খাদ্যমান। যেমন তালের পাতা দিয়ে ঘরের মাদুর তৈরি করা হয়, তালের পিঠা, তালের রস থেকে নানারকম পিঠা, পায়েস তৈরি করা হয় যা আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। হিন্দু শাস্ত্রের কৃষ্টিতে আছে তাল নবমী, তালের রস ক্যানসার প্রতিরোধী, তালগাছ দিয়ে তৈরি হয় তালের নৌকা। তালপাতা দিয়ে ঘরের ছাউনি, হাতপাখা, চাটাই, মাদুর, বিভিন্ন কুটির শিল্প, কাণ্ড দিয়ে বাড়িঘরের প্রয়োজনীয় কাঠ ও নৌকা তৈরি করা হয়। তালের কাণ্ড থেকে রস সংগ্রহ করে তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি এবং একপ্রকার চোলাই মদ তৈরি করা হয় যাকে সবাই ‘তাড়ি’ বলে চেনেন।

তা ছাড়া তাল অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গুণসমৃদ্ধ হওয়ায় ক্যানসার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তালের রসে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। তাল ভিটামিন-বি এবং ভিটামিন-এ এর আধার। তালে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে যা হাড় ও দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগ ভালো রাখতেও তালের জুড়ি নেই। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে প্রতি ১০০ গ্রাম তালে ৮৭ কিলোক্যালোরি খাদ্যশক্তি বিদ্যমান। এতে আরও রয়েছে, জলীয় অংশ- ৭৭.৫০ গ্রাম, আমিষ-০.৮ গ্রাম, চর্বি-০.১ গ্রাম, শর্করা ১০.৯ গ্রাম, খাদ্য আঁশ- ১ গ্রাম, ক্যালসিয়াম-২৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস-৩০ মিলিগ্রিাম, আয়রন-১ মিলিগ্রাম, থায়ামিন-০.০৪ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাবিন-০.০২ মিলিগ্রাম, নিয়াসিন-০.৩ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন নি-৫ মিলিগ্রাম ইত্যাদি।

বজ্রপাত নিরোধক হিসেবে তালের আঁটি রোপণ। এমনি একটি মহতি উদ্যোগের সঙ্গে বিগত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক আয়োজিত তালগাছ রোপণ কার্যক্রমে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। সেদিন তারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ দীপক কুমার পালের নেতৃত্বে উপজেলার সবপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী এ তালের আঁটি রোপণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। আমি এ কার্যক্রমে একটু বেশি আগ্রহ বোধ করেছি, কারণ একে তো আমি নিজেও একজন কৃষিবিদ আর সেই তালের আঁটিগুলো লাগানো হচ্ছে আমাদের নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা সহযোগী ছাড়াও সেখানকার বেশ কজন সংবাদকর্মীও উপস্থিত ছিলেন। এভাবেই আশা করি সামনের কয়েক বছরেই তাল, সুপারি ও নারিকেলগাছ দিয়ে ভরে উঠবে সারা দেশের আনাচে-কানাচে, যাতে বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দূরীভূত করা সম্ভব হবে।

বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি এখন রীতিমতো মহামারি আকারে দেখা দিচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি এগুলো সবই জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাও ঠিক যে প্রকৃতির বিরুদ্ধে বা বাইরে গিয়ে কোনো-কিছু করা সম্ভব নয়; কিন্তু সাময়িক ব্যবস্থাপনায় যদি সেগুলোকে কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হয় তবেই মঙ্গল। আর বজ্রপাতের মতো একটি নিয়ন্ত্রণহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে যদি সামান্য কিছু তালগাছ রোপণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়- তবে তার থেকে ভালো কাজ আর কি হতে পারে! কাজেই আসুন প্রতি বছর আমাদের পারিপার্শে সবাই মিলে তালগাছ লাগাই এবং এর মাধ্যমে বজ্রপাতের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার চেষ্টা করি।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


তরুণ কর্মজীবী জনসংখ্যা কমছে ও বেকারত্ব বাড়ছে

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১১:১৪
ড. মিহির কুমার রায়

বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। এখানকার তরুণ জনশক্তিকে দেখা হয় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হিসেবে। নীতিনির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময় প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, এ যুব শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতিক লভ্যাংশ আদায় করে নিতে সক্ষম হবে; কিন্তু দেশে এখন তরুণ কর্মজীবীর (১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি) সংখ্যা কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) শেষে দেশে তরুণ জনশক্তির সদস্যসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ২০ হাজার। ২০২৩ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার। সে অনুযায়ী এক বছরের ব্যবধানে দেশে যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি। শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত যুবকের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৪ লাখ ৬০ হাজার। এ ক্ষেত্রে মূলত পুরুষ শ্রমশক্তিই কমেছে সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপের এ পরিসংখ্যান উদ্বিগ্ন করে তুলছে বিশেষজ্ঞদের। যুব শ্রমশক্তি সংকোচনের কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তারা বলছেন, এ ক্ষেত্রে জন্মহার কমার একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে তা আগামীতেও অব্যাহত থাকতে দেখা যেতে পারে। তাছাড়া দেশে তরুণদের কাজের সুযোগও কম। অনেকে কাজ না পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণেও এমনটি হয়ে থাকতে পারে। তবে প্রবৃদ্ধি কমায় শিল্প খাতে তরুণ জনশক্তি সংকোচনের প্রভাব সেভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে না।

বিবিএসের জরিপের তথ্যমতে, ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের শেষ প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) দেশের শ্রমশক্তিতে যুবকের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার। সে হিসাবে গত প্রান্তিকে তিন মাসের ব্যবধানে যুবশক্তি কমেছে ৩ লাখ ৬০ হাজার।ব্যুরোর প্রতিবেদনে উঠে আসা লিঙ্গভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে পুরুষ যুব জনশক্তি ছিল ১ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার। এ বছর তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজারে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে পুরুষ জনশক্তি কমেছে ৯ লাখ ৮০ হাজার। আর গত বছরের প্রথম প্রান্তিকে নারী যুবশক্তি ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫০ হাজার, যা এবার কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৮ লাখ ৭০ হাজারে। বহুমাত্রিক কারণে এমনটা হতে পারে বলে মনে করছেন জনসংখ্যাতাত্ত্বিকরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের শ্রমশক্তিতে নিযুক্ত লোকজনের অধিকাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাই মৌসুম পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় কাজ বেশি বা কম থাকে। তখন কাজে নিযুক্ত মানুষের সংখ্যায় পার্থক্য দেখা দেয়। আবার যথাযথ কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকে কাজের সন্ধানে বিদেশে চলে যান। কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার জন্যও বিদেশে যান। তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এমন স্থানান্তর বেশি দেখা যায়।জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, গত বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন ১৩ লাখ ৫৪ হাজার বাংলাদেশি। এ বছর এখন পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২ লাখ ৩৬ হাজার ৮৩৭। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সুযোগ না থাকায় কর্মে যুক্ত হতে পারছেন না তরুণরা। বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। তবে এত বেশিসংখ্যক যুবশক্তি কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। এটা তথ্য সংগ্রহের কোনো ত্রুটির কারণেও হতে পারে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক বরকত-ই-খুদা বলেন, ‘তরুণরা যদি মনে করেন কাজ পাওয়া কঠিন বা চাকরি পাওয়া যাবে না, তাহলে তারা নিরুৎসাহিত হয়ে কাজ নাও খুঁজতে পারেন। তখন ডিসকারেজড ওয়ার্কফোর্স হিসেবে তাদের শ্রমশক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। কারণ শ্রমশক্তিতে যুক্ত থাকতে হলে কাজ খোঁজার মধ্যে থাকতে হবে। এটাও তরুণ জনশক্তি হ্রাসের একটি কারণ হতে পারে। কর্মে যুক্ত তরুণদের বড় অংশই ঢাকায় কাজ করে। দেশের অন্য বিভাগে একইভাবে কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। ফলে তরুণদের বেকারত্বের কারণে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড নিতে পারছে না। দেশের আর্থিক ও জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি যুব শ্রমশক্তি সংকুচিত হয়ে আসার পেছনে অনুঘটকের কাজ করেছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর নেতারা। তবে উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কমে আসার কারণে শিল্পখাত বিষয়টি এখনো সেভাবে অনুধাবন করতে পারছে না বলে মনে করছেন তারা। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, ‘তরুণরা শিল্প খাতের প্রধান শক্তি। এটা কমে গেলে শিল্পে প্রভাব পড়ার কথা; কিন্তু শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। গত নয় মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ শতাংশের কিছু বেশি। তাই শিল্প খাতে এখন শ্রমের চাহিদা নেই। বিবিএসের তথ্যে বেকার বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। প্রবৃদ্ধি না থাকায় এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। প্রবৃদ্ধি থাকলে হয়তো তরুণ শ্রমশক্তি কমে যাওয়ার ব্যথাটা অনুভব করত শিল্প খাত। আর সুদহার বৃদ্ধি ও গ্যাস সংকটের কারণে আগামীতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কি না সে বিষয়ে সন্দিহান আমি।’ সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘জন্মহার কমে যাওয়ায় দেশের তরুণ জনশক্তি কমে যাচ্ছে। এটা ক্রমাগত কমে আসবে। ২০৩৫-৩৬ সালের মধ্যে যুবকদের তুলনায় নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। আর তরুণদের ৩০ শতাংশ আবার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মে নেই। নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও আমরা তাদের কোনো কিছুতে যুক্ত করতে পারিনি। ধীরে ধীরে যুবকের সংখ্যা কমে বেকারের চাপও কমে আসবে। বয়স্ক মানুষ বাড়বে। তাই কর্মক্ষম ও অভিজ্ঞদের কাজে লাগাতে অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এটি যুক্ত করা যায়।’

বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, দেশের শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। এর মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এ ছাড়া শ্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা মূলত শিক্ষার্থী, অসুস্থ, বয়স্ক, কাজে অক্ষম, অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মে অনিয়োজিত বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক ব্যক্তি।

এখন আসা যাক বেকারত্বের চিত্র যা এক ভয়াবহ বলে প্রতীয়মান হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নিয়মানুসারে, যারা সাত দিনের মধ্যে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পাননি এবং গত এক মাস ধরে কাজপ্রত্যাশী ছিলেন, তারা বেকার হিসেবে গণ্য হবেন। বিবিএস এই নিয়মানুসারেই বেকারের হিসাব দিয়ে থাকে। সেই হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে যা বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে বেকারের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের গড় বেকারের হারের চেয়ে কিছুটা বেশি। ২০২৩ সালের গড় বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এদিকে পুরুষ বেকারের সংখ্যা বেড়েছে, নারী বেকার কমেছে। বিবিএস হিসাব অনুসারে, গত মার্চ মাস শেষে পুরুষ বেকারের সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ৪০ হাজার। ২০২৩ সালের প্রথম প্রান্তিকে (মার্চ-জানুয়ারি) সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ১০ হাজার। অন্যদিকে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ হাজার নারী বেকার কমেছে। এখন নারী বেকারের সংখ্যা ৮ লাখ ৫০ হাজার। বিবিএস বলছে, শ্রমশক্তিতে এখন ৭ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আছেন। তাদের মধ্যে ৭ কোটি ১১ লাখ ৬০ হাজার লোক কর্মে নিয়োজিত। বাকিরা বেকার। এ ছাড়া শ্রমশক্তির বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী আছে। তারা কর্মে নিয়োজিত নয়, আবার বেকার হিসেবেও বিবেচিত নয়। এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ৬০ হাজার। তারা মূলত সাধারণ ছাত্র, অসুস্থ ব্যক্তি, বয়স্ক নারী-পুরুষ, কাজ করতে অক্ষম ব্যক্তি, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং কর্মে নিয়োজিত নন বা নিয়োজিত হতে অনিচ্ছুক গৃহিণী। সর্বশেষ জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী কর্মসংস্থান বেশি কৃষিতে। বিবিএসের হিসাবে, জানুয়ারি-মার্চ মাস শেষে কৃষি খাতে কাজ করেন ৩ কোটি ১৮ লাখ ৩০ হাজার। শিল্প খাতে এ সংখ্যা ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার আর সেবা খাতে ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮০ হাজার। গত ডিসেম্বর শেষে কৃষি খাতে ছিল ৩ কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ, শিল্পে ১ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার আর সেবা খাতে ছিল ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার।

