শনিবার, ১৮ মে ২০২৪

একজন জননেত্রীর বিশ্বনেত্রী হয়ে ওঠা

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত
দৈনিক বাংলা ডেস্ক
প্রকাশিত : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ১০:১১

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম পরিচয় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান। জন্মের পর থেকে তিনি বাবার সংগ্রামী জীবন, বাংলার জনগণের মুক্তির জন্য কারাবরণ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একজন রাজনীতিকের কঠিন জীবন বেছে নেয়ার প্রত্যয় দেখেছেন। একটা সময়ে বঙ্গবন্ধুর সেই আন্দোলন-সংগ্রামে শেখ হাসিনাও শামিল হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা এবং ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে শেখ হাসিনার ভূমিকা আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।

১৯৬৮ সালে পরমাণুবিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়াকে সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। এরপর তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে শেখ হাসিনা হয়তো কখনোই আর রাজনীতিতে আসতেন না। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা তার দুই সন্তান ও বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল জার্মানিতে বেড়াতে যান। ওয়াজেদ মিয়া ওই সময়ে কার্লসরুয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চে নিয়োজিত ছিলেন। ১৫ আগস্ট ভোরে তিনি ব্রাসেলসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কবি সানাউল হকের বাসায় ছিলেন। পরের দিন দেশের ক্ষমতা বদলের পর রাষ্ট্রদূতের অবস্থান সম্পূর্ণ বদলে যায়। সানাউল হক টেলিফোনে জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে বললেন, ‘এসব ঝামেলা আপনি আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি ওদের নিয়ে যান।’

এরপর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সহযোগিতায় শেখ হাসিনা ও রেহানা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে ২৫ আগস্ট জার্মানি থেকে নয়াদিল্লি যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার থাকার জন্য একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেন। একই সময়ে ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় পরমাণু কেন্দ্রে একটি চাকরি দেয়া হয়। পরিচয় গোপন করে অতিকষ্টে শেখ হাসিনা দিল্লিতে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ, সন্তান লালন-পালন, বাজার করা ইত্যাদি করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অবশ্য কয়েক বছর পর শেখ রেহানা লন্ডনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যান। সত্তরের দশকের শেষের দিকে দুই বোন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে লন্ডনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনমত গড়তে শুরু করেন।

১৯৭৯ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। তখন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সদ্য উর্দি খুলে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের সময় খারাপ যাচ্ছিল। দলে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভক্তিও ছিল। এ অবস্থায় দলে ঐক্য ফিরিয়ে আনতে একজন গ্রহণযোগ্য নেতার প্রয়োজন ছিল। এই তাগিদ থেকেই ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি করা হয়। দলের হাল ধরতে ওই বছরের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন। সেদিন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে লাখ লাখ জনতা সমবেত হয় তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। মঞ্চে উঠে শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সর্বহারা, আমার কেউ নাই। আপনাদের মাঝে আমি আমার হারানো পিতা-মাতা, আমার ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাইকে খুঁজে পেতে চাই। আপনাদের কথা দিলাম এই দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করব। আমি আওয়ামী লীগের নেতা হতে আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে কতিপয় সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হন। এর কিছুদিন পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার পাশাপাশি এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলের সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতন ঘটে।

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সব ধরনের জরিপে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকলেও নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি। শেখ হাসিনা বিএনপির শাসনামল (১৯৯১-৯৬) এবং তারও আগে এরশাদের শাসনামলে সারা দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষের সুখ-দুঃখ এবং অভাব-অভিযোগের কথা শুনেছেন। এ সময় তিনি ‘শেখের বেটি’ হিসেবে দুঃখী মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হন। অবশেষ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করে।

শেখ হাসিনার সরকারের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে গঙ্গা নদীর পানির হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি সই হয়। পার্বত্য শান্তিবাহিনীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা করে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সই হয়। ফলে পার্বত্য জেলাগুলোতে শান্তিবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘকালের যুদ্ধ ও বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। একই সময়ে জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন পাস হলে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের পথ সুগম হয়। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম মেয়াদেই ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে তা উদ্বোধন করা হয়।

২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি পুনরায় সরকার গঠন করলে বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন এবং শেখ হাসিনা হন বিরোধী দলের নেতা। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা হলে আওয়ামী লীগের বহু নেতা-কর্মী হতাহত হন। মারা যান আইভি রহমানসহ আরও অনেকে। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সেই মেয়াদে সরকারের সচিব হিসেবে আমার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়। দ্বিতীয়বার সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর তাকে আগের চেয়ে আরও পরিপক্ব ও দক্ষ বলে আমার মনে হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটিকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং সরকারের মেয়াদকাল, অর্থাৎ ২০১৩-এর ডিসেম্বরের মধ্যে সমাপ্ত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো পদ্মা সেতু নির্মাণে টাকা দেবে না বলে জানায়। এরপর শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন এবং তা করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন।

২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ‘রূপকল্প-২০২১’, অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। নির্ধারিত সময়ের আগেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে যায়। আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। টানা তিন মেয়াদে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি গত ১২ বছর গড়ে ৬ শতাংশের ওপর এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে। ২০২২ সালে মোট জিডিপির আকার ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে যায়। ২০০৫ সালে দেশের দারিদ্র্যের হার যেখানে ৪০ শতাংশ, সেখানে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২২ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয় রেকর্ড ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পৌঁছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি ব্যয় হয় ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

২০২০ সালের প্রথমার্ধ থেকে করোনা মহামারির প্রকোপ শুরু হলে সারা বিশ্বে স্থবিরতা নেমে আসে। এ কঠিন সময়েও শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ছিল। যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল, সেখানে করোনার প্রথম বছর বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ। করোনা মোকাবিলায় এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বর্তমানে দেশে ১০-১২টি মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। পদ্মা সেতু গত ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। এ সেতু নির্মাণের ফলে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা যায়। মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল ও ঢাকা বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর অদূরে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মীয়মাণ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শিগগিরই চালু হবে। কৃষি ও শিল্পোৎপাদনে এগিয়ে থাকার কারণে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীর অনেক দেশে মন্দাভাব দেখা দিলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো। মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানিসংকট ইত্যাদি সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে দেশ সঠিক পথেই রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ‘রূপকল্প-২০৪১’ ঘোষণা করে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। ২১০০ সাল পর্যন্ত ‘ব-দ্বীপ’ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বৈশ্বিক নীতি- সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- এ মূলমন্ত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুসরণ করেন। সে জন্য বাংলাদেশ কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত নয়। বরং সব দুর্বল ও শক্তিশালী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। শেখ হাসিনার বৈশ্বিক নীতি এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তন, মাইগ্রেশন, সংকট মোকাবিলায় সম্পদ বণ্টন, নারীর ক্ষমতায়ন, যুদ্ধ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, জ্বালানি নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে প্রস্তাব প্রণয়ন ও বিশ্বসভায় উত্থাপন বিশ্বনেতৃত্বের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং শেখ হাসিনা ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে তিনি রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিশ্বনেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান।

বরাবরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উন্নত দেশসমূহ যেখানে পক্ষ-বিপক্ষভুক্ত, সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সব পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন। তা ছাড়া যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্বের দেশসমূহের অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ও তুলে ধরেন। এ পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থা সচল রাখা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা সরকারপ্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। দেশ শাসনে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দেশপ্রেম ও জনকল্যাণে অবদানের জন্য তিনি যেমন জননেত্রী হিসেবে পরিচিত, তেমনি সারা বিশ্বের সমস্যা ও মঙ্গলের জন্য কথা বলেন বিধায় তিনি এখন বিশ্বনেত্রী।

বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক, গণমানুষের নেতা, তারই আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শেখ হাসিনাও গণমুখী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে চলেছেন। দেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা তার নখদর্পণে। সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে দেশের বয়স্ক, দুস্থ, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, চা-শ্রমিক, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী প্রভৃতি শ্রেণির লোকদের ভাতা দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছেন। ভূমিহীন ও আশ্রয়হীনদের বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছেন। যার ফলে সংকটকালেও দরিদ্র মানুষ উপকৃত হয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে, বৈশ্বিক মন্দার হাতছানিতে দেশে যে সাময়িক অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, শেখ হাসিনার গণমুখী নেতৃত্ব ও সময়োচিত পদক্ষেপে তা কাটিয়ে উঠে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আবার ধাবিত হবে বাংলাদেশ।

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগদান উপলক্ষে নিউইয়র্কে তার জন্মদিন উদ্‌যাপিত হচ্ছে। তার প্রাণপ্রিয় দেশবাসীর পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও অসীম শ্রদ্ধা।

লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব, বর্তমানে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্টদূত



শিশুশ্রম রোধে আমাদের করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সোমা মুৎসুদ্দী

শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা ছোট শিশু তারাই আগামী দিনের দেশ পরিচালনায় গুরুদায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু নানা কারণে আমাদের দেশের শিশুরা আজ উপযুক্ত পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত। জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হচ্ছে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে এবং তাদের বাধ্য করা হচ্ছে হাড়ভাঙা খাটুনিতে। তাই শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে জাতিসংঘ ও নানা সংস্থা আছে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে। নানা কারণে শিশুশ্রম সমাজ ও দেশে শিকড় গেড়ে বসেছে। এখনো আমাদের দেশে দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ। এরা অভাব-অনটন ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে ও জ্বালায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের সন্তানদের শিশুশ্রমে বাধ্য করানো হচ্ছে। এ ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম-আর্থিক বণ্টনের প্রতিক্রিয়ার ফলে শিশু শ্রমিকের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। আমাদের দেশে পিতৃমাতৃহীন শিশুরাই অধিক হারে শিশুশ্রমে জড়িত। বেঁচে থাকার জন্য নিরুপায় হয়ে তারা এপথে পা বাড়ায়। বিদ্যালয়ের প্রতি অনীহাও শিশুশ্রমের অন্যতম একটি কারণ। আন্তর্জাতিক, শ্রমসংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় বিভাগীয় শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০১, পুরাতন জেলা শহরে ২০১, নতুন জেলা শহরে ১৮৭, থানা সদরে ১৩৩, পার্বত্য এলাকাগুলোতে ২৩ এবং পল্লি এলাকায় ৯৪ ধরনের কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এসব কাজের মধ্যে আছে- কুলি, হকার, রিকশা শ্রমিক, ফুল-বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, ইটপাথর ভাঙা, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক, বেডিং স্টোরের শ্রমিক ও গৃহকর্মীর পেশা। তা ছাড়া ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম’ শীর্ষক আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, কিছু বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও শিশুরা নিয়োজিত রয়েছে। যেমন- ইলেকট্রিশিয়ান, রাসায়নিকদ্রব্য তৈরির কারখানায় কাজ, মাদকদ্রব্য বিক্রি ও বহন। সমুদ্রবন্দর এলাকায় শিশুদের জোর করে মাফিয়া চক্রে যুক্ত করানো। এই উদ্দেশে অনেক শিশুকে অপহরণ করে পাশের দেশসহ নানা দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। চুরি, ছিনতাই, ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা কাজে এদের লাগিয়ে এক শ্রেণির দেশ ও সমাজবিরোধী লোক প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তা ছাড়া পোশাকশিল্প কারখানাতেও হাড়ভাঙা খাটুনিতে শিশুদের নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া শহরবাসী ভদ্রলোকদের বাসার কাজে শিশুরা প্রধান শ্রমিক হিসেবে কাজ পায়। শিশুদের শ্রমবৃত্তিতে নিয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে সভ্য দেশগুলোতে মানুষ যেখানে বিবেকশক্তি ও স্বাধীনতাবোধের বড়াই করে সেখানেও রয়েছে শিশুশ্রমের মতো ভয়ংকর পেশা। মানবতা আজ বড়ই বিপন্ন। বিশ্বের সব শিশুই, শিশু শ্রমিকরা মালিকের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকার বঞ্চিত শিশুরা, তাদের শ্রমকর্তা কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই নির্যাতিত হয়ে থাকে। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও তারা দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। অদক্ষ শ্রমিক বলে তাদের নেই নির্দিষ্ট মজুরি, অথচ আছে কথায়, কথায় জুলুম আর নিপীড়ন। সামান্যতম অমনোযোগিতার অভিযোগ এনে, গায়ে লাথি ও বেতের বারি সহ্য করতে হয় তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে বড়লোকদের ঘরে শিশু নির্যাতনের হার বেড়ে গেছে। এদের ঘরে কাজের মেয়ে হিসেবে যারা কাজ করে তাদের সামান্য অপরাধের জন্য বাড়ির গৃহিণী অমানবিক শাস্তি দিয়ে থাকে। গায়ে আগুনের ছেঁকা দেওয়াসহ, খেতে না দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকার পাতায় এসব নৃশংস ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশ পাচ্ছে। এ ছাড়া কল-কারখানায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন শিশু শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শিশুশ্রম একটি মানবতাবিরোধী ও জঘন্য কাজ। শুধু বাংলাদেশেই নয় যেকোনো দেশের জন্য এর পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কারণ যে শিশুরা জাতির কর্ণধার ও ভবিষ্যৎ, শিশুশ্রমের কারণে তারা হয়ে উঠছে অযোগ্য ও অকর্মণ্য। শিক্ষা ও সুন্দর পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা হয়ে যাচ্ছে সামাজিকভাবে পঙ্গু। অতিরিক্ত শ্রমদানের ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, তারা নানা অপুষ্টিতে রোগে ভোগে। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘাটতি পূরণ হয় না ও জীবনীশক্তি ক্ষয় পেতে থাকে। তাদের ভাঙা স্বাস্থ্য আর উদ্ধার হয় না, ফলে শিশুরা অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সমাজে বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ শিশু ও নারী নির্যাতন আইন বলবৎ থাকলেও এর মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। কেবল আইন দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জনসচেতনতা। উপযুক্ত শিক্ষার প্রসার ও দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যারা শিশু শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে, বিভিন্ন বিদেশি এনজিও ও সরকারকে নিতে হবে শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব। এক কথায় যেভাবেই হোক, আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম রোধ করতে হবে। না হয় জাতির ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার ও অভিশাপগ্রস্ত। তবে আশার কথা হলো এই কাজের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ইতোমধ্যে অনেক দরিদ্র পিতামাতাই তাদের সন্তানদের কাজে দেওয়ার পরিবর্তে বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করেছে। মানবতার বিকাশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিশুশ্রম রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বস্তি এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিদ্যালয় খুলে তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্ব শিশু দিবসে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও শিশুশ্রম বন্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে ও শিশুশ্রমের প্রতি নিন্দা জানাতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকার সচেতন হলেও কিছু মানুষের অসহযোগিতার কারণে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না ও সরকারি নানা উদ্যোগ অনেক সময় মুখ থুবড়ে পড়ছে। তবুও চাই আমরা সরকারের পাশাপাশি যে যার অবস্থান থেকে শিশুশ্রমকে না বলব ও শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করে যাব জয় হোক মানবতার।

লেখক: বাচিকশিল্পী ও কবি

বিষয়:

