মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক ইতিহাস: প্রেক্ষাপট পাগলা থানা

সোহেল মাজহার 
প্রকাশিত
সোহেল মাজহার 
প্রকাশিত : ২৮ মার্চ, ২০২৪ ১২:৩১

’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সব থেকে গৌরবময় অধ্যায়। ৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্ন এখনো অধরা রয়ে গেছে। জাতি হিসাবে বাংলাদেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে হাঁটছে।

এই সময়ের ভিতর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের অজানা ঘটনা ও অনালোকিত অধ্যায় পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে। তারপরেও অনেক ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের বহু গৌরবদীপ্ত স্মৃতি ও বীরগাঁথা আজও স্বীকৃতি পায়নি। অনেক অর্জন ও স্বীকৃতি বেহাত অথবা বেহাত হয়ে যাওয়ার পথে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ময়মনসিংহের পাগলা থানার গৌরব। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাগলা থানা স্বতন্ত্র কোনো পরিচয় ছিল না। পাগলা ছিল গফরগাঁও থানা অন্তর্গত দত্তের বাজার ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজার। তদুপরি অঞ্চলটি গফরগাঁও উপজেলার দক্ষিণের ৮টি ইউনিয়নের প্রায় মধ্যবিন্দু হওয়ার সব সময় এর একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। ২০১২ সালে পাগলা একটি নতুন থানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

শুধু ময়মনসিংহের মধ্যে নয়- বাংলাদেশের ভিতর পাগলা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গৌরবজনক ঘটনা ঘটে; কিন্তু প্রশাসনিক পরিচয়ের কারণে পাগলা অঞ্চলে সংগঠিত সকল যুদ্ধ ও যুদ্ধ সম্পর্কিত সকল ঘটনা- গৌরবময় বীরগাঁথা গফরগাঁও-এর নামে প্রচারিত হয়েছে। এই অঞ্চলের সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধ পাগলা থানার ৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার ঐতিহাসিক ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মূলত এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এই ঘোষণার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। একইভাবে তৎকালীন ঢাকা জেলা বর্তমান গাজীপুর জেলার কাওরাইদ কে এন উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু হয়। অঞ্চলটি গাজীপুর জেলার আওতাভুক্ত হলেও ময়মনসিংহ পাগলা থানার সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এই ট্রেনিং সেন্টারের মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনজন নেতা। তন্মধ্যে সাইদুর রহমান সিরাজ তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাদের দুজনের বাড়ি বর্তমান পাগলা থানার পাইথল ও নিগুয়ারী ইউনিয়নে। অপরজন কাওরাইদ ইউনিয়নের মনির উদ্দিন ফকির ছিলেন শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। একইভাবে মশাখালী রেলস্টেশন সংলগ্ন চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা মাঠে আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল ও শাহাদাত হোসেন মাস্টার।

২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ২৫ মার্চের রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন- গয়েশপুর মাদ্রাসা মাঠে, মশাখালী চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা, মাইজবাড়ি স্কুল মাঠ, দক্ষিণ হাড়িনা পার্বতীর মাঠ, দাওয়াদাইর প্রাইমারি স্কুল মাঠ, ছাপিলা মান্দারগড় প্রাইমারি স্কুল মাঠ, কুরচাই, তললী প্রাইমারি স্কুল মাঠ, অললী প্রাইমারি স্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হয়। এসব ট্রেনিং সেন্টারের নেতৃত্ব ও সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইদুর রহমান সিরাজ, গফরগাঁও থানা ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ, আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল, শাহাদাত হোসেন মাস্টার, ইকবাল ই আলম কামাল এ কে এম নিজাম উদ্দিন মাস্টার প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে-জুন মাসের দিকে সাইদুর রহমান সিরাজ, মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখ কসবা সি অ্যান্ড বি ব্রিজ পার হয়ে আগরতলা হাঁপানিয়া যুব শিবিরে যান। সেখানে সাইদুর রহমান সিরাজ যমুনা যুব শিবিরে উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবার সোনার বাংলা যুব শিবিরের চিফ ও ডেপুটি চিফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে- অধ্যাপক শামসুল হুদা এম এন এ ও অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ। মফিজুল হক ও গিয়াস উদ্দিন মাস্টার পলিটিকাল মটিভেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেনিং কার্যক্রম শেষ হলে ৩নং সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান মফিজুল হককে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন। তার ওপর ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি ও এম এ কাদির কোম্পানির দায়িত্ব ন্যস্ত করে গফরগাঁও ও ভালুকা অঞ্চলে পাঠিয়ে দেন। শুধু মফিজুল হক নয় তার সহোদর দুই ভাই বজলুল হক ও জহিরুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে জহিরুল হক নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ ভালুকা অঞ্চলের ৯নং বাঁধ এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে শহীদ হন। গফরগাঁও অঞ্চলের তিনজন কোম্পানি কমান্ডারের মতো চতুর্থ কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল ই আলম কামালের বাড়িও পাগলা থানায়।

গফরগাঁও উপজেলার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান পাগলা থানার ৮ ইউনিয়নের বাসিন্দা। গফরগাঁও-এর অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে বর্তমান পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চলে।

পাগলা থানা এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ১ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প দখল করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও রসদ দখল করে। যুদ্ধে মাইজউদ্দীন ফকির নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেপ্টেম্বর মাসের ১১-১২ তারিখ ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাগেরগাঁও- বাকশীতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তান বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। এই যুদ্ধে আবদুল মজিদ, আবদুর রশিদ, আবদুস সাহিদ, মহর চাঁদ, মনিন্দ্র মোদক, আবদুল হাই, আফাজ, মফিজসহ ১১ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। ১৭ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি দক্ষিণ পাড়ায় একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে মোবারক ও আলাউদ্দীন নামে দুজন শহীদ হন। ২৪-২৫ সেপ্টেম্বর সীমাখালীর দ্বিতীয় যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মাহতাব ও মান্নান শহীদ হোন। উস্থি- নয়াবাড়ির যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তান বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত হন। পরবর্তীতে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি পাকিস্তান বাহিনীর বারইগাঁও ক্যাম্পে আকাশ করে সাফল্য পায়। ৯ ডিসেম্বর মুক্ত গফরগাঁওয়ে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করেন।

অন্যদিকে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মফিজুল হক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ফজলুল হক কোম্পানি ও হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভারত থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করে মফিজুল হক, ফজলুল হক ও মো. সেলিমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি নিয়ে গফরগাঁও-পাগলা ও ভালুকায় পদার্পণ করেন। তন্মধ্যে দুটি সেকশন ভালুকার মেজর আফসার উদ্দিনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মফিজুল হক চেয়ারম্যান, ফজলুল হক ও এম এ সেলিম মূল বাহিনী নিয়ে প্রসাদপুর ওমর মেম্বারের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফরচুঙ্গি - শিলার রেলব্রিজে ও মশাখালী স্টেশনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। মশাখালী রেলস্টেশনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে ৬৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করেন। কিছুদিন পর অতর্কিতে পাকিস্তান বাহিনী ওমর মেম্বারের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও আক্রমণের তীব্রতায় একপর্যায়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে হেলাল নামে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

ইব্রাহিম খান একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নিগুয়ারী গৈয়ারপাড়ের রয়ান বিল পর্যন্ত অগ্রসর হলে শিলানদীর তীরে গৈয়ারপাড়ে অবস্থান নিয়ে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে পাকিস্তান বাহিনী অগ্রগতিকে রোধ করেন। ১৯ নভেম্বর পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নান্দিয়াসাঙ্গন- নিগুয়ারী খান বাড়ি হয়ে ত্রিমোহনীতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী তললী চৌকিদার বাড়ির ঘাট হয়ে সুতারচাপরে আশ্রয় নেয়। সেখানেও পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এই যুদ্ধে আ. রাজ্জাক, সালাহউদ্দিন, সুলতান ও মান্নানসহ অন্তত ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষ শহীদ এবং নিহত হন। একই দিন পাকিস্তান বাহিনী নিগুয়ারীতে অপারেশন শেষ করে কাওরাইদ ফিরে যাওয়ার পথে হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধারা কেল্লারপাড়ে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানের ওপর একটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত ও আহত হয়।

নভেম্বর মাসে মোশাররফ হোসেন রতনের নেতৃত্বে শিলার বাজার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। একপর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। মোশারফ হোসেন রতন একটি পুরাতন কবরে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচায়। যুদ্ধে আবদুল আওয়াল ঝানু, সিদ্দিকুর রহমান চানুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২০ নভেম্বর ফটুয়ার টেকে পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু ও ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির যৌথ নেতৃত্বে গয়েশপুর বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হলেও মহর আলী, আবদুস সাত্তার, আ. কাদের ও নিজাম উদ্দিনসহ মোট ১১ জন শহীদ হন।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি পাগলা থানায় কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি- উন্নয়ন সাধিত হয়নি। পাগলা থানার সমন্বিত উন্নয়নে নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করছি-

(১) সর্বাগ্রে পাগলা থানাকে উপজেলায় উন্নীত করতে হবে। (২) কিশোরগঞ্জ হতে হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, পাগলা ও কাওরাইদ হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত নতুন রেললাইন স্থাপন করতে হবে। (৩) পাগলা বাজারে একটি সরকারি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৪) দত্তের বাজার ও পাকুন্দিয়ার মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির জন্য পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর সড়ক সেতু নির্মাণ করতে হবে। (৫) পাগলা এলাকায় গ্যাস সংযোগসহ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৬) পাগলা থানায় আইটি পার্ক নির্মাণ করতে হবে। (৭) পাগলা থানার অভ্যন্তরীণ নদী-খাল ও সড়কপথ সংস্কার করতে হবে।

উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের মধ্যে পাগলা থানার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত। অন্যথায় এ অঞ্চলের গণমানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল পৌঁছাবে না। সব অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে নিহত গণমানুষ, নিপীড়িত মা-বোন প্রত্যেকের অতৃপ্ত আত্মা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন তাদের কাছে অর্থবহ না হয়ে ব্যর্থ বলে পরিগণিত হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্নের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা, উন্নয়ন বৈষম্য নিরসন করা ও সবার জন্য সমান সুযোগ অধিকার নিশ্চিত করা। পাগলায় এসব সূচকের কোনোটি পূরণ হয়নি। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট সব মহলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পাগলা উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক


তীব্র তাপপ্রবাহের স্মৃতি তালপাতার পাখা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে আর গরমের সময়ে সবার হাতে হাতে থাকত তালপাতার পাখা। সে তো ১৯৬০-এর দশকের কথা। তখন থাকতাম বলেশ্বর নদীতীরের ছোট্ট শহর পিরোজপুরে। সেই যুগে পিরোজপুরে ছিল না বিদ্যুৎ। তাহলে বৈদ্যুতিক পাখা আশা করা দুরাশা নয় কি!

তখন তো আমরা জানতাম না বিদ্যুৎ আর বৈদ্যুতিক পাখা দেখতে কেমন। বৈদ্যুতিক পাখা নিয়ে কারও মধ্যে কোনো ধরনের আলোচনা হতোই না। সবার মুখে মুখে ছিল তালপাতার পাখা। পড়ার সময়ে কিংবা ঘুমানোর সময় সবার হাতে হাতে ছিল তালপাতার পাখা। অতিরিক্ত গরম থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়ার জন্য তালপাতার পাখার বিকল্প ছিল না তখন।

আহারে আহারে কই গেল, কই গেল তালপাতার পাখা। প্রচণ্ড গরমে প্রাণ জুড়াতো তালপাতার পাখার হাওয়ায়। আবার ওই পাখা যাতে চটপট ভেঙে না যায় সে জন্য দাদি-নানি, মা-খালারা শাড়ির পাড় দিয়ে গোল করে ঢাকনা পরাতেন। পাখার গায়ে নানান কলকা ও ছবি আঁকা থাকত। মহিলা মহলে দুপুরের পান খাওয়ার সময় পাখার যেমন চাহিদা ছিল, তেমন আকাশবাণী কলকাতার অনুরোধের আসর শোনার সময়ে আমরা তালপাতার পাখা ব্যবহার করতাম বাতাস খাওয়ার আশায়। অনেক রমণীদের কাছে শোয়ার বিছানায় তালপাতার পাখা ছিল সতীনের মতো আরেক সঙ্গী। এই সতীনকে বড় সোহাগ করে স্বামীর হাতের পাশেই রাখতে হতো। গরমকালে তালপাতার পাখার চাহিদা ছিল অনেক বেশি। ধনী-গরিব সবার ঘরে ঘরে তালপাতার হাতপাখা দেখা যেত।

হাতপাখাকে কেন্দ্র করে গ্রাম-গঞ্জের প্রবাদবাক্য- রাতে পাখা করতে নেই। কারণ সে সময়ে গ্রামগঞ্জে বিদ্যুৎব্যবস্থা ছিল না, রেড়ির তেলে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপের আলোয় আমরা পড়াশোনা করতাম। পাখায় হাওয়া করলেই প্রদীপ নিভে যেত। রোদে চাষিরা যখন মাঠে কাজ করতেন, তার বউ মাঠে পান্তাভাত নিয়ে যেতেন, সঙ্গে নিতেন তালপাতার পাখার পাখা। মাঠে পাখা দিয়ে বাতাস করতেন। মাঠ-বিলে কৃষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে প্রচণ্ড গরম থেকে আরাম পেতে তালপাতার পাখার ফুরফুরে বাতাসে দেহ-মনে স্বস্তি পেতেন। তখন তালপাতার পাখার বিভিন্ন নাম ছিল, যেমন- শঙ্খলতা, কাঞ্চনমালা, পালংপোষ, মনসুন্দরী ইত্যাদি। স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে, কবে সেই গ্রামে দেখেছি ঘরের মেঝেতে বসে চাষি ভাত খাওয়ার সময় তার বউ হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন।

রাজা, বাদশাহ, জমিদার আমলে রাজসিংহাসনের দু’পাশে দুজন বড় বড় হাতপাখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আর ধীর লয়ে বাতাস করতেন। এ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বাড়িতে নতুন জামাই বা অতিথি এলে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করা হতো। তালপাতার হাতপাখা গ্রামীণ ঐতিহ্যের প্রতীক; কিন্তু এখন আর দেখা যায় না হাতপাখা তৈরির কারিগর। বিজ্ঞানের উন্নতিতে বৈদ্যুতিক পাখার অহরহ ব্যবহারে তালপাতার পাখা বোনার চাহিদা প্রায় লুপ্ত হয়েছে। কালের স্রোতে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী তালপাতার হাতপাখা আজ বিলুপ্তপ্রায়। আর গ্রাম থেকে উবে গেছে সারি সারি তালগাছ।

আজও খুব করে মনে পড়ে, পিরোজপুর শহরের বলেশ্বর নদীর তীরে ছিল লাইন ধরে শত শত তালগাছ। সেই তালগাছগুলো আজ কোথায়? বাংলাদেশ থেকে তালগাছ বিলুপ্ত হলে তালপাতার পাখা আসবে কোথা থেকে? তালপাতার পাখার চল উঠে গেছে, অথচ এক সময়ে গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েরা তালপাতার পাখা তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করত। দেশে এমনিতেই বেকারের অভাব নেই। সেই অবস্থায় তালগাছ কেটে কেটে উজাড় করে দিয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়াল কারা? তালগাছ ছিল, কিছু ছেলেমেয়েরা তালপাতার বিভিন্ন সামগ্রী বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। এই জীবিকাকর্মীদের পেটের ওপর কে লাথি মারল- যারা তালগাছ কেটে উজাড় করেছে, তারা নয় কী? ইন্ধনদাতাই বা কারা?