উচ্চশিক্ষিতরা মনমতো কাজ না পেলে নিজেদের বেকার হিসেবে পরিচয় দেন। যেমন স্নাতকোত্তর পাস করে ভালো চাকরির অপেক্ষা করছেন, এই সময় হয়তো টিউশনি করেন কিংবা অস্থায়ী চাকরি করছেন যেমন চিকিৎসকদের অনেকেই সম্মানীর বিনিময়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন অথচ জরিপের সময় তাদের অনেকেই নিজেদের বেকার হিসেবে গণ্য করেন। এ হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে। সপ্তাহে এক ঘণ্টার মজুরি এই মূল্যস্ফীতির যুগে জীবনধারণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তবে নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠীও আছে। তারা শিক্ষায় নেই, প্রশিক্ষণে নেই, আবার কাজের মধ্যেও নেই। বেকারত্ব নিয়ে বিবিএস যে সংখ্যা উল্লেখ করেছে, তা বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ প্রতি বছর চার-পাঁচ লাখ তরুণ-তরুণী স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হন। তাদের ৫০-৬০ শতাংশকে গড়ে দু-তিন বছর বেকার থাকতে হয়। সে অনুযায়ী কর্মসংস্থান না হওয়ায় প্রতি বছর বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। আরও উল্লেখ্য যে এক বছরের বেশি সময় ধরে অর্থনীতিতে এক ধরনের সংকট চলছে, ছোট-বড় সব ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকর্মী ছাঁটাই করছে এবং ছাঁটাই করা কর্মীদেরও বসে থাকতে হয় কিংবা আগের চেয়ে কম বেতনে চাকরি নিতে হয়। শিক্ষিত বেকারত্ব পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি হবে এমন সম্ভাবনাও নেই। আবার কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ পরিবেশেও এক ধরনের স্থবিরতা আছে এবং বিনিয়োগ প্রস্তাবও ৩০ শতাংশের মতো কমে গেছে। এখন অর্থনীতিতে এক ধরনের কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে, শোভন কাজের সুযোগ বাড়াতে হবে এবং শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে হবে। বাসাবাড়িতে নারীরা সংসারের নানা কাজ করেন; কিন্তু মজুরি পান না, এমন অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম কমে আসছে যেমন- ২০১০ সালে ৯১ লাখ নারী এমন মজুরহীন পারিবারিক কাজ করতেন। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, এই সংখ্যা ৩১ লাখে নেমে এসেছে। এক যুগের ব্যবধানে এই সংখ্যা ৬০ লাখ কমেছে, যা শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। ২০১০ সালে ১ কোটি ৭২ লাখ নারী শ্রমশক্তিতে ছিলেন যা এখন তা বেড়ে ২ কোটি ৫৮ লাখ হয়েছে। দেশে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয় মাত্র ১৫ দশমিক ১ শতাংশ, বাকি প্রায় ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান হয়। যেখানে কোনো চাকরির নিশ্চয়তা নেই, কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না এবং যেকোনো সময় মালিকপক্ষ চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দেয়। বিবিএস প্রণীত জরিপের ফলাফলগুলো আমাদের শ্রম বাজারের বিশ্লেষণের জন্য উপাদান যোগান দেবে। এর মাধ্যমে সরকারের নেওয়া কর্মসূচিগুলোর অগ্রগতিও পর্যবেক্ষণ করা যাবে। এই জরিপে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলো শ্রম বাজার উন্নয়নের চিত্রের প্রতিফলন ঘটায়। এসব তথ্য নীতি-নির্ধারক, পরিকল্পনাবিদ, গবেষক ও অন্যান্য ব্যবহারকারীরা ব্যবহার করতে পারবে। কার্যকর পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ জরিপের তথ্য।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি


তীব্র তাপপ্রবাহের স্মৃতি তালপাতার পাখা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে আর গরমের সময়ে সবার হাতে হাতে থাকত তালপাতার পাখা। সে তো ১৯৬০-এর দশকের কথা। তখন থাকতাম বলেশ্বর নদীতীরের ছোট্ট শহর পিরোজপুরে। সেই যুগে পিরোজপুরে ছিল না বিদ্যুৎ। তাহলে বৈদ্যুতিক পাখা আশা করা দুরাশা নয় কি!

তখন তো আমরা জানতাম না বিদ্যুৎ আর বৈদ্যুতিক পাখা দেখতে কেমন। বৈদ্যুতিক পাখা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের আলোচনা হতোই না। সবার মুখে মুখে ছিল তালপাতার পাখা। পড়ার সময়ে কিংবা ঘুমানোর সময় সবার হাতে হাতে ছিল তালপাতার পাখা। অতিরিক্ত গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তালপাতার পাখার বিকল্প ছিল না তখন।

আহারে আহারে কই গেল, কই গেল তালপাতার পাখা। প্রচণ্ড গরমে প্রাণ জুড়াতো তালপাতার পাখার হাওয়ায়। আবার ওই পাখা যাতে চটপট ভেঙে না যায় সে জন্য দাদি-নানি, মা-খালারা শাড়ির পাড় দিয়ে গোল করে ঢাকনা পরাতেন। পাখার গায়ে নানান কলকা ও ছবি আঁকা থাকত। মহিলা মহলে দুপুরের পান খাওয়ার সময় পাখার যেমন চাহিদা ছিল, তেমন আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসর শোনার সময়ে আমরা তালপাতার পাখা ব্যবহার করতাম বাতাস খাওয়ার আশায়। অনেক রমণীদের কাছে শোয়ার বিছানায় তালপাতার পাখা ছিল সতীনের মতো আরেক সঙ্গী। এই সতীনকে বড় সোহাগ করে স্বামীর হাতের পাশেই রাখতে হতো। গরমকালে তালপাতার পাখার চাহিদা ছিল অনেক বেশি। ধনী-গরিব সবার ঘরে ঘরে তালপাতার হাতপাখা দেখা যেত।

হাতপাখাকে কেন্দ্র করে গ্রাম-গঞ্জের প্রবাদবাক্য- রাতে পাখা করতে নেই। কারণ সে সময়ে গ্রামগঞ্জে বিদ্যুৎব্যবস্থা ছিল না, রেড়ির তেলে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপের আলোয় আমরা পড়াশোনা করতাম। পাখায় হাওয়া করলেই প্রদীপ নিভে যেত। রোদে চাষিরা যখন মাঠে কাজ করতেন, তার বউ মাঠে পান্তাভাত নিয়ে যেতেন, সঙ্গে নিতেন তালপাতার পাখার পাখা। মাঠে পাখা দিয়ে বাতাস করতেন। মাঠ-বিলে কৃষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে প্রচণ্ড গরম থেকে আরাম পেতে তালপাতার পাখার ফুরফুরে বাতাসে দেহ-মনে স্বস্তি পেতেন। তখন তালপাতার পাখার বিভিন্ন নাম ছিল, যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, পালংপোষ, মনসুন্দরী ইত্যাদি। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে, কবে সেই গ্রামে দেখেছি ঘরের মেঝেতে বসে চাষি ভাত খাওয়ার সময় তার বউ হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।

রাজা, বাদশাহ, জমিদার আমলে রাজসিংহাসনের দু’পাশে দুজন বড় বড় হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর ধীর লয়ে বাতাস করতেন। এ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বাড়িতে নতুন জামাই বা অতিথি এলে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা হতো। তালপাতার হাতপাখা গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক; কিন্তু এখন আর দেখা যায় না হাতপাখা তৈরির কারিগর। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বৈদ্যুতিক পাখার অহরহ ব্যবহারে তালপাতার পাখা বোনার চাহিদা প্রায় লুপ্ত হয়েছে। কালের স্রোতে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হাতপাখা আজ বিলুপ্তপ্রায়। আর গ্রাম থেকে উবে গেছে সারি সারি তালগাছ।

আজও খুব করে মনে পড়ে, পিরোজপুর শহরের বলেশ্বর নদীর তীরে ছিল লাইন ধরে শত শত তালগাছ। সেই তালগাছগুলো আজ কোথায়? বাংলাদেশ থেকে তালগাছ বিলুপ্ত হলে তালপাতার পাখা আসবে কোথা থেকে? তালপাতার পাখার চল উঠে গেছে, অথচ এক সময়ে গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েরা তালপাতার পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। দেশে এমনিতেই বেকারের অভাব নেই। সেই অবস্থায় তালগাছ কেটে কেটে উজাড় করে দিয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়াল কারা? তালগাছ ছিল, কিছু ছেলেমেয়েরা তালপাতার বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। এই জীবিকাকর্মীদের পেটের ওপর কে লাথি মারল- যারা তালগাছ কেটে উজাড় করেছে, তারা নয় কী? ইন্ধনদাতাই বা কারা?

হাতপাখা শিল্পও আজ শেষ। বেকারদের সংখ্যাও তাই আজ দিন দিন ভারী হচ্ছে। বিশাল নগরী ঢাকার দুই দুইটি এলাকার নাম তালতলা। একটি খিলগাঁওয়ের দিকে আর অন্যটি হলো আগারগাঁওয়ের কাছে। শত বছর আগে এই দুই জায়গায় ছিল তালগাছ আর তালগাছ। হাজার হাজার তালগাছ শহীদ করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। কোথাও তালগাছের দেখা নেই- তবু জায়গার নাম থেকে কেউ মুছে দিতে পারেনি ‘তালতলা’।

আমাদের বাংলাদেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তালগাছ লাগানোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে পারেন। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি তালরস সংগ্রহকারীদের জন্য এক বিমা-প্রকল্প ঘোষণা করতে পারেন। তাহলে অনেকেই তালগাছ লাগানো এবং এর চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আমাদের দেশে তালগাছকে নিয়ে সেভাবে চিন্তাভাবনা হয়নি- হতে দেখা বা শোনাও যাচ্ছে না। কৃষি দপ্তর আছে বলে জানি। বিষয়টি তাদের ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: চিঠিপত্র গবেষক ও পরিবেশবিদ


বাজেট ও মুদ্রানীতির সমন্বয় নিশ্চিতকরণ জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. আতিউর রহমান

আসছে জুনে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট। এটি হবে সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। আগামী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক ভিত্তি বছর হিসেবে আসন্ন অর্থ বছরের বাজেট তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশি উচ্চমূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় পেশ হতে যাচ্ছে আগামী বাজেট। এ প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি এবারে মুখ্য বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। তাই বরাবর যে মাত্রায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ানো হয় এবার তা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই এবার সংকোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগপ্রবাহ অতটা বলশালী না হওয়ায় আমাদের প্রবৃদ্ধি মূলত নির্ভর করে সরকারি ব্যয়ের ওপর। কাজেই কাটছাঁটের বাজেট করলে প্রবৃদ্ধির চাকা তুলনামূলক কম গতিশীল থাকবে। এমনিতেই চলতি অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। ২০২৩-এর অক্টোবরে আইএমএফ চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করলেও এ বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে তা কমিয়ে ৫.৭ শতাংশ করেছে। এ অবস্থায় কাটছাঁটের বাজেট করলে আসছে অর্থ বছরেও প্রবৃদ্ধি খুব গতিশীল হবে না, এ কথা বলাই যায়। ভোগ ও বিনিয়োগ সংকোচনের কারণেই যে এমনটি আশঙ্কা করা হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