এসএসসির ফল ও শিক্ষার মানোন্নয়ন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে, চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে, ফল প্রকাশের অনুভূতি প্রকাশকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘ছেলের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কেন কমে যাচ্ছে, একটু ভেবে দেখা দরকার। এরা কি স্কুলে যাচ্ছে না? পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কেন কমে গেল? আমার মনে হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তা ভালোভাবে দেখা দরকার।’

আমরা সাধারণ জনগণ তার বক্তব্যকে সাধুবাদ ও অভিনন্দন জানিয়ে সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে আরও কিছু বিষয় নিয়ে দুটি কথা বলতে চাই।

ফল প্রকাশের আনন্দঘন মুহূর্তের জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করি, এই অপেক্ষার অবসান ঘটে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্যদিয়ে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দিচ্ছি। করোনার সময়ও সঠিক সময়ে পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি এবং প্রতিটি জিনিসের দাম বেড়েছে। এটা শুধু আমাদের দেশে নয়, ইউরোপ-আমেরিকায়ও একই অবস্থা। তার মধ্যেও আমরা বিনা মূল্যে শিক্ষার উপকরণ ও বই বিতরণ করেছি। এখানে আমরা কোনো কার্পণ্য করিনি। যেটা প্রয়োজন সেটা আমরা দিতে পেরেছি।’ ফলাফল প্রকাশের দিন সংবাদ সম্মেলনে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কমে যাওয়াকে স্বাভাবিক হিসেবেই তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি। করোনাভাইরাস মহামারির জন্য গত বছর সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে পরীক্ষা হলেও এবার হয়েছে পূর্ণ নম্বরে। এতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা।

হতাশাজনক খবর হলো এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষায় ৪৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। কেন এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা পাস করতে পারেনি শিক্ষা-সংশ্লিষ্টদের সেই কারণ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শতভাগ শিক্ষার্থী পাস না করা কাম্য নয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ রাখা দরকার, পাসের হার বাড়া-কমায় নজর না দিয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

চলতি বছর এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা করোনার পর দুই বছর সময় পেয়েছিল, এই দুই বছর তারা কাজে লাগিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে। এ বছর ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২০ লাখ ২৪ হাজার ১৯২ জন ।এর মধ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয় ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন, এদের মধ্যে পাস করেছে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন। গড় পাসের হার ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন শিক্ষার্থী। তবে গত বছরের চেয়ে এবার পাসের হার কিছুটা বেড়েছে ২ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও গত বছরের চেয়ে কমেছে। গত বছর সারা দেশে জিপিএ-৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন শিক্ষার্থী। গত বছর এ হার ছিল ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

শুরু হয়ে যাবে কলেজে ভর্তির দৌড়ঝাপ, অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রবণতা ইত্যাদি।

এ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি ও সমমানের ফলে গণিত ও ইংরেজিতে তুলনামূলক কম পাস করেছে। এই দুই বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের দুর্বলতা রয়েই গেছে, করোনা মহামারিতে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে মৌলিক জ্ঞানের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, কারণ শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা বছরের পুরোটা সময় ধরে অনলাইনে ক্লাস করার মাধ্যমে পড়াশুনা চালিয়েছে। করোনার সময় পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা না দেওয়ার প্রবণতা, না লেখার চর্চা শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাডেমিক দুর্বলতা তৈরি করেছে, কিছুটা ভীতি কাজ করেছে। পরীক্ষায় ভালো ফল করার অনুষঙ্গ হচ্ছে লেখা, আগামীতে যারা ভালো পড়াশুনা করে খাতায় লিখে ভালো ফল করতে আগ্রহী তাদের সবারই উচিত বেশি বেশি করে লেখা।

দেশে শিক্ষার মান কতটুকু বাড়ল বা কমল তা বোঝা যায় পাসের হারের দিকে ভালোভাবে তাকালে, তবে পাসের হার যে শিক্ষার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে না তার প্রমাণ এইচএসসি পাসের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সফলতার দিকে তাকালে প্রতীয়মান হয়, কারণ প্রতিবছর ৮০-৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী এসএসসি ও এইচএসসি পাস করার পরও ১০-১২ শতাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে থাকে। বাকিদের একটি বিশাল অংশ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো এবং বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষায় অংশ নিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।

প্রতিবছর এই শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ আর পড়াশুনা চালাতে পারে না।

খুঁজে বের করতে হবে এই ঝরে পড়ার পিছনের কারণ, অভিভাবকদের সামর্থ্যের ব্যর্থতার পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা, উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ, খেলার মাঠ, শরীর চর্চা ইত্যাদি ক্ষেত্রের অপর্যাপ্ততা, মেধা বিকাশ ও মননশীল প্রতিভা অন্বেষণের অভাব, সচেতন শিক্ষকের স্বল্পতা ও সামাজিক অবস্থান ও তলিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন সুধী সমাজের বোদ্ধারা। সবাই গুণগত শিক্ষার অনুসন্ধান করে থাকেন। নীতি ও নৈতিকতা ও আদর্শবান হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সর্বত্র মানোন্নয়ন।

গুণগত শিক্ষা বা মানসম্মত শিক্ষা বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এটি উন্নত বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল বিশ্বেও শিক্ষাবিদদের মনোযোগ আকর্ষণ করে চলেছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো টেকসই উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে গুণগত শিক্ষার ধারণা ও গুরুত্ব বিশেষভাবে তুলে ধরেছে।

শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর এই যোগ্যতা অর্জনের মান অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক সর্বত্রই এর অবস্থা একই রকম। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়লেও মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ ভীষণভাবে পিছিয়ে রয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আশাব্যঞ্জক নয়। বস্তুতপক্ষে সব স্তরের শিক্ষাতেই তাত্ত্বিক ধারা প্রাধান্য বিস্তার করছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত মান উন্নয়ন দরকার। আরও অধিক পরিমাণে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও ল্যাব ব্যবহারের সুবিধা, শ্রেণিকক্ষে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকার নিরাপত্তা জোরদার করার প্রকল্প বাস্তবায়ন জরুরি।

গুণগত শিক্ষার অনেক অপরিহার্য পূর্ব শর্তের মধ্যে একটি হচ্ছে অধিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা খাতে অর্থ বরাদ্দ অপর্যাপ্ত। এ কথাও অনস্বীকার্য, বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক ক্ষেত্রেই সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে খরচ করা হয় না, যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। দেশে শিক্ষা খাতে প্রকৃত বিনিয়োগ চাহিদার তুলনায় একেবারেই কম। শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষা কেন্দ্রগুলোর চিত্র আরও ভয়াবহ।

গুণগত শিক্ষা মূল্যায়নের সার্বজনীন কিছু নির্দেশক রয়েছে। এগুলোর ভিত্তিতে গুগণত শিক্ষা অর্জনে ও টেকসইকরণে কিছু সাধারণ পূর্বশর্ত পূরণ প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে- বৈষম্যহীন সমন্বিত শিক্ষা, আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাক্রম, মানসম্মত ও পেশার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ শিক্ষক সমাজ, প্রয়োজনীয় সুযোগ দিয়ে মেধাবীদের শিক্ষকতায় এনে ধরে রাখা, সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতি, মাদক নির্মূল ও অপচয়রোধ এবং শিক্ষায় অধিক বিনিয়োগ ইদানিং আরও একটি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, তা হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার বা অতিরিক্ত ডিভাইস-নির্ভরতা এবং মোবাইলের অপব্যবহার, তবে শিক্ষার মানোন্নয়নে কতগুলো বিশেষ পূর্বশর্ত বিবেচনা অপরিহার্য। শর্তগুলো হচ্ছে- শিক্ষক, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, তত্ত্বাবধান, নেতৃত্ব, শিক্ষাক্রম, শিক্ষণসামগ্রী, মূল্য যাচাই, শিক্ষানীতি ও পরিকল্পনা, বহিস্থ প্রশাসন, গবেষণা, পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত অর্থায়ন ইত্যাদি।

এসব পূর্বশর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করে গুণগত শিক্ষার মাত্রা বৃদ্ধি সরকারের এই আসন্ন বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে অনুদান ও অর্থায়ন বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে সঠিক মনিটরিং এজেন্ট দ্বারা সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

বিষয়:

ঘূর্ণিঝড় আইলার বিরুদ্ধে রিট

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

মে এবং নভেম্বর এ দুটি মাস বাংলাদেশের উপকূলে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের হানা দেওয়ার মৌসুম। ১৯৬০ সালের ১৪ মে, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর, ২০০৭ সালের ১৬ নভেম্বর সিডর, ২০০৯ সালের ১৫ মে আইলার আক্রমণ সবই এখনো দারুণ দুঃস্বপ্নের স্মৃতি। সাম্প্রতিককালের সালতামামীতে সিডর ও আইলা বহুল উচ্চারিত। ২০০৯-এর ১৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার আক্রমণ নিয়ে সুন্দরবনে বসবাসকারী প্রাণী বৈচিত্র্যের পক্ষ থেকে যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে রসরচনায় তা তুলে ধরা হলো-

ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে রিট করার সিদ্ধান্ত নেয় সুন্দরবনের বাবাহকু (বাংলাদেশ বাঘ হরিণ ও কুমির) ফেডারেশনের আইন ও নিবর্তন নিরোধসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি। আজ সুন্দরবনের কচিখালিতে বাবাহকুর কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রকের মুখপত্র মলিশা মঞ্জিলা সাংবাদিকদের এ কথা জানান। মলিশার সংবাদ সম্মেলনের সূত্র ধরে বার্তাসংস্থা উবিসস (উড়ো বিভ্রান্তকর সংশয় সন্দেহ) প্রেরিত বাতাস বার্তায় জানা যায় গত বৃহস্পতিবার বাবাহকুর উচ্চ পরিষদ বনে-জঙ্গলে বিরোধীদলীয় সদস্যদের আনা এক মোশন প্রস্তাবের ওপর তীব্র ও প্রখর আলোচনার একপর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলায় সুন্দরবনের প্রাণী ও প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিতে এখনো পর্যন্ত পর্যাপ্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গৃহীত না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশে ফেটে পড়েন পক্ষের বিপক্ষের সবাই। সবার সম্মিলিত দাবির মুখে খোদ সিডর ও আইলার বিরুদ্ধেই সালিশী ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর সুবিদখালীর বর্ষীয়ান সদস্য, পাখ-পাখালি গোত্রের নেতা শঙ্খশালিয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে গৃহীত হওয়ার পর উচ্চ পরিষদ অধ্যক্ষ শিয়ালেন্দু মামাইয়া তার রুলিংয়ে বলেন- সালিশ বিভাগ নিজের উদ্যোগে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে না গেলে বাবাহকুর পক্ষে কোনো কমিটি রিট পিটিশনটি দাখিল করতে পারে। ফেডারেশনের পরিচালনায় থাকায় বাবাহকুর নিজে এ জাতীয় মামলা দায়েরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা এর সঙ্গে ঘরে-বাইরের সম্পর্ক সংস্থাপনসংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয়াদির যোগসূত্র রয়েছে।

সিডর ও আইলা এসেছে বাইরের থেকে, তাদের অভ্যন্তরীণ আইনের আওতায় সালিশে সোপর্দ করা যুক্তিযুক্ত হবে কি না এ ব্যাপারে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করেন বাবাহকুর আইন ও সালিশ উপদেষ্টা বানরিয়া বাচাবন। অবশ্য বানরিয়া বাচাবনের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিরোধী পক্ষের বিচার-সালিশ বিশেষজ্ঞ ময়নামন্দা। ময়নামন্দার মতে যেখান থেকেই আসুক না কেন বাতাস যেখানে যার ঘর ভেঙেছে সেখানেই তার হতে হবে বিচার। তিনি মেকং বনে বাঘ সম্প্রদায়ের সুখ্যাতির সর্বনাশ সাধনে দূর দ্বীপবাসী তক্ষক ও ভক্ষকদের বিরুদ্ধে দেওয়া একটি ঐতিহাসিক রায়ের কথা উল্লেখ করেন। উচ্চ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবটি আজ সকালে বাবাহকু প্রেসিডিয়ামের প্রেসিডেন্ট সুন্দরমিয়ার সানুগ্রহ সম্মতি লাভ করলে রিট দায়েরের জন্য বাবাহকুর আইন ও নিবর্তন নিরোধ কমিটিকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। আগামী কাল সালিশালয় বন্ধ থাকায় পরশু এটি দাখিল হতে পারে বলে মঞ্জিলা সংবাদ ব্রিফিংয়ে আভাস দেন।

এদিকে দুবলারচর থেকে সলিশালয় সূত্রে সাংবাদিকরা জানিয়েছেন সিডর ও আইলার বিরুদ্ধে সালিশালয় থেকে স্বউদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না প্রাজ্ঞ পণ্ডিত প্রবরেরা। তবে তাদের ধারণা সব ব্যাপারে স্বউদ্যোগে অভিযোগ দায়েরে সংশ্লিষ্ট হতে গেলে সালিশে মনোযোগের সময় কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে এবং সালিশজীবীরাও এর মধ্যে তাদের মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করতে পারেন। পরশু সালিশজীবীদের পলিটব্যুরোতে এতদবিষয়ক এক আলোচনায় এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রাথমিক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে সংবাদসংস্থা বৈরী বাতাস ডট কম পরিবেশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়-

উপকূলীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রতিপক্ষ আইলার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের বিবরণীটি সিভিনিউজ ডট ৪৮ মিডিয়ার জন্য উন্মুক্ত করেছে। তাতে বলা হয়েছে ২০০৯ সালের মে মাসে আইলা ঘাপটি মেরে থাকা আপসহীন মনোভাব নিয়ে অতর্কিত আক্রমণে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় অবর্ণনীয় দুর্যোগ এবং দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভোগের কারণ সৃষ্টি করে। আইলা দুদেশের সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল কালিন্দীর মোহনা দিয়ে উঠে এসে ব্যাপক জলোচ্ছ্বাস ঘটায়, ফলে উভয় পাড়ের সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয় আর সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের নিম্নাঞ্চল হঠাৎ পাবনের পানিতে তলিয়ে যায়। পরে সেখানে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় জনবসতিতে, কৃষিক্ষেতে, মৎস্য চাষে। মুহূর্তের মধ্যে সহায়-সম্বল ও গৃহহীন হয়ে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সুন্দরবনের মধ্যে সৃষ্ট বীভৎসকর পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বাবাহকুর তথ্য বিভাগের প্রধান হরিণা হাপানের সে সময়কার বিবৃতিটি এক্সিবিট আকারে আরজির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। হরিণা আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের জন্য তাৎক্ষণিক বড় ক্ষতি সম্পর্কে সে সময় বলেছিলেন, এবারের বানে [আইলায়] আমরা বেশি সমস্যায় পড়েছি খাবার পানি নিয়ে। বাদার মধ্যে যে কয়টা পুকুর আছে আমরা দলবেঁধে সেখানকার পানি খেতাম। নোনা পানি আমরা তেমন খেতে পারি না। এসব পুকুরে আমাদের জন্য মিষ্টি পানির ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এবারের বানে এসব পুকুর তলিয়ে গিয়ে নোনাপানিতে ভরে গেছে। এখনকার ছিটেফোঁটা বৃষ্টির পানি এই নোনা পানিকে মিষ্টি করতে পারছে না। আমাদের কষ্ট দেখার কেউ নেই। দুবলার চরে অনেক বন্দুকওয়ালা সেই লোকটা বড় পাড় বাঁধা পুকুর কেটে কি উপকারটা না করেছিলেন এবার সে পুকুর ডোবেনি। ওখানে আমাদের যারা আছে তারা সে পানি পাচ্ছে। আমাদের এখান থেকে তা অনেক দূর। ওরকম পাড়বাঁধা পুকুর কাটলে খুব কাজে লাগত। আর বর্তমানের এসব পুকুরের নোনা পানি ছেচে বের করে দিয়ে বৃষ্টির মিষ্টি পানি ধরার ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো।’