হাতপাখা শিল্পও আজ শেষ। বেকারদের সংখ্যাও তাই আজ দিন দিন ভারী হচ্ছে। বিশাল নগরী ঢাকার দুই দুইটি এলাকার নাম তালতলা। একটি খিলগাঁওয়ের দিকে আর অন্যটি হলো আগারগাঁওয়ের কাছে। শত বছর আগে এই দুই জায়গায় ছিল তালগাছ আর তালগাছ। হাজার হাজার তালগাছ শহীদ করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল বিশাল অট্টালিকা। কোথাও তালগাছের দেখা নেই- তবু জায়গার নাম থেকে কেউ মুছে দিতে পারেনি ‘তালতলা’।

আমাদের বাংলাদেশের সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তালগাছ লাগানোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে পারেন। তালগাছ লাগানোর পাশাপাশি তালরস সংগ্রহকারীদের জন্য এক বিমা-প্রকল্প ঘোষণা করতে পারেন। তাহলে অনেকেই তালগাছ লাগানো এবং এর চাষাবাদে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। আমাদের দেশে তালগাছকে নিয়ে সেভাবে চিন্তাভাবনা হয়নি- হতে দেখা বা শোনাও যাচ্ছে না। কৃষি দপ্তর আছে বলে জানি। বিষয়টি তাদের ভেবে দেখা দরকার।

লেখক: চিঠিপত্র গবেষক ও পরিবেশবিদ


বাজেট ও মুদ্রানীতির সমন্বয় নিশ্চিতকরণ জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. আতিউর রহমান

আসছে জুনে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট। এটি হবে সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রীর প্রথম বাজেট। আগামী পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক ভিত্তি বছর হিসেবে আসন্ন অর্থ বছরের বাজেট তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশি উচ্চমূল্যস্ফীতির বাস্তবতায় পেশ হতে যাচ্ছে আগামী বাজেট। এ প্রেক্ষাপটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নটি এবারে মুখ্য বলে বিবেচিত হওয়ার কথা। তাই বরাবর যে মাত্রায় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাড়ানো হয় এবার তা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার স্বার্থেই এবার সংকোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগপ্রবাহ অতটা বলশালী না হওয়ায় আমাদের প্রবৃদ্ধি মূলত নির্ভর করে সরকারি ব্যয়ের ওপর। কাজেই কাটছাঁটের বাজেট করলে প্রবৃদ্ধির চাকা তুলনামূলক কম গতিশীল থাকবে। এমনিতেই চলতি অর্থ বছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে এসেছে। ২০২৩-এর অক্টোবরে আইএমএফ চলতি অর্থ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ হবে বলে প্রক্ষেপণ করলেও এ বছরের এপ্রিলের মাঝামাঝি এসে তা কমিয়ে ৫.৭ শতাংশ করেছে। এ অবস্থায় কাটছাঁটের বাজেট করলে আসছে অর্থ বছরেও প্রবৃদ্ধি খুব গতিশীল হবে না, এ কথা বলাই যায়। ভোগ ও বিনিয়োগ সংকোচনের কারণেই যে এমনটি আশঙ্কা করা হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।

আসছে অর্থ বছরে যেহেতু তুলনামূলক সংকোচনমুখী বাজেট হতে যাচ্ছে, সেহেতু সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে বরাদ্দের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করার সময়ও বাজেটপ্রণেতাদের বরাবরের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হতে হবে। তবে সম্পদ বরাদ্দের যথাযথ অগ্রাধিকার (বাজেটের ব্যয়ের দিক) নিশ্চিত করার পাশাপাশি সম্পদসমাবেশ অর্থাৎ বাজেটের আয়ের দিক নিয়েও একই রকম সংবেদনশীলতা কাম্য। বেশ কয়েক বছর ধরেই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর দিকে নীতি-মনোযোগ আকর্ষণ করে আসছেন। জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরকারের আহরিত করের পরিমাণ ১০ শতাংশের নিচেই রয়ে যাচ্ছে। আসন্ন বাজেটে এ সংস্কারের প্রতিফলন ঘটার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের বহিঃঅর্থনীতি নিয়ে টানাপড়েনের কারণে আমদানি কমেছে। তাই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বহিঃঅর্থনীতির সংকটের কারণে মোটা দাগে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিই কমে এসেছে। এ কারণেও রাজস্ব আহরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। চলতি অর্থ বছরে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ পরিমাণ তার আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক অর্থ বছরগুলোর কোনোটিতেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব হয়নি। রাজস্ব আহরণের দক্ষতা বাড়াতে এ প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাইজেশনের যে কোনো বিকল্প নেই সে কথাটি বারবার সামনে আনছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অংশীজনরা। এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরাও এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছেন। তারা ইলেকট্রনিকস টেক্সট ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। ডিজিটাইজেশনকে অগ্রাধিকার দিয়ে রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া আরও দক্ষ করতে নেওয়া এনবিআরের এসব উদ্যোগ যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা যাবে ততই মঙ্গল।

বাংলাদেশের ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২২ থেকে ২০৪১ সময়ের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরোপিত কর ৩৩ শতাংশ কমানো গেলে ওই সময়ের ব্যবধানে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে সরকারের রাজস্ব ৩৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২২৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে (যা জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশের সমান হবে)। শুধু তাই নয়- এর ফলে জিডিপির শতাংশ হিসেবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও ২.২ শতাংশে উন্নীত হবে (বর্তমানে ০.৩ শতাংশ)। দেখা যাচ্ছে, ঢালাওভাবে আরোপিত কর না বাড়িয়ে ক্ষেত্রবিশেষ করছাড় দিয়েও রাজস্ব আহরণ বাড়ানো সম্ভব। করছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন খাতগুলো অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত তা নিয়েও নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

কর আহরণবিষয়ক অনুশীলনগুলোয় কিছু পরিবর্তন করে বিদ্যমান উৎসগুলো থেকেও আরও বেশি বেশি কর আদায় সম্ভব। যেমন- সিগারেটের দাম প্রতি বছর বাজেটে অল্প অল্প করে বাড়ানো হয়; কিন্তু তামাকবিরোধী গবেষকদের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, এ ক্ষতিকারক পণ্যটির দাম এক ধাক্কায় অনেকখানি বাড়িয়ে তার থেকে কর আহরণ করলে একদিকে সিগারেটের ব্যবহার যেমন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমবে, অন্যদিকে সিগারেট বিক্রি থেকে আরও বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা কর পাওয়া সম্ভব। বিদ্যমান ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আমাদের নিজস্ব সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলোর প্রেক্ষাপটে আসছে অর্থ বছরে বাস্তবতার প্রতি সংবেদনশীল একটি ব্যয় পরিকল্পনাই দরকার। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব এখানে তুলে ধরতে চাই।Ñ

০১) মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে জনগণ বিশেষত নিম্ন আয় শ্রেণির পরিবারগুলো সুরক্ষিত রাখাকেই প্রধানতম অগ্রাধিকার হিসেবে দেখতে হবে। ইতোমধ্যে ওএমএস কার্যক্রম এবং ১ কোটি পরিবারকে কার্ডের মাধ্যমে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহের উদ্যোগগুলো বিশেষ কার্যকর হয়েছে। এসব কর্মসূচির পরিধি বাড়ানো এবং এমন নতুন নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে (বিশেষত নগরাঞ্চলের জন্য) বেশি বেশি বরাদ্দ দিতে হবে।

০২) জ্বালানির দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর প্রভাব বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে পড়েছে। এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হওয়ায় বলা যায় নিশ্চিতভাবেই আসছে অর্থ বছরে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামে অস্থিরতা থাকবে। জ্বালানির দাম খুব বেশি বেড়ে গেলে দরকারবোধে বাড়তি ভর্তুকি দেওয়ার জন্য কিছু সম্পদ বাজেটে আলাদা করে বরাদ্দ রাখা যেতে পারে। জনগণকে স্বস্তি দিতে এলপি গ্যাসে কিছু রাজস্ব ছাড়ের কথাও বিবেচনা করা যায়।

০৩) জ্বালানি কেনাকাটার জন্য আমরা বেশি মাত্রায় ব্যক্তি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সরকার এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের গ্যারান্টর হিসেবে ভূমিকা রাখে। সরকার নিজে সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি কেনা শুরু করলে কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কার্যক্রমও শুরু হওয়ার পথে। দেরিতে হলেও এটি একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। পাশাপাশি সবুজ জ্বালানির ক্ষেত্রগুলো আরও প্রসারিত করার জন্য বাজেটারি উদ্যোগ নিতে হবে।

০৪) যেহেতু কৃষিই আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির রক্ষাকবচ, তাই বিভিন্ন কৃষি ইনপুটসে যতটা সম্ভব করছাড় দেওয়ার কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভর্তুকি দেওয়ার ধারাবাহিকতাও বজায় রাখতে হবে। কেননা কৃষিতে দেওয়া এ ভর্তুকি মূলত এক ধরনের গণমুখী বিনিয়োগ। কৃষির সুরক্ষায় নেওয়া বাজেটারি উদ্যোগগুলো দেশের কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তায়ও ভূমিকা রাখবে।

০৫) প্রবাসী আয়প্রবাহ বলশালী করার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দক্ষতা একটি বড় প্রতিবন্ধক। এ লক্ষ্যে প্রবাসগামী শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাজেট বরাদ্দে বিশেষ মনোযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষায় বরাদ্দের ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষাকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিখন ও প্রশিক্ষণে বাড়তি নীতি সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।

০৬) অবকাঠামোগত উন্নয়নে বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংযমী হতেই হবে। তবে যেসব প্রকল্প দেশের শিল্পায়ন গতিশীল করবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে সেগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করে যথাযথ বরাদ্দ দিতে হবে।

০৭) অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানোর জন্য এবারের বাজেটে হয়তো করছাড় ও প্রণোদনার নানা দিক যৌক্তিক করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। নিঃসন্দেহে এমন সংস্কার কাম্য। তবে এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন এগুলোর ফলে দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত না হয়। বিশেষ করে ৭০০-র বেশি এমএফআই যে ছোটখাটো ঋণ দেয় তার এক-তৃতীয়াংশ যায় কৃষিতে। আরেকটি বড় অংশ যায় এমএসএমই খাতে। এর বেশির ভাগ সুবিধা পায় নারী ও প্রান্তিক উদ্যোক্তারাই। এমএফআইকেও তাই করারোপের প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখাই শ্রেয় হবে। এ খাতে করারোপ করলে গ্রামীণ ভোগ কমে যাবে। ভ্যাট আহরণও কমে যেতে পারে।

০৮) পুরো জলবায়ু অর্থায়নের বিষয়টিকেই বেশি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে আগামী দিনের বাজেটগুলোয়। বাংলাদেশকে জলবায়ু তহবিলের ন্যায্য হিস্‌সা দিতে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরা বিশেষভাবে আগ্রহী। তাই জাতীয় বাজেটে জলবায়ুবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বেশি অগ্রাধিকার দিতে পারলে সে জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া সহজ হবে। বাজেটপ্রণেতাদের তাই প্রতিটি খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যতটা সম্ভব জলবায়ু-সংবেদনশীল করে সাজাতে হবে।

সর্বোপরি বাজেট এবং মুদ্রানীতির একটি কার্যকর ও সময়োচিত সমন্বয় নিশ্চিত করার বিষয়ে সর্বোচ্চ নীতি-মনোযোগ নিশ্চিত করতেই হবে। কেননা বহিঃঅর্থনীতির চ্যালেঞ্জ, রিজার্ভ ক্ষয়রোধ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, বিনিময় হারে ভারসাম্য রক্ষার মতো বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সরকারের বাজেট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: অর্থনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর


বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি ও প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন প্রসঙ্গ 

আপডেটেড ১৩ মে, ২০২৪ ১৫:৫৫
মো. রহমত উল্লাহ্

‘গত ০৫ মে ২০২৪ তারিখ রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষক বদলি নীতিমালা ২০২৪’-এর খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। সভায় বদলি কার্যক্রম আপাতত বাস্তবায়ন না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’ এতে অত্যন্ত আশাহত ও মর্মাহত হয়েছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা! এরূপ সিদ্ধান্তের প্রকাশিত কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের শূন্য পদে বদলির সুযোগ রাখলে আইনি জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। কেননা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের নিয়োগ দেয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/ গভর্নিং বডি। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মাধ্যমে বদলি শুরু করা আইনসম্মত নয়। এ কারণটির বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সম্ভবত অন্যান্য জটিলতার পাশাপাশি আইনি এ জটিলতার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেই এমপিও নীতিমালা ২০২১-তে (ধারা ১২.২) বলা হয়েছে, ‘এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক/ প্রদর্শক/ প্রভাষকদের কোনো প্রতিষ্ঠানে পদ শূন্য থাকা সাপেক্ষে সমপদে ও সমস্কেলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রণালয় নীতিমালা প্রণয়ন করে জনস্বার্থে আদেশ জারি করতে পারবে।’ লক্ষণীয়, এখানে ‘বদলি’ শব্দটির স্থলে ‘প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন’ লিখে এর জন্য পৃথক নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। বদলি নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়নি!

এতে প্রতীয়মান হয়, বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না, নেই। অর্থাৎ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে যেভাবে শিক্ষক-কর্মচারীরা এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানের শূন্য পদের বিপরীতে বিধি মোতাবেক আবেদন করে যোগ্য বিবেচিত হলে নিয়োগ নিয়ে সে প্রতিষ্ঠানে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আসছিলেন এবং পরবর্তীতে এমপিও ট্রান্সফার ও সিনিয়ারিটি সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন এখনো সেরকম সুযোগ পাবেন। তদুপরি সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষক/প্রদর্শক/প্রভাষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ আরও সহজ ও সম্প্রসারিত করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে এমপিও নীতিমালায়।

অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের নিমিত্তে প্রকাশিত চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শিক্ষকদের ‘বদলির’ বিকল্প ‘প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন’-এর ন্যূনতম সুযোগটুকুও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতেও বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। অবাক ব্যাপার এই, একদিকে দেখা যাচ্ছে, এমপিও নীতিমালায় বলা হয়েছে এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য জনস্বার্থে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করার কথা। আর অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, উল্লিখিত নীতিমালা প্রণয়ন না করেই অর্থাৎ বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি না করেই যুগ যুগ ধরে চলে আসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের প্রচলিত ন্যূনতম সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে! বর্তমানে সব বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর বদলির খসড়া নীতিমালা স্থগিত এবং এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ! বিদ্যমান শিক্ষকদের বদলির বা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ আর থাকল না! এমন অবস্থায় বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকরা অত্যন্ত আশাহত, মর্মাহত ও মনোকষ্টে নিমজ্জিত! শিক্ষকদের মন ভালো না থাকলে ভালো পাঠদানের কোনোই সম্ভাবনা থাকে না। শিক্ষকতা অত্যন্ত মননশীল কাজ।

বদলি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত না করে স্থগিত করার পিছনে সম্ভাব্য আইনি জটিলতা ছাড়াও অন্য যে কারণটি উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো- বদলি শুরু হলে গ্রামপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে যা পূর্ণ করা কঠিন হবে। অর্থাৎ গ্রামের শিক্ষকরা বদলি হয়ে শহরে চলে যাবেন এবং গ্রামে কেউ নতুন করে নিয়োগ নিতে চাইবেন না। এটি সর্বক্ষেত্রে সর্বাংশে সঠিক নয়। বিষয়টি বদলি নীতিমালার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাছাড়া স্বল্প বেতনে সব বিষয়ের শিক্ষক শহরে এসে টিকে থাকতে পারবেন না। শহরের সব প্রতিষ্ঠানই যে অধিক সচ্ছল তাও নয়। তবে অধিক যোগ্য-দক্ষরা অধিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের জন্য ও বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করবেন নিয়োগ পাবেন ও বদলি হবেন এটাই স্বাভাবিক। তা না হলে অধিক যোগ্যরা আসবেন না ও থাকবেন না শিক্ষকতায়। মনে রাখতে হবে, বদলি সুবিধা হ্রাস করে বা যোগ্যতা শিথিল করে অথবা অন্য কোনো কৌশল করে তুলনামূলক কম যোগ্যদের শিক্ষকতায় এনে ও ধরে রেখে অধিক যোগ্য নেতা-কর্মী, শ্রমিক, আমলা, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি তৈরি করা সম্ভব নয়! কেননা, একজন কম যোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করেন অগণিত কম যোগ্য বা অযোগ্য মানুষ। তাই বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে শিক্ষকদের সব শূন্যপদ (গ্রামের ও শহরের) অধিক যোগ্যদের দ্বারা পূর্ণ করাই দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির জন্য অধিক কল্যাণকর।