আসছে অর্থ বছরে যেহেতু তুলনামূলক সংকোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে, সেহেতু সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে বরাদ্দের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার সময়ও বাজেটপ্রণেতাদের বরাবরের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। তবে সম্পদ বরাদ্দের যথাযথ অগ্রাধিকার (বাজেটের ব্যয়ের দিক) নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্পদসমাবেশ অর্থাৎ বাজেটের আয়ের দিক নিয়েও একই রকম সংবেদনশীলতা কাম্য। বেশ কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর দিকে নীতি-মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছেন। জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারের আহরিত করের পরিমাণ ১০ শতাংশের নিচেই রয়ে যাচ্ছে। আসন্ন বাজেটে এ সংস্কারের প্রতিফলন ঘটার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের বহিঃঅর্থনীতি নিয়ে টানাপড়েনের কারণে আমদানি কমেছে। তাই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বহিঃঅর্থনীতির সংকটের কারণে মোটা দাগে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিই কমে এসেছে। এ কারণেও রাজস্ব আহরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থ বছরে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ পরিমাণ তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক অর্থ বছরগুলোর কোনোটিতেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। রাজস্ব আহরণের দক্ষতা বাড়াতে এ প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাইজেশনের যে কোনো বিকল্প নেই সে কথাটি বারবার সামনে আনছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অংশীজনরা। এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছেন। তারা ইলেকট্রনিকস টেক্সট ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ডিজিটাইজেশনকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া আরও দক্ষ করতে নেওয়া এনবিআরের এসব উদ্যোগ যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে ততই মঙ্গল।

বাংলাদেশের ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ থেকে ২০৪১ সময়ের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরোপিত কর ৩৩ শতাংশ কমানো গেলে ওই সময়ের ব্যবধানে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরকারের রাজস্ব ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে (যা জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশের সমান হবে)। শুধু তাই নয়- এর ফলে জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও ২.২ শতাংশে উন্নীত হবে (বর্তমানে ০.৩ শতাংশ)। দেখা যাচ্ছে, ঢালাওভাবে আরোপিত কর না বাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষ করছাড় দিয়েও রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব। করছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন খাতগুলো অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তা নিয়েও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

কর আহরণবিষয়ক অনুশীলনগুলোয় কিছু পরিবর্তন করে বিদ্যমান উৎসগুলো থেকেও আরও বেশি বেশি কর আদায় সম্ভব। যেমন- সিগারেটের দাম প্রতি বছর বাজেটে অল্প অল্প করে বাড়ানো হয়; কিন্তু তামাকবিরোধী গবেষকদের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষতিকারক পণ্যটির দাম এক ধাক্কায় অনেকখানি বাড়িয়ে তার থেকে কর আহরণ করলে একদিকে সিগারেটের ব্যবহার যেমন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে, অন্যদিকে সিগারেট বিক্রি থেকে আরও বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা কর পাওয়া সম্ভব। বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের নিজস্ব সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে আসছে অর্থ বছরে বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল একটি ব্যয় পরিকল্পনাই দরকার। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব এখানে তুলে ধরতে চাই।Ñ

০১) মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে জনগণ বিশেষত নিম্ন আয় শ্রেণির পরিবারগুলো সুরক্ষিত রাখাকেই প্রধানতম অগ্রাধিকার হিসেবে দেখতে হবে। ইতোমধ্যে ওএমএস কার্যক্রম এবং ১ কোটি পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহের উদ্যোগগুলো বিশেষ কার্যকর হয়েছে। এসব কর্মসূচির পরিধি বাড়ানো এবং এমন নতুন নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে (বিশেষত নগরাঞ্চলের জন্য) বেশি বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।

০২) জ্বালানির দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর প্রভাব বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে পড়েছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় বলা যায় নিশ্চিতভাবেই আসছে অর্থ বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামে অস্থিরতা থাকবে। জ্বালানির দাম খুব বেশি বেড়ে গেলে দরকারবোধে বাড়তি ভর্তুকি দেওয়ার জন্য কিছু সম্পদ বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। জনগণকে স্বস্তি দিতে এলপি গ্যাসে কিছু রাজস্ব ছাড়ের কথাও বিবেচনা করা যায়।

০৩) জ্বালানি কেনাকাটার জন্য আমরা বেশি মাত্রায় ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের গ্যারান্টর হিসেবে ভূমিকা রাখে। সরকার নিজে সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কেনা শুরু করলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কার্যক্রমও শুরু হওয়ার পথে। দেরিতে হলেও এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। পাশাপাশি সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রগুলো আরও প্রসারিত করার জন্য বাজেটারি উদ্যোগ নিতে হবে।

০৪) যেহেতু কৃষিই আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ, তাই বিভিন্ন কৃষি ইনপুটসে যতটা সম্ভব করছাড় দেওয়ার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়ার ধারাবাহিকতাও বজায় রাখতে হবে। কেননা কৃষিতে দেওয়া এ ভর্তুকি মূলত এক ধরনের গণমুখী বিনিয়োগ। কৃষির সুরক্ষায় নেওয়া বাজেটারি উদ্যোগগুলো দেশের কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তায়ও ভূমিকা রাখবে।

০৫) প্রবাসী আয়প্রবাহ বলশালী করার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দক্ষতা একটি বড় প্রতিবন্ধক। এ লক্ষ্যে প্রবাসগামী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বরাদ্দে বিশেষ মনোযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিখন ও প্রশিক্ষণে বাড়তি নীতি সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।

০৬) অবকাঠামোগত উন্নয়নে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংযমী হতেই হবে। তবে যেসব প্রকল্প দেশের শিল্পায়ন গতিশীল করবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে সেগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ বরাদ্দ দিতে হবে।

০৭) অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এবারের বাজেটে হয়তো করছাড় ও প্রণোদনার নানা দিক যৌক্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। নিঃসন্দেহে এমন সংস্কার কাম্য। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন এগুলোর ফলে দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত না হয়। বিশেষ করে ৭০০-র বেশি এমএফআই যে ছোটখাটো ঋণ দেয় তার এক-তৃতীয়াংশ যায় কৃষিতে। আরেকটি বড় অংশ যায় এমএসএমই খাতে। এর বেশির ভাগ সুবিধা পায় নারী ও প্রান্তিক উদ্যোক্তারাই। এমএফআইকেও তাই করারোপের প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখাই শ্রেয় হবে। এ খাতে করারোপ করলে গ্রামীণ ভোগ কমে যাবে। ভ্যাট আহরণও কমে যেতে পারে।

০৮) পুরো জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়টিকেই বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আগামী দিনের বাজেটগুলোয়। বাংলাদেশকে জলবায়ু তহবিলের ন্যায্য হিস্‌সা দিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা বিশেষভাবে আগ্রহী। তাই জাতীয় বাজেটে জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বেশি অগ্রাধিকার দিতে পারলে সে জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। বাজেটপ্রণেতাদের তাই প্রতিটি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যতটা সম্ভব জলবায়ু-সংবেদনশীল করে সাজাতে হবে।

সর্বোপরি বাজেট এবং মুদ্রানীতির একটি কার্যকর ও সময়োচিত সমন্বয় নিশ্চিত করার বিষয়ে সর্বোচ্চ নীতি-মনোযোগ নিশ্চিত করতেই হবে। কেননা বহিঃঅর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, রিজার্ভ ক্ষয়রোধ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, বিনিময় হারে ভারসাম্য রক্ষার মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকারের বাজেট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: অর্থনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর


বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি ও প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন প্রসঙ্গ 

আপডেটেড ১৩ মে, ২০২৪ ১৫:৫৫
মো. রহমত উল্লাহ্

‘গত ০৫ মে ২০২৪ তারিখ রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষক বদলি নীতিমালা ২০২৪’-এর খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। সভায় বদলি কার্যক্রম আপাতত বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ এতে অত্যন্ত আশাহত ও মর্মাহত হয়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা! এরূপ সিদ্ধান্তের প্রকাশিত কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের শূন্য পদে বদলির সুযোগ রাখলে আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। কেননা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/ গভর্নিং বডি। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমে বদলি শুরু করা আইনসম্মত নয়। এ কারণটির বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্ভবত অন্যান্য জটিলতার পাশাপাশি আইনি এ জটিলতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেই এমপিও নীতিমালা ২০২১-তে (ধারা ১২.২) বলা হয়েছে, ‘এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক/ প্রদর্শক/ প্রভাষকদের কোনো প্রতিষ্ঠানে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে সমপদে ও সমস্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয় নীতিমালা প্রণয়ন করে জনস্বার্থে আদেশ জারি করতে পারবে।’ লক্ষণীয়, এখানে ‘বদলি’ শব্দটির স্থলে ‘প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন’ লিখে এর জন্য পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। বদলি নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়নি!

এতে প্রতীয়মান হয়, বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, নেই। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে যেভাবে শিক্ষক-কর্মচারীরা এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের বিপরীতে বিধি মোতাবেক আবেদন করে যোগ্য বিবেচিত হলে নিয়োগ নিয়ে সে প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আসছিলেন এবং পরবর্তীতে এমপিও ট্রান্সফার ও সিনিয়ারিটি সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন এখনো সেরকম সুযোগ পাবেন। তদুপরি সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষক/প্রদর্শক/প্রভাষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ আরও সহজ ও সম্প্রসারিত করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে এমপিও নীতিমালায়।

অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের নিমিত্তে প্রকাশিত চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষকদের ‘বদলির’ বিকল্প ‘প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন’-এর ন্যূনতম সুযোগটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতেও বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অবাক ব্যাপার এই, একদিকে দেখা যাচ্ছে, এমপিও নীতিমালায় বলা হয়েছে এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য জনস্বার্থে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা। আর অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত নীতিমালা প্রণয়ন না করেই অর্থাৎ বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি না করেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের প্রচলিত ন্যূনতম সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে! বর্তমানে সব বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর বদলির খসড়া নীতিমালা স্থগিত এবং এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ! বিদ্যমান শিক্ষকদের বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ আর থাকল না! এমন অবস্থায় বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকরা অত্যন্ত আশাহত, মর্মাহত ও মনোকষ্টে নিমজ্জিত! শিক্ষকদের মন ভালো না থাকলে ভালো পাঠদানের কোনোই সম্ভাবনা থাকে না। শিক্ষকতা অত্যন্ত মননশীল কাজ।

বদলি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত না করে স্থগিত করার পিছনে সম্ভাব্য আইনি জটিলতা ছাড়াও অন্য যে কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো- বদলি শুরু হলে গ্রামপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে যা পূর্ণ করা কঠিন হবে। অর্থাৎ গ্রামের শিক্ষকরা বদলি হয়ে শহরে চলে যাবেন এবং গ্রামে কেউ নতুন করে নিয়োগ নিতে চাইবেন না। এটি সর্বক্ষেত্রে সর্বাংশে সঠিক নয়। বিষয়টি বদলি নীতিমালার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাছাড়া স্বল্প বেতনে সব বিষয়ের শিক্ষক শহরে এসে টিকে থাকতে পারবেন না। শহরের সব প্রতিষ্ঠানই যে অধিক সচ্ছল তাও নয়। তবে অধিক যোগ্য-দক্ষরা অধিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের জন্য ও বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করবেন নিয়োগ পাবেন ও বদলি হবেন এটাই স্বাভাবিক। তা না হলে অধিক যোগ্যরা আসবেন না ও থাকবেন না শিক্ষকতায়। মনে রাখতে হবে, বদলি সুবিধা হ্রাস করে বা যোগ্যতা শিথিল করে অথবা অন্য কোনো কৌশল করে তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষকতায় এনে ও ধরে রেখে অধিক যোগ্য নেতা-কর্মী, শ্রমিক, আমলা, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব নয়! কেননা, একজন কম যোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য বা অযোগ্য মানুষ। তাই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের সব শূন্যপদ (গ্রামের ও শহরের) অধিক যোগ্যদের দ্বারা পূর্ণ করাই দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির জন্য অধিক কল্যাণকর।