আইলায় সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হরিণা হাপান তখন জানিয়েছিলেন, আমরা প্রকৃতির কোলেই আছি। এজাতীয় বান আমরা প্রায়ই মোকাবিলা করি- আমাদের নিজস্ব একটা নিয়ন্ত্রণ বা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে। তবে এবারের বানটা এসেছে হঠাৎ করে, আমরা বুঝে সারতে পারিনি। পানি এসেছে আচমকা ও অনেক পরিমাণে ফলে অনেকে সময়মতো উঁচু জায়গায় যাওয়ার সুযোগ না পাওয়ায় আমাদের অনেকেই মারা পড়েছেন। জোয়ারের সময় জলোচ্ছ্বাস হওয়ায় এমনটি হয়েছে, সচরাচর ভাটার সময় বান আসে।’

আইলার বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ সে পূর্ণিমার ভরা জোয়ারের সময় আঘাত হানে এর ফলে পানির পরিমাণ ও স্রোতের তোড় বেশি হওয়ায় বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে সবকিছু ডুবে যায় হঠাৎ করেই।

আর্জিতে স্থানীয় জনগণের জীবনে নেমে আসা দুর্গতির বর্ণনায় বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় আইলায় পশ্চিমবঙ্গের হাসনাবাদ, শমসেরনগর আর বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর আশাশুনি আর খুলনার দাকোপ ও কয়রার বেশ কয়েকটা ইউনিয়নের মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে আজ দারুণ অসহায় অবস্থায় । শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের হরিচরণ মণ্ডল মোটামুটি অবস্থাপন্ন-তার দুদুটো দশ একরি মাছের ঘের, পঞ্চাশ বিঘে ভালো ধানী জমি, গোলাভরা ধান আর আটচালা ঘর উঠোন দহলিজ সবই এখন থৈ থৈ পানির নিচে। মেয়েটা শ্যামনগর কলেজে পড়ে, এবার আই এ পরীক্ষা দেবে, টুঙ্গীপুর শ্বশুরবাড়িতে পরিবার পাঠিয়ে দিয়ে সে আর তার বড় ছেলে নিবারণ বেড়িবাঁধের ওপর পলিথিনের চোঙায় থাকে। এ যেন সকালবেলার আমির ফকির সন্ধ্যাবেলা। তিনশ বিঘে জমির মালিক কয়রার নাংলার নাসের সরদার সেদিন লাইনে দাঁড়িয়ে রিলিফ নিতে গিয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। টিভির বাক্সে সেই ছবি দেখে জায়গীরমহলে বাড়ি তার এক আত্মীয় ঢাকা থেকে ফোন করে তাকে আর কি সান্ত্বনা দেবে? মাসের পর মাস গেল পানি তো কমেইনি তাদের বুকের ভেতর এই পানি কালা পানির স্রোত হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের আশাভরসা আর সব স্বপ্নকে। আজকাল সাগরে, নদীতে এমনিতে প্রায়ই জোয়ার বড় বাড়ন্ত। রাজধানী ঢাকায় বসে বিশেষজ্ঞরা বলা বলি করছে এই পানি নাকি সহজে সরবে না, সমুদ্রের তলা উঁচু হয়ে গেছে পানি টানবে কীভাবে? আইলার আক্রমণের প্রতি ইঙ্গিত করে আর্জিতে বলা হয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিচু এলাকাগুলো এ ধরনের আক্রমণে স্থায়ীভাবে তলিয়ে যেতে পারে, সুন্দরবন ডুবে যেতে পারে, মালদ্বীপের মতো দেশও হয়তো তলিয়ে গেলে আর জাগবে না। সমুদ্রের তলা উঁচু হচ্ছে কেন, কার কারসাজি কিংবা দোষে? যার জন্য হোক কিংবা যেভাবে হোক দেশের উপকূল অঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষ আর সুন্দরবনের তাবৎ প্রাণিসম্পদ গাছ-গাছালি তার ভোগান্তির শিকার, কত অসহায় আজ তারা। আইলার সময় বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে কিংবা ছাপিয়ে নোনা পানি সেই যে ঢুকল বর্গীর মতো, মাছের ঘের ধানচালের খামার, বনের সব প্রাণী ও গরু-ছাগলের খাবার সবই তো পয়মাল। আইলার বিরুদ্ধে মানবতা, প্রাণিসম্পদ , প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগ এনে আর যাতে এ ধরনের বিপর্যয় না আসে তার প্রতিবিধান বা প্রতিরোধাত্মক নির্দেশনা কামনা করা হয়েছে।

লেখক: উপকূলীয় অর্থনীতির গবেষক ও বিশ্লেষক, সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান


১৭ মে: বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা দিন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোঃ শাহিনুর রহমান

বাংলাদেশের চলমান ইতিহাসে ১৯৮১’র ১৭ মে বঙ্গকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ঘটনাটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ক্ষমতায় আসা প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরশাসকেরা স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনরায় যেভাবে উল্টোরথে চড়িয়ে অধঃপাতে নিয়ে যাচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন ফিরে না এলে আর কোনোদিন নিজের অভীষ্ট লক্ষ্যের সোজা পথে ফিরে আসা বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ সম্ভব হতো কি না সে-ব্যাপারে গভীর সন্দেহের অবকাশ আছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবনের জন্য তৎকালীন রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর সামান্য আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি। কারণ এ ইতিহাস পুরোনো প্রজন্মের অনেকের জানা থাকলেও এ ব্যাপারে নতুন প্রজন্মের কোনো ধারণা নেই বললেই চলে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন তার ছোটবোন শেখ রেহানা এবং দুই সন্তানসহ স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে ছিলেন, যার ফলে তারা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাকি সদস্যরা এবং সম্প্রসারিত পরিবারের অনেক সদস্যও সেদিন শিকার হন শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের এক নৃশংসতম রাজনৈতিক গণহত্যাকাণ্ডের।

এ হত্যাকাণ্ডের পর জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং এ আবেদন অনুমোদিত হয় ২৪ আগস্ট। জার্মানির ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা জননেত্রী শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া, তাদের দুই শিশুসন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ রেহানাকে ১৯৭৫-এর ২৫ আগস্ট সকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে করে দিল্লি পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।

দিল্লিতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে গিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা ও তার স্বামী বাংলাদেশের ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত হন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১—টানা প্রায় ছয় বছর দিল্লিতে তাদের নির্বাসিত জীবন কাটানোর সময় আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা বিভিন্ন সময়ে দিল্লিতে যান তাদের খোঁজখবর নিতে এবং দেশ ও দলের এক গভীরতম সঙ্কটলগ্নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রাজি করানোর অভিপ্রায় নিয়ে। এদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, তৎকালীন যুবনেতা আমির হোসেন আমু প্রমুখ।

এর পর ১৯৮১’র ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সম্মেলনের এক সপ্তাহ পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি আবদুল মালেক উকিল, জিল্লুর রহমান, আবদুল মান্নান, আবদুস সামাদ, এম. কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, গোলাম আকবর চৌধুরী, সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, আইভি রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ প্রমুখ ঢাকা থেকে দিল্লিতে যান, এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে পর পর কয়েকটি বৈঠকে বসে নেত্রীকে দেশে ফিরতে রাজি করান এবং ফেরার পরবর্তী কর্মপন্থার খসড়া পরিকল্পনা করেন।

দলীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথ থেকে জোর করে বিচ্যুত করা জাতিকে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধু-তনয়ার প্রয়োজনের গভীরতা তারা সেদিন নেত্রীকে বোঝাতে পেরেছিলেন। দেশ, জাতি আর দলের সেই ভয়াবহ সঙ্কটকালে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশেষে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দেশে ফিরতে সম্মত হন।

দিল্লিতে দুই শিশুসন্তান জয় আর পুতুলকে ছোটবোন শেখ রেহানার কাছে রেখে ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফেরেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক আবহের মতো সেদিনকার আবহাওয়াও ছিল তীব্র ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ। ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে বইছিল ঝোড়ো বাতাস, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঝড়বাদল অগ্রাহ্য করে সেদিন লক্ষ লক্ষ লোক জমা হয়েছিল তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে স্বাগত জানানোর জন্যে।

সেদিন বিকেল ৪টায় কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে জননেত্রী শেখ হাসিনা পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে চরাচর মুখরিত হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কণ্ঠে সমস্বরে ঘোষিত হয়-- ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’; ‘পিতৃহত্যার বদলা নিতে, লক্ষ ভাই বেঁচে আছে’; ‘জননেত্রী শেখ হাসিনার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’...।

দেশের মাটিতে পা দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা সেদিন জনতার উদ্দেশ্যে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।... সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতা হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসি নি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’

দেশে ফিরে যেসব অঙ্গীকার নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন তার মধ্যে ছিল: বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়ন, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্বৈরতন্ত্রের চিরঅবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠা। এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কখনো পিছু হটেননি বঙ্গবন্ধুকন্যা।

দেশে ফেরার পর শুরু হয় সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জননেত্রী শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম, যা চলে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাকে তার পথ থেকে একতিলও টলাতে পারে নি। বাংলার মানুষের হৃত অধিকার পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বার বার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার জনগণ তার বৈপ্লবিক ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ভূষিত করেছে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ অভিধায়।

দেশে ফেরার পর জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতার অপূর্ণ স্বপ্নকে সম্পূর্ণতা দেয়ার পথে সকল বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে পুরোপুরি প্রস্তুত বলে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হতে হয়।’ মহান নেত্রী তার জীবন দিয়ে তার এ উক্তিকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালে ঘাতকেরা তার ওপর একের পর এক প্রাণঘাতী হামলা চালিয়েছে। বার বার তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর মখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করেন নি। বঙ্গকন্যার অদম্য সাহস আমাদেরকে প্রাণিত ও প্রণোদিত করে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সংগ্রামে আরো সাহসী হয়ে ওঠায়। মৃত্যুঞ্জয়ী জননেত্রী শেখ হাসিনা আজ সত্যিই এক মহৎ প্রেরণার নাম।

১৯৮১ থেকে ২০২৪-- সুদীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার দশক পেরিয়ে যাওয়ার পর জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন আর অঙ্গীকারের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য ক্রমপরিস্ফূট হয়ে উঠছে। বঙ্গবন্ধু-কন্যা যদি সেদিন ফিরে না আসতেন, কবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী, উগ্র সাম্প্রদায়িক, সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের আগ্রাসন থেকে জাতি কোনোদিন মুক্তি পেতো কিনা সন্দেহ। জাতির পিতা আর তার স্বপ্নের হন্তারকেরা জাতিকে যে-উল্টোরথে চড়িয়ে এক কৃষ্ণবিবরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনাই তার চুয়াল্লিশ বছরব্যাপী সংগ্রাম আর সরকার পরিছালিনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বিনিময়ে সেই উল্টোরথকে উন্নয়ন ও প্রগতির আলোকাভিমুখী সোজা পথে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন।

১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে জননেত্রী শেখ হাসিনা যেসব কথা বলেছিলেন, যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, সেগুলোকে সত্যে পরিণত করেছেন কঠোর নিষ্ঠা আর একাগ্র প্রচেষ্টায়। পঁচাত্তরপরবর্তী প্রবল প্রতিকূল সময়ে বিরুদ্ধস্রোতে কুটোর মতো ভাসমান ও ভগ্নপ্রায় আওয়ামী লীগ তার সময়োপযোগী বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই আজ একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অনেক বেশি সুসংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছে। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আর ২০০৯ থেকে চলতি ২০২৪ পর্যন্ত মোট কুড়ি বছর প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব সর্বোচ্চ যোগ্যতার সঙ্গে পালন করে চলেছেন। ২০২৩-এ জনগণের নিরঙ্কুশ রায় নিয়ে টানা চতুর্থবার এবং সব মিলিয়ে পঞ্চমবার ক্ষমতায় আসার সূত্রে এ দফায় তাকে আমরা আরও চার বছর সরকার-প্রধান হিসেবে পাচ্ছি, এটা জাতির জন্যে এক বিরাট পাওয়া। আগামীতে আবারো আমরা তাকে নির্বাচিত করবো এবং আজীবন তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, এটাই আমাদের আশা।

এ ছাড়া ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি জাতীয় সংসদে একজন সংগ্রামী বিরোধী দলীয় নেতার ভূমিকাও পালন করেছেন। বঙ্গকন্যার হাত ধরে তার দল ও দেশ আজ প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক স্বৈরাচারী অপশাসনের দুঃসহ স্মৃতিকে পেছনে ফেলে পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। জননেত্রী শেখ হাসিনার সেদিনকার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে বিশ্বসভায় সমুন্নত শিরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে।

জননেত্রী শেখ হাসিনার গত ৪৪ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অর্জিত মাইল ফলকগুলো হলো: সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এবং জাতির ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশকে তিনিই আজ খাদ্যে সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর করে তুলতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিদের এবং একাত্তরের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন তথা রায় কার্যকর করিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের এক নতুন পথের অভিযাত্রী। তারই দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের চোখে ‘উন্নয়নের আইকন’ হয়ে উঠেছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কথিত বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে ‘স্বল্পোন্নত দেশ’ থেকে ‘উন্নয়নশীল দেশ’-এ ।

প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রখর দূরদৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ফলে দেশের এমজিডি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন, লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠা, কৃষি দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ার মাধ্যমে পোশাক শিল্প, ওষুধ শিল্প প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া বাস্তবায়িত হয়েছে পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রো রেল, চট্টগ্রামের কর্ণফুলি টানেল প্রভৃতি মেগা-প্রকল্পগুলো এবং বাস্তবায়নের পথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর প্রভৃতি আরও কিছু মেগা-প্রকল্প।

প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতক চক্রের হাতে পড়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে পড়া একটি দেশ ও জাতিকে আবার নিজের সুস্থ সবল দৃঢ় পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন অনাপোষ ও স্থিতপ্রতিজ্ঞ বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন একটি সম্মানজনক পরিচিতি। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে তারই কারণে। তিনি আজ জাতীয় নেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন।
বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন ‘মানবতার জননী’, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাকে আজ অনেকটাই বাস্তবে পরিণত করেছে তার সুযোগ্য কন্যার গতিশীল নেতৃত্ব। আর এসব সম্ভব হচ্ছে শুধুমাত্র তিনি ১৯৮১’র ১৭ মে দেশে ফিরে আসার যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন বলেই। আর সেকারণেই ১৭ মে দিনটি স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সোনার আখরে লেখা হয়ে গেছে।

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ, ফোকলোরিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


হিজড়া সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
খন্দকার হাসানুজ্জামান