নিবন্ধনধারী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করার সুযোগ বন্ধ করার পিছনে আলোচিত কারণগুলোর অন্যতম ছিল বিদ্যমান শিক্ষকদের আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হলে তাদের তুলনায় কম নম্বর প্রাপ্ত নিবন্ধনধারী বেকার প্রার্থীরা তাদের অধিক পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিলেকশন পান না অথবা তৎকালে আবেদনকৃত কোনো প্রতিষ্ঠানেই চাকরি পান না। আবার বিদ্যমান শিক্ষকরা তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে চলে গেলে তাদের ছেড়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানে শূন্য পদ থেকে যায়। অর্থাৎ নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করার পরেও একদিকে শূন্য পদ থেকে যায়, অন্যদিকে আবেদন করেও চাকরিপ্রার্থী বেকার থেকে যান! এমন অবস্থা কিন্তু নিবন্ধন পরীক্ষা শুরুর আগেও বিরাজমান ছিল। যখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরীক্ষা নিয়ে বাছাই করে নিয়োগ দিত তখনো এক প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকরা অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে আবেদন করে বিধি মোতাবেক নিয়োগ নিয়ে যোগদান করলে পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের পদ শূন্য হতো। পুনরায় সেই প্রতিষ্ঠানের কমিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিধি মোতাবেক নতুন লোক নিয়োগ করত। সেখানেও বিধি মোতাবেক অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক এসে যোগদান করলে তার ছেড়ে আসা প্রতিষ্ঠানে পদ শূন্য হতো। কোনো ক্ষেত্রে নতুনরা নিয়োগ পেলে বিদ্যমান শিক্ষকদের আগের পদ শূন্য হতো না। অর্থাৎ বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের পদ শূন্য হওয়া, শূন্য পদ নতুন/ফ্রেশ প্রার্থীর দ্বারা পূর্ণ হওয়া বা বিদ্যমান শিক্ষকদের দ্বারা পূর্ণ হয়ে সে শিক্ষকের ছেড়ে আসা পদ শূন্য হওয়া এমন একটি বাস্তব প্রক্রিয়া সুদূর অতীত থেকেই সারা দেশে কার্যকর ছিল। সে প্রক্রিয়াটি বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে চলমান ছিল বলে সবার দৃষ্টিগোচর হতো না। এখন এনটিআরসিএর মাধ্যমে সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ একসঙ্গে হচ্ছে বলে বিষয়টি বড় আকারে সবার দৃষ্টিতে এসেছে। অবশ্যই এ সমস্যার একটা অনুকূল সমাধান প্রয়োজন ছিল। কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে এর সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন! যা বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের চরমভাবে মর্মাহত ও হতাশাগ্রস্ত করেছে। এটি কোনো দিক থেকেই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত হয়নি।

অথচ নিম্নলিখিত উপায়ে সহজেই সমাধান হতে পারে এ সমস্যার। যাতে এমপিওভুক্ত নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের অধিক হারে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার সম্ভব হবে, নিবন্ধনধারী নতুন প্রার্থীদের অধিক হারে নিয়োগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সব শূন্য পদ পূর্ণ করা সম্ভব হবে, সর্বোপরি বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের বদলির চাহিদা আংশিক পূর্ণ হবে। তা হচ্ছে, বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে বিভক্ত করে প্রতিবছর বা প্রতিবার পৃথকভাবে সম্পন্ন করতে হবে দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া। প্রথমে প্রদান করতে হবে শুধুমাত্র নিবন্ধিত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। এ ক্ষেত্রে কোনো নতুন প্রার্থী আবেদন করতে পারবেন না। কেবল বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকরা আবেদন করতে পারবেন। এদের নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করে পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন সম্পন্ন করার পরবর্তীতে চিহ্নিত করতে হবে শূন্য পদ। সেই শূন্য পদে নতুনদের নিয়োগের জন্য প্রকাশ করতে হবে গণবিজ্ঞপ্তি। সে ক্ষেত্রে কোনো এমপিওভুক্ত শিক্ষক আবেদন করতে পারবেন না। শুধু নিবন্ধিত প্রার্থীরা আবেদন করবেন। নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে তাদের নিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান শূন্যপদগুলো পূর্ণ করা সম্ভব হবে। এভাবে প্রতি বছর বা প্রতিবার বিদ্যমান এমপিওভুক্ত নিবন্ধিত শিক্ষকদের পুনর্নিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য একটি এবং শুধু নিবন্ধিত প্রার্থীদের নতুন নিয়োগের জন্য একটি অর্থাৎ মোট দুটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে অবশ্যই অনেকাংশে পূর্ণ হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বদলিপ্রত্যাশী লাখ লাখ শিক্ষকের দাবি। সেই সঙ্গে নিয়োগ পাবেন অধিক সংখ্যক নতুন প্রার্থী এবং পূর্ণ হবে অধিক শূন্য পদ। এমনি দুই ভাগে নিয়োগ সম্পন্ন করতে গিয়ে যদি অধিক জনবল ও অধিক অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ে তাহলে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আবেদনের ফি নতুন/বেকার প্রার্থীদের তুলনায় কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। আমার এ প্রস্তাবটি তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে যখন অনেক পদ শূন্য থেকে গিয়েছিল এবং অনেক বেকার চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছিল তখনো পরে একাধিক জাতীয় পত্রিকায় উপস্থাপন করেছিলাম। এর মধ্যে গত ১৪ আগস্ট ২০২১ তারিখে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘দুই ভাগে হোক বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ’। সেটির পক্ষে ছিল ব্যাপক সমর্থন; কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের আবেদন করার সুযোগ বন্ধ করে দিল চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি থেকেই। পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতেও বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য দেওয়া হয়নি আবেদনের সুযোগ! তাই বিষয়টি আবারও আলোচনায় আনার তাগিদ অনুভব করলাম। তখন কেউ কেউ বলছিলেন, বিদ্যমান শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের পৃথক সুযোগ দেওয়া হলে তারা ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চলে যাবেন। ফলে নতুনদের ভালো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ কমে যাবে। হ্যাঁ সেটি অবাস্তব নয়। তবে এটিও স্বীকার করতে হবে, পুরাতন বা বিদ্যমান শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার ও প্রশিক্ষণের অবশ্যই একটা মূল্য আছে। সেটিকে যথাযথ মূল্যায়ন করাও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অধিক যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞরা অধিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভের জন্য ও বদলি হওয়ার জন্য আবেদন করবেন নিয়োগ পাবেন ও বদলি হবেন এটাই স্বাভাবিক। এ প্রক্রিয়া সচল থাকলে এক সময় নবীনরাও অভিজ্ঞ হবেন এবং অনুরূপ সুযোগ পাবেন। এনটিআরসিএ যখন শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তখন তো এমন কোনো শর্ত থাকে না যে, এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যারা শিক্ষক হবেন তারা যেহেতু নিজের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানে আবেদন করে নিয়োগ নেবেন সেহেতু ভবিষ্যতে আর ওই প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের জন্য কিংবা বদলি হওয়ার জন্য কোনোরূপ দাবি উত্থাপন করতে পারবেন না। তাহলে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বা বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের দাবিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে কেন, হবে কেন বারবার? উত্তম বিকল্প ব্যবস্থা না করে বন্ধ করা হলো কেন, হবে কেন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ? মানুষ গড়ার কারিগরদের সুবিধা বাড়ানোর পরিবর্তে কমিয়ে, দুঃখ-কষ্ট কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে কীভাবে সম্ভব হবে কাঙ্ক্ষিত মানুষ গড়া?

যেহেতু আইনি জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করা যাচ্ছে না বিধায় এখন সাধারণ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না সেহেতু সব এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পারস্পরিক বদলির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া এবং শুধু নিবন্ধিত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বিশেষ/পৃথক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বেচ্ছায় প্রতিষ্ঠান পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়া অধিক যুক্তিযুক্ত ও ন্যায়সঙ্গত বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বদলিপ্রত্যাশী শিক্ষকদের দুঃখ-কষ্ট সামান্য লাঘব করে পাঠদানে তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার জন্য আবারও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট


আসন্ন বাজেট ও করনীতি সংস্কার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রজত রায়

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বিভিন্ন কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান কবে হবে তা অনিশ্চিত। ফলে আগামী বছরও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করাটা বেশ জটিল এবং বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।

বহু ক্ষেত্রেই আমরা উন্নতি করছি। আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার বেড়েছে, পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির বহু দিকের উন্নতি ঘটেছে। বেসরকারি ক্ষেত্রের কিছু অংশ টগবগ করছে, প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য আর্থসামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমলেও আয়বৈষম্য বেড়েছে। বেড়েছে ভোগবৈষম্য। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এতে প্রমাণ হয় দেশের সম্পদের একটি বড় অংশ কিছু মানুষের হাতে চলে যাচ্ছে। একটি উচ্চ আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং করোনাভাইরাস মহামারির বৈরী প্রভাবের পরও দেশের দারিদ্র্যের হার গত ছয় বছরে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। তবে দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মাসিক গড় পারিবারিক আয় ২০২২ সালে বেড়ে ৩২,৪২২ টাকায় পৌঁছায়। ছয় বছর আগে ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপের তুলনায় এটি প্রায় ১০২ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০১৬ সালে মাসিক গড় আয় ছিল ১৫,৯৮৮ টাকা। আর ২০১০ সালে এ আয় ছিল আরও কম ১১,৪৭৯ টাকা। তবে আয়ের এ প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও তা হয়তো সর্বক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ দেশে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। যারা আয়ের নিম্নসীমায় আছেন, তাদের সম্পদের পরিমাণ আগের চেয়ে আরও কমে গেছে। দেশে আয়বৈষম্য এবং ভোগবৈষম্য দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।

সমাজে আয়বৈষম্য নিরূপণের জন্য ব্যবহৃত হয় জিনি সূচক। জিনি সূচকের মান হতে পারে শূন্য থেকে এক। কোনো সমাজের সব সম্পদের মালিক একজনই হলে অন্য কারও হাতে কোনো সম্পদ না থাকলে সে সমাজে হবে চূড়ান্ত বৈষম্য ও এর জিনি সূচক হবে ‘এক’। বিপরীত দিকে, যে সমাজের সব সম্পদ সবার মধ্যে শতভাগ সমভাবে বণ্টন হয়ে থাকে সে সমাজের জিনি সূচক হবে ‘শূন্য’। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের মূল বিতর্কটি মূলত এর দ্বারা মানুষে মানুষে বৈষম্য বোঝাতে পারে না। ওইসিডি যথার্থই বলেছে, জিডিপি আয়ের পরিমাপ করে, তবে সমতা নয়, এটি সামাজিক সংহতি ও পরিবেশের মতো মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে।

জিডিপি হিসাব করা হয় তিনটি উপাদানের ভিত্তিতে। মানুষের ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়, সরকারের ভোগ ব্যয় এবং স্থায়ী মূলধন নির্মাণ অর্থাৎ বিনিয়োগ। দেখা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এই অর্থবর্ষে জিডিপিতে সরকারি ভোগ ব্যয়ের অনুপাতও বেড়েছে, স্থায়ী মূলধন নির্মাণের অনুপাতও বেড়েছে, কমে গিয়েছে ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়ের অনুপাত। মানুষের খরচের মাত্রা এখনো কোভিড-পূর্ব স্তরে পৌঁছায়নি।

জিডিপি বাড়ছে, অথচ মানুষের ভোগ ব্যয় সেই অনুপাতে বাড়ছে না কেন? তাহলে যারা বেশি খরচ করেন তাদের বদলে রোজগার গিয়েছে যারা বেশি সঞ্চয় করেন তাদের হাতে? বিষয়টা তাহলে কি এমন লোকের হাতে টাকা বেড়েছে, অন্যদের তুলনায় যাদের রোজগারের অনুপাতে ভোগ ব্যয় কম। তাহলে এমন লোক কারা? গরিব মানুষের যেহেতু রোজগার কম তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই খরচ হয়ে যায় চাল, ডাল, জামা, কাপড়, ওষুধ, যাতায়াত, লেখাপড়ায়। অর্থব্যবস্থা যদিবা ঘুরে দাঁড়ায় তবে সুফল দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের বদলে পৌঁছাচ্ছে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে।

বাংলাদেশে গরিবদের আয় বৃদ্ধির হারের তুলনায় ধনীরা অনেক বেশি হারে আরও ধনী হয়েছেন। ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী মোট আয়ে দারিদ্র্যসীমার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকা ৪০ শতাংশ মানুষের অংশ ছিল ২১ শতাংশ আর সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অংশ ছিল ২৭ শতাংশ। আর ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল কেবল ১ শতাংশ লোকের হাতে। আর দারিদ্র্যসীমার নিচের অর্ধেকের হাতে ছিল ১৭ শতাংশ; কিন্তু বেশ কয়েকটি কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে। যেমন- দীর্ঘদিন ধরেই বাজেটের বড় ভাগ চলে ভর্তুকি আর পুরোনো ঋণ মেটাতে। রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলোর খাতায় ক্রমবর্ধমান অনাদায়ী ঋণের পাহাড়। জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়েনি। বাড়ছে সরকারের ঋণ। জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ও রাজস্ব আয়ের এ অসামঞ্জস্যতা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করছে বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) চূড়ান্ত হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চলতি মূল্যে জিডিপির মোট দেশজ উৎপাদনের আকার দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। আর সব মিলিয়ে কর আদায় হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরে ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর-জিডিপি অনুপাত ছিল ৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী অধিকাংশ দেশের কর-জিডিপির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যেমন নেপালের কর-জিডিপির হার হচ্ছে ২৩ শতাংশ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রতিযোগী ১০ দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে। অন্য দেশগুলো হচ্ছে শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ভারত, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া। উল্লিখিত দেশগুলোতে এই হার ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২৪ শতাংশ।

কর-জিডিপির অনুপাত দিয়ে সাধারণত বিভিন্ন দেশে কর আহরণ ব্যবস্থাপনার দক্ষতা পরিমাপ করা হয়। কোনো দেশের কর-জিডিপি অনুপাত বেশি হলে সম্পদ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা বেশি বলে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত বেশ কয়েক বছর থেকে ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অনেক অর্জন থাকলেও কর-জিডিপির অনুপাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আশাব্যঞ্জক নয়। তাহলে এর কারণ কি? এর প্রধান কারণ হলো দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় ব্যাপক হারে অব্যাহতি দেওয়া।

আমরা দেখতে পাচ্ছি কৃষি, পশু সম্পদ, মৎস্য, স্বাস্থ্য জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে পুরোপুরি ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। তৈরি পোশাক ছাড়াও বিদেশি পণ্যে নির্ভরতা কমিয়ে আনতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক পণ্যে দেওয়া হয়েছে ভ্যাট ছাড়। এ ছাড়া ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় রয়েছে ওষুধের কাঁচামালসহ বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্য। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে স্থানীয় পর্যায়ে আহরিত ভ্যাটের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা যা গত অর্থ বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। সরকারের প্রতি ১০০ টাকার রাজস্ব আদায়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের খরচ সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের খরচ হয় ২১ পয়সা। এ খরচ ভারতে ৬০ পয়সা, থাইল্যান্ডে ৭১ পয়সা, সিঙ্গাপুরে ৭৯ পয়সা, মালয়েশিয়ায় ১ টাকা, জার্মানিতে ১ টাকা ৫০ পয়সা এবং জাপানে ১ টাকা ৭০ পয়সা। তবে এটা ঠিক রাজস্ব খাতে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কমাতে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। ইআরএফ তথ্য মোতাবেক, যদি সব কর যোগ্য ব্যক্তিরা আয়কর স্লাব অনুযায়ী কর প্রদান করে তাহলে জিডিপির অনুপাতে বর্তমানে ১ শতাংশ ব্যক্তি আয়কর বাড়িয়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হবে। এ জন্য নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে। বর্তমানে পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ এবং প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ।

আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও উন্নত দেশে যেতে হলে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় ২০৩০ সালের মধ্যে ১৭ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ২১ শতাংশ করতে হবে। আর এর উল্লেখযোগ্য অংশ প্রত্যক্ষ কর থেকে আসতে হবে। আবার করপোরেট কর জিডিপির অনুপাতে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে ২ লাখ ৭০ হাজার নিবন্ধিত কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১১ শতাংশ বা ৩০ হাজারের মতো কোম্পানি কর দেয়। এ ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে তারা কম কর দেন। সরকার অনেক খাত থেকে কর পাচ্ছে না। অপ্রচলিত খাতে প্রায় ৮০ ভাগ জনশক্তি কাজ করে। আর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তারা করের আওতার বাইরে আছে। এসব খাত থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারলে বৈষম্য দূর হবে। আবার আবাসন খাত এবং ফেসবুক, আমাজন ও ফুডপান্ডার মতো নতুন ব্যবসার প্রসার হচ্ছে সেখান থেকে সরকার কাঙ্ক্ষিত কর পায় না।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মোতাবেক, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সব বিভাগ মোট ৩ লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। বাংলাদেশে কর আদায়ে তুলনামূলক খরচ কম হলেও কর দিতে গিয়ে কর দাতাদের অনেক সময়ই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় বলে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ আছে। তাই করদাতারা যেন সহজে ও নির্বিঘ্নে কর দিতে পারে সেদিকে এনবিআরের নজর দিতে হবে। বেশি সম্পদের মালিকদের বেশি সম্পদ থাকার কারণে অতিরিক্ত কর হিসেবে সারচার্জ আরও বাড়াতে হবে। গাড়ির মালিকদের ওপর বেশি পরিমাণে কর বহাল রাখতে হবে।