নিবন্ধনধারী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ বন্ধ করার পিছনে আলোচিত কারণগুলোর অন্যতম ছিল বিদ্যমান শিক্ষকদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হলে তাদের তুলনায় কম নম্বর প্রাপ্ত নিবন্ধনধারী বেকার প্রার্থীরা তাদের অধিক পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিলেকশন পান না অথবা তৎকালে আবেদনকৃত কোনো প্রতিষ্ঠানেই চাকরি পান না। আবার বিদ্যমান শিক্ষকরা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে চলে গেলে তাদের ছেড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদ থেকে যায়। অর্থাৎ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরেও একদিকে শূন্য পদ থেকে যায়, অন্যদিকে আবেদন করেও চাকরিপ্রার্থী বেকার থেকে যান! এমন অবস্থা কিন্তু নিবন্ধন পরীক্ষা শুরুর আগেও বিরাজমান ছিল। যখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করে নিয়োগ দিত তখনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকরা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আবেদন করে বিধি মোতাবেক নিয়োগ নিয়ে যোগদান করলে পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের পদ শূন্য হতো। পুনরায় সেই প্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিধি মোতাবেক নতুন লোক নিয়োগ করত। সেখানেও বিধি মোতাবেক অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক এসে যোগদান করলে তার ছেড়ে আসা প্রতিষ্ঠানে পদ শূন্য হতো। কোনো ক্ষেত্রে নতুনরা নিয়োগ পেলে বিদ্যমান শিক্ষকদের আগের পদ শূন্য হতো না। অর্থাৎ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পদ শূন্য হওয়া, শূন্য পদ নতুন/ফ্রেশ প্রার্থীর দ্বারা পূর্ণ হওয়া বা বিদ্যমান শিক্ষকদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে সে শিক্ষকের ছেড়ে আসা পদ শূন্য হওয়া এমন একটি বাস্তব প্রক্রিয়া সুদূর অতীত থেকেই সারা দেশে কার্যকর ছিল। সে প্রক্রিয়াটি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে চলমান ছিল বলে সবার দৃষ্টিগোচর হতো না। এখন এনটিআরসিএর মাধ্যমে সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ একসঙ্গে হচ্ছে বলে বিষয়টি বড় আকারে সবার দৃষ্টিতে এসেছে। অবশ্যই এ সমস্যার একটা অনুকূল সমাধান প্রয়োজন ছিল। কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন! যা বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের চরমভাবে মর্মাহত ও হতাশাগ্রস্ত করেছে। এটি কোনো দিক থেকেই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত হয়নি।

অথচ নিম্নলিখিত উপায়ে সহজেই সমাধান হতে পারে এ সমস্যার। যাতে এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের অধিক হারে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার সম্ভব হবে, নিবন্ধনধারী নতুন প্রার্থীদের অধিক হারে নিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সব শূন্য পদ পূর্ণ করা সম্ভব হবে, সর্বোপরি বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের বদলির চাহিদা আংশিক পূর্ণ হবে। তা হচ্ছে, বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে বিভক্ত করে প্রতিবছর বা প্রতিবার পৃথকভাবে সম্পন্ন করতে হবে দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রথমে প্রদান করতে হবে শুধুমাত্র নিবন্ধিত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। এ ক্ষেত্রে কোনো নতুন প্রার্থী আবেদন করতে পারবেন না। কেবল বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকরা আবেদন করতে পারবেন। এদের নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন সম্পন্ন করার পরবর্তীতে চিহ্নিত করতে হবে শূন্য পদ। সেই শূন্য পদে নতুনদের নিয়োগের জন্য প্রকাশ করতে হবে গণবিজ্ঞপ্তি। সে ক্ষেত্রে কোনো এমপিওভুক্ত শিক্ষক আবেদন করতে পারবেন না। শুধু নিবন্ধিত প্রার্থীরা আবেদন করবেন। নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে তাদের নিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান শূন্যপদগুলো পূর্ণ করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতি বছর বা প্রতিবার বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকদের পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য একটি এবং শুধু নিবন্ধিত প্রার্থীদের নতুন নিয়োগের জন্য একটি অর্থাৎ মোট দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে অবশ্যই অনেকাংশে পূর্ণ হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বদলিপ্রত্যাশী লাখ লাখ শিক্ষকের দাবি। সেই সঙ্গে নিয়োগ পাবেন অধিক সংখ্যক নতুন প্রার্থী এবং পূর্ণ হবে অধিক শূন্য পদ। এমনি দুই ভাগে নিয়োগ সম্পন্ন করতে গিয়ে যদি অধিক জনবল ও অধিক অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে তাহলে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আবেদনের ফি নতুন/বেকার প্রার্থীদের তুলনায় কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমার এ প্রস্তাবটি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে যখন অনেক পদ শূন্য থেকে গিয়েছিল এবং অনেক বেকার চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিল তখনো পরে একাধিক জাতীয় পত্রিকায় উপস্থাপন করেছিলাম। এর মধ্যে গত ১৪ আগস্ট ২০২১ তারিখে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘দুই ভাগে হোক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ’। সেটির পক্ষে ছিল ব্যাপক সমর্থন; কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আবেদন করার সুযোগ বন্ধ করে দিল চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি থেকেই। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতেও বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য দেওয়া হয়নি আবেদনের সুযোগ! তাই বিষয়টি আবারও আলোচনায় আনার তাগিদ অনুভব করলাম। তখন কেউ কেউ বলছিলেন, বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের পৃথক সুযোগ দেওয়া হলে তারা ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চলে যাবেন। ফলে নতুনদের ভালো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। হ্যাঁ সেটি অবাস্তব নয়। তবে এটিও স্বীকার করতে হবে, পুরাতন বা বিদ্যমান শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার ও প্রশিক্ষণের অবশ্যই একটা মূল্য আছে। সেটিকে যথাযথ মূল্যায়ন করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অধিক যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞরা অধিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের জন্য ও বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করবেন নিয়োগ পাবেন ও বদলি হবেন এটাই স্বাভাবিক। এ প্রক্রিয়া সচল থাকলে এক সময় নবীনরাও অভিজ্ঞ হবেন এবং অনুরূপ সুযোগ পাবেন। এনটিআরসিএ যখন শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তখন তো এমন কোনো শর্ত থাকে না যে, এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যারা শিক্ষক হবেন তারা যেহেতু নিজের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে নিয়োগ নেবেন সেহেতু ভবিষ্যতে আর ওই প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য কিংবা বদলি হওয়ার জন্য কোনোরূপ দাবি উত্থাপন করতে পারবেন না। তাহলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বা বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের দাবিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে কেন, হবে কেন বারবার? উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা না করে বন্ধ করা হলো কেন, হবে কেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ? মানুষ গড়ার কারিগরদের সুবিধা বাড়ানোর পরিবর্তে কমিয়ে, দুঃখ-কষ্ট কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে কীভাবে সম্ভব হবে কাঙ্ক্ষিত মানুষ গড়া?

যেহেতু আইনি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা যাচ্ছে না বিধায় এখন সাধারণ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না সেহেতু সব এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পারস্পরিক বদলির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া এবং শুধু নিবন্ধিত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিশেষ/পৃথক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের দুঃখ-কষ্ট সামান্য লাঘব করে পাঠদানে তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য আবারও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট


আসন্ন বাজেট ও করনীতি সংস্কার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রজত রায়

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিভিন্ন কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান কবে হবে তা অনিশ্চিত। ফলে আগামী বছরও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করাটা বেশ জটিল এবং বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।

বহু ক্ষেত্রেই আমরা উন্নতি করছি। আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার বেড়েছে, পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির বহু দিকের উন্নতি ঘটেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রের কিছু অংশ টগবগ করছে, প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য আর্থসামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও আয়বৈষম্য বেড়েছে। বেড়েছে ভোগবৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এতে প্রমাণ হয় দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাবের পরও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ছয় বছরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। তবে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মাসিক গড় পারিবারিক আয় ২০২২ সালে বেড়ে ৩২,৪২২ টাকায় পৌঁছায়। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপের তুলনায় এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৬ সালে মাসিক গড় আয় ছিল ১৫,৯৮৮ টাকা। আর ২০১০ সালে এ আয় ছিল আরও কম ১১,৪৭৯ টাকা। তবে আয়ের এ প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও তা হয়তো সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ দেশে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। যারা আয়ের নিম্নসীমায় আছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ আগের চেয়ে আরও কমে গেছে। দেশে আয়বৈষম্য এবং ভোগবৈষম্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমাজে আয়বৈষম্য নিরূপণের জন্য ব্যবহৃত হয় জিনি সূচক। জিনি সূচকের মান হতে পারে শূন্য থেকে এক। কোনো সমাজের সব সম্পদের মালিক একজনই হলে অন্য কারও হাতে কোনো সম্পদ না থাকলে সে সমাজে হবে চূড়ান্ত বৈষম্য ও এর জিনি সূচক হবে ‘এক’। বিপরীত দিকে, যে সমাজের সব সম্পদ সবার মধ্যে শতভাগ সমভাবে বণ্টন হয়ে থাকে সে সমাজের জিনি সূচক হবে ‘শূন্য’। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের মূল বিতর্কটি মূলত এর দ্বারা মানুষে মানুষে বৈষম্য বোঝাতে পারে না। ওইসিডি যথার্থই বলেছে, জিডিপি আয়ের পরিমাপ করে, তবে সমতা নয়, এটি সামাজিক সংহতি ও পরিবেশের মতো মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে।

জিডিপি হিসাব করা হয় তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে। মানুষের ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়, সরকারের ভোগ ব্যয় এবং স্থায়ী মূলধন নির্মাণ অর্থাৎ বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এই অর্থবর্ষে জিডিপিতে সরকারি ভোগ ব্যয়ের অনুপাতও বেড়েছে, স্থায়ী মূলধন নির্মাণের অনুপাতও বেড়েছে, কমে গিয়েছে ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়ের অনুপাত। মানুষের খরচের মাত্রা এখনো কোভিড-পূর্ব স্তরে পৌঁছায়নি।

জিডিপি বাড়ছে, অথচ মানুষের ভোগ ব্যয় সেই অনুপাতে বাড়ছে না কেন? তাহলে যারা বেশি খরচ করেন তাদের বদলে রোজগার গিয়েছে যারা বেশি সঞ্চয় করেন তাদের হাতে? বিষয়টা তাহলে কি এমন লোকের হাতে টাকা বেড়েছে, অন্যদের তুলনায় যাদের রোজগারের অনুপাতে ভোগ ব্যয় কম। তাহলে এমন লোক কারা? গরিব মানুষের যেহেতু রোজগার কম তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় চাল, ডাল, জামা, কাপড়, ওষুধ, যাতায়াত, লেখাপড়ায়। অর্থব্যবস্থা যদিবা ঘুরে দাঁড়ায় তবে সুফল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বদলে পৌঁছাচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে।

বাংলাদেশে গরিবদের আয় বৃদ্ধির হারের তুলনায় ধনীরা অনেক বেশি হারে আরও ধনী হয়েছেন। ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ। আর ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল কেবল ১ শতাংশ লোকের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হাতে ছিল ১৭ শতাংশ; কিন্তু বেশ কয়েকটি কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে। যেমন- দীর্ঘদিন ধরেই বাজেটের বড় ভাগ চলে ভর্তুকি আর পুরোনো ঋণ মেটাতে। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর খাতায় ক্রমবর্ধমান অনাদায়ী ঋণের পাহাড়। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়েনি। বাড়ছে সরকারের ঋণ। জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ও রাজস্ব আয়ের এ অসামঞ্জস্যতা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি মূল্যে জিডিপির মোট দেশজ উৎপাদনের আকার দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে কর আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশের কর-জিডিপির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যেমন নেপালের কর-জিডিপির হার হচ্ছে ২৩ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিযোগী ১০ দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে। অন্য দেশগুলো হচ্ছে শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ভারত, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। উল্লিখিত দেশগুলোতে এই হার ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশ।