বাংলাদেশের বহুল আলোচিত এক জনগোষ্ঠীর নাম ‘হিজড়া’। হিজড়া বলতে সাধারণত দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তলিঙ্গ, উভয়লিঙ্গ, তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরিত নারী-পুরুষদের বোঝানো হয়। তারা পূর্ণাঙ্গ পুরুষ নয়, আবার পূর্ণাঙ্গ মহিলাও নয়। দৈহিক বা জিনগত পুরুষ ও নারীর মধ্যবর্তী জন্মগতভাবে কোনো অবস্থানের ব্যক্তিরাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’। আরবিতে হিজড়াদের বলা হয় ‘খুনছা’। চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে, ক্রোমোজমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যাদের দৈহিক বা জেনেটিক কারণে নারী বা পুরুষ কোনো শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সমাজে তারা হিজড়া হিসেবে পরিচিত। হিন্দু পুরাণে বর্ণিত কৃতবীর্যের পুত্র অর্জুনও ছিলেন হিজড়া, যার অপর নাম বৃহন্নলা। যেকোনো দেশে যেকোনো পরিবারে হিজড়া সন্তানের জন্ম হতে পারে। অনাদর ও অবহেলায় বড় হলে তারা বাড়ি থেকে পালিয়ে হিজড়াদের দলে ভিড়ে যায়। বিশ্বের ট্রান্সজেন্ডারদের ৪০ শতাংশ বিষণ্নতায় আত্মহত্যার চেষ্টা করে। অথচ তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার কেউ নেই।

পথচারীদের বেশিরভাগ সময় উত্ত্যক্ত করে জোরপূর্বক টাকা আদায় করে বিশেষ করে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি রুটে চলাচলকারী বাস সমুহে দুইজন করে হিজড়া উঠে এবং অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে চাঁদাবাজি করে থাকে যা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে, এদের আচরণে কোমলমতি শিশুদের এ মহিলা যাত্রীদের সামনে পুরুষ সদস্যদের বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়।

দীর্ঘকাল ধরে তারা এরা অবহেলিত, অনাদৃত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত। সমাজের সদস্যদের মনের অন্ধকার ও ব্যাধিগ্রস্ত মানসিকতার কারণে এ জনগোষ্ঠী নিজেদের বিচ্ছিন্নভাবে। তাচ্ছিল্য, উপহাস ও সামাজিক বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয়ে জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা যৌনব্যবসা, ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এসব মানুষ পরিণত বয়সে অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের চিকিৎসা ও দেখভালের জন্য কোনো আপনজন বা নিকট আত্মীয় থাকে না। এদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে এনে সম্মানজনক জীবিকার ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রথম উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন সাদিয়া আখতার পিংকি। তিনি মনে করেন, ‘হিজড়ারাও মানুষ। তাদের হেয় চোখে দেখার কিছু নেই।’ তিনি নিজে তাই সব মানুষের জন্য কাজ করতে চাচ্ছেন। আর এলাকার মানুষ চাইলে আরো বড় দায়িত্ব নিতে চান ভবিষ্যতে। নানা সামাজিক প্রতিকূলতা তাকে পার হতে হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে দাঁড়ানোর পরও তাকে কটূক্তি শুনতে হয়েছে। পিংকি বলেন, ‘যারা আমাকে কটূক্তি করেছেন তাদের আমি এড়িয়ে চলিনি। তাদের কাছে গিয়ে বলেছি, আমিও তো তোমাদের মতো মানুষ।’ তারা আমার কথা তখন শুনেছেন। আমাকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পিংকি বলেন, সবার সঙ্গে মিশে তাদের মন জয় করেছি।

বাংলাদেশে হিজড়াদের পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পেতে বিড়ম্বনা ও জটিলতা রয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো আইনেই স্পষ্ট কিছু বলা নেই। হিজড়া জনগোষ্ঠী যেন মা-বাবার সম্পত্তির সমান ভাগ পান, সে জন্য আইন মন্ত্রণালয় মুসলিম শরিয়াহ আইন এবং সংবিধানের আলোকে একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বরে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। শরিয়াহ আইনে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর পারিবারিক সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীও মানুষ। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক মানবিক আচরণ করতে হবে। লৈঙ্গিক বৈকল্যের কারণে কাউকে দূরে ঠেলে দেওয়া কোনোক্রমে উচিত হবে না। সমাজের একটি অংশকে অন্ধকারে রেখে আমরা আলোর সন্ধান করতে পারি না। তাদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত ও কর্মমুখী শিক্ষা ও সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হলে তারাও অবদান রাখতে পারবে এবং মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা এখন সহজ হবে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান , গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি এনজিও এবং সেবা সংস্থাগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়ে আসতে পারে।

লেখক: গবেষক, পরিবেশকর্মী


প্রত্যাবর্তন শেখ হাসিনার: পূর্ণতা স্বদেশের

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোস্তফা কামাল

১৯৮১ সালের ১৭ মের আগ পর্যন্ত আরেকটি তারিখ ছিল স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের। সেটি ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে এ তারিখটিতে স্বাধীন দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর মা-বাবাসহ স্বজনহারা মুজিবকন্যার একাশির ১৭ মে স্বদেশ ফেরার আরেক প্রেক্ষিত। তবে ভিন্ন ভিন্ন স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাঝেই দেশের ও ইতিহাসের পরিপূর্ণতা, ছিল অনেক বেদনা। সঙ্গে আবেগ-আনন্দাশ্রু। পঁচাত্তরের আগস্ট ট্র্যাজেডির সময় বিদেশ থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। দুই বোনের আর্থিক সম্বল বলতে ছিল কেবল ২৫ ডলার। স্বামীর জার্মান ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে ২৫ আগস্ট স্বামী, বোন ও দুই সন্তানসহ দিল্লিতে পৌঁছান শেখ হাসিনা। ভারতে তখন জরুরি অবস্থা, দুই সপ্তাহ দিল্লির ডিফেন্স কলোনিতে থাকার পর ইন্দিরা গান্ধীর স্বাক্ষাৎ পান তারা। ইন্দিরা গান্ধীর আদেশে দুজন নিরাপত্তাকর্মীসহ তাদের থাকার নতুন ঠিকানা হয় ইন্ডিয়া গেট সংলগ্ন পান্ডারা পার্ক, সি-ব্লক ফ্ল্যাটে। ১ অক্টোবর ’৭৫ সালে এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে পরমাণু শক্তি বিভাগে স্বল্প বেতনে ফেলোশিপ দেয় ভারত সরকার। লন্ডনপ্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে বিয়ের পর ১৯৭৬ সালের ২৪ জুলাই শেখ রেহানা লন্ডন চলে যান।

দেশের রাজনীতিতে তখন ভিন্ন পরিস্থিতি। মুশতাক-সায়েম ইত্যাদি পর্ব শেষে রাষ্ট্রক্ষমতায় জিয়াউর রহমান। আর আওয়ামী লীগ অনেকটা নেতৃত্বহীন, কয়েকভাগে ব্যাকেট বন্ধী। নৌকা কাণ্ডারিহীন। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে দলের শীর্ষ কয়েক নেতার উপলব্ধিতে আসে দল রক্ষা করতে গেলে দরকার বঙ্গবন্ধুর রক্তের অধিকার। তাদের ওই সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের পর ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ওই সম্মেলনে শেখ হাসিনা শুধু দলটির সভানেত্রীই হলেন না, ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পায় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই রাজনৈতিক দলটিকে। এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৬ মে পুতুলকে নিয়ে রওনা দিয়ে কলকাতা হয়ে ১৭ মে ফেরেন নিজ মাতৃভূমিতে। তথ্য-সাবুদে দেখা যায়, তাকে বহন করা ইন্ডিয়া বোয়িং এয়ারলাইন্সের কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে নামে বিকাল সাড়ে ৪টায়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে সেদিন বাতাস ছিল বেশ গতিময়। সঙ্গে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি। তাকে বরণ করতে সেই বিরূপ আবহাওয়ার মাঝেই প্রায় ১৫ লাখ মানুষ জড় হয় শেরেবাংলা নগর হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত।

শেরেবাংলা নগরের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যার ভাষণের কয়েকটি লাইন ছিল এমন- ‘সব হারিয়ে আজ আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ ... ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হিসেবে জনগণের সামনে আসিনি। আমি আপনাদের বোন, মেয়ে হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেদিন শেখ হাসিনার আরও উচ্চারণ ছিল, ‘সব হারিয়ে আজ আমি এসেছি বাংলায়। এ দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। আমার আজ হারানোর কিছুই নেই।’ আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। শেখ হাসিনা বলেন, ভাই রাসেল আর কোনো দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। বড় আবেগময় শেখ হাসিনার সেই ভাষণ। আর প্রত্যাবর্তন ছিল দেশ- দলের জন্য সময়ের দাবি। তা অনেকটা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘যাত্রী আমি ওরে। পারবে না কেউ রাখতে আমায় ধরে’-র মতো। শেখ হাসিনাকে কেউ ধরে রাখতে পারেনি। পারছেও না। একাশিতে দেশে ফেরার পর অবিরাম কেবল এগোচ্ছেন তিনি। বিভক্ত দলকে একই করেননি। দীর্ঘ একুশ বছরের লড়াই-সংগ্রাম শেষে ছিয়াশিতে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন। এরপর ২০০৯ থেকে আছেন টানা চারবার। যা কারো কাছে বিস্ময়ের । কারো কাছে ঈর্ষার। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হওয়ার। মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে সাহস- প্রজ্ঞায় অপ্রতিরোধ্য গতিতে তিনি কেবলই আগোয়ান-ধাবমান। তা কোনো ম্যাজিক বা মন্ত্র পাঠে নয়। তা সম্ভব হয়েছে সাহস আর চেতনায়।

বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনা সরাসরি গিয়েছিলেন তাদের বাড়ি ৩২ নম্বর ধানমন্ডি যেখানে ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে ৬ বছর আগে বাবা-মাসহ পরিবারের সব আপনজনকে হারিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিল না। তখন ৩২ নম্বরের সামনের রাস্তাতে বসেই বুকফাটা আর্তনাদে সবার জন্য দোয়া করেছিলেন, আত্মার মাগফিরাত কামনা করেছিলেন। ওই সময়টায় গণমাধ্যম আজকের মতো বিস্তৃত ছিল না। আর গণমাধ্যম মানে পত্রিকা। এর মাঝেও শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিয়ে লেখালেখি কম হয়নি। তখনকার আলোচিত সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’ এ লেখা হয়, ‘ইন্দিরার নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে এবং বাংলাকে সিকিম বানাবার জন্যই শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠানো হচ্ছে।’ সরকারি পত্রিকা ‘দৈনিক বাংলা’ এ ঘটনায় ভারতীয় পত্রিকায় ‘খুশির জোয়ার’ দেখেছে। ‘হলিডে’ তে লেখা হয়, ‘তার দেশে ফেরার ব্যাপারটি ঢাকা ও দিল্লি কর্তৃপক্ষের মধ্যকার এক চুক্তি অনুসারে বহু আগেই স্থির করা হয়।’ শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে পরদিন ১৯৮১ সালের ১৮ মে দৈনিক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় লেখা হয় ‘লাখো জনতা অকৃপণ প্রাণঢালা অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয় তাদের নেত্রীকে’ শিরোনামে লিখে- রাজধানী ঢাকা ১৭ মে মিছিলের শহরে পরিণত হয়েছিল। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টিও মিছিলের গতিরোধ করতে পারেনি। শ্লোগানেও ভাটা পড়েনি। লাখো কণ্ঠের স্লোগান নগরীকে প্রকম্পিত করেছে।

দলকে এবং দেশকে এ অভিযাত্রায় আনতে অনেক লড়াই-সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই, হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার আগের ছয়টা বছর তার দুঃসহ যন্ত্রণা এখনো অনেকের ধারণা-কল্পনার বাইরে। রওনা হওয়ার কয়েকদিন আগে মার্কিন সাপ্তাহিক নিউজউইকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে শেখ হাসিনা একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ১১ মে ৮১ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, তিনি নিহত হওয়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত নন; এমন কী যে সরকারের মোকাবিলা করবেন তার শক্তিকে তিনি বাধা বলে গণ্য করবেন না। ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ ভারত থেকে ফেরার সময় দিল্লি বিমানবন্দরে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছ-বছরের প্রবাস জীবনে আমার প্রতি যে মমতা ও ভালোবাসা দেখানো হয়েছে, তার জন্য আমি ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।’ সেই ঝুঁকির মাঝেই যে তার দেশে ফেরা, ফেরার পর বেঁচে থাকা, দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ক্ষমতা, সেই ক্ষমতায় টিকে থাকা- সে কথা তিনি নিজ মুখেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। সে সময়ে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে শেখ রেহানার এক স্মৃতিচারণে রয়েছে- ‘কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ঘাতকরা যদি আবার সক্রিয় হয়ে তাদের আরাধ্য কাজ শেষ করতে তৎপর হয়ে ওঠে? আমি ঠিক করলাম জয় আর পুতুলকে আমি সেই মৃত্যুপুরীতে যেতে দেব না। ওদের লন্ডনে নিয়ে আসব। ঠিক তখনই পুতুলের পক্স হলো। এদিকে দিল্লিতে আমার তিন সপ্তাহ থাকার কথা। কিন্তু বিশ্রীভাবে হাত পুড়ে যাওয়ায় প্রায় দু’মাস তখন চলে গেছে। আমার অফিসের ছুটি ও আর বাড়ানো যাচ্ছিল না। তাই কেবল জয়কে নিয়ে আমি লন্ডন ফিরলাম।’

আজকের বাস্তবতায় ভাবা যায় দুই বোনসহ পরিবারটির দুঃসহ সেই কষ্টের দিনাতিপাতের কথা? বাস্তব ও কঠিন এ পথে দেশে ফিরে বারবার মৃত্যুর মুখে পড়ছেন শেখ হাসিনা। এ পর্যন্ত তিনি ২০-২১ বার শত্রুপক্ষের হত্যা চেষ্টার সম্মুখীন হয়েছেন। শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিনটি তাই কেবল একটি তারিখ নয়, ইতিহাসের বাঁক ঘুরানো ঘটনা। এর মাঝে শুধু তার দল নয়, রাজনীতির মাঠের আরও অনেকের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় আছে। কথা দেওয়া, কথা রাখার পথে ডানবাম না তাকানোর চর্চা বঙ্গবন্ধুর ছিল। সেই শিক্ষা শেখ হাসিনাও নিয়েছেন। ওয়াদা বা অঙ্গীকার অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে কুখ্যাত ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বিচার শুরু করেন তিনি। ওই আমলেই ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের আদালত কর্তৃক ঘোষিত বিচারের রায়ে প্রকাশ্য ফায়ারিং স্কোয়াডে ১৫ জন ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুলভোটে জিতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেন। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। কারও কাছে হার না মানার এ বৈশিষ্ট্যেই এগিয়ে চলছেন তিনি। যা কেবল স্থানিক বা জাতীয় রাজনীতিতে নয়, বিশ্ব দরবারেও আলোচিত অভিযাত্রায় শামিল করেছে। বিশ্ব নেতৃত্বে এখন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা শেখ হাসিনার। আর সেখানে শেখ হাসিনা মানেই বাংলাদেশ।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন


বঙ্গবন্ধুকন্যা না ফিরলে কেমন হতো বাংলাদেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

১৯৮১ সালের ১৭ মে। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশে ফিরবেন। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের মানুষের কাছে এটা যেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ৯ বছর আগে তারা যেমন প্রতিক্ষায় ছিলেন, তেমনি ৯ বছর পরও তারা প্রতিক্ষায়। তবে এবারের প্রতিক্ষা অনেক ভয়ের। ভয়টাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু নাম এ দেশে নিতে দেওয়া হয় না। তার ছবি কোথাও টাঙ্গাতে দেওয়া হয় না। তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকারীদের বিচার আইন (ইনডেমনিটি) করে বন্ধ করা হয়েছে। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে পুরস্কার স্বরূপ চাকরি দিয়ে পাঠানো হয়েছে। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর চলছে দমন-পীড়ন। প্রায় ৬২ হাজার আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। ১৯৭৭ সালের অক্টোবরের ২ তারিখে অনুষ্ঠিত এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ১১৪৩ জনকে বিভিন্ন কারাগারে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। বিচারবহির্ভূতভাবে অন্তত ৩০০০ সেনাসদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা হত্যা ও গুম করা হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ’৭২-এর ঘাতক দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি দেওয়া হয়েছে, যাদের মধ্যে ৭৫২ জন দণ্ডপ্রাপ্ত ছিল। জামায়াতে ইসলাম জিয়ার সমর্থনে চলছে। দেশে গণতন্ত্র উধাও। গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সেনা শাসন চলছে।

সেই সময়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আলোকবর্তিকা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে প্রিয় জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা; দীর্ঘ ৬ বছরের নির্বাসন শেষে, নিজের ছেলে জয় (সজিব ওয়াজেদ জয়) ও মেয়ে পুতুলকে (সায়মা ওয়াজেদ পুতুল) বোন রেহানার (শেখ রেহানা) কাছে রেখে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে। এ দিন ঢাকায় বয়ে যাচ্ছিল কালবৈশাখী, ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়া। তাতে কী! শেখ হাসিনা আসবেন তাই কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগর লক্ষপ্রাণ মুজিবপ্রেমীর ভিড়। বিকাল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে। সেদিন রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকা শহর মিছিল আর স্লোগানে প্রকম্পিত হয়। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয় জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে এক নজর দেখতে সেদিন সারা দেশের মানুষের গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকা। বেলা ৪টা ৩২ মিনিটে শেখ হাসিনা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ট্রাকে নেমে আসেন। এই সময় লাখো জনতার কণ্ঠে ছিল গগণবিদারী স্লোগান; স্বাধীনতার অমর স্লোগান, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল ‘হাসিনা তোমায় কথা দিলাম পিতৃ হত্যার বদলা নেব’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে আমরা আছি তোমার সঙ্গে’। ‘শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’। এ সময় অনেকের চোখে ছিল অশ্রুধারা। প্রয়াত জননেতা আবদুর রাজ্জাক যখন মালা পরিয়ে দেন তাকে, তখন শেখ হাসিনাও অঝোর ধারায় কান্না করছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনার পরনে ছিল সাদা রঙের ওপর কালো ডোরাকাটা তাঁতের মোটা শাড়ি।

কুর্মিটোলা থেকে শেখ হাসিনার শেরেবাংলা নগরে এসে পৌঁছাতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেদিনের গগণবিদারী মেঘ গর্জন, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল। আর বৃষ্টির পানি মিশে গিয়েছিল বাঙালির চোখের আনন্দঅশ্রুতে। শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্থিত প্রায় ১৫ লাখ মানুষের হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসার জবাবে তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ একবার ভেবে দেখুন: ১৯৭৫ সালের আগস্টের সেই ভয়াল রাতের কথা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। বঙ্গমাতা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল কেউ বাদ গেল না। যদি সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানিতে না থাকতেন? যদি সেদিন তারা ৩২ নম্বরে থাকতেন তাহলে কী হতো? নিশ্চিতভাবেই ওই ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের চরম নিষ্পত্তি ঘটতে পারত; বেঁচে গেলে সেটি অলৌকিকই হতো। অথবা শেখ হাসিনা যদি কোনোদিন বাংলাদেশে ফিরে না আসতেন। যদি অভিমানে থেকে যেতেন নিরাপদ দূরত্বে। তাহলে আমরা বর্তমান যে বাংলাদেশকে দেখি সেই বাংলাদেশ কেমন হতো? আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অবস্থা আজ কোথায় থাকত? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশ যেভাবে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে তারইবা উত্তরণ ঘটত কী? এমন অজস্র প্রশ্নের উত্তর একটাই- শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসার কারণেই আজ গণতন্ত্রের মুক্তি মিলেছে, উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রার পথে বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ২০২২ সালে বলেন, ‘১৯৮১ সালে ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রয়োদশ জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের এক দূরদর্শী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।’ বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই থেকে দলের এবং দেশের হাল ধরে আছেন। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতায় না থেকেও মানুষের মুক্তির জন্য তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি বারবার বলেন, তার আর হারানোর কিছু নেই। তিনি যতদিন বেঁচে আছেন ততদিন বাংলাদেশ পথ হারাবে না।

শেখ হাসিনা দেশে ফিরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন হয়, বিজয় হয় গণতন্ত্রের। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এ সময় পাহাড়ি-বাঙালি দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে পার্বত্য শান্তিচুক্তি এবং প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি সই হয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসে এবং জনগণের কল্যাণে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে তার সাহসিকতা, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, দারিদ্র্যবিমোচন, বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তর, রোহিঙ্গাদের মানবিক আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব মানবতার ইতিহাসে মানবিক নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি এমন অসংখ্য দৃশ্যমান কার্যক্রম আজ মহিমান্বিত করেছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে আজ বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেলের স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব কিছু সম্ভব হয়েছে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যার ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা চার দশকের বেশি সময় আওয়ামী লীগের সভাপতি। নানা চড়াই-উৎড়াই, কারাবরণ, মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়াসহ অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে আজকের অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বের ফলেই আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ রেখে পাঁচ বার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছে এবং বর্তমানে টানা চতুর্থবার ক্ষমতাসীন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এই সময়ের শাসন আমলেই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নতুন মাত্রা সূচিত হয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলেই বাংলাদেশ স্বল্পন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ ডিজিটাল দেশে পরিণত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ উন্নত বাংলাদেশ হবার পথে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে বদ্ধপরিকর। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে পিতার মতোই অবিচল, দৃঢ় ও সাহসী শেখ হাসিনা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের কল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। ‘রূপকল্প ২০২১’ এর মধ্যম আয়ের বাংলাদেশকে ‘রূপকল্প ২০৪১’ এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধু-কন্যা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দেশের উন্নয়নে এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন শতবর্ষব্যাপী কর্মসূচি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০।

জাতির পতিা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাজারো প্রচেষ্টা, ত্যাগ তিতিক্ষার পর দেশের রাজনীতিতে একজন সফল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে নেতৃত্বে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু দেশের রত্ন নয়, তিনি বিশ্বরত্ন। তিনি বাঙালি জাতির চেতনার প্রতীক। আমাদের অহংকার। যার অপ্রতিরোধ্য পথ চলায় বাংলাদেশ আজ ছুটে চলছে উন্নয়নের মহাসড়কে। শেখ হাসিনা মানেই উন্নয়নের জয়জয়কার। বাংলাদেশের আস্থার প্রতীক। আমাদের সবার অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দলে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে বেশ কয়েকবার মরণ আঘাত চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শুধু তাকে নয় আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল বিএনপি-জামায়াত। এরপর ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একুশ শতকে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন। ডিজিটাল বিপ্লব ঘটানোই এই সরকারের লক্ষ্য ছিল না, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিই ছিল মূল লক্ষ্য। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের করে। এরপর ১১ জানুয়ারি (নির্বাচন হয় ৭ জানুয়ারি) ২০২৪ শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের (মোট ৫ বার) মতো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

শেখ হাসিনা যদি না ফিরতেন তাহলে কেমন হতো বাংলাদেশ? বাংলাদেশে কী আজও সেনাশাসন থাকত? গণতন্ত্রের কী মুক্তি মিলত? বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কখনো বিচার হতো? জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার হতো? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতো? দেশে যে এত উন্নয়ন তা কী হতো? এই যে বাংলাদেশে এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে, এই যে ঢাকার চারপাশের বৃত্তাকার রাস্তা, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, ডিজিটাল ও স্মার্ট শব্দ, ২৪ ঘণ্টা ঘরে ঘরে বিদ্যুৎÑএসব ঘটনা কী ঘটত? তবে একটি জিনিস নিশ্চিতই ঘটত। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল তারা ক্ষমতায় থাকত। ২০০১ সালে জিয়া প্রতিষ্ঠিত দলের মাধ্যমে তাদের গাড়িতে আমরা জাতীয় পতাকা দেখেছি। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে কিছু থাকত না। সংবিধানের চারটি মূলনীতি থাকত না। অসাম্প্রদায়িক দেশ থাকত না। হয়তো বদলে যেত জাতীয় সঙ্গীত। বদলে যেত মানুষের গায়ের পোশাক। উৎসবের রকম। মোড়ে মোড়ে হয়তো সেনাবহিনী থাকত। বাংলাদেশ এসব দেখার জন্য স্বাধীন হয়নি। আজ (মে ১৭) প্রধানমন্ত্রী-জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। আমরা বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই এ জন্য যে, বাংলাদেশের আজ যা কিছু অর্জন সেই অর্জন তার হাত ধরেই। আমরা তার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)

বিষয়:

মশামাছির মুখপোড়া 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

আবহমান গ্রামবাংলা হাজারো ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক হয়ে আজও টিকে আছে স্মৃতি জাগানিয়া হয়ে। নানা ধরনের পূজা, পার্বণ, আচার, পালন করত ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। সংস্কার, আচার, লোকাচার যাই বলিনা কেন, তখনকার লোকজন তা মানত। সংস্কৃতি মানেই একটি জাতি বা গোষ্ঠীর যাপিতজীবন চারণ। দুর্গা পুজোতে পাড়ার হিন্দু লোকজন চাঁদা ধরে প্রতিমা গড়তেন। কোনো জাতির আয়না হয়ে সমুজ্জ্বল থাকে তাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কার্তিকের শেষে ভোলা সংক্রান্তি যা ভোলাভুলি উৎসব বা মশামাছির মুখ পোড়া নামে পূজা ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পালন করা হতো। হিন্দু মুসলমান সবাই পালন করত এটা। বাঙালি জাতির সংস্কৃতি ধরে রাখার বয়স প্রায় দুই হাজার বছরের মূলে প্রোথিত। বঙ্গ বা বাংলা ছিল সম্পদে প্রাচুর্যে ভরপুর এক জনপদ। ফলে বারবার আঘাত এসেছে, যুদ্ধ হয়েছে, শত বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতিকে শুকুনের মতো খামছে ধরেছে ঔপনিবেশিক শাসন। আঘাত করেছে বর্গীরা। বিভিন্ন জাতির বসবাস হয়ে শংকর জাতির বারোয়ারি উপদ্রব সইতে হয়েছে চোখ বুঁজে। বারো মাসে তেরো পার্বণে একটি হলো মশামাছির মুখপোড়া বা ভোলাভুলি পূজা। খড়-বাঁশ দিয়ে তৈরি ভোলার প্রতিকৃতি বানিয়ে তাতে মশামাছি রেখে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর কেউ সেটা উঁচু করে ধরে দৌড়ে যেত আর চিৎকার করে বলত,

‘ভালা আইয়ে বুড়া যা, মশা-মাছির মুখ পোড়া যা।’

বাড়িতে ঠাট্টা সম্পর্কীয় ভাবী, বেয়াই, দাদা, দাদি, বেয়াইনরা কলাগাছের ডাগ্গোয়া কেটে পিছন থেকে পিঠে বারি দিয়ে বলত,

‘ভোলা ছাড় ভুলি ছাড়, বার মাইয়া পিছা ছাড়’। কেউ কেউ বাঁশের নতুন কুলা পিঠে পিটাইয়া দৌড়ানো দিত। বলত,

‘মশা মাছি বাইর অ, টাকা-পয়সা ঘর ল, জঞ্জাল সব দূর হ’।

সবাই মিলে কাঁচা তেঁতুল পেড়ে এই আগুনে পুড়িয়ে খাওয়া হতো। খড়, দড়ি, শোলা, কাপড়, কলাগাছের ডাগ্গোয়া, প্রয়োজন পড়ত এই কাজে। জনমনে ধারণা ছিল, খড়ের আগুনে এবং কলাগাছের ও কুলা দিয়া পিটিয়ে ঘর বা সংসারের যাবতীয় বদ বা খারাপি দূর হয়ে যাবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন মাসব্যাপী পূজা করত। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের লোকজন কার্তিক মাসে প্রতিদিন সকালে স্নান করে দেবতাকে ভোগ দিত। বাড়িতে মাইক বাজিয়ে গান হতো, লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি, কাগজ, ত্রিকোণাকৃতি করে কেটে পাটের সুতলীতে আঁটা দিয়ে লাগিয়ে বাড়ি-ঘর সাজাত মানুষ। কার্তিক পূজা করা হতো এ মাসেই। মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে। পুজোতে প্রসাদ দেয়, আতপ চাল ভিজিয়ে তাতে কলা মাখিয়ে। সাথে আখ টুকরা করে কেটে দেওয়া হতো। ঢোল, খঞ্জনি, কাঁসা বাজিয়ে কীর্তন গাইত পূজারী ও তার লোকজন। অন্যরা সাথে কোরাস গাইত। মেহমান, মেয়ে নাইওর আসত বাবার বাড়িতে। আজকের প্রজন্ম ইন্টারনেট মোবাইলে বুঁদ হয়ে সামাজিকতা ভুলে গেছে। গুছিয়ে কথাই বলতে জানে না। সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে তাদের জ্ঞান খুব নগণ্য। বিভিন্ন সামাজিক আচার, মশামাছির মুখপোড়া কিংবা ভোলাভুলির পূজা কি তা জানেই না। দল বেঁধে খড়ের মূর্তি বানিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে হৈ-হুল্লোড় করার মানুষ নেই আর। সেই মন-মানসিকতা হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। বাঙালির গ্রামীণ ঐতিহ্যের ইতিহাস হাজার বছরের লালিত স্বপ্নমোড়ানো ইতিহাস। যা যুগ যুগ ধরে, কাল থেকে মহাকাল রচনা করে যাবে নীরবে নিভৃতে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে।

লেখক: শিশু সাহিত্যিক

বিষয়:

গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে। কলেজে পড়ার সময় যা ছিল মুখে মুখে এবং বিশ্বাসে, আজ তা-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের লেখা। আপনি ইচ্ছেমতো লিখবেন, মুছবেন, আঁকবেন, মুছবেন আর সুর করে বলবেন ‘কুমির, তোমার জলে নেমেছি; পারলে আমায় ধরে দেখাও।’ অথবা গম্ভীর গলার হুঙ্কারÑ ‘ক্যাচ মি, ইফ ইউ ক্যান’। এটি আজকের দিনে হয়ে দাঁড়িয়েছে ম্যাজিক স্লেটের গল্প। এখন মনে হয় প্রজা যে তন্ত্র নির্মাণ করেছে, সেই তন্ত্রের চালিকাশক্তি কি প্রকৃতই প্রজার হাতে থাকে? নাকি এ তন্ত্রে প্রজার প্রেরিত প্রতিনিধি আর শাসক দল এক দুরূহ অন্তরালে নিজেদের ঢেকে রাখে যাকে সবাই দেখতে পায় না; শুধু কোনো অজ্ঞাত নির্দেশ বা কোনো অলীক সম্মোহনে রথের চাকাগুলো অবিরাম ঘুরতে থাকে, যার সামনে হুজুর মাই-বাপ বলে হাঁটু মুড়ে বসা ছাড়া প্রজার আর কোনো গতি নেই।

ধরুন, আপনার পাড়ায় একজন কুঁড়েঘরে থাকে। হঠাৎ এক দিন দেখলেন, বাড়িটা প্রাসাদ হয়ে গেল। তার আগে থেকেই আপনি দেখছিলেন, লোকটি শাসক দলের সঙ্গে ওঠাবসা করছে, নেতার পিছনে হাত কচলাচ্ছে, তার মোটরবাইক হচ্ছেÑ এক দিন সে জনপ্রশাসক হলো কিংবা জনপ্রতিনিধি হলো। আপনার ফুটপাত বাঁধানো হলো, কলে পানি এল, রাস্তায় বাতি জ্বলল, আর তার বাড়িটা হঠাৎ প্রাসাদ হয়ে গেল। আপনি খোঁজ নিলেন। জনপ্রতিনিধি কিংবা সরকারের কর্তাব্যক্তিটির বেতন, পরিবারের আয়, খরচ সবকিছু মিলিয়েও আপনি হিসাব মেলাতে পারলেন না; কিন্তু এ অবস্থায় আপনি কী করবেন? আপনার কী মনে হবে মাস্টারমশাই তো বটেই, কারও কিছু করার নেই। আপনি বড়জোর, সবকিছু ম্যাজিক স্লেটে লিখে রাখতে পারেন; কিন্তু ম্যাজিক স্লেটের ওই লেখা দেখে আপনার পোষা বিড়ালটাও কিন্তু ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হেসে উঠবে। বাকি সবাই বলবে, মাস্টার মশাই এবং আপনি দুজনেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন। আপনি বলতে থাকবেন, স্লেটে সব লেখা আছে; কিন্তু সময়মতো দেখলেন, সেই ম্যাজিক স্লেটটিও ফাঁকা। শয়তান বেড়ালটা থাবা দিয়ে ম্যাজিক বাটনটা টিপে দিয়ে স্লেটটি ফাঁকা করে দিয়েছে ততক্ষণে। আপনার রাগ হলে কোনো লাভ নেই; কেননা এমন ঘটনা এখন থেকে আপনার জীবনে ঘটতেই থাকবে, আর ঘটতেই থাকবে। যেমন কিছু লোক জেলে যাবে, কিছু লোক জেলে যাবে না বিদেশে যাবে। যেমন কিছু লোক বিদেশেই থাকবে, জেলে যাবে না। আরও শুনতে চান? ঠিক আছে, না-হয় আরও একটু বলি। আপনি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দেখলেন, একটা লোককে অনেকে মাটিতে ফেলে পেটাচ্ছে। আপনি দৌড়ে গেলেন সেখানে; কিন্তু গায়ের জোরে পারবেন না ওদের সঙ্গে। পরে যখন পুলিশ আপনাকে ডাকবে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে, আপনি চিনতে পারবেন কারা মেরেছিল লোকটিকে; কিন্তু পুলিশসহ কেউ আপনাকে মানবে না। গোলাপি শার্ট পরা ওই লোকটাই যে রাস্তার প্রধান গুণ্ডা ছিল, সে আপনি বললেই হলো? প্রমাণ কোথায়? গোলাপি শার্ট তো কত মানুষই পরে। যতসব ভুল-ভাল কথাবার্তা। আপনি মাথা নিচু করে থানা থেকে বেরিয়ে আসবেন। আপনি ওই মাস্টার মশাইয়ের মতো কিছুই দেখেননি অথবা যা দেখেছেন, তা আপনি আসলে দেখছেন না। অতএব হে পাঠক, হে মহামান্য পাঠকÑআপনারা এতক্ষণ যা পড়লেন, এই এতগুলো শব্দ আসলে আপনারা পড়েননি; একটা সাদা পাতা দেখেছেন শুধু। আর ভেবেছেন, এগুলো আপনি পড়েছেন। পাড়ার লোকটার প্রাসাদোপম বাড়ির জন্য, ওই গোলাপি শার্ট পরা লোকটার বিরুদ্ধে লেখার জন্য যদি কখনো আমার দিকে কেউ আঙুল তোলে, আমি কিন্তু বলব যে লেখে, সে আমি নই। সে ম্যাজিক স্লেটের ম্যাজিক লেখক- অন্য কেউ।

লজ্জার মতো অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের মতো ভয়ও সমাজে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমার যদি মনে হয়, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে অপরাধবোধে ভুগব কিংবা কলঙ্কের ভয়ে সারাক্ষণ কাঁটা হয়ে থাকব, তাহলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে আমি বহুবার ভাবব। অন্যদিকে, সমাজে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত আমাদের অপরাধবোধ এবং কলঙ্কের ভয় কমায়। সমাজের অধিকাংশ লোক দুর্নীতিতে যুক্ত না থাকলে দুর্নীতিতে না জড়ানোটাই তখন সমাজের আদর্শ হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে কেউ সামান্য দুর্নীতিতে যুক্ত হলেই সে অপরাধবোধে ভোগে, কলঙ্কের ভয়ে থাকে। কিন্তু সমাজে যদি সবাই দুর্নীতিতে যুক্ত হয়, তাহলে দুর্নীতিটাই ‘আদর্শ আচরণ’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে যায়। সেই দুর্নীতিতে আর অপরাধবোধ থাকে না, কলঙ্কের ভয় থাকে না। তখন দুর্নীতিতে এমনিতেই জড়িয়ে পড়ার মানসিক জরিমানার অঙ্কটা কমতে থাকে। এক সময় দুর্নীতি হয়ে পড়ে ‘স্বাভাবিক’। এমন সমাজব্যবস্থায় বেঁচে থাকার জন্য দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়াটাই মানুষের পক্ষে হয়ে ওঠে যুক্তিযুক্ত। অন্তত এমন যুক্তিই দাঁড় করিয়ে ফেলে দুর্নীতিগ্রস্তরা। খুব প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন হলো- এমন সমাজ হয়ে গেলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? উত্তরটা কারও জানা থাকে না সেই বাস্তবতায়। তবে এর মাঝখানে যেটা সবার জানা আছে তা হলো, সরকার বা রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্দরে যে ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে সেটা ক্রমাগত অস্বীকার করলে কিংবা সমাজের স্বাভাবিক আচরণ বলে মেনে নিলে সেই দুর্নীতি থেকে বেরোনো যাবে না কোনোদিনই।

মাস্টার মশাই, এত কথাই বা কেন বলতে যাবেন? আমাকেও তেমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। কী দায় এত আমার কিংবা মাস্টার মশাইয়ের? যখন অন্যরা চোখ বুঁজে আছে, তখন বাপু তোমার এত বাড়বাড়ন্ত কেন? তুমি কী দেখছ না- চারদিকে কী ঘটছে? পাঁচ বছর পর পর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে সরকারের সরে আসার উদ্যোগ ইতোমধ্যেই গোচরীভূত হয়েছে। নতুন আইন হয়ে যাওয়ার পথে সরকার হাঁটছে, যেখানে পাঁচ বছর পর

পর আর ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের বিবরণী দিতে হবে না। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জবাবদিহি থেকে দায়মুক্তি দেওয়ার রাস্তা নিশ্চিত হয়ে যাবে। দুর্নীতিকে সুরক্ষিত ও উৎসাহিত করার এর চেয়ে ভালো পন্থা আর কি-বা হতে পারে। আপনি যা-ই ভাবেন, যেভাবেই ভাবেন ১৫ লাখ সরকারি চাকরিজীবীদের পাঁচ বছর পর পর সম্পত্তি বিবরণের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে সংশোধন সংসদে আসছে শিগগিরই। সংশোধনী আনার পক্ষের যুক্তি তো অকাট্য। যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়া যাবে। সরাসরি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কেন এ বিপদের মধ্যে ফেলা! আপনি যতই বলবেন, এ সংশোধনী আনা হলে এতে অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসাহিত হবে দুর্নীতি করতে। যারা এখনো সাধু হওয়ার স্বপ্নে আছে, তারাও অচিরেই ভুল পাল্টে অধিক সংখ্যার মানুষের কাতারে যোগ দেবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান নেই। বাঃ! দারুণ ব্যাপার। নির্ভয়ে দুর্নীতি করুন, নির্ভয়ে অবৈধ সম্পদ বাড়িয়ে চলুন- ভয়ের চিহ্ন নেই, কেউ আর পিছুটানে আটকে যাবেন না। স্বদম্ভে এগিয়ে যাও তুমি দুর্নীতি। ম্যাজিক স্লেটে যা লেখা হচ্ছে, মুছে দিয়ে এগিয়ে যাও স্বদর্পে। গোলাপি শার্ট পরে ধুলো দেওয়া মানুষটির মতো এগিয়ে চলো হে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেউ দেখছে না তোমাদের। দেখলেও ওদের দেখায় বিশ্বাস করে কে? বিবরণী দিয়ে আটকে যেও না। সংশোধনী পাস করিয়ে নাও জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে। তারপর মাণিকজোড় হয়ে চলো একসঙ্গে, একপথে।

লেখক: কলামিস্ট


সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের জন্য তরুণদের দক্ষ করে তোলা জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন থেকে তরুণ যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তরুণদের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতার কারণে এ বিষয়ে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই তরুণদের পড়াশোনার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে নিজেকে প্রস্তুত করতে আহ্বান জানান। কোনোমতে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য পড়াশোনা না করে নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তোলার আহ্বানও প্রধানমন্ত্রী অসংখ্যবার জানিয়েছেন; কিন্তু আমাদের দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী সেদিকে মোটেও মনোযোগ দিচ্ছে না। এমনকি অসংখ্য তরুণ যারা পড়াশোনা এবং কর্মসংস্থান নিয়ে হতাশ এবং উদাসীন রয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২৩ জরিপে উঠে এসেছে যে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই আছেন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে নেই। বাংলাদেশের ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার তিনগুণেরও বেশি মেয়েদের ক্ষেত্রে। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সি মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার শতকার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিপরীতে ছেলেদের এই হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছেলে। মেয়েদের বাল্যবিয়ে, দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা কিংবা মূল্যস্ফীতির কারণেই তরুণদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ পাওয়া যায়।

গত ১১ মে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রত্যয় নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক নাটোরে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো তরুণ-তরুণী আর কর্মহীন ও বেকার থাকবে না। যদি আমরা তাদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।’ যৌক্তিকভাবেই এখন যোগ্যতা এবং দক্ষতার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তরুণদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমাদের দেশ একধাপ এগিয়ে যাবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের নানাভাবে দক্ষ করে তুলতে উদ্যোগ এবং উৎসাহ থাকলেও তারা নিজেদের দক্ষ করে তুলতে একধাপ পিছিয়ে রয়েছে। তারা শুধুই চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নেমেছে; কিন্তু নিজেদের কীভাবে দক্ষ করে দেশের উন্নয়নের ধারক হওয়া যায়- সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করে না বললেই চলে।

গত ১৪ মে গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পারলাম, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের অর্থায়নে বাংলাদেশসহ চার দেশের তরুণ উদ্যোক্তা ও উদ্যোক্তা উন্নয়নে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রতি বছর প্রো-ফেলোস কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ২০২৪ সালের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ চলছে। ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সি ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসার প্রতিষ্ঠাতা, ব্যবসার উদ্যোক্তা, স্টার্টআপের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তারা এ ফেলোশিপের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ধরনের ফেলোশিপের মাধ্যমে বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে বসে যারা কাজ করছেন, তাদের অনেক সম্ভাবনা আছে। যারা বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন, তাদের জন্য এই ফেলোশিপ ভীষণ কার্যকর হতে পারে; কিন্তু এর জন্য নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতাকে প্রমাণ করতে হবে।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। আমরা জানি, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। দেশের অভ্যন্তরেও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তির বৃদ্ধির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।

আওয়ামী লীগের ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘দিন বদলের সনদ’, ২০১৪ সালের ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’, ২০১৮ সালের ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ: উন্নয়ন দৃশ্যমান, বাড়বে এবার কর্মসংস্থান’ স্লোগানে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগ। ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাসহ মোট ১১টি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যিক কৃষি, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং রোবোটিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ন্যানো টেকনোলজিসহ গ্রামীণ অকৃষিজ খাতের উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন মোকাবিলায় উপযুক্ত কর্মকৌশল গ্রহণ করার বিষয়ে সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং কৃষি গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপের বিষয়টিও ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ কর্মরত রয়েছেন। যাদের ৮৮ শতাংশই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়া অর্থাৎ প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীর কাজের প্রশিক্ষণ নেই। আমাদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে হলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স, ফিজিক্যাল ইন্টেলিজেন্স, সোশ্যাল ইন্টেলিজেন্স, কনটেস্ট ইন্টেলিজেন্সের মতো বিষয়গুলো মাথায় প্রবেশ করাতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে জাতিসংঘের ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়ন সূচকে সেরা ৫০টি দেশের তালিকায় থাকার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশে অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রোরেল, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু করা, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালী বিদ্যুৎ প্রকল্প। বাংলাদেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণ, উন্নয়ন ও মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার।

তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে কী করণীয়, সে বিষয়ে সবাই সজাগ থাকলেও ফলপ্রসূভাবে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তরুণ জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা এবং উন্নয়নে সম্পৃক্ত করা সম্ভব না হলে দেশের জন্য আশানুরূপ উন্নয়ন সফলতা পাওয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগই এখন তরুণ যুবগোষ্ঠী। বাংলাদেশে তরুণরা সংখ্যায় বিশাল হলেও তাদের কতটা ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে যুবশক্তিকে যথাযথভাবে জনশক্তি হিসেবে কাজে লাগানো যায়নি। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রমবাজারের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত যুবক প্রতি বছর শ্রমবাজারে যুক্ত হলেও সে অনুপাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়া।

আমরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি; কিন্তু কীভাবে সেই উন্নয়ন হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। দেশের তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে, দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ এই তরুণগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুততর এবং টেকসই করা সম্ভব। আর এ জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নয়, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু আমরা ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের কার্যকর অনুকূল পরিবেশ নেই। অন্যদিকে সরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, এটি ঠিক; কিন্তু সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে দুর্নীতির হার বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যদি আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে অবশ্যই যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আন্তরিক দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


ক্রলিং পেগ মুদ্রাস্ফীতি রোধ, রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের জন্যও ইতিবাচক