সকল পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি না দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় পণ্যে শুধু ভ্যাট অব্যাহতি রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতি উপকরণে পুরোপুরি ভ্যাট মুক্ত রাখতে হবে এবং শুধু কৃষিখাতে ভর্তুকি রাখা সমীচীন হবে। তাই করনীতি সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

বিষয়:

ডোনাল্ড লু আসছেন, রাজনীতিতে লুর হাওয়া ভাসছে

আপডেটেড ১২ মে, ২০২৪ ১৪:২৬
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু আগামী মঙ্গলবার ঢাকায় আসছেন, বুধবার সফর শেষে দেশের উদ্দেশ্য যাত্রা করবেন। ১০ মে শুক্রবার তিনি ভারতে এসেছেন। ভারতের সফর শেষে শ্রীলঙ্কা যাবেন, শ্রীলঙ্কা থেকে ঢাকায় আসবেন। ভারতে তার সফর নিয়ে গণমাধ্যম কিংবা সরকারি কোনো মহলে তেমন কোনো আলোচনা নেই। তিনি চেন্নাই সফর করছেন এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে কনসুলেট কর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন। ভারতীয় সরকারি কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে তার দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সংবাদ কোনো ভারতীয় গণমাধ্যমে নেই। ভারতে এই মুহূর্তে লোকসভা নির্বাচন চলছে। নির্বাচন চলাকালে ভারতে কোনো দেশের কে আসে, কে যায় তা নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। এই সময় তেমন উচ্চপর্যায়ের কোনো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় নেতা ভারতে আমন্ত্রিতও হন না। ডোনাল্ড লু ভারতের দৃষ্টিতে কোন পর্যায়ের মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা-তার অবস্থান দেখেই বোঝা যায়। ডোনাল্ড লু এখনো বাংলাদেশে এসে পৌঁছাননি এরই মধ্যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ অনেক ক্ষেত্রেই লু (উত্তপ্ত) হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বিরোধীদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস, স্বস্তি এবং মধ্যবর্তী নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির কানাঘুষোও প্রচার করতে শোনা যাচ্ছে, তথাকথিত নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদেরও কারও কারও সাজগোজের প্রস্তুতি নেওয়ার আয়োজন ভেতরে ভেতরে চলছে। ডোনাল্ড লু শ্রীলঙ্কাতে বেশ সমাদর পাবেন- তেমনটি গণমাধ্যমের সংবাদ থেকে বোঝা যাচ্ছে। সেখানে অর্থনৈতিক সংকট থাকায় সরকার এবং বিভিন্ন মহলের সঙ্গে তার নানা ধরনের বৈঠক হবে বলেও জানা গেছে। সে দেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গেও তার কথাবার্তা হবে। অবশ্য ভারতের নাগরিক সমাজ ডোনাল্ড লুর সঙ্গে বৈঠকে বসেনি- তেমন খবর সে দেশের গণমাধ্যমে কেন দিতে পারছে না সেটি বোঝা গেল না!

ডোনাল্ড লু ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ঢাকায় তিনবার সফর করে গেছেন। যদিও তখন বলা হয়েছিল তিনি রোহিঙ্গা বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে ঢাকা সফর করেছিলেন। তবে সেই সময়ে তিনি বা অন্য মার্কিন প্রতিনিধিদের ঢাকা সফরের উদ্দেশ্য সবারই জানার বিষয় ছিল। মূলত যুক্তরাষ্ট্র যে একটি মুক্ত, অবাধ ও সমৃদ্ধ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দেখতে চায়, তাতে বাংলাদেশকে যুক্ত করাই এবং এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য সেটি সবারই জানার বিষয়। এতে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চলে বলয় বৃদ্ধি পায় এটি সহজেই অনুমেয়; কিন্তু বাংলাদেশ ‘কারও সঙ্গে বৈরিতা নয় সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব’ এমন পররাষ্ট্রনীতিতে অটল রয়েছে। বাংলাদেশের এই নীতি খুবই পরীক্ষিত। এ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে শেখ হাসিনা সরকার বঙ্গবন্ধুর বিঘোষিত নীতির কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। সে কারণেই কোনো দেশ এখনো পর্যন্ত প্রশ্ন তুলতে পারেনি যে শেখ হাসিনা শাসনামলে বাংলাদেশ বড় কোনো শক্তির বলয়ের ভেতরে এক ইঞ্চিও প্রবেশ করেছে। আবার কোনো বড় রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী কোনো আচরণেও লিপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সবার সঙ্গে বজায় রেখে চলার যে দক্ষতা দেখাতে পেরেছে সেটি একমাত্র সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার সাহস, দৃঢ়তা এবং দক্ষতার প্রমাণ বহন করে। বৃহৎ কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মাখামাখি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হচ্ছে অন্যদের সঙ্গে শত্রুতা বাড়ানো। বাংলাদেশের সেটি একেবারেই প্রয়োজন নেই বরং সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ বৃদ্ধি করা বাংলাদেশের জন্য এই পর্বে সবচেয়ে জরুরি বিষয়। বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ, পৃথিবীর সবচেয়ে জনঘনবসতির দেশ। আমাদের বিপুল এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করার কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু সেটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছাড়া মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করা মোটেও সম্ভব নয়। সে জন্যই আমাদের প্রয়োজন সবার সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে টাল-মাটাল বিশ্ব ব্যবস্থায় নিজেদের রক্ষা করার স্বার্থে এগিয়ে চলা। শেখ হাসিনার সরকারই এই নীতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনার নীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করতে নানাভাবে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভূরাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব বাস্তবতাই তুলে ধরেছে; কিন্তু তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা ছাড়ছে না, বাংলাদশও তার নীতি ও অবস্থানের পরিবর্তন করছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে- সেটি তাদের হিসাব-নিকাশের ব্যাপার; কিন্তু বাংলাদেশে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন কেন, ছোট কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেও বৃহৎ রাষ্ট্রের কোনো বলয়ে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আমলে নিতে চায় না। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে চীনের টানাপড়েন সম্পর্কে অবহিত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ চীন এবং ভারতের সঙ্গে চমৎকার ভারসাম্যমূলক অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। সে কারণে ভারত বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো ধরনের চাপ কখনো দিচ্ছে না, উভয় দেশের মধ্যে এ ব্যাপারে চমৎকার আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবকিছু জেনে-শুনেও বারবার বাংলাদেশকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কাছে টানতে চাইছে। সেই চাওয়ার অবস্থান থেকেই মার্কিনীরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। গত নির্বাচনের আগে বিষয়টি তারা মোটেও গোপন রাখতে পারেনি। তাদের একপক্ষীয় অবস্থান ও আচরণ দেশে-বিদেশে বড় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল-সেটি প্রকাশ্যেই সবাই দেখেছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বড় বড় দেশগুলোর এভাবে বাগ-বিতণ্ডায় লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই বাংলাদেশ পর্যবেক্ষণ করেছে এবং এর বিরোধিতা করেছে। তবে যেহেতু দেশে কোনো বিষয় নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ঐকমত্য নেই, তাই সরকার খুব কঠোরভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। বিরোধীদল সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো বিদেশি শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতে খুব এগিয়ে থাকে তা তাদের আচরণ, কথাবার্তা, সরকারবিরোধী আন্দোলন ইত্যাদির মধ্যেই প্রকাশ পেয়ে থাকে, সেটি গত বছর কে না দেখেছে? ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডে হাসের ভূমিকা তখন কতটা কূটনৈতিক নরমস বহির্ভূত ছিল তা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়েছিল; কিন্তু আমাদের সমাজে আন্তর্জাতিক নরমস মেনে চলার বিষয়টি অনেকের মধ্যেই যথেস্ট দুর্বলভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, ভোজ সভায় মিলিত হতে অথবা দেশের সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অথবা পক্ষে কথা বলতে কতটা যে মুখিয়ে থাকেন সেটি গত বছর দেখা গেছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বলে যারা নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তারা কিসের ভিত্তিতে এই অধিকার চর্চা করেন তা মোটেও বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এই দুর্বলতার সুযোগ কোনো কোনো দেশ নিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। ভারতে কোনো রাজনৈতিক দলই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলেন না, অভিযোগও করেন না। সে দেশের নাগরিক সমাজও একই নীতি অনুসরণ করেন। শ্রীলঙ্কায় আগে বিদেশিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিল কি না জানিনা, তবে এখন অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের ওঠাবসার বিষয়টি ঘটেছে কি না বলা মুশকিল। আমাদের এখানে স্বাধীনতার পর থেকেই গোপনে অনেকেই যে বিদেশি দূতাবাসে যাতায়াত করতেন, ষড়যন্ত্রও করতেন এ সম্পর্কে বেশ কিছু বই-পুস্তকে বিস্তর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে প্রকাশ্যেই বিষয়টি ঘটছে। তবে তাদের আলোচনার সব বিষয়বস্তুই জানা যায় না। সেখানেই সমস্যার রহস্য আবৃত থাকছে!

ঢাকায় ডোলান্ড লু মঙ্গলবার আসার পর সরকারি কর্মকর্তা এবং নাগরিক সমাজের নেতারাসহ অন্যান্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীরকরণসহ মার্কিন-বাংলাদেশ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করবেন বলে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। বিএনপি ডোলান্ড লুর এই সফরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে। যদিও বিএনপির কোনো নেতার সঙ্গে লুর বৈঠক হবে কি না তা উচ্চপর্যায়ের কোনো নেতাই বলতে পারেননি। তবে বিএনপি নেতাদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রধানমন্ত্রীর কিছু বক্তব্যকে নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহের জাল বিস্তার করছে বলে প্রচার করছে। তাদের ধারণা লু মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন- যার কোনো তথ্য ভিত্তি নেই। তা ছাড়া এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে নির্বাচনী ঝড় এবং ছাত্র আন্দোলনের ঘূর্ণিঝড়। ইসরায়েলের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে সারা বিশ্বেই যখন বিরূপ প্রতিক্রিয়া বিস্তৃত হচ্ছে তখন সে দেশের একজন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদমর্যাদার কেউ বাংলাদেশে এসে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে এমন চাপ সৃষ্টির কথা কল্পনা করতে পারার কথা নয়। তা ছাড়া ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনকারীদের ঢাকায় মহাসমাবেশের শেষ দিকে আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়দানকারী মিয়া আরেফীর সংবাদ সম্মেলনের নাটক যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। ভুয়া এই উপদেষ্টা কোনো না কোনো মহলের বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই সেদিন রাজনীতির মঞ্চে বক্তৃতা দিতে প্রস্তুত হয়ে এসেছিলেন। মিয়া সাহেব তখন আটক হয়ে জেলে গেছেন, তিনি এখন কোথায় আছেন তা গণমাধ্যমেও জানা যাচ্ছে না। তবে এসব যে বাংলাদেশে তখন বড় ধরনের সংঘর্ষ তৈরিতে কাজে লাগানো হতো এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুতরাং ২৮ অক্টোবর পরবর্তী বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, অগ্নিসংযোগ ও প্রতিহত করা নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে আদর্শিক, গণতান্ত্রিক নির্বাচন করার প্রত্যাশা যুক্তরাষ্ট্রেরও দেখার আশা করা সম্ভব নয়। তারপরও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন এড়িয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন যেতে পেরেছে তা মোটেও হালকা করে দেখার বিষয় নয়। বিরোধীরা নির্বাচনকে কলঙ্কিত এবং প্রশ্নবোধক করার লক্ষ্যেই অবস্থান করছে; কিন্তু এটি বিএনপির জন্য এখন মোটেও সুখের হচ্ছে না তা বুঝতে পেরেই তারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের স্বপ্ন দেখতে চাইছে। সেই চাপ সরকারের ওপর প্রয়োগ করতে তারা আবারও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সওয়ার হতে চাচ্ছে। তবে সেই আশায় বোধ হয় না ডোলান্ড লু কোনো হাওয়া দিয়ে যেতে চাইবেন।

লেখক: ইতিহাসবিদ, অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


শুভ জন্মদিন

বাংলা ধারাভাষ্যের মহীরুহ চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইসমাইল হোসেন মিলন

আদি ও অকৃত্রিম বাঙালিয়ানায় ভরা একজন মানুষ যখন কমেন্ট্রি বক্সে ভরাট, গম্ভীর, সুললিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, আসসালামু আলাইকুম চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত বলছি। ঠিক তখনই বেতারে কান পাতা আপামর খেলাপ্রেমী বাঙালি আবিষ্ট হয়, যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে জীবন্ত একটি মাঠ… উদ্বেল হয়ে ওঠে গ্রাম থেকে শহর, গলি থেকে রাজপথ (১৯৯৭)। বাংলা ধারাভাষ্যের সেই মহীরুহ হলেন চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।

ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় তার নিখুঁত বাংলা আলংকারিক শব্দচয়ন, ব্যতিক্রমধর্মী কণ্ঠস্বর ইথারে ভেসে শিহরণ জাগায় আপামর বাংলাভাষীকে। ক্রিকেট খেলার সঙ্গে পরিচয় নেই, এমন মানুষ বর্তমানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় জন্ম বলে এই খেলাটি সরাসরি বা টিভিতে দেখার সুযোগ না হলেও শুধু রেডিওতে যার জাদুকরী কণ্ঠের কিছু কথামালা শুনেই এই ‘ক্রিকেট’ নামক অচেনা খেলাটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম এবং ধারাভাষ্যকার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই জাদুকরী কণ্ঠের মানুষটিই বাংলাদেশ ক্রিকেট অঙ্গনের সবার পরিচিত নাম ও মুখ- চৌধুরী জাফরউল্লাহ শারাফাত।

এখনো রেডিও কিংবা টিভির পর্দায় যার জাদুকরী কণ্ঠের ধারাভাষ্যে ক্রিকেটীয় উন্মাদনায় মাতোয়ারা হয় গ্রামগঞ্জ-শহর-বন্দরের লাখ লাখ বাঙালি।

আজ কিংবদন্তিতুল্য এই মানুষটির জন্মদিন। জন্মদিনে প্রিয় মানুষটির প্রতি রইল অফুরন্ত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা। ক্রিকেট পাগল এই জাতিকে আরও দীর্ঘদিন আপনার কণ্ঠের জাদুতে ক্রিকেটীয় উন্মাদনায় মাতিয়ে রাখুন সেই শুভ কামনায়- শুভ জন্মদিন জাফরউল্লাহ শারাফাত।


বঙ্গবন্ধুর ভাবনাদর্শে রবীন্দ্রনাথ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আব্দুল্লাহ্ আল-মামুন

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই বিশ্বমানবতা ও বিশ্বশান্তির জন্য নিবেদিত প্রাণ। এ দুই মহাপুরুষের চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড ছিল বাংলা ও বাঙালির অপরিসীম প্রেম। বাংলা ও বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন একজন সাহিত্য দিয়ে, অন্যজন রাজনীতি দিয়ে। ‘বাঙালি’ বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সে জাতিকেই আবিষ্কার করেন ‘সোনার বাংলায়’। যে বাংলাকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি,’ বঙ্গবন্ধু সেটিকে ভালোবেসে জাতীয় সংগীতে রূপ দেন।

শেখ হাসিনা তার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে অবহিত করেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানায় বই বেশির ভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন; কিন্তু আমার মায়ের অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাড শয়ের কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল।...মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কি না। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মায়ের সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল।...আমার খুবই কষ্ট হয় ওই বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ মুজিব আমার পিতা, পৃ: ৭০ ও ৭১)।

বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ও তার সহকর্মী মাজহারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন, রুশ লেখক আইজ্যাক অ্যাসিমভ, তুর্কি কবি নাজিম হিকমতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখকদের সম্মেলনে যোগদান করেছেন, লাহোরে কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি ‘জাভেদ মঞ্জিল’-এ অবস্থান করেছেন। তার রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে করাচি অভিমুখে যাত্রাকালে তিনি সহযাত্রী কয়েকজন কৌঁসূলিকে কাজী নজরুল ইসলামের কিছু কবিতা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাংশ আবৃত্তি করে শোনান। বাংলা ভাষার দিগন্তকে বিস্তৃত করার জন্য বিশ্বকবির অবদানকে বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করতেন। চীনে ভ্রমণকালে তিনি তার উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ২২৮)