কর-জিডিপির অনুপাত দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন দেশে কর আহরণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। কোনো দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বেশি হলে সম্পদ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বেশি বলে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত বেশ কয়েক বছর থেকে ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনেক অর্জন থাকলেও কর-জিডিপির অনুপাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আশাব্যঞ্জক নয়। তাহলে এর কারণ কি? এর প্রধান কারণ হলো দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে অব্যাহতি দেওয়া।

আমরা দেখতে পাচ্ছি কৃষি, পশু সম্পদ, মৎস্য, স্বাস্থ্য জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে পুরোপুরি ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। তৈরি পোশাক ছাড়াও বিদেশি পণ্যে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যে দেওয়া হয়েছে ভ্যাট ছাড়। এ ছাড়া ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় রয়েছে ওষুধের কাঁচামালসহ বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্য। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে স্থানীয় পর্যায়ে আহরিত ভ্যাটের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা যা গত অর্থ বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। সরকারের প্রতি ১০০ টাকার রাজস্ব আদায়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের খরচ সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের খরচ হয় ২১ পয়সা। এ খরচ ভারতে ৬০ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৭১ পয়সা, সিঙ্গাপুরে ৭৯ পয়সা, মালয়েশিয়ায় ১ টাকা, জার্মানিতে ১ টাকা ৫০ পয়সা এবং জাপানে ১ টাকা ৭০ পয়সা। তবে এটা ঠিক রাজস্ব খাতে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কমাতে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ইআরএফ তথ্য মোতাবেক, যদি সব কর যোগ্য ব্যক্তিরা আয়কর স্লাব অনুযায়ী কর প্রদান করে তাহলে জিডিপির অনুপাতে বর্তমানে ১ শতাংশ ব্যক্তি আয়কর বাড়িয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে। এ জন্য নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ এবং প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ।

আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নত দেশে যেতে হলে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২১ শতাংশ করতে হবে। আর এর উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসতে হবে। আবার করপোরেট কর জিডিপির অনুপাতে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে ২ লাখ ৭০ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ বা ৩০ হাজারের মতো কোম্পানি কর দেয়। এ ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারা কম কর দেন। সরকার অনেক খাত থেকে কর পাচ্ছে না। অপ্রচলিত খাতে প্রায় ৮০ ভাগ জনশক্তি কাজ করে। আর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা করের আওতার বাইরে আছে। এসব খাত থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারলে বৈষম্য দূর হবে। আবার আবাসন খাত এবং ফেসবুক, আমাজন ও ফুডপান্ডার মতো নতুন ব্যবসার প্রসার হচ্ছে সেখান থেকে সরকার কাঙ্ক্ষিত কর পায় না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মোতাবেক, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সব বিভাগ মোট ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। বাংলাদেশে কর আদায়ে তুলনামূলক খরচ কম হলেও কর দিতে গিয়ে কর দাতাদের অনেক সময়ই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আছে। তাই করদাতারা যেন সহজে ও নির্বিঘ্নে কর দিতে পারে সেদিকে এনবিআরের নজর দিতে হবে। বেশি সম্পদের মালিকদের বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর হিসেবে সারচার্জ আরও বাড়াতে হবে। গাড়ির মালিকদের ওপর বেশি পরিমাণে কর বহাল রাখতে হবে।

সকল পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি না দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যে শুধু ভ্যাট অব্যাহতি রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি উপকরণে পুরোপুরি ভ্যাট মুক্ত রাখতে হবে এবং শুধু কৃষিখাতে ভর্তুকি রাখা সমীচীন হবে। তাই করনীতি সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

বিষয়:

ডোনাল্ড লু আসছেন, রাজনীতিতে লুর হাওয়া ভাসছে

আপডেটেড ১২ মে, ২০২৪ ১৪:২৬
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আগামী মঙ্গলবার ঢাকায় আসছেন, বুধবার সফর শেষে দেশের উদ্দেশ্য যাত্রা করবেন। ১০ মে শুক্রবার তিনি ভারতে এসেছেন। ভারতের সফর শেষে শ্রীলঙ্কা যাবেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকায় আসবেন। ভারতে তার সফর নিয়ে গণমাধ্যম কিংবা সরকারি কোনো মহলে তেমন কোনো আলোচনা নেই। তিনি চেন্নাই সফর করছেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে কনসুলেট কর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন। ভারতীয় সরকারি কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সংবাদ কোনো ভারতীয় গণমাধ্যমে নেই। ভারতে এই মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচন চলছে। নির্বাচন চলাকালে ভারতে কোনো দেশের কে আসে, কে যায় তা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই সময় তেমন উচ্চপর্যায়ের কোনো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নেতা ভারতে আমন্ত্রিতও হন না। ডোনাল্ড লু ভারতের দৃষ্টিতে কোন পর্যায়ের মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা-তার অবস্থান দেখেই বোঝা যায়। ডোনাল্ড লু এখনো বাংলাদেশে এসে পৌঁছাননি এরই মধ্যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ অনেক ক্ষেত্রেই লু (উত্তপ্ত) হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিরোধীদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস, স্বস্তি এবং মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কানাঘুষোও প্রচার করতে শোনা যাচ্ছে, তথাকথিত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও কারও কারও সাজগোজের প্রস্তুতি নেওয়ার আয়োজন ভেতরে ভেতরে চলছে। ডোনাল্ড লু শ্রীলঙ্কাতে বেশ সমাদর পাবেন- তেমনটি গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে বোঝা যাচ্ছে। সেখানে অর্থনৈতিক সংকট থাকায় সরকার এবং বিভিন্ন মহলের সঙ্গে তার নানা ধরনের বৈঠক হবে বলেও জানা গেছে। সে দেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গেও তার কথাবার্তা হবে। অবশ্য ভারতের নাগরিক সমাজ ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বৈঠকে বসেনি- তেমন খবর সে দেশের গণমাধ্যমে কেন দিতে পারছে না সেটি বোঝা গেল না!

ডোনাল্ড লু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঢাকায় তিনবার সফর করে গেছেন। যদিও তখন বলা হয়েছিল তিনি রোহিঙ্গা বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে ঢাকা সফর করেছিলেন। তবে সেই সময়ে তিনি বা অন্য মার্কিন প্রতিনিধিদের ঢাকা সফরের উদ্দেশ্য সবারই জানার বিষয় ছিল। মূলত যুক্তরাষ্ট্র যে একটি মুক্ত, অবাধ ও সমৃদ্ধ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দেখতে চায়, তাতে বাংলাদেশকে যুক্ত করাই এবং এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য সেটি সবারই জানার বিষয়। এতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে বলয় বৃদ্ধি পায় এটি সহজেই অনুমেয়; কিন্তু বাংলাদেশ ‘কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এমন পররাষ্ট্রনীতিতে অটল রয়েছে। বাংলাদেশের এই নীতি খুবই পরীক্ষিত। এ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে শেখ হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধুর বিঘোষিত নীতির কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। সে কারণেই কোনো দেশ এখনো পর্যন্ত প্রশ্ন তুলতে পারেনি যে শেখ হাসিনা শাসনামলে বাংলাদেশ বড় কোনো শক্তির বলয়ের ভেতরে এক ইঞ্চিও প্রবেশ করেছে। আবার কোনো বড় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী কোনো আচরণেও লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সবার সঙ্গে বজায় রেখে চলার যে দক্ষতা দেখাতে পেরেছে সেটি একমাত্র সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার সাহস, দৃঢ়তা এবং দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। বৃহৎ কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মাখামাখি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হচ্ছে অন্যদের সঙ্গে শত্রুতা বাড়ানো। বাংলাদেশের সেটি একেবারেই প্রয়োজন নেই বরং সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ বৃদ্ধি করা বাংলাদেশের জন্য এই পর্বে সবচেয়ে জরুরি বিষয়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ, পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনবসতির দেশ। আমাদের বিপুল এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু সেটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছাড়া মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করা মোটেও সম্ভব নয়। সে জন্যই আমাদের প্রয়োজন সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে টাল-মাটাল বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজেদের রক্ষা করার স্বার্থে এগিয়ে চলা। শেখ হাসিনার সরকারই এই নীতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার নীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে নানাভাবে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব বাস্তবতাই তুলে ধরেছে; কিন্তু তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা ছাড়ছে না, বাংলাদশও তার নীতি ও অবস্থানের পরিবর্তন করছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে- সেটি তাদের হিসাব-নিকাশের ব্যাপার; কিন্তু বাংলাদেশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন কেন, ছোট কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেও বৃহৎ রাষ্ট্রের কোনো বলয়ে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আমলে নিতে চায় না। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে চীনের টানাপড়েন সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চীন এবং ভারতের সঙ্গে চমৎকার ভারসাম্যমূলক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। সে কারণে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো ধরনের চাপ কখনো দিচ্ছে না, উভয় দেশের মধ্যে এ ব্যাপারে চমৎকার আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবকিছু জেনে-শুনেও বারবার বাংলাদেশকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কাছে টানতে চাইছে। সেই চাওয়ার অবস্থান থেকেই মার্কিনীরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। গত নির্বাচনের আগে বিষয়টি তারা মোটেও গোপন রাখতে পারেনি। তাদের একপক্ষীয় অবস্থান ও আচরণ দেশে-বিদেশে বড় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল-সেটি প্রকাশ্যেই সবাই দেখেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বড় বড় দেশগুলোর এভাবে বাগ-বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করেছে এবং এর বিরোধিতা করেছে। তবে যেহেতু দেশে কোনো বিষয় নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য নেই, তাই সরকার খুব কঠোরভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে খুব এগিয়ে থাকে তা তাদের আচরণ, কথাবার্তা, সরকারবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদির মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে থাকে, সেটি গত বছর কে না দেখেছে? ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডে হাসের ভূমিকা তখন কতটা কূটনৈতিক নরমস বহির্ভূত ছিল তা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়েছিল; কিন্তু আমাদের সমাজে আন্তর্জাতিক নরমস মেনে চলার বিষয়টি অনেকের মধ্যেই যথেস্ট দুর্বলভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, ভোজ সভায় মিলিত হতে অথবা দেশের সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অথবা পক্ষে কথা বলতে কতটা যে মুখিয়ে থাকেন সেটি গত বছর দেখা গেছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বলে যারা নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তারা কিসের ভিত্তিতে এই অধিকার চর্চা করেন তা মোটেও বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই দুর্বলতার সুযোগ কোনো কোনো দেশ নিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ভারতে কোনো রাজনৈতিক দলই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলেন না, অভিযোগও করেন না। সে দেশের নাগরিক সমাজও একই নীতি অনুসরণ করেন। শ্রীলঙ্কায় আগে বিদেশিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল কি না জানিনা, তবে এখন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের ওঠাবসার বিষয়টি ঘটেছে কি না বলা মুশকিল। আমাদের এখানে স্বাধীনতার পর থেকেই গোপনে অনেকেই যে বিদেশি দূতাবাসে যাতায়াত করতেন, ষড়যন্ত্রও করতেন এ সম্পর্কে বেশ কিছু বই-পুস্তকে বিস্তর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্যেই বিষয়টি ঘটছে। তবে তাদের আলোচনার সব বিষয়বস্তুই জানা যায় না। সেখানেই সমস্যার রহস্য আবৃত থাকছে!