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
হীরেন পণ্ডিত

ক্রলিং পেগ পদ্ধতি কী? যার মাধ্যমে বাড়ল ডলারের দাম। একলাফে ৭ টাকা বাড়িয়ে ডলারের নতুন দাম নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন ১১০ টাকায় থাকা ডলারের অফিসিয়াল দাম একদিনে ১১৭ টাকায় উন্নীত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। সম্প্রতি একটি সার্কুলার জা‌রি করে এ দাম ঘোষণা করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। ক্রলিং পেগ হচ্ছে দেশিয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভোজ্য তেল, মসুর ডাল ও চিনি-পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্য আমদানি করতে ব্যাংক থেকে ডলার কিনে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। সাধারণত ডলারের দাম যখন বেড়ে যায়, দেশের বাজারেও পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। আবার ডলারের দাম কমে গেলে সে অনুযায়ী পণ্যের দাম কমে যায়। গত দুই বছরে বাজারে ডলারের প্রকৃত যে রেট ছিল, সেই তুলনায় অফিসিয়াল রেট ছিল ভিন্ন। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর আগেও রেমিট্যান্স ও আমদানি বাবদ ডলারমূল্য নির্ধারিত ছিল ১১০ টাকায়। অথচ অধিকাংশ ব্যাংককে রেমিট্যান্স কিনতে হয়েছে ১১৫-১১৬ টাকার বেশি দামে। ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে লোকসানে ডলার বিক্রি করেনি। তারা এরচেয়ে ১-২ টাকা বেশি দরে ডলার বিক্রি করেছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমদানি এলসি নিষ্পত্তিতে ১২০ টাকা বেশি ডলারের দর নিয়েছে। বিনিময় হার অস্থিতিশীল হওয়ার প্রবণতা থাকলে এবং মূল্যস্ফীতি উচ্চ হারে থাকলে কোনো দেশ ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশ এখন এই পরিস্থিতির মধ্যেই আছে।

নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ব্যবসায়ীদের পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। কারণ এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণ করছে, এটাই প্রকৃত মার্কেট রেট। তবে নতুন করে এই রেট বাড়ানো হলে তখন পণ্যমূল্য বাড়ার সম্ভাবনা থাকবে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ফলে ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা হয়েছে। আমদানিকারকরা এখন যেকোনো ব্যাংক থেকে নির্ধারিত দামে ডলার পেতে পারবেন। নতুন ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের দাম বাড়েনি। উল্টো গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় দাম কম রয়েছে।

বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ করে মার্কিন ডলারের জোগান বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে অবস্থায় আছে, তা যে কোনো সময় বিপদের কারণ না হতে পারে সেদিকেও লক্ষ্য রাখা। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকদিন ধরেই কৃত্রিমভাবে ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বাজারের ওপর সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। শুধু অস্বাভাবিক কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেই সরকার বাজারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু শুরু থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় হার পরোক্ষভাবে হলেও নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল।

ক্রলিং পেগ পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে চাচ্ছে। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি হচ্ছে এ রকম এ ব্যবস্থায় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি করিডর সৃষ্টি করা হবে। সেই করিডরের ভেতওে থেকে ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোকে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক শিডিউল ব্যাংকের জন্য ডলারের বিনিময় হার

বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এ মুহূর্তে ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করে, তাহলে ডলারের বিপরীতে টাকা যে অতিমূল্যায়িত হয়ে আছে তা কমে আসবে। ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেও আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে-এ ধারণা সত্য নয়। কারণ, বর্তমানে আমদানিকারকদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে চাহিদামতো ডলার কিনতে না পেরে কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে ডলার সংগ্রহ করে তাদের চাহিদা পূরণ করছেন।

কাজেই ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হলেই যে বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে, তা নয়। যদি ডলারের উচ্চ বিনিময় হারের কারণেই স্থানীয় বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাহলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য কেন বাড়ছে? স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার পেছনে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিই একমাত্র কারণ নয়। এজন্য বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাই বেশি দায়ী।

বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবছর যে পরিমাণ পণ্য ভোগ করে, এর মাত্র ২৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এবং বাজারজাত করা হয়। তাহলে এসব পণ্যের মূল্য যখন তখন বাড়ে কেন? দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একক বৃহত্তম খাত হচ্ছে পণ্য রপ্তানি। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রথমবার ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছে এ খাত থেকে। এর মধ্যে তৈরি পোশাকসামগ্রী রপ্তানি করে অর্জিত হয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলারের মতো।

এ খাতটি আমদানিনির্ভর বিধায় জাতীয় অর্থনীতিতে এর মূল্য সংযোজনের হার তুলনামূলকভাবে কম। এ খাত থেকে যে অর্থ আয় হয়, তার ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশই কাঁচামাল, ক্যাপিটাল মেশিনারিজ এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে পুনরায় বিদেশে চলে যায়। এছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ কাজ করেন।

বাংলাদেশের প্রকৌশলী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ কর্মীরা বিদেশে গিয়ে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে দক্ষ লোকবল তৈরির চেয়ে দক্ষ জনশক্তি আমদানির প্রতি বেশি ঝোঁক লক্ষ করা যায়। দীর্ঘ মেয়াদে এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। যেহেতু বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে, তাই বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসজাত ১২২টি পণ্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করে এসব পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে। এর উদ্দেশ্য ছিল লেনদেনের ভারসাম্যকে অনুকূল অবস্থায় নিয়ে আসা। দেখা গেল, আমদানি ব্যয় অনেকটাই কমে এসেছে।

আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যকে পরিকল্পিতভাবে ঢেলে সাজানো দরকার। যাতে এ খাতের সম্ভাবনাকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানো যায়। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে জনশক্তি রপ্তানি। এ খাতে যে অর্থ আয় হয় তার প্রায় শতভাগই জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করে। এছাড়া প্রায় দেড় কোটি মানুষের বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এ খাত। কিন্তু এ খাতটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। গত বছর ১৩ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে গিয়েছে কর্মসংস্থানের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানি খাতে আয় করেছে ২৩ বিলিয়ন ডলার।

তাহলে বাংলাদেশিরা কি পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ দেশে প্রেরণ করেনি? তারা অবশ্যই দেশে অর্থ পাঠিয়েছে। কিন্তু তা বৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠিয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ দেশে প্রেরণ করা হলে প্রতি ডলারে গড়ে ১২ থেকে ১৪ টাকা বেশি পাওয়া যায়। এজন্য ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রবাসী আয়ের ওপর দেওয়া নগদ আর্থিক প্রণোদনা বহাল রাখা যেতে পারে। তাহলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ চ্যানেলে অর্থ দেশে প্রেরণে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার আগে এই পদ্ধতি চালুকে কার্যকরী একটি পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেন বেসরকারি ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্ট। ব্যাংকগুলো এখন ১১৭ টাকার নিচে বা ওপরে ডলারের কেনাবেচা করতে পারছে। তবে এই দরের চেয়ে খুব বেশি কম বা বেশি দামে ডলারের লেনদেন করা যাবে না। প্রতিদিন কত দামে ডলার কেনাবেচা করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সেটা জানিয়ে দিতে হবে। এছাড়া ক্রলিং পদ্ধতি চালুর ফলে চলমান ডলার-সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে মনে করেন এই ব্যাংকার।

এদিকে ডলারের দাম বাড়ায় আমদানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এতদিন ডলার পাওয়া নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা থাকলেও পাওয়া যাচ্ছিল এবং দাম তুলনামূলক কম ছিল। এখন ডলারের দাম একবারে ৭ টাকা বাড়ানোর ফলে আমদানি ব্যয় বাড়বে, বাড়বে পণ্যের দাম। একই সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। ফলে চাপ বাড়বে সাধারণ মানুষের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এখন থেকে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলার কেনাবেচা হবে। এ পদ্ধতিতে সম্প্রতি ডলারের রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা। মুদ্রানীতিতে একই সঙ্গে ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে। ক্রলিং পেগ হলো একটি আর্থিক ব্যবস্থা, যা জাতীয় মুদ্রা বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট পরিসরে (ব্যান্ড) ওঠানামা করতে দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যান্ডের বাইরে চলে যাওয়া থেকে বিনিময় হার রাখতে চেষ্টা করে।

চীন, ভিয়েতনাম, নিকারাগুয়া এবং বতসোয়ানা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এমন কয়েকটি দেশ। পেমেন্টের ভারসাম্যের স্থিতিশীলতা প্রচারের জন্য তারা এই সিস্টেমটি বেছে নেয়। এবং কখনও কখনও তারা রপ্তানি বাজারে দেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বাড়াতে পর্যায়ক্রমে বিনিময় হার সামঞ্জস্য করে। মূল্যস্ফীতি হলো স্বতন্ত্র পণ্য ও পরিষেবার দাম বৃদ্ধি। এটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। যেমন ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচ, বর্ধিত চাহিদা বা সরকারিনীতি। বাজারে যদি কোনো পণ্য ও সেবার চাহিদা বেড়ে যায় এবং সে অনুযায়ী সরবরাহ না থাকে, তখন দাম বেড়ে যায়। আবার কোনো জিনিস তৈরি করতে যে সামগ্রী প্রয়োজন তার দাম বাড়লেও মূল পণ্যের দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে একটি দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে পণ্য ও সেবা সরবরাহ পর্যাপ্ত না থাকলেও দামে এর প্রভাব পড়ে।

মুদ্রানীতিতে ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ ও সরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ। বেসরকারি উৎপাদনশীল খাতে ঋণ কমে গেলে উৎপাদন কার্য কমে যাবে; ফলে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সরকারি খাতে তো ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হয়েছে।

ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, 'ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম বাড়লেও এর জেরে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বাড়ার সুযোগ নেই। কারণ প্রকৃত বিনিময় হার বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েছে। তাদের মতে, ডলারের অফিসিয়াল দাম ১১০ টাকা হলেও খোলাখুলিভাবে ১১৮-১২০ টাকা বা তারও বেশি দামে বেচাকেনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবধান কমানোর পদক্ষেপ নিয়ে ডলারের গড় দাম ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এরচেয়ে ১ টাকা কম বা বেশি রাখা যাবে ডলারের দাম।

ক্রলিং পেগ চালুর ফলে আমদানি ব্যয় খুব বেশি বা বাড়বে না। বরং ডলারের দামের এই সমন্বয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘদিন ধরে ডলারের রেটকে ঘিরে অনিশ্চয়তায় থাকা আমদানিকারকরা এই অনিশ্চয়তা দূর হওয়ায় স্বস্তি পাবেন। এছাড়াও আমদানিকৃত পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা সহজ হবে। উল্টো ডলারের ভালো দাম পাওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গবেষক


উন্নয়নশীল দেশের বাজেট প্রণয়ন সব সময় চ্যালেঞ্জিং

আপডেটেড ১৫ মে, ২০২৪ ১১:১২
ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ

জাতীয় বাজেট আসছে। আগামী জুনের শুরুর দিকে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হবে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বাজেট প্রণয়ন সব সময়ই বেশ চ্যালেঞ্জিং। রাষ্ট্রীয়পর্যায়ে তো বার্ষিক বাজেট তৈরি করতেই হয়। আমরা জানি ব্যক্তিপর্যায়ে এবং প্রাতিষ্ঠানিকপর্যায়ে বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে। বাজেট হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বছরের সম্ভাব্য আয়- ব্যয়ের খতিয়ান। তবে জাতীয় বাজেট এবং ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক বাজেটের ক্ষেত্রে আয় বুঝে খাতওয়ারি ব্যয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করতে হয়। কারণ এসব ক্ষেত্রে চাইলেই আয় বাড়ানো যায় না। আর জাতীয় বাজেটের ক্ষেত্রে প্রয়োজন নির্ধারণ করে আয়ের পরিমাণ এবং খাত নির্ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। তবে সরকারের আয় বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকলেও সব সময় তা যৌক্তিকভাবে বাড়ানো সম্ভব হয় না। জনগণের ওপর বর্ধিতহারে করারোপ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। অনেক সময় যাদের কর দেওয়ার তারা নানা ছুতোয় কর দেন না এবং আদায় করও যায় না। বর্তমান সরকার গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে।

আগামী অর্থ বছরের জন্য প্রণীত বাজেটে অতীতের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরের (২০০২৩-২০২৪) জন্য বাস্তবায়নাধীন জাতীয় বাজেটে যেসব অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলা হয়েছিল নানা কারণেই তা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করা সম্ভব হবে বলে দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি। চলতি অর্থ বছরের জন্য ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে তা ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, তা হবে সাড়ে পাঁচ বা ছয় শতাংশ। কেন এমন হচ্ছে? অর্থনীতিতে করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতের কারণে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার কার্যকর পদক্ষেপ বাজেট থাকা জরুরি বলে আমি মনে করি। মূল্যস্ফীতি একটি জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী সমস্যা, যা নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজন রয়েছে। আর ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।

আগামী অর্থ বছরে জাতীয় বাজেটে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণের হার খুবই কম। বর্তমানে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৮ শতাংশ (২০২২-২৩)। অথচ প্রতিবেশী দেশগুলোতেই কর-জিডিপির অনুপাত অনেক বেশি। যেমন- নেপালে তা ১৮/১৯ শতাংশ এবং ভারতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ (২০২২-২৩)। পৃথিবীতে যেসব দেশে কর-জিডিপি অনুপাত সবচেয়ে কম বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। চেয়ে খারাপ হলেও কর-জিডিপির অনুপাত সেই দেশে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ (২০২১)। অন্যদিকে বাংলাদেশে ধনী হওয়ার হার উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কিন্তু সঠিক মাত্রায় কর প্রদান না করা। নানাভাবে তারা ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। এটা কোনোভাবেই চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এ রকমটি চলতে থাকলে সরকারকে বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উৎস থেকে বর্ধিত হারে ঋণ গ্রহণ করতে হবে।

অতি মাত্রায় ঋণ নির্ভর হয়ে পড়া একটি দেশের জন্য কোনোক্রমেই লাভজনক নয়। এখনো আমরা ঋণের ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক অবস্থানে রয়েছি, কিন্তু এটা কত দিন থাকবে সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে বিদেশি ঋণের পরিমাণ হচ্ছে মোট জিডিপির ২১ শতাংশের মতো। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের হার প্রায় সমপরিমাণ। অর্থাৎ বিদেশি এবং অভ্যন্তরীণ মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট ঋণের হার হচ্ছে জিডিপির ৪২ শতাংশের মতো। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যাদের ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী জিডিপির ১২৯ শতাংশ (২০২২)। আর জাপানের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ২৬৩ শতাংশ (২০২৩) এবং ভারতে ৮৬ শতাংশ (২০২২-২৩)। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে যে ঋণ না। সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে আসে। সেই ঋণের অর্থ ব্যবহারের দায়িত্ব যাদের হাতে থাকে তারা অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে তা ব্যবহার করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধান্ধাবাজির মাধ্যমে। আমাদের সমস্যা জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাতে নয়। সমস্যা হচ্ছে গৃহীত ঋণের সব অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পের সুফল যতটা পাওয়ার কথা ততটা পাওয়া যাচ্ছে না। বাজেটে বিভিন্ন খাতে ও প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে যথাসময়ে এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ আরও বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা খাতে জিডিপির অনুপাত হিসেবে বাজেট বরাদ্দ ধীরে ধীরে কমছে। চলতি বছরে তা ২ শতাংশের কম। শিক্ষা অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজের জন্য ব্যয়িত হচ্ছে। ফলে খুবই কম। বলা হয়, যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই শিক্ষা বাজেটের প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই। বাজেটে থাতে যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে তাঁর বেশির ভাগই শিক্ষার মানোন্নয়ন ও গবেষণার কাজে অর্থ বরাদ্দ থাকছে খুবই কম। বলা হয় যেহেতু বাজেটের আকার বাড়ছে তাই অনুপাত কম হলেও টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে না। কিন্তু শিক্ষা খাত এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে সেখানে শুধু ব্যজের অঙ্ক কিছু বাড়লেই চলবে না, জিডিপির অনুপাতও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন; কিন্তু অনেক সময় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয় না, শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোর এবং পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থ যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। গবেষণা ও শিক্ষার মানোন্নয়নে বরাদ্দ ও সঠিক ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন।