স্বদেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি যেমন প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি বৈশ্বিকপর্যায়ে বাংলা ভাষার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব উন্মোচনে তিনি ছিলেন অতি উদ্যমী। ১৯৫২ সালে পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক শান্তি সম্মেলনে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু ও ভারতের ঔপন্যাসিক মনোজ বসু বাংলায় বক্তব্য উপস্থাপন করায় কৌতূহলী অনেক শ্রোতাকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে উত্তর দান করেন তা স্মরণযোগ্য, ‘বাংলা ভাষা যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষা এ অনেকেই জানে। ঠাকুর দুনিয়ায় ‘ট্যাগোর’ নামে পরিচিত। যথেষ্ঠ সম্মান দুনিয়ার লোক তাকে করে।...পাকিস্তানের শতকরা ৫৫ জন লোক এই ভাষায় কথা বলে এবং দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ভাষার অন্যতম ভাষা বাংলা।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃ: ৪৪)

বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট যে গান বাউল সুরে গীত হয় তা বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শিল্পী জাহিদুর রহিমের কণ্ঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ শুনতে পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জাহিদুর রহিম বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রায় নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশ করতেন। বঙ্গবন্ধু ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, ‘সুপ্রভাত’, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো’, ‘দুই বিঘা জমি’ প্রভৃতি কবিতা যেমন আবৃত্তি করতেন, তেমনি গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথের গানও গাইতেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়, খুলে যাবে এই দ্বার’ বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

১৯৫৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে বঙ্গবন্ধু কার্জন হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গানসহ লোকসংগীত পরিবেশিত হয়। ডি এল রায় রচিত ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গানটি বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান হিসেবে অনুষ্ঠানে গীত হয়। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সনজীদা খাতুনকে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য বঙ্গবন্ধু অনুরোধ জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানিদের নিকট ‘সোনার বাংলা’র রূপমাধুর্য ও প্রীতি পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু এ গানটি নির্বাচন করেছিলেন।

পাকিস্তানি সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও বাঙালি পালন করে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। এতে দেশে অসম্প্রদায়িক আন্দোলনের ধারা গতিশীল হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের ধারা অধিকতর বেগবান হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা ঘোষণার পর। তার স্বতন্ত্র জাতিসত্তার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ কীভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৬ সালের ঢাকার ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে। এই অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি দিয়ে, গানটির প্রতি ছিল তার আলাদা আবেগ।

১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধ থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রসংগীত প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়’। প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ দানাবেঁধে ওঠে। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ‘ক্ষমতাবলে হয়তো সাময়িকভাবে রেডিও ও টেলিভিশন হইতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার বন্ধ করা যাইতে পারে। কিন্তু গণচিত্ত হইতে রবীন্দ্রসংগীতের সুমধুর আবেদনকে কোনোকালেই মুছিয়া ফেলা যাইবে না।’

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতা প্রদানকালে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সে তুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখে যিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়বই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই।’ (মুনতাসীর মামুন, পৃ: ২৯৬)

১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ঞধমড়ৎব যধফ ৎবভষবপঃবফ ঃযব যড়ঢ়বং ধহফ ধংঢ়রৎধঃরড়হ ড়ভ ঃযব সরষষরড়হং ড়ভ ইবহমধষরবং ঃযৎড়ঁময যরং ড়িৎশং. ডরঃযড়ঁঃ যরস ঃযব ইবহমধষর খধহমঁধমব ধিং রহপড়সঢ়ষবঃব (ঞযব চধশরংঃধহ ঞরসবং, ১৭.১২.১৯৬৯). রবীন্দ্রসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সমধিক গুরুত্বারোপ করে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে রবীন্দ্র-রচনাবলি প্রকাশের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু জানতেন, একটি জাতির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি দমিত হলে সে জাতি ক্রমান্বয়ে নির্মূল হয়ে পড়ে। তার ভাষায়, ‘একটি জাতিকে পঙ্গু ও পদানত করে রাখার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো তার ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করা।’ তিনি শাহজাদপুরে অবস্থিত রবীন্দ্র কুঠিবাড়ী সংরক্ষণের দাবি উত্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে কলিম শরাফী, জাহিদুর রহিম, আফসারী খানম, বিলকিস নাসির উদ্দীন ও রাখী চক্রবর্তী রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করেন।

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জনসভা করেন বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গান দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। ৩০০ ফুট দীর্ঘ এক সুবৃহৎ নৌকার অবয়বে তৈরি হয়েছিল মঞ্চ। এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা শপথ নিলেন ৬ দফা বাস্তবায়নই তাদের লক্ষ্য। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা সার্বজনীন। ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিককর্মী ধীরে ধীরে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুতি করছেন। ঠিক সেই সময় বঙ্গবন্ধু শিক্ষার্থীদের জনসভায় রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর ২৩তম বার্ষিকী

উদ্‌যাপিত হয় ১৯৭১ সালের ৪ জানুয়ারি। এ উপলক্ষে ঢাকার রমনায় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রধান অতিথি। রবীন্দ্র-নজরুলকে পাকিস্তানি শাসকরা বাদ দিতে চাইলে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না; কিন্তু এর ওপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয়, কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে।’

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি কারাগার থেকে মুক্তি পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর বিমানে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে কূটনৈতিক অফিসার শশাঙ্ক এস ব্যাণার্জি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। তার স্মৃতিচারণে জানা যায়, বিমানে বসে বঙ্গবন্ধু ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গাইতে শুরু করেন। এ সময় তার চোখে জল দেখেন ভারতীয় কূটনৈতিক। গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করা উচিত বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মিস্টার ব্যানার্জিকে গানটি গাওয়ার অনুরোধ করেন। তার ভাবনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন আর নতুন রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতও তিনি অনেক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন।

১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করেন। সেদিন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে রেসকোর্সের ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর সেই বিখ্যাত কবিতার লাইন ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি’র বিপরীতে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবিগুরু তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ রবীন্দ্র গবেষকরা মনে করেন এর থেকে বড় শ্রদ্ধার্ঘ্য কবিগুরুর প্রতি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের আর কী হতে পারে?

১২ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পরেই জনৈক সাংবাদিক যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজকের দিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কি?’ জবাবে চিরাচরিত হাস্যমুখে তিনি বলেন, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’ তিনি ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে রূপ দেন। বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতরূপে আমার সোনার বাংলা স্বীকৃতি লাভ করে।

বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লাখ লাখ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছে, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন উদ্বোধন করছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন একাডেমির কর্মকর্তারা। তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালোবাসি তাকে-সাহিত্যে আমার পুঁজি তো ওইটুকুই।’

বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি যতদিন থাকবে, ততদিন এ দুজন আমাদের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-তে লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবী। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’ এক বিশাল পরিপূর্ণ হৃদয় দিয়ে তিনি মানবকল্যাণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তার জীবনবোধের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত করে তুলেছেন।

লেখক: পুলিশ সুপার নৌ পুলিশ, সিলেট অঞ্চল

বিষয়:

টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. জাহাঙ্গীর আলম

কৃষির ইংরেজি প্রতিশব্দ এগ্রিকালচার। শব্দটি ল্যাটিন এজারো এবং কালচারা শব্দদ্বয় দিয়ে গঠিত। এর আভিধানিক অর্থ মাটি কর্ষণ। বাংলা শব্দ কৃষি। শব্দার্থ অনুসারে শস্যের চাষ ও বৃক্ষরোপণ সরাসরিভাবে কৃষিকর্মের অন্তর্ভুক্ত। এর সঙ্গে পশুপাখি পালন ও মৎস্য চাষও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতএব, কৃষি খাত বলতে আমরা শস্য, মৎস্য, বন ও পশুপাখি উপখাতসমূহকে সমন্বিতভাবে বুঝে থাকি। বর্তমানে দেশের জিডিপিতে কৃষিখাতের অবদান ১২ শতাংশ। মোট রপ্তানিতে কৃষিজাত পণ্যের শরিকানা প্রায় ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে হিমায়িত মৎস্য ও পাটজাত দ্রব্য যোগ করা হলে মোট রপ্তানিতে কৃষির হিস্যা প্রায় ৭ শতাংশে বৃদ্ধি পায়। এখনো দেশের শতকরা ৪০ ভাগ শ্রমিক কৃষিখাতে নিয়োজিত। শিল্প ও সেবাখাতের অগ্রগতিও বহুলাংশে নির্ভরশীল কৃষিখাতের অগ্রগতির ওপর। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কৃষিখাতের উন্নয়ন একান্তভাবে প্রয়োজন।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন খাতে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান খাতটি হলো কৃষি খাত। অতীতে বাংলাদেশ ছিল একটি খাদ্য ঘাটতির দেশ। এ অঞ্চলে প্রতি বছর গড়ে খাদ্য আমদানি করা হতো ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় কৃষির উৎপাদন। ফলে ১৯৭১-৭২ সালে দেশে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টন। এটি ছিল মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। বর্তমানে সে ঘাটতির হার নেমে এসেছে ১৫ শতাংশেরও নিচে। স্বাধীনতার পর দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৬০ লাখ টনের ওপরে। গত ৫২ বছরে দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩ শতাংশ হারে। যে কৃষকের আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিল সে এখন খাদ্যে উদ্বৃত্ত। যে শ্রমিকের দাবি ছিল দৈনিক ৩ কেজি চালের সমান মজুরি, সে এখন কাজ করে ১০ কেজি চালের সমান দৈনিক মজুরিতে। কী কৃষক, কী শ্রমিক-কারোরই আর তেমন খাদ্যের অভাব হয় না। না খেয়ে দিন কাটে না কোনো মানুষেরই। কৃষি খাতে এখন উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে চাল উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ও উন্নয়নে বাংলাদেশের স্থান হলো সবার ওপরে। তা ছাড়া পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের স্থান দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়। চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনে দ্বিতীয়, গম উৎপাদনে সপ্তম ও আলু উৎপাদনে অষ্টম বলে বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ নাগাদ চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ, গম দুই গুণ, ভুট্টা ১০ গুণ ও সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। আলু, মৎস্য, মাংস ও ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত। চিরকালের দুর্ভিক্ষ, মঙ্গা আর ক্ষুধার দেশে এখন ঈর্ষণীয় উন্নতি হয়েছে খাদ্যোৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে। প্রতি বছর এ দেশে মানুষ বাড়ছে ২০ লাখ। কৃষিজমি কমছে ৮ লাখ হেক্টর। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের। বরং তা বাড়ছে নিরন্তর। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জনপ্রতি আমাদের খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা ছিল দৈনিক ৪৫৬ গ্রাম, ২০০০ সালে তা ৫২২ গ্রাম এবং ২০২০ সালে তা ৬৮৭ গ্রামে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ দ্রুত অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি। সম্প্রতি নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে আমাদের কৃষি খাতে। আগের খোরপোশ পর্যায়ের কৃষি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক কৃষিতে। এক নীরব বিপ্লব সূচিত হয়েছে কৃষির প্রতিটি উপখাতে।

বর্তমান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কৃষি খাতকে। রাসায়নিক সারের দাম দফায় দফায় কমিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে কৃষকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে পাঁচ দফায় কমিয়ে ইউরিয়া সারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি কেজি ১৬ টাকায়। টিএসপি সারের দাম ৮০ টাকা থেকে কমিয়ে ২২ টাকায়, এমওপি সারের দাম ৭০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫ টাকা, ডিএপি সারের দাম ৯০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৬ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখন তা কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ২৭ (ইউরিয়া), ২৭ (টিএসপি), ২০ (এমওপি) ও ২১ (ডিএপি) টাকায়।। গত ১৫ বছরে (২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩) শুধু সারেই ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। গত বছর তার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর চালু করা হয়েছে ২০ শতাংশ ভর্তুকি। ৫০ শতাংশ (ক্ষেত্র বিশেষে ৭০ শতাংশ) ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে কৃষি যন্ত্রপাতি। মোট বাজেটের প্রায় ২ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে কৃষি ভর্তুকি খাতে। তা ছাড়া দ্রুত হ্রাস করা হয়েছে কৃষিঋণের সুদের হার। এখন কৃষিঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার ৯ শতাংশ। মসলা ফসলের জন্য তা ৪ শতাংশ। দুগ্ধখামার করার জন্য ৫ শতাংশ। পানি সেচের আওতা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে মোট আবাদি জমির ৭৪ শতাংশে। উচ্চফলনশীল জাতের আওতায় এসেছে ৮৫ শতাংশ ধানি জমি। ফলে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে খাদ্যশস্যের উৎপাদন। ত্বরান্বিত হয়েছে খাদ্যনিরাপত্তা।

দানাদার খাদ্যশস্যের পর আলুর উৎপাদনে বিপুল উদ্বৃত্ত অর্জনের বিষয়টি উল্লেখ করার মতো। দেশের মানুষের দৈনিক জনপ্রতি আলুর চাহিদা হচ্ছে ৭০ গ্রাম, প্রাপ্যতা অনেক বেশি। বর্তমান শতাব্দীর শুরুতে আমাদের আলুর মোট উৎপাদন ছিল প্রায় অর্ধকোটি টন। এখন তা ১ কোটি ৯ লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে এখন আলু রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। তাতে প্রতি বছর গড়ে আমাদের আয় হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি ডলার। তা ছাড়া আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে এর ব্যবহারও বহুমুখী হচ্ছে। আগে আলুর ব্যবহার হতো মূলত সবজি হিসেবে। এখন তা চিপস ও পটেটো ক্রেকার্স হিসেবেও অনেক সমাদৃত। বিদেশিদের মতো অনেক বাংলাদেশিও এখন মূল খাদ্য হিসেবে রোস্টেড পটেটো খেতে পছন্দ করেন। আলু উৎপাদনে গত ২০ বছরে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।

খাদ্যশস্যের আর একটি বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে সবজি উৎপাদনে। ২০০৮-০৯ সাল থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সবজি উৎপাদন প্রতি বছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন ও ভারতের পর বিশ্বে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মৌসুমের শুরুতে বাজারে সবজির দাম ভালো থাকায় এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সবজি রপ্তানি সম্প্রসারিত হওয়ায় দেশের কৃষকরা এখন সবজি চাষে বেশ উৎসাহিত হচ্ছেন। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন আধুনিক সবজি চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে স্বীয় উদ্যোগে এরা গড়ে তুলছেন সবজি খামার।

বাংলাদেশে সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে ফলের উৎপাদনে। বর্তমানে এ দেশে ফলের উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টন। ফল উৎপাদনে পৃথিবীর প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। গত ২ দশক ধরে এ দেশে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল বছরে গড়ে ১১ শতাংশের ওপরে। দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ফলের মাথাপিছু প্রাপ্যতা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। ২০০৬ সালে আমাদের মাথাপিছু দৈনিক ফল গ্রহণের পরিমাণ ছিল ৫৫ গ্রাম, ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ গ্রামে। তাতে কিছুটা হ্রাস পেয়েছে আমাদের পুষ্টিহীনতা। বর্তমানে আমাদের দেশে আমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। চিরায়তভাবে গড়ে ওঠা রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, দিনাজপুরের বাগানগুলো ছাপিয়ে এখন প্রচুর আম উৎপাদিত হচ্ছে সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায়। তা ছাড়া বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক ধানিজমি পরিণত হয়েছে আম বাগানে। অধিকন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাষ করা হচ্ছে নতুন ফল স্ট্রবেরি। আরও চাষ করা হচ্ছে রাম্বুতান, ড্রাগন ফল ও অ্যাভোকেডো। মানুষ আপেলের পরিবর্তে বেশি করে খাচ্ছে কাজী পেয়ারা। তাতে বিদেশি ফলের আমদানি হ্রাস পাচ্ছে। সাশ্রয় হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা।

এ দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। দীর্ঘমেয়াদে এর আবাদি এলাকা কমেছে। তবে একরপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। ২০১০ সালে পাটের জিন রহস্য উন্মোচনের ফলে এর উৎপাদন বৃদ্ধির পথ আরও সুগম হয়েছে। বিশ্ববাজারে এখন পাটের চাহিদা বাড়ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ। সাম্প্রতিক করোনাকালেও পাটের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজার ছিল বেশ চড়া। এখন দেশে কৃষকের খামারপ্রান্তে কাঁচা পাটের মূল্য ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা প্রতি মণ। এটা বেশ লাভজনক মূল্য। বর্তমানে দেশে পাটের উৎপাদন প্রতি বছর ৭৫ থেকে ৮৫ লাখ বেল। আগামীতে এর উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। অদূর ভবিষ্যতে আবার ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের পাটখাত।