ঢাকায় ডোলান্ড লু মঙ্গলবার আসার পর সরকারি কর্মকর্তা এবং নাগরিক সমাজের নেতারাসহ অন্যান্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরকরণসহ মার্কিন-বাংলাদেশ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। বিএনপি ডোলান্ড লুর এই সফরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে। যদিও বিএনপির কোনো নেতার সঙ্গে লুর বৈঠক হবে কি না তা উচ্চপর্যায়ের কোনো নেতাই বলতে পারেননি। তবে বিএনপি নেতাদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর কিছু বক্তব্যকে নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহের জাল বিস্তার করছে বলে প্রচার করছে। তাদের ধারণা লু মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন- যার কোনো তথ্য ভিত্তি নেই। তা ছাড়া এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে নির্বাচনী ঝড় এবং ছাত্র আন্দোলনের ঘূর্ণিঝড়। ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে সারা বিশ্বেই যখন বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিস্তৃত হচ্ছে তখন সে দেশের একজন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ বাংলাদেশে এসে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এমন চাপ সৃষ্টির কথা কল্পনা করতে পারার কথা নয়। তা ছাড়া ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীদের ঢাকায় মহাসমাবেশের শেষ দিকে আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়দানকারী মিয়া আরেফীর সংবাদ সম্মেলনের নাটক যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। ভুয়া এই উপদেষ্টা কোনো না কোনো মহলের বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই সেদিন রাজনীতির মঞ্চে বক্তৃতা দিতে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। মিয়া সাহেব তখন আটক হয়ে জেলে গেছেন, তিনি এখন কোথায় আছেন তা গণমাধ্যমেও জানা যাচ্ছে না। তবে এসব যে বাংলাদেশে তখন বড় ধরনের সংঘর্ষ তৈরিতে কাজে লাগানো হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং ২৮ অক্টোবর পরবর্তী বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, অগ্নিসংযোগ ও প্রতিহত করা নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে আদর্শিক, গণতান্ত্রিক নির্বাচন করার প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রেরও দেখার আশা করা সম্ভব নয়। তারপরও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এড়িয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন যেতে পেরেছে তা মোটেও হালকা করে দেখার বিষয় নয়। বিরোধীরা নির্বাচনকে কলঙ্কিত এবং প্রশ্নবোধক করার লক্ষ্যেই অবস্থান করছে; কিন্তু এটি বিএনপির জন্য এখন মোটেও সুখের হচ্ছে না তা বুঝতে পেরেই তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের স্বপ্ন দেখতে চাইছে। সেই চাপ সরকারের ওপর প্রয়োগ করতে তারা আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সওয়ার হতে চাচ্ছে। তবে সেই আশায় বোধ হয় না ডোলান্ড লু কোনো হাওয়া দিয়ে যেতে চাইবেন।

লেখক: ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


শুভ জন্মদিন

বাংলা ধারাভাষ্যের মহীরুহ চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইসমাইল হোসেন মিলন

আদি ও অকৃত্রিম বাঙালিয়ানায় ভরা একজন মানুষ যখন কমেন্ট্রি বক্সে ভরাট, গম্ভীর, সুললিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, আসসালামু আলাইকুম চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত বলছি। ঠিক তখনই বেতারে কান পাতা আপামর খেলাপ্রেমী বাঙালি আবিষ্ট হয়, যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবন্ত একটি মাঠ… উদ্বেল হয়ে ওঠে গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ (১৯৯৭)। বাংলা ধারাভাষ্যের সেই মহীরুহ হলেন চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।

ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় তার নিখুঁত বাংলা আলংকারিক শব্দচয়ন, ব্যতিক্রমধর্মী কণ্ঠস্বর ইথারে ভেসে শিহরণ জাগায় আপামর বাংলাভাষীকে। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন মানুষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় জন্ম বলে এই খেলাটি সরাসরি বা টিভিতে দেখার সুযোগ না হলেও শুধু রেডিওতে যার জাদুকরী কণ্ঠের কিছু কথামালা শুনেই এই ‘ক্রিকেট’ নামক অচেনা খেলাটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম এবং ধারাভাষ্যকার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই জাদুকরী কণ্ঠের মানুষটিই বাংলাদেশ ক্রিকেট অঙ্গনের সবার পরিচিত নাম ও মুখ- চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।

এখনো রেডিও কিংবা টিভির পর্দায় যার জাদুকরী কণ্ঠের ধারাভাষ্যে ক্রিকেটীয় উন্মাদনায় মাতোয়ারা হয় গ্রামগঞ্জ-শহর-বন্দরের লাখ লাখ বাঙালি।

আজ কিংবদন্তিতুল্য এই মানুষটির জন্মদিন। জন্মদিনে প্রিয় মানুষটির প্রতি রইল অফুরন্ত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা। ক্রিকেট পাগল এই জাতিকে আরও দীর্ঘদিন আপনার কণ্ঠের জাদুতে ক্রিকেটীয় উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখুন সেই শুভ কামনায়- শুভ জন্মদিন জাফরউল্লাহ শারাফাত।


বঙ্গবন্ধুর ভাবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। এ দুই মহাপুরুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড ছিল বাংলা ও বাঙালির অপরিসীম প্রেম। বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন একজন সাহিত্য দিয়ে, অন্যজন রাজনীতি দিয়ে। ‘বাঙালি’ বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে জাতিকেই আবিষ্কার করেন ‘সোনার বাংলায়’। যে বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,’ বঙ্গবন্ধু সেটিকে ভালোবেসে জাতীয় সংগীতে রূপ দেন।

শেখ হাসিনা তার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে অবহিত করেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানায় বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন; কিন্তু আমার মায়ের অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাড শয়ের কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।...মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কি না। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মায়ের সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল।...আমার খুবই কষ্ট হয় ওই বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ মুজিব আমার পিতা, পৃ: ৭০ ও ৭১)।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও তার সহকর্মী মাজহারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, রুশ লেখক আইজ্যাক অ্যাসিমভ, তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখকদের সম্মেলনে যোগদান করেছেন, লাহোরে কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি ‘জাভেদ মঞ্জিল’-এ অবস্থান করেছেন। তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে করাচি অভিমুখে যাত্রাকালে তিনি সহযাত্রী কয়েকজন কৌঁসূলিকে কাজী নজরুল ইসলামের কিছু কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাংশ আবৃত্তি করে শোনান। বাংলা ভাষার দিগন্তকে বিস্তৃত করার জন্য বিশ্বকবির অবদানকে বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করতেন। চীনে ভ্রমণকালে তিনি তার উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ২২৮)

স্বদেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি যেমন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি বৈশ্বিকপর্যায়ে বাংলা ভাষার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব উন্মোচনে তিনি ছিলেন অতি উদ্যমী। ১৯৫২ সালে পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু ও ভারতের ঔপন্যাসিক মনোজ বসু বাংলায় বক্তব্য উপস্থাপন করায় কৌতূহলী অনেক শ্রোতাকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে উত্তর দান করেন তা স্মরণযোগ্য, ‘বাংলা ভাষা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা এ অনেকেই জানে। ঠাকুর দুনিয়ায় ‘ট্যাগোর’ নামে পরিচিত। যথেষ্ঠ সম্মান দুনিয়ার লোক তাকে করে।...পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ জন লোক এই ভাষায় কথা বলে এবং দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষার অন্যতম ভাষা বাংলা।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ: ৪৪)

বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট যে গান বাউল সুরে গীত হয় তা বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শিল্পী জাহিদুর রহিমের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনতে পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাহিদুর রহিম বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রায় নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশ করতেন। বঙ্গবন্ধু ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, ‘সুপ্রভাত’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’, ‘দুই বিঘা জমি’ প্রভৃতি কবিতা যেমন আবৃত্তি করতেন, তেমনি গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথের গানও গাইতেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে বঙ্গবন্ধু কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গানসহ লোকসংগীত পরিবেশিত হয়। ডি এল রায় রচিত ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান হিসেবে অনুষ্ঠানে গীত হয়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য বঙ্গবন্ধু অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানিদের নিকট ‘সোনার বাংলা’র রূপমাধুর্য ও প্রীতি পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এ গানটি নির্বাচন করেছিলেন।

পাকিস্তানি সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাঙালি পালন করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এতে দেশে অসম্প্রদায়িক আন্দোলনের ধারা গতিশীল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার পর। তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ কীভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৬ সালের ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে। এই অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে, গানটির প্রতি ছিল তার আলাদা আবেগ।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়’। প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ দানাবেঁধে ওঠে। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘ক্ষমতাবলে হয়তো সাময়িকভাবে রেডিও ও টেলিভিশন হইতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার বন্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু গণচিত্ত হইতে রবীন্দ্রসংগীতের সুমধুর আবেদনকে কোনোকালেই মুছিয়া ফেলা যাইবে না।’

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই।’ (মুনতাসীর মামুন, পৃ: ২৯৬)

১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ঞধমড়ৎব যধফ ৎবভষবপঃবফ ঃযব যড়ঢ়বং ধহফ ধংঢ়রৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব সরষষরড়হং ড়ভ ইবহমধষরবং ঃযৎড়ঁময যরং ড়িৎশং. ডরঃযড়ঁঃ যরস ঃযব ইবহমধষর খধহমঁধমব ধিং রহপড়সঢ়ষবঃব (ঞযব চধশরংঃধহ ঞরসবং, ১৭.১২.১৯৬৯). রবীন্দ্রসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সমধিক গুরুত্বারোপ করে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে রবীন্দ্র-রচনাবলি প্রকাশের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু জানতেন, একটি জাতির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি দমিত হলে সে জাতি ক্রমান্বয়ে নির্মূল হয়ে পড়ে। তার ভাষায়, ‘একটি জাতিকে পঙ্গু ও পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা।’ তিনি শাহজাদপুরে অবস্থিত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ী সংরক্ষণের দাবি উত্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে কলিম শরাফী, জাহিদুর রহিম, আফসারী খানম, বিলকিস নাসির উদ্দীন ও রাখী চক্রবর্তী রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করেন বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ৩০০ ফুট দীর্ঘ এক সুবৃহৎ নৌকার অবয়বে তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিলেন ৬ দফা বাস্তবায়নই তাদের লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা সার্বজনীন। ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিককর্মী ধীরে ধীরে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুতি করছেন। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু শিক্ষার্থীদের জনসভায় রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর ২৩তম বার্ষিকী

উদ্‌যাপিত হয় ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে ঢাকার রমনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। রবীন্দ্র-নজরুলকে পাকিস্তানি শাসকরা বাদ দিতে চাইলে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না; কিন্তু এর ওপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয়, কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।’

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে কূটনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক এস ব্যাণার্জি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তার স্মৃতিচারণে জানা যায়, বিমানে বসে বঙ্গবন্ধু ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে শুরু করেন। এ সময় তার চোখে জল দেখেন ভারতীয় কূটনৈতিক। গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা উচিত বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মিস্টার ব্যানার্জিকে গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেন। তার ভাবনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন আর নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতও তিনি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন।

১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন। সেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’র বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে?