আগামী জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থানের ওপর ব্যাপক মাত্রায় জোর দিতে হবে। করোনাকালিন অবস্থায় অনেকেই তাদের কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এ ছাড়া শ্রম বাজারে নতুন নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার অতীতের মতো আগামী বাজেটেও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত ব্যয় বরাদ্দ দেবে বলে আশা করা যায়। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের অংশ হিসেবেও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির ওপর বিশেষ জোর দিতে হবে।

বর্তমান সময়ে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকার এখন জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ ব্যয় করছে। সরকার পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে আন্তরিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই ব্যাপকভাবে ঘটতে দেখছি। জটিলতা সৃষ্টি করবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের আরও ব্যয় বাড়াতে হবে, যা অগ্রাধিকার নির্ধারণ এই খাতে ব্যয় ও কার্যক্রম বাড়ানো না হলে আগামীতে আগামী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরও করে প্রকল্প গ্রহণ ও কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।

আগামী অর্থ বছবের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টার পাশাপাশি বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা প্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি যদি কমিয়ে এনে সহনীয় পর্যায়ে নামানো না যায় তাহলে জনগণের মনে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। এখানে বড় চ্যালেঞ্জ দুষ্টচক্র (সিন্ডিকেট)। অনেক সময় দেখা যায় সরকারের ভালো পদক্ষেপ বা উদ্যোগ গ্রহণ মাঠপর্যায়ে গিয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মহল বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। উচ্চমূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পলিসি ব্রেট বাড়ানো হয়েছে এবং ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েছে; কিন্তু দেশে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব পড়ছে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ রকম পদক্ষেপ কাজ করেছে; কিন্তু বাংলাদেশে এই উদ্যোগ সঠিকভাবে কাজ করছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এমন উদ্যোগ কাজ করেছে এমনকি অর্থনৈতিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত শ্রীলঙ্কায় এমন পদক্ষেপের মাধ্যমে উচ্চমূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ এই উদ্যোগ কাজ করেনি। কেন কাজ করল না তা আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। বিভিন্ন খাতে বিদ্যমান দুষ্টচক্র এসব উদ্যোগকে কাজ করতে দিচ্ছে না বলে আমি মনে করি। এই দুষ্টচক্রগুলোর হোতাদের অনেকেই পরিচিত। কিন্তু তাদের জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা সব সময় তৎপর থাকছে, জবাবদিহি মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।

মার্কিন ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া উচিত কি না তা নিয়ে অনেকেই। প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন। এটি একটি জটিল প্রশ্ন বটে। আমি মনে করি, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এখনই বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে নানা জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই বলছেন, মার্কিন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারিত করে রাখার কারণে রেমিট্যান্স হুন্ডির মাধ্যমে আসছে। যদি বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা হতো তাহলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আরও বেশি আসত। আমি এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত নই রেমিট্যান্স তো প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এখন প্রশ্ন হলো- যে সংখ্যক বাংলাদেশি বিদেশে যাচ্ছে কর্মসংস্থান উপলক্ষে রেমিট্যান্স সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, বাংলাদেশ থেকে উপার্জন করার জন্য বিদেশে যাচ্ছে কারা? গ্রামীণ দরিদ্র এবং অদক্ষ ব্যক্তিরাই মূলত 'বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাচ্ছেন। তারা বিদেশে গিয়ে ভালো কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কেউ বেকার থাকছেন। ফলে যে সংখ্যক মানুষ বিদেশে যাচ্ছেন সেই অনুপাতে রেমিট্যান্স আসছে কম। হয়তো হুন্ডি যারা করে তাদের মধ্যে থেকে কিছু মানুষ ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হতে পারে, কিন্তু কার্ব মার্কেটে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে গেলে সেই প্রবণতা বাস্তবে রূপ লাভ নাও করতে পারে।

বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে মূল্যস্ফীতি অনেক বৃদ্ধি পাবে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে। আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। কিছু দিন আগেও বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার একাধিক বিনিময় হার চালু ছিল। এখন তা সঠিকভাবেই একক বিনিময় হারে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এ জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না। এটা বন্ধ করতে হবে। গৃহীত প্রকল্প যাতে নির্ধারিত সময়ে এবং ব্যয়ে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। এর বাতায় ঘটলে যারা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান ঢাকা স্কুল অব ইকোনোমিকস

বিষয়:

পরীক্ষার ফল, মিষ্টি ও মৃত্যুর অনুক্রম

আপডেটেড ১৪ মে, ২০২৪ ১৬:৫৬
সজীব সরকার

এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত রোববার। মুদ্রিত, সম্প্রচার ও অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বরাবরের মতোই এবারও প্রাধান্য পেয়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের খবর। এর পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে সর্বোচ্চ পাস, সবচেয়ে বেশি জিপিএ-৫ এবং সবচেয়ে বেশি ফেল করা বা খারাপ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর খবর।

এসব খবরের, মোটা দাগে, দুটি দিক থাকে:

এক. জিপিএ-৫ পেয়ে উল্লসিত কিছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আনন্দের খবর; দুই. পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে অর্থাৎ ফেল করে কিছু শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর।

এবারও, একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের উল্লাসের খবর দেখা গেছে, তেমনি জানা গেছে পরীক্ষায় ফেল করে বা জিপিএ-৫ না পেয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর। সামনের দিনগুলোতে এমন খবর আরও পাওয়া যাবে হয়তো।

জিপিএ-৫ পাওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের ব্যাপার; তবে, এ নিয়ে প্রতিবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে, তা কখনোই কাম্য নয়। গণমাধ্যমগুলোও যেভাবে এসব পাবলিক পরীক্ষার ফল সম্পর্কিত খবর প্রচার করে, তাতে এ প্রতিযোগিতা আরও গতি পায়। এমন সাংবাদিকতা মোটেও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় না।

জিপিএ-এর স্কোর তথা ‘ভালো রেজাল্ট’ সবসময় শিক্ষার্থীর জ্ঞানার্জনের নিশ্চয়তা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগবঞ্চিত কিন্তু স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর বলেছিলেন, ‘বিদ্যাশিক্ষার ডিগ্রি আছে জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই, জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন’। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক - সবার মধ্যেই এ বোধোদয় ঘটা দরকার।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনটি ভালো বা মন্দ- তা নির্ণয় করা হয় পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার হার কতো - এ বিচারে। স্কুল-কলেজগুলোর বিজ্ঞাপনেও এসব তথ্যই গুরুত্ব পায়। কোচিং সেন্টারগুলোও জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা উল্লেখ করে বিজ্ঞাপন দেয়; অনেকের বিজ্ঞাপনে থাকে বিষয়ভিত্তিক ‘এ প্লাস’ বা জিপিএ-৫ পাইয়ে দেওয়ার ‘লিখিত গ্যারান্টি’ বা ‘বিফলে মূল্য ফেরত’-এর শর্ত। কিন্তু, পড়াশোনার প্রকৃত উদ্দেশ্য যে বিদ্যা অর্জন, জ্ঞান অর্জন- সে গ্যারান্টি কোথায়? বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যে কুসংস্কারমুক্ত উদার মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার কথা, সে নিশ্চয়তা কোথায়?

পরীক্ষার ফল ভালো হওয়া তথা জিপিএ-এর স্কোর বেশি থাকা মানেই ওই শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞানার্জন হয়েছে- এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তেমনি, পরীক্ষার ফল খারাপ হলেই যে ওই শিক্ষার্থী নিরেট মূর্খ- সে কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা আরজ আলী মাতুব্বর কতো ক্লাস পড়েছেন আর তাদের পরীক্ষার ফল কেমন ছিলো - এমন প্রশ্ন অবান্তর নয় কি? বিশ্বের তাবৎ জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে কার বা কতোজনের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল ঘেঁটে তাদের মূল্যায়ন করা হয়?

তাহলে, এভাবে কেবল পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলনির্ভর মূল্যায়ন একটি একমুখী, অবৈজ্ঞানিক, অপর্যাপ্ত ও অসার পদ্ধতি। বরং, শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে যদি শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞানার্জনকে গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং সার্বিকভাবে যদি শিক্ষার্থীবান্ধব একটি কাঠামো গড়ে তোলা যায়, তাহলে পরীক্ষার তথাকথিত ‘ফল’ বা জিপিএ-এর স্কোর অনিবার্যভাবে ‘ভালো’ই হওয়ার কথা।

চাকরিদাতাদের একটি সাধারণ অভিযোগ হলো, দেশের নামকরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল নিয়ে পাস করে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইন্টারভিউ বোর্ডে অত্যন্ত হতাশাজনক পারফর্ম করছে। তাহলে, মোটা স্কোর-অলা এসব সার্টিফিকেটের মূল্য কী? গণমাধ্যমগুলোও বিভিন্ন সময় প্রতিবেদনে দেখিয়েছে, ‘নামকরা’ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, বিজয় দিবস, জাতীয় দিবস বা শহীদ দিবস - এমন ধারণাগুলোর সঙ্গে পরিচিত নয়; এসব বিষয়ে তারা তেমন কিছুই জানে না বা বলতে পারে না। তাহলে, প্রতিবছর গণমাধ্যমগুলোই বা কেন জিপিএ-নির্ভর এমন ফল বিশ্লেষণে গা ভাসাচ্ছে?

আমাদের মধ্যে অনেকেরই বিবেচনায় এটি নেই যে বুদ্ধিমত্তা, মেধা বা জ্ঞানের ধরন আলাদা। গান গাইতে না পারায় আইনস্টাইনকে যেমন 'মূর্খ' বলা অবিচার, তেমনি পদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক না হওয়ার দায়ে লতা মঙ্গেশকরকে 'অপদার্থ' বলাও অযৌক্তিক। আইনস্টাইন, বিটোফেন, শেক্সপিয়র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইলা মিত্র, লীলা নাগ, রোকেয়া, সুফিয়া কামাল, মাইকেল ফেলপস, শচীন টেন্ডুলকার, সাকিব আল হাসান, রোনালদো বা লিওনেল মেসি - কে জ্ঞানী, আর কে মূর্খ? পরীক্ষার ফল দিয়ে তাদের বিচার করা সম্ভব কি?

জ্ঞান, মেধা বা যোগ্যতার অনেকগুলো দিক রয়েছে। প্রতিটি ব্যক্তির শারীরিক-মানসিক দক্ষতা ভিন্ন। আমাদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে কার কোনদিকে সুপ্ত বা স্পষ্ট আগ্রহ ও যোগ্যতা বা দক্ষতা রয়েছে, তা বুঝে সে অনুযায়ীই শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা। নির্বিচারে সবাইকে জিপিএ-৫ পাওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক চাপে ফেললে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় বৈ কিছু নয়। পৃথিবীর সবাইকে বিজ্ঞানী বানানো যেমন অসম্ভব ও অযৌক্তিক, তেমনি সবাইকে এসএম সুলতান বা লতা মঙ্গেশকর বানাতে চাওয়াটাও ভুল। কার মধ্যে কী ধরনের মেধা রয়েছে, তা নির্ণয় করে তার মধ্যে ওই বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা তৈরি করে দেওয়াই হতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য। তাহলেই শিক্ষার্থীরা একসময় নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হবে। সফলতাকে কেবল 'পরীক্ষায় ভালো ফলের' সীমায় সীমিত করে রাখলে তা ভুল হবে।

এবার ফল প্রকাশের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন; তিনি বলেছেন, যারা পরীক্ষায় খারাপ করেছে, তাদের মন এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে, তাই তাদের যেন বকা-ঝকা করা না হয়। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এ নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সবার একমুখী অতি-প্রত্যাশার চাপ সামলাতে না পেরে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করলে এ দায় আসলে কার? নিজের সন্তান ভালো ফল করলে খুশি হতেও বাধা নেই, মিষ্টি বিতরণেও দোষ নেই; কিন্তু, যারা কোনো কারণে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারেনি, তাদের এমন মানসিক চাপে পড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করা ঠিক নয় যে তারা আত্মহত্যার মাধ্যমে ওই চাপ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বাধ্য হয়। তাদের তিরস্কার না করে বরং পাশে দাড়ানো উচিত যেন মনোবল না হারিয়ে বরং তারা নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার মতো ভরসা পায়। শিক্ষক ও অভিভাবকসহ গণমাধ্যমগুলোরও এ ব্যাপারে সতর্ক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার।

অবৈজ্ঞানিক প্রতিযোগিতার এমন পরিবেশে শিশুদের শৈশব আমরা কেড়ে নিয়েছি; সেই সাত-সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাত অবধি কেবল ক্লাস-কোচিং-টিউটর। ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে ‘ভালো রেজাল্ট’ করানোর জন্য অন্যদের চেয়ে বেশিসংখ্যক টিউটর বা কোচিং ক্লাসের চাপে শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন পিষ্ট হতে হচ্ছে। এমন প্রতিযোগিতা শুরু হয় একেবারে প্রাথমিক স্তরেই। তাদের খেলাধুলা, শরীরচর্চা বা বিনোদন কোথায়? ধরে-বেঁধে সবাইকে জিপিএ-৫ পেতেই হবে? শিক্ষার্থীরা তো গরু-ছাগল বা হাঁস-মুরগি নয় যে এক খোঁয়াড়ের সবগুলো একই চেহারার এবং একই বৈশিষ্ট্যের হতে হবে! এরা মানবসন্তান এবং প্রতিটি শিশু আলাদা; তাদেরকে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়াটাই বরং যৌক্তিক নয় কি?

শিক্ষাব্যবস্থার সঠিক সংস্কার দরকার, গতি দরকার- যেখানে চাকরির বাজারে যোগান দেওয়ার জন্য কেবল চাকুরে তৈরির দিকে মনোযোগ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও সুপ্ত মেধা অন্বেষণে মনোযোগ থাকবে। এমন একটি ব্যবস্থা চাই, যেখানে পরীক্ষার ফলের ওপর অতিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রকৃত বিদ্যার্জনকে উৎসাহিত করা হবে। এতে সব ক্ষেত্রের জন্য দক্ষ কর্মী যেমন অনিবার্যভাবেই তৈরি হবে, তেমনি তাদের মধ্যেই পাওয়া যাবে সত্যিকার সুনাগরিক ও নৈতিক মানুষ; প্রকৃত-পূর্ণাঙ্গ মানুষ।

লেখক: সজীব সরকার : সহযোগী অধ্যাপক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।

বিষয়:

banner close