কেবল শস্যখাতই নয়- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে কৃষির সব উপখাতেই বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভর বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ২০০৭-০৮ সালে এ দেশে মাছের মোট উৎপাদন ছিল ২৫ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ লাখ টনে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আহরিত মাছের পরিমাণ প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত মাছের হিস্যা মাত্র ১৫ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা প্রায় ২৮ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে এবং ৫৭ ভাগ আসে বদ্ধ জলাশয় থেকে। সামুদ্রিক মৎস্যের শতকরা প্রায় ৮২ ভাগ জোগান আসে আর্টিশনাল বা চিরায়ত আহরণ পদ্ধতির মাধ্যমে। আর বাকি ১৮ শতাংশ আসে ট্রলারকেন্দ্রিক শিল্পায়িত আহরণের মাধ্যমে। বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের হিস্যা হ্রাস পেয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ আহরণের হিস্যা বেড়েছে। এর কারণ, সামুদ্রিক আহরণের প্রবৃদ্ধির হার কম, অভ্যন্তরীণ আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে বদ্ধ জলাশয় তথা চাষাধীন জলাশয় থেকে আহরণের প্রবৃদ্ধির হার বেশি বিধায় মোট মৎস্য উৎপাদনে এ খাতের হিস্যা দ্রুত বেড়েছে। গত ৩৬ বছরে (১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত) অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক জলসম্পদ থেকে মৎস্য আহরণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ২.৭, ৮.৫৭ এবং ৩.৯৪ শতাংশ। এ সময় মাছের মোট উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ৫ শতাংশ হারে। অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে উন্নত পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য। এর পেছনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অধিক উৎপাদনক্ষম মৎস্য প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গত ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রুইজাতীয় মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পাঙ্গাশ, কৈ, শিং, মাগুর ও তেলাপিয়া মাছের উৎপাদন বিপুল পরিমাণে বেড়েছে। তাতে অভ্যন্তরীণ পুকুর-দীঘিতে হেক্টরপ্রতি মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৫ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। মৎস্য খাতের উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- ইলিশের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া। ২০০৮-০৯ সালে ইলিশের মোট উৎপাদন ছিল ২.৯৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫ লাখ মেট্রিক টনে। নদীতে জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকরণ এবং ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন ও আকার আশাতীত বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এ দেশে উৎপাদিত মোট মাছের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। পৃথিবীর মোট ইলিশ উৎপাদনে দুই-তৃতীয়াংশেরও অধিক হিস্যা বাংলাদেশের রয়েছে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। বিশ্ব দরবারে এর পরিচয় ‘বাংলাদেশ ইলিশ’ হিসেবে। এর ভৌগোলিক নিবন্ধন বা জিআই সনদ রয়েছে।

পুষ্টির অন্যান্য উপাদান ডিম, দুধ ও মাংস উৎপাদনে উচ্চমাত্রার প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশ এখন ডিম ও মাংস উৎপাদনে স্বয়ম্ভর। দুগ্ধ উৎপাদনে এখনো ঘাটতি আছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে যে হারে উৎপাদন বাড়ছে তাতে এর ঘাটতি মেটানো সম্ভব হবে অচিরেই। বর্তমানে (২০২১-২২ অর্থ বছরের তথ্যানুসারে) মাংসের উৎপাদন ৯২.৬৫ লাখ মেট্রিক টন। জনপ্রতি বার্ষিক প্রাপ্যতা ৫৪ কেজি। ডিমের উৎপাদন ২৩৩৫.৩৫ কোটি। বার্ষিক জনপ্রতি প্রাপ্যতা ১৩৬টি। দুধের উৎপাদন ১৩০.৭৪ লাখ মেট্রিক টন। জনপ্রতি বার্ষিক প্রাপ্যতা ৭৬ লিটার। তবে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের তুলনায় বাংলাদেশে মাংস, ডিম ও দুধের দাম বেশি। প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ হ্রাস করে ভোক্তাপর্যায়ে পশু-পাখি উপজাতের মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ খাতে নতুন প্রযুক্তির ধারণ উৎসাহিত করা উচিত।

কৃষির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপখাত বন। এ খাতে বৃক্ষের মোট আচ্ছাদিত এলাকা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৪ বছর আগে দেশের ৭-৮ শতাংশ এলাকা বৃক্ষাচ্ছাদিত বনভূমির আওতায় ছিল বলে ধরে নেওয়া হতো। এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৭.৪৫ শতাংশে। উপকূলীয় এলাকায় সবুজ বেষ্টনী এবং গ্রামীণ কৃষি বনায়ন দেশের পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। বৃক্ষরাজী থেকে মানুষের পুষ্টি গ্রহণ, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বনসম্পদের আরও দ্রুত সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার এখন অনেক এগিয়েছে। ভূমি কর্ষণ, ফসল কর্তন ও মাড়াই, ধান ভানা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই এখন কায়িক শ্রমের ব্যবহার সীমিত হয়ে আসছে। বাড়ছে যন্ত্রের ব্যবহার। স্বাধীনতার পর ভূমি কর্ষণের ৯০ শতাংশই সম্পন্ন করা হতো কাঠের লাঙল দিয়ে। ব্যবহার করা হতো পশুশক্তি। এখন পশুশক্তির ব্যবহার হ্রাস পেয়ে নেমে এসেছে ৫ শতাংশে। বাকি ৯৫ শতাংশই আবাদ হচ্ছে যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। ধান কাটা ও মাড়াই ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার এখন বেশ প্রচলিত। তবে তার পরিধি এখনো বেশ সীমিত। বর্তমানে কৃষিযন্ত্র সংগ্রহে কৃষকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকিমূল্যে যন্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। হাওর, চরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় ভর্তুকির পরিমাণ বেশি, ৭০ শতাংশ। তবে এর সুবিধাভোগীর সংখ্যা খুবই কম। এটি বাছাইকৃতভাবে এখনো কার্যকর হচ্ছে গ্রামীণ এলাকায়। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে চলছে শ্রমিক সংকট। তাতে দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে শ্রমিকের মজুরি। তদুপরি ফসল উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে সময়ক্ষেপণ, অপচয় ও অদক্ষতার কারণে কৃষির উৎপাদনে লাভজনকতা হ্রাস পাচ্ছে। এমতাবস্থায় কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যবহার দ্রুত সম্প্রসারিত করা দরকার। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সম্প্রতি ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা হয়েছে ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’। ভবিষ্যতে আরও বড় আকারের কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে।

অধুনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্থায়িত্বশীল বা টেকসই কৃষি উন্নয়নের ওপর। কারণ কৃষি উৎপাদনের প্রধান ৩টি উপকরণ মাটি, পানি ও বায়ু সসীম। ইচ্ছে করলেই এদের সীমিত সরবরাহকে অসীম করা যাবে না। ভবিষ্যতে দ্রুত বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য অনেক বেশি পরিমাণে খাদ্যোৎপাদন করতে হবে; কিন্তু তার জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও পানির অভাব দারুণভাবে পরিলক্ষিত হবে। পৃথিবী পৃষ্ঠে বায়ুর অভাব আপাতত পরিলক্ষিত না হলেও জলবায়ুর উষ্ণায়ন আমাদের এক চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কৃষির উৎপাদনে তা এক মারাত্মক প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করবে। সে কারণে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন বলতে এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যা ভবিষ্যতের জন্য সম্পদের মজুত অটুট রাখবে এবং তাতে প্রকৃতি ও এর কোনো অংশের বিনাশ সাধন করা হবে না। টেকসই উন্নয়ন মানুষের বর্তমান চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে; কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে তা সক্ষমতা ঘাটতির কোনো কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। টেকসই কৃষিব্যবস্থা বলতে এমন পরিবেশবান্ধব কৃষি কার্যক্রমকে বোঝায় যা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ অক্ষুণ্ন রেখে মানুষের উৎপাদন চাহিদা মিটিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তাতে পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকবে। মানবগোষ্ঠী ও প্রাণিসম্পদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান সম্ভব হবে।

টেকসই কৃষি উন্নয়নের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো- ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল করা এবং সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করা টেকসই কৃষি উন্নয়নের আর একটি প্রধান লক্ষ্য। তা ছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্যের উৎপাদন দ্বিগুণ করা এবং বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো কৃষি উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা এর অন্য একটি লক্ষ্য। অন্যান্য লক্ষ্যের মধ্যে আছে কৃষিজমিতে সবার অভিগম্যতা ও এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, শস্য ও প্রাণিসম্পদের জীববৈচিত্র্য অক্ষুণ্ন রাখা, বাণিজ্যের প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করা এবং কৃষিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।

কৃষির বিভিন্ন উপখাতে ক্রমাগতই উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন ও সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে এবং তা টেকসই করতে হলে এ প্রবৃদ্ধির হার আরও গতিশীল করা দরকার। সে কারণে কৃষিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা দরকার। জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতের হিস্যা বাড়ানো দরকার। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে কৃষি খাতের বাজেট বরাদ্দ ও ভর্তুকি হ্রাস পেয়েছে। এখন তা কিয়দাংশ বৃদ্ধি পেলেও স্থায়িত্বশীল কৃষি উন্নয়নের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এর পরিমাণ আরও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে কৃষির চিরায়ত উৎপাদনব্যবস্থাকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত করার জন্য পুঁজির সঞ্চার ঘটাতে হবে। তা ছাড়া কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাত শিল্প স্থাপনে এবং এর বিপণনে বিশেষ সহায়তা প্রদান করতে হবে। কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রমকে চিহ্নিত করতে হবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের খাত হিসেবে।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ; পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকস এবং প্রাক্তন উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।


গ্রীষ্মের দাবদাহ ও বৃক্ষরোপণ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সৈয়দ শাকিল আহাদ

জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশকে সবুজায়নে অসম্ভব সাফল্য দেখিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের দিকে।

গণতন্ত্রের মানসকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সারা দেশে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শোনা যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের প্রস্তুতির বিকল্প নেই- এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধু আগেই অনুধাবন করেন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার সঙ্গে সঙ্গে দেশকে সবুজায়ন, বনায়নের মধ্য দিয়ে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনকি উপকূলীয় এলাকায় সবুজায়ন করার উদ্যোগও বঙ্গবন্ধুই নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু একজন পরিবেশ প্রেমিক, প্রকৃতি প্রেমিক হিসেবে সব সময় পরিবেশের উন্নয়নের বিষয়টি প্রাধান্য দিতেন। এ সময়ে প্রচণ্ড দাবদাহের ফলে বঙ্গবন্ধুর এই সোনার বাংলায় চলছে দুর্বিষহ পরিস্থিতি।

গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, একবিন্দু পানির জন্য চারদিকে হাহাকার, জনহীন পথে মরীচিকার হাতছানি, তখন কবিগুরু প্রকৃতিকে বলছিলেন ‘তুমি কত নির্মম হবে হও সেই নির্মমতার সঙ্গেই হবে আমার মিলন।’ তাই তো কবিগুরু তার কবিতায় লিখেছেন-

‘নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।

খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা।।

যদি ঝরে পড়ে পড়ুক পাতা,

ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,

থাক জনহীন পথে পথে মরীচিকাজাল ফেলা।।

শুষ্ক ধূলায় খসে পড়া ফুলদলে

ঘূর্ণী- আঁচল উড়াও আকাশতলে।

প্রাণ যদি করো মরুসম

তবে তাই হোক- হে নির্মম,

তুমি একা আর আমি একা,

কঠোর মিলনমেলা।।’

এপ্রিল মাসজুড়ে সারা দেশে বয়ে গেছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এবং মে মাসেও তা চলছে। এই তীব্র গরমে সুস্থ থাকার উপায় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবেদ হোসেন খানের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনি বলেন, ‘হিমশীতল বা লু-হাওয়া যে তাপমাত্রাই হোক না কেন, মানব শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া তার নিজের তাপমাত্রা ৩৭.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নির্দিষ্ট রাখতে চায়।

শরীরে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণেই কেবল মানুষ জাগতিক কাজকর্ম করে থাকে। কিন্তু সূর্যের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল তাপমাত্রা নির্দিষ্ট একটি মাত্রায় ঠাণ্ডা রাখার জন্য শরীরকে বাড়তি কাজ করতে হয়। এর ফলে ত্বকের কাছাকাছি রক্তবাহী ধমনিগুলো তীব্র তাপ চারপাশে ছড়িয়ে দিতে বেশি করে কাজ করতে শুরু করে, আর তখনই ঘাম হতে শুরু করে। শুনতে খুব সাধারণ শোনালেও, শরীরের জন্য ব্যাপারটি মোটেও সহজ নয়। যত গরম, মানব শরীরের জন্য তা সামলানো তত কঠিন। ত্বকের নিচের ধমনিগুলো যখন খুলে যেতে থাকে, তখন রক্তচাপ কমে যায় এবং হৃৎপিণ্ডের কাজ বাড়িয়ে দেয়। শরীরের সবখানে রক্ত পৌঁছে দিতে হৃৎপিণ্ডকে তখন দ্রুত পাম্প করতে হয়।

এর ফলে শরীরে হালকা র‍্যাশ বা দানা দেখা দিতে পারে, মানে ছোট ফুসকুড়ির মতো যা চুলকাতে পারে। অথবা কারও পা ফুলে যেতে পারে গরমে। কিন্তু রক্তচাপ বেশি কমে গেলে হার্ট অ্যাটাক পর্যন্ত হতে পারে। সেই বেশি ঘামের কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়তে পারে। এই গরমে ঠাণ্ডা পানি খাওয়া একেবারেই উচিত না। বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে রোদ এড়িয়ে চলে বাইরে বের হতে হলে যতটা সম্ভব ছাতা, টুপি বা কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হবে। বিশেষ করে সুতির তৈরি হালকা রঙের পোশাক পরা ও পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি পান করা প্রয়োজন। সহজে হজম হয় এমন খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং বাসি, খোলামেলা খাবার খাওয়া এড়িয়ে চলা দরকার। তীব্র গরমে কাউকে অসুস্থ হয়ে পড়তে দেখলে কী করা উচিত, সে বিষয়ে ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ কিছু পরামর্শ দিয়েছে।

  • ঐ ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব ঠাণ্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
  • শুইয়ে দিতে হবে, এবং তার পা কিছুটা ওপরে তুলে দিতে হবে।
  • প্রচুর পানি বা পানীয় খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে, পানিশূন্যতা দূর করার পানীয় দেওয়া যেতে পারে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা করতে হবে, ভেজা কাপড় বা স্পঞ্জ দিয়ে মুছে দেওয়া যেতে পারে পুরো শরীর।

বগলের নিচে এবং ঘাড়ে-গলায় ঠাণ্ডা পানি দেওয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু ৩০ মিনিটের মধ্যে যদি সুস্থ না হয়, তাহলে ঐ ব্যক্তির হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কালক্ষেপণ না করে তক্ষুনি চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। হিটস্ট্রোক হলে মানুষের ঘেমে যাওয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

সে ক্ষেত্রে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ঐ ব্যক্তি।

এই গরমে সবারই একটু বুঝতে হবে, কাদের ঝুঁকি বেশি?