১২ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই জনৈক সাংবাদিক যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি?’ জবাবে চিরাচরিত হাস্যমুখে তিনি বলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ তিনি ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে রূপ দেন। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে আমার সোনার বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে।

বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছে, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন একাডেমির কর্মকর্তারা। তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালোবাসি তাকে-সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই।’

বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন এ দুজন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবী। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ এক বিশাল পরিপূর্ণ হৃদয় দিয়ে তিনি মানবকল্যাণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তার জীবনবোধের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন।

লেখক: পুলিশ সুপার নৌ পুলিশ, সিলেট অঞ্চল

বিষয়:

টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. জাহাঙ্গীর আলম

কৃষির ইংরেজি প্রতিশব্দ এগ্রিকালচার। শব্দটি ল্যাটিন এজারো এবং কালচারা শব্দদ্বয় দিয়ে গঠিত। এর আভিধানিক অর্থ মাটি কর্ষণ। বাংলা শব্দ কৃষি। শব্দার্থ অনুসারে শস্যের চাষ ও বৃক্ষরোপণ সরাসরিভাবে কৃষিকর্মের অন্তর্ভুক্ত। এর সঙ্গে পশুপাখি পালন ও মৎস্য চাষও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব, কৃষি খাত বলতে আমরা শস্য, মৎস্য, বন ও পশুপাখি উপখাতসমূহকে সমন্বিতভাবে বুঝে থাকি। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১২ শতাংশ। মোট রপ্তানিতে কৃষিজাত পণ্যের শরিকানা প্রায় ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে হিমায়িত মৎস্য ও পাটজাত দ্রব্য যোগ করা হলে মোট রপ্তানিতে কৃষির হিস্যা প্রায় ৭ শতাংশে বৃদ্ধি পায়। এখনো দেশের শতকরা ৪০ ভাগ শ্রমিক কৃষিখাতে নিয়োজিত। শিল্প ও সেবাখাতের অগ্রগতিও বহুলাংশে নির্ভরশীল কৃষিখাতের অগ্রগতির ওপর। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষিখাতের উন্নয়ন একান্তভাবে প্রয়োজন।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি খাত। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে খাদ্য আমদানি করা হতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমানে সে ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৫ শতাংশেরও নিচে। স্বাধীনতার পর দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টনের ওপরে। গত ৫২ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। যে কৃষকের আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল দৈনিক ৩ কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক-কারোরই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, গম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্যোৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতি বছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জনপ্রতি আমাদের খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল দৈনিক ৪৫৬ গ্রাম, ২০০০ সালে তা ৫২২ গ্রাম এবং ২০২০ সালে তা ৬৮৭ গ্রামে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ দ্রুত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষি খাতে। আগের খোরপোশ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপখাতে।

বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কৃষি খাতকে। রাসায়নিক সারের দাম দফায় দফায় কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে পাঁচ দফায় কমিয়ে ইউরিয়া সারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি কেজি ১৬ টাকায়। টিএসপি সারের দাম ৮০ টাকা থেকে কমিয়ে ২২ টাকায়, এমওপি সারের দাম ৭০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা, ডিএপি সারের দাম ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন তা কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ২৭ (ইউরিয়া), ২৭ (টিএসপি), ২০ (এমওপি) ও ২১ (ডিএপি) টাকায়।। গত ১৫ বছরে (২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩) শুধু সারেই ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। গত বছর তার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর চালু করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভর্তুকি। ৫০ শতাংশ (ক্ষেত্র বিশেষে ৭০ শতাংশ) ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি। মোট বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে কৃষি ভর্তুকি খাতে। তা ছাড়া দ্রুত হ্রাস করা হয়েছে কৃষিঋণের সুদের হার। এখন কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৯ শতাংশ। মসলা ফসলের জন্য তা ৪ শতাংশ। দুগ্ধখামার করার জন্য ৫ শতাংশ। পানি সেচের আওতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মোট আবাদি জমির ৭৪ শতাংশে। উচ্চফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানি জমি। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। ত্বরান্বিত হয়েছে খাদ্যনিরাপত্তা।

দানাদার খাদ্যশস্যের পর আলুর উৎপাদনে বিপুল উদ্বৃত্ত অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। দেশের মানুষের দৈনিক জনপ্রতি আলুর চাহিদা হচ্ছে ৭০ গ্রাম, প্রাপ্যতা অনেক বেশি। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে আমাদের আলুর মোট উৎপাদন ছিল প্রায় অর্ধকোটি টন। এখন তা ১ কোটি ৯ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে এখন আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। তাতে প্রতি বছর গড়ে আমাদের আয় হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তা ছাড়া আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে এর ব্যবহারও বহুমুখী হচ্ছে। আগে আলুর ব্যবহার হতো মূলত সবজি হিসেবে। এখন তা চিপস ও পটেটো ক্রেকার্স হিসেবেও অনেক সমাদৃত। বিদেশিদের মতো অনেক বাংলাদেশিও এখন মূল খাদ্য হিসেবে রোস্টেড পটেটো খেতে পছন্দ করেন। আলু উৎপাদনে গত ২০ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।

খাদ্যশস্যের আর একটি বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে সবজি উৎপাদনে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সবজি উৎপাদন প্রতি বছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও ভারতের পর বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মৌসুমের শুরুতে বাজারে সবজির দাম ভালো থাকায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানি সম্প্রসারিত হওয়ায় দেশের কৃষকরা এখন সবজি চাষে বেশ উৎসাহিত হচ্ছেন। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন আধুনিক সবজি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্বীয় উদ্যোগে এরা গড়ে তুলছেন সবজি খামার।

বাংলাদেশে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ফলের উৎপাদনে। বর্তমানে এ দেশে ফলের উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন। ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। গত ২ দশক ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে ১১ শতাংশের ওপরে। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। ২০০৬ সালে আমাদের মাথাপিছু দৈনিক ফল গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৫৫ গ্রাম, ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ গ্রামে। তাতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে আমাদের পুষ্টিহীনতা। বর্তমানে আমাদের দেশে আমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চিরায়তভাবে গড়ে ওঠা রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুরের বাগানগুলো ছাপিয়ে এখন প্রচুর আম উৎপাদিত হচ্ছে সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায়। তা ছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক ধানিজমি পরিণত হয়েছে আম বাগানে। অধিকন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে নতুন ফল স্ট্রবেরি। আরও চাষ করা হচ্ছে রাম্বুতান, ড্রাগন ফল ও অ্যাভোকেডো। মানুষ আপেলের পরিবর্তে বেশি করে খাচ্ছে কাজী পেয়ারা। তাতে বিদেশি ফলের আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সাশ্রয় হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা।

এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। দীর্ঘমেয়াদে এর আবাদি এলাকা কমেছে। তবে একরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। ২০১০ সালে পাটের জিন রহস্য উন্মোচনের ফলে এর উৎপাদন বৃদ্ধির পথ আরও সুগম হয়েছে। বিশ্ববাজারে এখন পাটের চাহিদা বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক করোনাকালেও পাটের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল বেশ চড়া। এখন দেশে কৃষকের খামারপ্রান্তে কাঁচা পাটের মূল্য ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা প্রতি মণ। এটা বেশ লাভজনক মূল্য। বর্তমানে দেশে পাটের উৎপাদন প্রতি বছর ৭৫ থেকে ৮৫ লাখ বেল। আগামীতে এর উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। অদূর ভবিষ্যতে আবার ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের পাটখাত।

কেবল শস্যখাতই নয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে কৃষির সব উপখাতেই বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এ দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ লাখ টনে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত মাছের হিস্যা মাত্র ১৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা প্রায় ২৮ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে এবং ৫৭ ভাগ আসে বদ্ধ জলাশয় থেকে। সামুদ্রিক মৎস্যের শতকরা প্রায় ৮২ ভাগ জোগান আসে আর্টিশনাল বা চিরায়ত আহরণ পদ্ধতির মাধ্যমে। আর বাকি ১৮ শতাংশ আসে ট্রলারকেন্দ্রিক শিল্পায়িত আহরণের মাধ্যমে। বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের হিস্যা হ্রাস পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ আহরণের হিস্যা বেড়েছে। এর কারণ, সামুদ্রিক আহরণের প্রবৃদ্ধির হার কম, অভ্যন্তরীণ আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে বদ্ধ জলাশয় তথা চাষাধীন জলাশয় থেকে আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি বিধায় মোট মৎস্য উৎপাদনে এ খাতের হিস্যা দ্রুত বেড়েছে। গত ৩৬ বছরে (১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত) অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে মৎস্য আহরণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২.৭, ৮.৫৭ এবং ৩.৯৪ শতাংশ। এ সময় মাছের মোট উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ৫ শতাংশ হারে। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য। এর পেছনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধিক উৎপাদনক্ষম মৎস্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গত ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রুইজাতীয় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঙ্গাশ, কৈ, শিং, মাগুর ও তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। তাতে অভ্যন্তরীণ পুকুর-দীঘিতে হেক্টরপ্রতি মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৫ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। মৎস্য খাতের উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- ইলিশের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া। ২০০৮-০৯ সালে ইলিশের মোট উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫ লাখ মেট্রিক টনে। নদীতে জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকরণ এবং ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন ও আকার আশাতীত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এ দেশে উৎপাদিত মোট মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনে দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক হিস্যা বাংলাদেশের রয়েছে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বিশ্ব দরবারে এর পরিচয় ‘বাংলাদেশ ইলিশ’ হিসেবে। এর ভৌগোলিক নিবন্ধন বা জিআই সনদ রয়েছে।

পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ এখন ডিম ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ম্ভর। দুগ্ধ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে যে হারে উৎপাদন বাড়ছে তাতে এর ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে অচিরেই। বর্তমানে (২০২১-২২ অর্থ বছরের তথ্যানুসারে) মাংসের উৎপাদন ৯২.৬৫ লাখ মেট্রিক টন। জনপ্রতি বার্ষিক প্রাপ্যতা ৫৪ কেজি। ডিমের উৎপাদন ২৩৩৫.৩৫ কোটি। বার্ষিক জনপ্রতি প্রাপ্যতা ১৩৬টি। দুধের উৎপাদন ১৩০.৭৪ লাখ মেট্রিক টন। জনপ্রতি বার্ষিক প্রাপ্যতা ৭৬ লিটার। তবে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশে মাংস, ডিম ও দুধের দাম বেশি। প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ হ্রাস করে ভোক্তাপর্যায়ে পশু-পাখি উপজাতের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন প্রযুক্তির ধারণ উৎসাহিত করা উচিত।

কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত বন। এ খাতে বৃক্ষের মোট আচ্ছাদিত এলাকা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৪ বছর আগে দেশের ৭-৮ শতাংশ এলাকা বৃক্ষাচ্ছাদিত বনভূমির আওতায় ছিল বলে ধরে নেওয়া হতো। এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৪৫ শতাংশে। উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী এবং গ্রামীণ কৃষি বনায়ন দেশের পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। বৃক্ষরাজী থেকে মানুষের পুষ্টি গ্রহণ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বনসম্পদের আরও দ্রুত সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক এগিয়েছে। ভূমি কর্ষণ, ফসল কর্তন ও মাড়াই, ধান ভানা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই এখন কায়িক শ্রমের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে। বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার। স্বাধীনতার পর ভূমি কর্ষণের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন করা হতো কাঠের লাঙল দিয়ে। ব্যবহার করা হতো পশুশক্তি। এখন পশুশক্তির ব্যবহার হ্রাস পেয়ে নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। বাকি ৯৫ শতাংশই আবাদ হচ্ছে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। ধান কাটা ও মাড়াই ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখন বেশ প্রচলিত। তবে তার পরিধি এখনো বেশ সীমিত। বর্তমানে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকিমূল্যে যন্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। হাওর, চরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি, ৭০ শতাংশ। তবে এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই কম। এটি বাছাইকৃতভাবে এখনো কার্যকর হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চলছে শ্রমিক সংকট। তাতে দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে শ্রমিকের মজুরি। তদুপরি ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে সময়ক্ষেপণ, অপচয় ও অদক্ষতার কারণে কৃষির উৎপাদনে লাভজনকতা হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত সম্প্রসারিত করা দরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্প্রতি ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয়েছে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’। ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে।

অধুনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্থায়িত্বশীল বা টেকসই কৃষি উন্নয়নের ওপর। কারণ কৃষি উৎপাদনের প্রধান ৩টি উপকরণ মাটি, পানি ও বায়ু সসীম। ইচ্ছে করলেই এদের সীমিত সরবরাহকে অসীম করা যাবে না। ভবিষ্যতে দ্রুত বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্যোৎপাদন করতে হবে; কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও পানির অভাব দারুণভাবে পরিলক্ষিত হবে। পৃথিবী পৃষ্ঠে বায়ুর অভাব আপাতত পরিলক্ষিত না হলেও জলবায়ুর উষ্ণায়ন আমাদের এক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কৃষির উৎপাদনে তা এক মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। সে কারণে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন বলতে এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যা ভবিষ্যতের জন্য সম্পদের মজুত অটুট রাখবে এবং তাতে প্রকৃতি ও এর কোনো অংশের বিনাশ সাধন করা হবে না। টেকসই উন্নয়ন মানুষের বর্তমান চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে; কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে তা সক্ষমতা ঘাটতির কোনো কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। টেকসই কৃষিব্যবস্থা বলতে এমন পরিবেশবান্ধব কৃষি কার্যক্রমকে বোঝায় যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ অক্ষুণ্ন রেখে মানুষের উৎপাদন চাহিদা মিটিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তাতে পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকবে। মানবগোষ্ঠী ও প্রাণিসম্পদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হবে।

টেকসই কৃষি উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল করা এবং সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করা টেকসই কৃষি উন্নয়নের আর একটি প্রধান লক্ষ্য। তা ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করা এবং বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা এর অন্য একটি লক্ষ্য। অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে আছে কৃষিজমিতে সবার অভিগম্যতা ও এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, শস্য ও প্রাণিসম্পদের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা, বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা এবং কৃষিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

কৃষির বিভিন্ন উপখাতে ক্রমাগতই উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে এবং তা টেকসই করতে হলে এ প্রবৃদ্ধির হার আরও গতিশীল করা দরকার। সে কারণে কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার। জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের হিস্যা বাড়ানো দরকার। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে কৃষি খাতের বাজেট বরাদ্দ ও ভর্তুকি হ্রাস পেয়েছে। এখন তা কিয়দাংশ বৃদ্ধি পেলেও স্থায়িত্বশীল কৃষি উন্নয়নের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এর পরিমাণ আরও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষির চিরায়ত উৎপাদনব্যবস্থাকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত করার জন্য পুঁজির সঞ্চার ঘটাতে হবে। তা ছাড়া কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপনে এবং এর বিপণনে বিশেষ সহায়তা প্রদান করতে হবে। কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমকে চিহ্নিত করতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের খাত হিসেবে।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ; পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস এবং প্রাক্তন উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।


গ্রীষ্মের দাবদাহ ও বৃক্ষরোপণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশকে সবুজায়নে অসম্ভব সাফল্য দেখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের দিকে।

গণতন্ত্রের মানসকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সারা দেশে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শোনা যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতির বিকল্প নেই- এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধু আগেই অনুধাবন করেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে সবুজায়ন, বনায়নের মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি উপকূলীয় এলাকায় সবুজায়ন করার উদ্যোগও বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজন পরিবেশ প্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে সব সময় পরিবেশের উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য দিতেন। এ সময়ে প্রচণ্ড দাবদাহের ফলে বঙ্গবন্ধুর এই সোনার বাংলায় চলছে দুর্বিষহ পরিস্থিতি।

গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, একবিন্দু পানির জন্য চারদিকে হাহাকার, জনহীন পথে মরীচিকার হাতছানি, তখন কবিগুরু প্রকৃতিকে বলছিলেন ‘তুমি কত নির্মম হবে হও সেই নির্মমতার সঙ্গেই হবে আমার মিলন।’ তাই তো কবিগুরু তার কবিতায় লিখেছেন-

‘নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।

খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা।।

যদি ঝরে পড়ে পড়ুক পাতা,

ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,

থাক জনহীন পথে পথে মরীচিকাজাল ফেলা।।

শুষ্ক ধূলায় খসে পড়া ফুলদলে

ঘূর্ণী- আঁচল উড়াও আকাশতলে।

প্রাণ যদি করো মরুসম

তবে তাই হোক- হে নির্মম,

তুমি একা আর আমি একা,

কঠোর মিলনমেলা।।’

এপ্রিল মাসজুড়ে সারা দেশে বয়ে গেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এবং মে মাসেও তা চলছে। এই তীব্র গরমে সুস্থ থাকার উপায় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খানের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনি বলেন, ‘হিমশীতল বা লু-হাওয়া যে তাপমাত্রাই হোক না কেন, মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া তার নিজের তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নির্দিষ্ট রাখতে চায়।

শরীরে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণেই কেবল মানুষ জাগতিক কাজকর্ম করে থাকে। কিন্তু সূর্যের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল তাপমাত্রা নির্দিষ্ট একটি মাত্রায় ঠাণ্ডা রাখার জন্য শরীরকে বাড়তি কাজ করতে হয়। এর ফলে ত্বকের কাছাকাছি রক্তবাহী ধমনিগুলো তীব্র তাপ চারপাশে ছড়িয়ে দিতে বেশি করে কাজ করতে শুরু করে, আর তখনই ঘাম হতে শুরু করে। শুনতে খুব সাধারণ শোনালেও, শরীরের জন্য ব্যাপারটি মোটেও সহজ নয়। যত গরম, মানব শরীরের জন্য তা সামলানো তত কঠিন। ত্বকের নিচের ধমনিগুলো যখন খুলে যেতে থাকে, তখন রক্তচাপ কমে যায় এবং হৃৎপিণ্ডের কাজ বাড়িয়ে দেয়। শরীরের সবখানে রক্ত পৌঁছে দিতে হৃৎপিণ্ডকে তখন দ্রুত পাম্প করতে হয়।

এর ফলে শরীরে হালকা র‍্যাশ বা দানা দেখা দিতে পারে, মানে ছোট ফুসকুড়ির মতো যা চুলকাতে পারে। অথবা কারও পা ফুলে যেতে পারে গরমে। কিন্তু রক্তচাপ বেশি কমে গেলে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। সেই বেশি ঘামের কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে। এই গরমে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া একেবারেই উচিত না। বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে রোদ এড়িয়ে চলে বাইরে বের হতে হলে যতটা সম্ভব ছাতা, টুপি বা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হবে। বিশেষ করে সুতির তৈরি হালকা রঙের পোশাক পরা ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা প্রয়োজন। সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং বাসি, খোলামেলা খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলা দরকার। তীব্র গরমে কাউকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখলে কী করা উচিত, সে বিষয়ে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ কিছু পরামর্শ দিয়েছে।

  • ঐ ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব ঠাণ্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
  • শুইয়ে দিতে হবে, এবং তার পা কিছুটা ওপরে তুলে দিতে হবে।
  • প্রচুর পানি বা পানীয় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, পানিশূন্যতা দূর করার পানীয় দেওয়া যেতে পারে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করতে হবে, ভেজা কাপড় বা স্পঞ্জ দিয়ে মুছে দেওয়া যেতে পারে পুরো শরীর।

বগলের নিচে এবং ঘাড়ে-গলায় ঠাণ্ডা পানি দেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু ৩০ মিনিটের মধ্যে যদি সুস্থ না হয়, তাহলে ঐ ব্যক্তির হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কালক্ষেপণ না করে তক্ষুনি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। হিটস্ট্রোক হলে মানুষের ঘেমে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সে ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ঐ ব্যক্তি।

এই গরমে সবারই একটু বুঝতে হবে, কাদের ঝুঁকি বেশি?

অতি গরমে স্বাস্থ্যবান মানুষের হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন।

শুরুতেই বয়স্ক, বৃদ্ধ এবং যাদের আগে থেকেই অসুস্থতা রয়েছে, তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে অনেকাংশে বেশি।

যাদের ডায়াবেটিস টাইপ ওয়ান বা টু রয়েছে, তাদের শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে এবং কিছু জটিলতা দেখা দেয়।

এ ছাড়া বাচ্চাদের খুব কষ্ট হয় বেশি গরমে।

অনেক সময় বাচ্চারা বা শিশুরা নিজেদের অস্বস্তির কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না, যে কারণে মা-বাবারা সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে পারেন না।

বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে তাপপ্রবাহের কারণে তীব্র গরম চলছে। আরও কয়েকদিন দেশে তীব্র গরম থাকবে জানিয়ে সম্প্রতি ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় গরমের তাপমাত্রা এর মধ্যেই রেকর্ড অতিক্রম করেছে।

প্রচণ্ড গরমের কারণে দেশের অনেক স্থানে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, এ রকম তীব্র গরমের সময় সতর্ক না থাকলে শারীরিক নানা সমস্যার পাশাপাশি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।

এই তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা পশুপাখিদেরও। তাদের ভয়াবহ করুণ পরিস্থিতি দেখা যায় চিড়িয়াখানায় গেলে, সেখানে দেখা যায় নেই বাঘের হুংকার, নেই বানরের লাফালাফি, হাতিদের খেলা, রোদের খরতাপে পাখিদের বেড়েছে অস্বস্তি, থেমেছে কলকাকলী, একত্রে চাঞ্চল্য হারিয়েছে যেন সব পশুপাখি, দর্শনার্থীর সংখ্যাও হাতে গোনা, দু-একটি ময়ূরের ডাক ছাড়া পুরো চিড়িয়াখানা জুড়েই লক্ষ করা যায় সর্বত্র বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।

এই সময়ে দেশের কোথাও কোথাও অল্পবিস্তর বৃষ্টিও হয়েছে, আবহাওয়াবিদরা আগাম বন্যারও আশঙ্কা করছেন।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষরাজি শুধু কার্বন নিঃসরণ কমায় না; শব্দদূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বনের জমি পাইকারি হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সবুজ গাছের সঙ্গে জীবশ্রেণির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রাণীর অস্তিত্ব বজায় রাখতে গাছ প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই স্থান-পরিক্রমায় জীবকুলের উপকারার্থে স্রষ্টা উদ্ভিদকুলকে বৈচিত্র্যময় করে সাজিয়েছেন। তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় পরস্পর নির্ভরশীল। অথচ এ দেশে প্রতিনিয়ত গাছ কর্তন করে শুধু মানুষরাই নিজেদের সব প্রাণিকুলের সর্বনাশ ডেকে আনছে। গাছ কাটা প্রতিরোধ করে মানুষের বসবাসে পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানোর বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়ে জানা যায়, সবাই ব্যাপক ভিত্তিতে সারা দেশে গাছ লাগানোর পক্ষে।

পরিবেশের দূষণ ও বিপর্যয় রোধে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। প্রকৃতি ও আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষার্থে গাছ লাগানো জরুরি।

এ কথা সত্য যে, গাছ মানুষের নিঃস্বার্থ ও উপকারী বন্ধু। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা জরিপ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৃক্ষ বা উদ্ভিদের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। এ দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে প্রতিনিয়ত নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে, যা পরিবেশের ওপর হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের আয়তনের অনুপাতে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সেই পরিমাণ বনভূমি এ দেশে নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। যদিও সরকারি হিসাবে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ বলা হয়ে থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জাতীয় ঐতিহ্য, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, ইত্যাদিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধ, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাসহ নৈসর্গিক শোভাবর্ধনে গাছের অসীম গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের প্রতি বছর বাড়ির আশপাশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা খোলা জায়গায় সাধ্যমতো ফলজ এবং ঔষধি গাছ লাগানো উচিত। তবেই আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশও ভালো থাকবে।

আমাদের ধর্মীয় দিক, অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা অনুসারে একজন মুমিন ও মুসলিম সর্বদা পরিবেশবান্ধব। যে ব্যক্তি অকারণে ছায়াযুক্ত গাছ কেটে ফেলে, তাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। আবদুল্লাহ বিন হুবশি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অকারণে একটি কুলগাছ কাটবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৫২৩৯)

আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ এবং বৈষম্য আমাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রখর সতর্কতা এবং পারিবারিকভাবে, শিক্ষাকেন্দ্রে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে আরও বেশি বৃক্ষরোপণ করার ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক


banner close