অতি গরমে স্বাস্থ্যবান মানুষের হিটস্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা কম। কিন্তু কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন।

শুরুতেই বয়স্ক, বৃদ্ধ এবং যাদের আগে থেকেই অসুস্থতা রয়েছে, তাদের অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে অনেকাংশে বেশি।

যাদের ডায়াবেটিস টাইপ ওয়ান বা টু রয়েছে, তাদের শরীর দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে এবং কিছু জটিলতা দেখা দেয়।

এ ছাড়া বাচ্চাদের খুব কষ্ট হয় বেশি গরমে।

অনেক সময় বাচ্চারা বা শিশুরা নিজেদের অস্বস্তির কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না, যে কারণে মা-বাবারা সঠিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে পারেন না।

বাংলাদেশে গত কয়েকদিন ধরে তাপপ্রবাহের কারণে তীব্র গরম চলছে। আরও কয়েকদিন দেশে তীব্র গরম থাকবে জানিয়ে সম্প্রতি ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি করেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় গরমের তাপমাত্রা এর মধ্যেই রেকর্ড অতিক্রম করেছে।

প্রচণ্ড গরমের কারণে দেশের অনেক স্থানে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে।

চিকিৎসকরা বলেছেন, এ রকম তীব্র গরমের সময় সতর্ক না থাকলে শারীরিক নানা সমস্যার পাশাপাশি হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়।

এই তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা পশুপাখিদেরও। তাদের ভয়াবহ করুণ পরিস্থিতি দেখা যায় চিড়িয়াখানায় গেলে, সেখানে দেখা যায় নেই বাঘের হুংকার, নেই বানরের লাফালাফি, হাতিদের খেলা, রোদের খরতাপে পাখিদের বেড়েছে অস্বস্তি, থেমেছে কলকাকলী, একত্রে চাঞ্চল্য হারিয়েছে যেন সব পশুপাখি, দর্শনার্থীর সংখ্যাও হাতে গোনা, দু-একটি ময়ূরের ডাক ছাড়া পুরো চিড়িয়াখানা জুড়েই লক্ষ করা যায় সর্বত্র বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।

এই সময়ে দেশের কোথাও কোথাও অল্পবিস্তর বৃষ্টিও হয়েছে, আবহাওয়াবিদরা আগাম বন্যারও আশঙ্কা করছেন।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বৃক্ষরাজি শুধু কার্বন নিঃসরণ কমায় না; শব্দদূষণও রোধ করে। এক হেক্টর পরিমাণ মাঝারি বন ১০ ডেসিবল শব্দ হ্রাস করতে পারে। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে বনের জমি পাইকারি হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সবুজ গাছের সঙ্গে জীবশ্রেণির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রাণীর অস্তিত্ব বজায় রাখতে গাছ প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই স্থান-পরিক্রমায় জীবকুলের উপকারার্থে স্রষ্টা উদ্ভিদকুলকে বৈচিত্র্যময় করে সাজিয়েছেন। তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় পরস্পর নির্ভরশীল। অথচ এ দেশে প্রতিনিয়ত গাছ কর্তন করে শুধু মানুষরাই নিজেদের সব প্রাণিকুলের সর্বনাশ ডেকে আনছে। গাছ কাটা প্রতিরোধ করে মানুষের বসবাসে পরিবেশবান্ধব গাছ লাগানোর বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের মতামত নিয়ে জানা যায়, সবাই ব্যাপক ভিত্তিতে সারা দেশে গাছ লাগানোর পক্ষে।

পরিবেশের দূষণ ও বিপর্যয় রোধে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। প্রকৃতি ও আবহাওয়ার ভারসাম্য রক্ষার্থে গাছ লাগানো জরুরি।

এ কথা সত্য যে, গাছ মানুষের নিঃস্বার্থ ও উপকারী বন্ধু। বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা জরিপ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি প্রাণীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৃক্ষ বা উদ্ভিদের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। এ দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের কারণে প্রতিনিয়ত নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন করা হচ্ছে, যা পরিবেশের ওপর হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশের আয়তনের অনুপাতে ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সেই পরিমাণ বনভূমি এ দেশে নেই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। যদিও সরকারি হিসাবে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৭ শতাংশ বলা হয়ে থাকে। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি জাতীয় ঐতিহ্য, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, ইত্যাদিতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব রোধ, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষাসহ নৈসর্গিক শোভাবর্ধনে গাছের অসীম গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের প্রত্যেকের প্রতি বছর বাড়ির আশপাশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা খোলা জায়গায় সাধ্যমতো ফলজ এবং ঔষধি গাছ লাগানো উচিত। তবেই আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশও ভালো থাকবে।

আমাদের ধর্মীয় দিক, অর্থাৎ ইসলামী শিক্ষা অনুসারে একজন মুমিন ও মুসলিম সর্বদা পরিবেশবান্ধব। যে ব্যক্তি অকারণে ছায়াযুক্ত গাছ কেটে ফেলে, তাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিশাপ দিয়েছেন। আবদুল্লাহ বিন হুবশি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অকারণে একটি কুলগাছ কাটবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৫২৩৯)

আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ এবং বৈষম্য আমাদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের সর্বস্তরের জনগণের প্রখর সতর্কতা এবং পারিবারিকভাবে, শিক্ষাকেন্দ্রে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে আরও বেশি বৃক্ষরোপণ করার ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক


বিদায় হজের ভাষণ

আপডেটেড ১০ মে, ২০২৪ ১৬:৪৯
আতিকুল ইসলাম খান

এই ভাষণই ইসলাম ধর্মের শেষ খুতবা বলে আখ্যায়িত। দশম হিজরিতে আরাফার ময়দানে জুমার দিন সংগঠিত, আখেরি নবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই ভাষণে সমাজ ও রাষ্ট্রে অরাজকতা, বিদ্রোহ এবং কুপরামর্শ প্রদানকারী শয়তানের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে বলেছেন। এই ভাষণে বিভিন্ন সুদ প্রথা রোহিত করে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকারকে নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয় বরং সমগ্র বিশ্বমানবতার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সুরাতুল আরাফে আল্লাহ বলেন; ও নবী আপনার উম্মতকে জানিয়ে দিন, আজকের দিনে ইসলামকে আমি জীবন বিধান হিসাবে তোমাদের জন্য কবুল করলাম। এই আয়াত শুনে একজন ইহুদি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রহ.)কে বলেছিল এমন একটা দিন পেলে আমরা ইহুদিরা ঈদের দিন বানিয়ে নিতাম। এ কথা শুনে হজরত ওমর (রা.) আল্লাহর কসম করে বললেন, নিশ্চয়ই আজকের এই দিন মুসলমানদের ঈদের দিন এবং এই জুমাবারে সাপ্তাহিক ঈদ পালন করার দিন। এই ভাষণ হচ্ছে তেইশ বছরের নবুওয়তি জীবনের কর্মপন্থা ও প্রজ্ঞার নির্যাস।

বিদায় হজের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা-

১) হে মানব মণ্ডলী---

তোমরা হৃদয়ের কর্ণে ও মনোযোগ সহকারে আমার বক্তব্য শ্রবণ করো, আমি জানি না আগামী বছর এ সময়ে এ স্থানে এ নগরীতে সম্ভবত

তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ হবে কি না।

২) হে মানব সকল ---

সাবধান! সব প্রকার জাহিলিয়াতকে আমার দুই পায়ের নিচে পিষ্ট করে যাচ্ছি। নিরপরাধ মানুষের রক্তপাত চিরতরে হারাম ঘোষিত হলো।

প্রথমে আমি আমার বংশ থেকে রবিয়া বিন হারেস বিন আব্দুল মুত্তালিবের রক্তের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সে বনি লাইস গোত্রের দুধ পান করেছে। হুযাইল তাকে হত্যা করেছে।

৩) হে মানুষ সকল ---

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র থেকে ‘সুদ’কে চিরদিনের জন্য হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। আমি আজ আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের যাবতীয় সুদের দাবি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।

৪) হে লোক সকল ---

বলো আজ কোন দিন? সবাই বলল, আজ মহান আরাফার দিন। আজ হজের দিন। সাবধান! আজকের এই দিন জুমার দিন। এই মাস জিলহজ মাস। এই শহর (মক্কা) যেমন পবিত্র, তোমাদের জান মাল ইজ্জত মান-সম্মান আবরু কিয়ামত পর্যন্ত পবিত্র। তোমাদের একের জন্য অপরের রক্ত, তার মাল, সম্পদ, তার ইজ্জত-সম্মান, আজকের দিনের মতোই পবিত্র। এই হারাম মাসের মতো হারাম অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম। তোমাদের কাছে একজনের গচ্ছিত সম্পদ এ সম্মানিত নগরীর মতো পবিত্র আমানত। সাবধান! মানুষের আমানত, প্রকৃত মালিকের নিকট পৌঁছে দেবে।

৫) হে মানুষ সকল ---

ঋণ অবশ্যই তোমাদের ফেরত দিতে হবে। বিশ্বস্ততার সাথে প্রত্যেকের আমানত রক্ষা করতে হবে। তোমরা কেউ দুর্বলের ওপর অবিচার করবে না। কারও সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারও জন্য হালাল নয়।

৬) হে মানব সকল ---

নিশ্চয়ই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ একজন। তোমাদের পিতাও একজন। তোমরা সবাই আদম (আ.) থেকে আর আদম (আ.) মাটি থেকে সৃষ্টি। তোমাদের সবার পিতা আদম (আ.)। হে মানবজাতি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। অতএব শুনে রাখ, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। অন্ধকার যুগের কৌশিল্য বিলুপ্ত করা হলো। শুধু কাবা ঘরের তত্ত্বাবধান ও হাজীদের পানি পান করানো ছাড়া। আরবের ওপর অনারবের এবং অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সাদার ওপর কালোর আর কালোর ওপর সাদার কোনো মর্যাদা নেই।

তাকওয়াই শুধু পার্থক্য নির্ণয় করবে। তোমাদের মাঝে যারা মুত্তাকি, আল্লাহভীরু, কেবল তারাই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদাবান।

৭) হে লোক সকল ---

পুরুষদের নারী জাতির ওপর নেতৃত্বের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তবে, নারীদের বিষয়ে তোমরা আল্লাহ তা’য়ালাকে স্মরণ করো। নারীদের ওপর যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষদের ওপরও রয়েছে নারীদের অধিকার। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর জামিনে আল্লাহর আমানত হিসেবে আল্লাহর কালিমার মাধ্যমে হালাল করে গ্রহণ করেছ। স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে তারা যেন নিজ স্বামী ছাড়া পর পুরুষের সঙ্গে ভোগে লিপ্ত না হয়। যদি তারা তা করে তাহলে আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তাদের প্রতি কঠোরতার অনুমতি দিয়েছেন। এমতাবস্থায় তোমরা তাদের শয্যা পৃথক করে দেবে এবং মৃদু প্রহার করবে। তাতে তারা বিরত হলে নিয়মাফিক তাদের ভরণ পোষণের প্রতি লক্ষ রাখবে। স্ত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে, কেননা তারা তোমাদের সহযোগী ও সাহায্যকারিনী।

৮) হে উপস্থিত সকল ---

মুমিনরা পরস্পর ভাই আর তারা সকলে মিলে এক অখণ্ড ভ্রাতৃসমাজ। এই ভাইয়ের ধন-সম্পদ তার অনুমতি ব্যতিরেকে ভক্ষণ করবে না।

তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কাউকে কিছু দেয়, তাহলে সেটা স্বতন্ত্র ব্যাপার। আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেও না। পরস্পর খুনাখুনি করো না এবং তোমরা একে অপরের ওপর জুলুম করো না।

৯) হে মানুষেরা ---

তোমরা শুনে রাখ, শয়তান আজ নিরাশ হয়ে পড়েছে। বড় বড় বিষয়ে সে তোমাদের পথভ্রষ্ট করতে সামর্থ্য হবে না। তবে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে তোমরা সতর্ক থাকবে এবং তার অনুসারী হবে না।

১০) হে আল্লাহর বান্দা ---

তোমরা আল্লাহর বন্দেগি করবে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত প্রতিষ্ঠা করবে। রমজান মাসে সিয়াম পালন করবে এবং জাকাত আদায় করবে। তবেই তোমরা জান্নাত লাভ করতে পারবে।

১১) হে মানুষ সাবধান ---

তোমরা তোমাদের গোলাম ও অধীনস্থদের বিষয়ে আল্লাহ তা’য়ালাকে ভয় করো। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তা খেতে দেবে। তোমরা যা পরবে, তাদেরকেও সেভাবে পরতে দেবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।

১২) হে মানুষ ---

বিশ্বাসী তো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্যের সম্মান ধন প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্যের জন্যও তাই পছন্দ করে।

১৩) হে মানুষ ---

তোমরা ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে, ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সব সৎ গুণকে ধ্বংস করে দেয়। শুনে রাখো, আজ হতে বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বা কৌলিন্য প্রথা বিলুপ্ত করা হলো। কৌলিন্য বা শ্রেষ্ঠ সেই- যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে।

১৪) হে লোক সকল ---

আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহ তা’য়ালার পয়গাম পৌঁছে দেইনি? তখন লোকেরা বলল, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন; আমার বিষয়ে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে- সেদিন তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে? সকলে এক বাক্যে বলে উঠল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আমাদের নিকট রিসালাতের পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। উম্মতকে সব বিষয়ে উপদেশ দিয়েছেন এবং সব গোমরাহির আবরণ ছিন্ন করে ওহির আমানত পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজ শাহাদাৎ অঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ তা’য়ালা! আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

১৫) হে মানুষেরা ---

আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক উত্তরাধিকারীর অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার থেকে কম বেশি করবে না। উত্তরাধিকারীর জন্য কোনো অসিয়ত প্রযোজ্য নয়। সাবধান! অন্যদের জন্য এক-তৃতীয়াংশের অধিক ওসিয়ত করা বৈধ নয়।

১৬) হে মানব মণ্ডলী---

সন্তান যার বিছানায় জন্মগ্রহণ করবে সে তারই হবে। ব্যভিচারের শাস্তি হচ্ছে প্রস্তরাঘাত, অর্থাৎ সন্তানের জন্য শর্ত হলো তা, বিবাহিত দম্পতি হতে হবে। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই।

যে সন্তান আপন পিতা ব্যতীত অন্যকে পিতা এবং যে দাস নিজের মালিক ব্যতীত অন্য কাউকে মালিক বলে স্বীকার করে, তাদের ওপর আল্লাহতা’য়ালা ফেরেস্তাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ। তার ফরজ নফল কোনো ইবাদতই কবুল হবে না।

১৭) হে কুরাইশ সম্প্রদায়---

তোমরা দুনিয়ার মানুষের বোঝা নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন কিয়ামতে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করো, কেননা, আমি আল্লাহর আজাবের মোকাবেলায় তোমাদের কোনো উপকার করতে পারব না। তোমাদেরকে দেখেই লোকেরা আমল করবে। মনে রেখ সকলকে একদিন আল্লাহ তা’য়ালার নিকট হাজির হতে হবে। সেদিন তিনি প্রতিটি কর্মের হিসাব গ্রহণ করবেন।

১৮) হে মানুষ সকল ---

তোমরা আমার পরে গোমরাহিতে লিপ্ত হবে না। পরস্পর মারামারি হানাহানিতে মেতে উঠবে না। আমিই আখেরি নবী। আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না। আমার সাথেই ওহির পরিসমাপ্তি হতে যাচ্ছে।

১৯) হে মানুষেরা ---

তোমরা জেনে রাখ, আমি নিঃসন্দেহে একজন মানুষ। সুতরাং আমাকেও আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যেতে হবে। (সুরা ইসরাইলের প্রথম আয়াতের মধ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.)কে আবদ্ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। আবদ্ অর্থ বান্দা। আল্লাহই ভালো জানেন, তবে মাটি আর নূর নিয়ে তর্ক বিতর্ক করার আগে প্রাধান্য দিতে হবে তিনি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানব সমাজে মনুষ্য আচরণ প্রদর্শনের জন্য তিনি মাটির সৃষ্টি হলেও সে মাটি ছিল অসাধারণ, নূরের থেকেও শ্রেষ্ঠ।

২০) হে মানুষ সকল ---

শুনে রাখ আমার পরে আর কোনো নবী নেই। হে মানুষ আমি তোমাদের কাছে দুটি আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এই দুটি অনুসরণ করবে, ততদিন তোমরা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হবে না। এর একটি হলো ‘আল্লাহর কিতাব আর অপরটি আমার জীবন দৃষ্টান্ত।’

২১) হে মানব মণ্ডলী---

তোমরা নেতার আনুগত্য করবে এবং তার কথা শ্রবণ করবে। যদিও তিনি হন হাবশী ক্রীতদাস। যতদিন পর্যন্ত তিনি আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করেন, ততদিন অবশ্যই তার কথা শুনবে এবং তার নির্দেশ মানবে ও তার প্রতি আনুগত্য করবে। আর যখন তিনি আল্লাহর কিতাবের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করবেন, তখন থেকে তার কোনো কথা শুনবে না এবং তার আনুগত্যও করা যাবে না।

২২) হে মানুষ সাবধান ---

তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকবে। জেনে রেখো, তোমাদের পরবর্তীরা এই বাড়াবাড়ির করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে। এই নির্দেশটি হচ্ছে অমুসলিমদের ক্ষেত্রে অর্থাৎ কোনো বিধর্মীকে বাড়াবাড়ি বা জোর জবরদস্তি করে ইসলামের দীক্ষা দেওয়া যাবে না। তবে, একজন মুসলমানকে অবশ্যই পরিপূর্ণ ইসলামী জিন্দেগী অবলম্বন করে জীবন যাপন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সুবিধাবাদের কোন সুযোগ নেই।

২৩) হে মানুষ ---

প্রত্যেককে শেষ বিচারের দিনে নিজেদের কাজের হিসাব দিতে হবে, অতএব তোমরা তোমাদের কর্মের ব্যাপারে সাবধান হও।

২৪) হে মানুষ ---

শুনে রাখ, অপরাধের দায়িত্ব কেবল অপরাধীর ওপরেই বার্তায়, অর্থাৎ পিতা তার পুত্রের জন্য আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী হবে না। যার যার কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হবে।

২৫) হে মানুষ ---

তোমরা ইসলামি জ্ঞান অর্জন করবে, কেননা, ইসলামি জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য অপরিহার্য, কারণ জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। জ্ঞানবিহীন মানুষ অন্ধ। মূলত, ইসলামি জ্ঞান ছাড়া একজন মানুষ মূর্খ ছাড়া কিছুই নয়।

২৬) মনে রেখ মানুষ ---

আমি তোমাদের সকলের আগেই হাওজে কাওসারে পৌঁছে যাব এবং তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। আর অন্য সকল উম্মতের মধ্যে তোমাদের আধিক্য নিয়ে আমি গর্ব করব। অতএব হে আমার উম্মতেরা, তোমরা বিদায়াত সৃষ্টি করে আমার চেহারায় কালিমা লিপ্ত করো না।

২৭) তোমরা শুনে রাখ ---

আমি সেদিন অনেককে মুক্ত করব, যারা কোরআন সুন্নার ওপর অটল থেকে দুনিয়া হতে বিদায় হবে এবং অনেকে সেদিন আমার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে তারা হলো, যারা ইসলামের মধ্যে বিদায়াত সৃষ্টি করেছে এবং যারা আমার পরে আমার সুন্নত অর্থাৎ দ্বীনকে পরিবর্তন করেছে।

২৮) অতঃপর তিনি বলেন---

আমি কি তোমাদের নিকট আল্লাহর দ্বীন পৌঁছে দিয়েছি? সকলেই বলল ‘নিশ্চয়ই’ অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) শাহাদাত আঙ্গুলি আকাশের দিকে তুলে আবার বলবেন; হে আল্লাহ তা’য়ালা! আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন, আপনি সাক্ষী থাকুন।

২৯) হে উপস্থিতগণ--

তোমরা অনুপস্থিতদের নিকট আমার এই পয়গাম পৌঁছে দেবে। হয়তো বা তাদের মধ্যে কেউ এ নসিহতের ওপর তোমাদের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে আমল করবে। তোমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক।

পৃথিবীর মহামনীষিদের বাণী কখনো সত্য কখনো মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা মুহূর্তের জন্য মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না। একটি সুন্দর বাণীর কারণে মানুষ হয় বিশ্ববিখ্যাত আবার একটি অসুন্দর বাণীর কারণেই মানুষ হয় বিশ্বকুখ্যাত। তাইতো আমাদের জাতীয় কবি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ বলেছিলেন, আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান?

আয় আল্লাহ! আমাদেরকে প্রিয় নবীজির আদর্শের সেই মুসলমান হওয়ার সঠিক জ্ঞান দান করুন। ‘আমীন’

লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।


বাংলাদেশ হাইকমিশন যুক্তরাজ্যের কাছে প্রত্যাশা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. আজিজুল আম্বিয়া

বাংলাদেশ হাইকমিশন, লন্ডন যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের প্রধান কূটনৈতিক মিশন। হাইকমিশন লন্ডনের সাউথ কেনসিংটনের কুইন্স গেট রাস্তায় অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকার ম্যানচেস্টার এবং বারমিংহামে অবস্থিত দুটি সহকারী হাইকমিশন ও পরিচালনা করে। অধিকন্তু এটির আয়ারল্যান্ডের সমবর্তী স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে অনুমান করা হয় যে প্রায় ৫৫০০০০ বাংলাদেশি এখানে বসবাস করছেন। যাদের মধ্যে ৯৫% অভিবাসী সিলেটি। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক বাস করছেন পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হেমলেটে যা ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ৩৩ ভাগ। এ কারণে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনের চেষ্টা কওরা উচিত বলে গুণীজন মনে করেন। তাই হাইকমিশন ও এই এলাকায় বিশেষ তৎপরতা চালিয়ে যান। বাংলাদেশি সিলেটিরা এখানে সুপ্রতিষ্ঠ। বর্তমান হাইকমিশনার যিনি অনেকটা সফল হিসেবে অনেকে মনে করেন। তিনি হলেন সাইদা মুনা তাসনিম । তিনি অনেক ভালো কাজ করার চেষ্টা করছেন বলে এখানকার মানুষের ধারণা রয়েছে। তার অনেক সুনাম ও রয়েছে দেশে ও বিদেশে। এ কূটনীতিবিদরা বাংলাদেশের বৃহৎ দাবিগুলো নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রস্তাব আনেন এবং দাবি জানান। তারা দেশের জন্য কাজ করেন নিরলসভাবে। উনারা এখান থেকে দেশের জন্য কূটনৈতিক কাজ চালিয়ে যান ইউকেসহ সারাবিশ্বের সঙ্গে। বাংলাদেশের সর্বপ্রথম বাজেটের টাকার সিংহভাগ গিয়েছিল এই দেশের ব্রিটিশ বাঙালিদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দেশের মানুষের বিরাট ভূমিকার কারণে সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুকে জীবিত অবস্থায় পাকিস্তানিরা এই দেশে পাঠাতে বাধ্য হয়। আর এখান থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের উদ্দেশ্যে ফিরে যান তার দেশে। তাই এই দেশ বাঙালির অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে । এ কারণে সব সময় বাংলাদেশের কাছ থেকে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্যতা রাখে যুক্তরাজ্য কিন্তু অভিযোগ আছে এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী মানুষ পাচ্ছে না কাঙ্ক্ষিত সার্ভিস। ২০১৮ নভেম্বর মাস থেকে এখন পর্যন্ত সাইদা মুনা তাসনিম এই দায়িত্বে আছেন। তিনি সম্প্রীতি তার কাজের জন্য ডিপ্লোম্যাট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। তিনি কাজ করে বাংলাদেশের সুনাম বয়ে আনছেন অথচ এখানকার অনেক বাঙালি এই হাইকমিশন অফিসের কর্মচারীদের কাজে খুশি হতে পারছেন না এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। অবশ্য বর্তমান হাইকমিশনার আসার পর সেবার মান উন্নত করার চেষ্টা করছেন এবং করেও যাচ্ছেন কিন্তু এই অর্জন ম্লান করে দিচ্ছেন উনার অফিসের এই কিছু কুচক্রী লোক। মানুষকে সঠিক সেবা দেওয়ার স্বার্থে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার এখন সময় এসেছে বলে সুশীলরা মনে করছেন। এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করা হয় মর্যাদার সঙ্গে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করা হয় দিনরাত। বর্তমান হাইকমিশনার আসার পর সর্বপ্রথম বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ দেখা করলেন । বাংলাদেশের জাতীয় দিবসে এখন এই দেশের অনেক জায়গাতে বাংলাদেশের পতাকা পতপত করে উড়তে দেখা যায়। বাংলাদেশ হাইকমিশন বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য বিভিন্ন সভা ও সেমিনার এর আয়োজন করে থাকে যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ অবদান রাখছে । বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে যে যে কাজ করা হয় তা হলো- ই-পাসপোর্ট ও মেশিন রিডাবল পাসপোর্ট (এমআরপি), এনআইডি, ভিসা, প্রত্যয়ন দলিল, জন্ম নিবন্ধন, মৃত্যু নিবন্ধন, পাওয়ার অব এটর্নি, দ্বৈত নাগরিক সনদপত্র, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট, পুলিশ কিলিয়ারেন্স ফর ফরেন ন্যাশনাল, ভ্রমণের অনুমতি, নো ভিসা রিকয়ারড (এনভিআর), বিভিন্ন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এসব কাজ করতে আসা মানুষের নানা অভিযোগ রয়েছে। হাইকমিশনের ওয়েবসাইট এ যে হেল্প নাম্বার দেওয়া রয়েছে তাতে কল করলে সব সময় উত্তর আসেনা অন্যান্য হাইকমিশনের মতো। ওয়েবসাইট ও উন্নতমানের নয় এই অভিযোগ অনেকেই করেন । এখানে সহজে প্রবেশ করা যায়না সব সময়। এ ছাড়া এখানে কিছু বুঝতে অক্ষম হলে সাহায্য করার মতো কাউকে পাওয়া যায় না। অফিসে গেলে তারা বলেন, এটা করেন, ওটা করেন কিন্তু দেখানের কেউ নেই তাই মানুষ বাধ্য হয় দালালের কাছে যেতে। আর দালালরা প্রতিটি কাজে ৩০ পাউন্ড থেকে ৬০ পাউন্ড পর্যন্ত চার্য করে থাকেন । উপায় নেই তাই মানুষকে এই টাকা দিতে হয়। হেল্পলাইনে কোনো বিষয়ে জানতে চাইলে তা অজানাই থেকে যায় অনেকের। তখন অসম্পূর্ণ কাজ নিয়ে অফিসে যেতে হয়। সেখানে গিয়েও অনেক বিড়ম্বনা পোহাতে হয় এই সাধারণ মানুষের। অথচ এই দেশে অন্যান্য হাইকমিশনে কল করার সঙ্গে সঙ্গে অপশন আসে এখানে কোনো অপশন চান সেটি পছন্দ করার জন্য বলা হয় এবং যে বিষয়ে দরকার সেই বিষয়ে পরামর্শদাতা নিজে কথা বলেন ফোনে এবং যেকোনো সমস্যার ও সমাধান করে দেন নিজে । এখানে কিন্তু এটি স্বপ্ন। অথচ একই দেশে দুই সিস্টেম চালু রয়েছে। তাই দিন দিন মানুষ এই প্রতিষ্ঠানকে অথর্ব বলে ভাবতে শুরু করেছে। ইমেইল করলেও সঙ্গে সঙ্গে অনেকে রেস্পন্স পান না বলে অভিযোগ আছে। সিরিয়াল এ অনিয়ম নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেছে অনেকে মনে করেন বলে গুজব আছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সম্মানিত নাগরিকবৃন্দকে সিরিয়ালে নাম ডাকার সময় সম্মানের জায়গাতে অসম্মানিত করা হচ্ছে অবস্হা দৃস্টে অনেকে ভাবেন এই কথা। কেউ কেউ জানান মনে হয় পাকিস্তানের কোনো অফিসে বাঙালিকে কটাক্ষ করে কেউ নাম ডাকছেন, সিরিয়াল অনেক সময় বেশ দীর্ঘ হয় কিন্তু ট্র্যাভেল এজেন্সির লোক বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে দেখা যায় হরহামেশা। এই হলো সাধারণ মানুষের অভিযোগ। অফিসের ভিতরের লিফট নষ্ট কিন্তু এটি কেন ঠিক হচ্ছে না কেন তা জানা নেই মানুষের। তাই অক্ষম ব্যক্তিরা ই ভিসার আবেদন করলে সম্ভব হচ্ছেনা এই কাজ সম্পন্ন করা । কারণ মেশিন রাখা হয়েছে গ্রাউন্ড ফ্লোরে তাই এ কাজ কি করে করা সম্ভব? সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় তাদের তখন দীর্ঘসময় বসে থাকতে হয় তা দুই তিন ঘণ্টা পর্যন্ত ও ছাড়িয়ে যায় অনেক সময় এটি হলো ভুক্তভুগোদের কথা। এ ছাড়া শুনতে হয় অনেক তিরস্কার, অফিসাররা খুব ব্যস্ত থাকার বান করেন, যেখানে ইউকে সরকার সিলেটি ভাষাকে সম্মান করে বিভিন্ন জায়গাতে সিলেটি অনুবাদক রেখেছেন সেখানে অনেক স্টাফ আছেন এখানে তারা এই ভাষাভাষী মানুষদের অবজ্ঞা করছেন বলে শক্ত অভিযোগ আছে এই দেশের মানুষের কাছ থেকে। কেউ কেউ নীরবে হজম করছেন এই অবজ্ঞাকে। এরকম ও অভিজ্ঞতা আছে অনেকে বলেন , অনেক সময় লাইনে থেকে অনেককে বলতে শুনা যায় আমারা তাদের দেশের লোক না । মানে সিলেটি না হলে হয়তো ভালো ব্যবহার পাওয়া যেত। সিলেটিরা এই বিসয়ে খুব ক্ষুদ্ধ বলা যায়। সিলেট অঞ্চলের মানুষ বেশি এই দেশে তবুও কেন যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হাইকমিশন অফিসে প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ১ দুই জনের বেশি সিলেটি লোকজন কে চাকরি দিতে চায়না বাংলাদেশ সরকার এই প্রশ্ন এখন সব সিলেটি মানুষের মনে। তাই তারা এখন নারাজ বলা যায় সরকারের ওপর।

সেবা নিতে আসা অনেকে জানান, কর্মচারীদের কাউকে যদি বলা হয় আমাদের ট্যাক্সের টাকায় সরকার আপনাদের বেতন দেয় তবে কেন আপনারা এই কাজে আমাদের ঠিকমতো সহযোগিতা করেন না? তখন তিনি জানান, আপনাদের টাকায় আমাদের বেতন হয় না; কিন্তু প্রশ্ন হলো এ রকম উত্তর কি শুভা পায় একজন সরকারি কর্মচারীর মুখে। এ দেশে বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনেক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ লাভ করেন নিয়মিত কিছু মানুষ। এরা এই কমিশনের পছন্দের লোক বলা যায়। কিন্তু বিশাল এই দেশে যে অন্য গুণীজনরা রয়েছেন বা তৈরি হচ্ছেন সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মনে হয় এই কমিশনের । তাই এই তালিকার বাহিরের কিছু সুশীলরা দাওয়াতের বাহিরে থাকেন সব সময় । লন্ডনে সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে হাই কমিশনের তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায়না । এদেশে বছরে একবার বইমেলা হলেও হাইকমিশন অফিস থেকে কোনো অর্থনীতিক সহযোগিতা করতে পারছেন বলে কোনো খবর মিলছে না; কিন্তু এই দেশে যারা বসবাস করেও বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কাজ করছেন তারা খুব একটা সচ্ছল নয়, আমরা তা জানি। তাই এই বিষয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত বলে সুশীলরা মনে করেন। এদিকে পাসপোর্ট করতে আসা অনেক ব্রিটিশ নাগরিকরা জানান, অফিসের অসহযোগিতা আর অনিয়মের কারণে মনে হয় বাংলাদেশি পাসপোর্ট না করলেই ভালো হতো। কেন এই বিতৃষ্ণা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে এখানে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত তৈরি করা উচিত। যেখানে মানুষ রিপোর্ট করতে পারবে সহজে এবং সঙ্গে সঙ্গে বিচার লাভ করতে পারবে। এখানে অনেক সময় বিচার দেওয়ার জন্য ও সঠিক জায়গা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বিচারপ্রার্থী হলে কর্মকর্তারা দায় এড়ানোর জন্য বলেন লিখিত অভিযোগ করেন। এই সময় এ দেশের মানুষের সবার নেই এটা তারা জেনেই এই সুবিধা নেন বলে অনেকে ধারণা করেন । যদি বাংলাদেশ সরকার ছদ্ম বেশে একদল তদন্তকারী সেখানে প্রেরণ করে, তবে এই অনিয়ম চোখে পড়বে বলে বিজ্ঞজনরা মনে করেন এবং সব অফিসে সিসি ক্যামেরার আওতায় নিয়ে যদি আসা হয় আর তা যদি প্রতিনিয়ত চেক করা হয় তবেই এই অনিয়ম চোখের সামনে আসবে আর এই অসাধু লোকদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক


নাম না জানা দেশই হোক তারুণ্যের কর্মসংস্থান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রফেসর ড. মো. নাছিম আখতার

শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ গড়তে চাই জনগণের কর্মসংস্থান। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের চাকরি। সৎ উপায়ে বেঁচে থাকার অবলম্বন। আমাদের দেশ অত্যন্ত জনবহুল দেশ। এ দেশের কর্মসংস্থানের সুযোগ স্বভাবতই দেশের জনসংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল। তাই শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে রয়েছে হতাশা ও উৎকণ্ঠা। একটি জাতীয় পত্রিকার পরিসংখ্যানে দেখেছি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের প্রায়ই ৬৪ শতাংশ বেকার থাকছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও চাকরিবিহীন গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা উল্লেখ করার মতো। শিক্ষিত হওয়ার ফলে তরুণ প্রজন্মের দ্বারা খেত-খামারে কাজ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে, আবার চাকরিও দুর্লভ। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পিয়ন পোস্টে ৪টি পোস্টের জন্য ১৬ শ আবেদন করেছেন। তাদের মধ্যে আবার অসংখ্য আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স-মাস্টার্স। একটি সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে দেখেছিলাম ২১টি পৃথক পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছে ১ লাখ ২১ হাজার। বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি সরকারি চাকরির জন্য মানুষ ব্যাগভর্তি টাকা নিয়ে তদবির করছে, যা দেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের শামিল। এমন কঠিন প্রতিযোগিতাময় পরিবেশে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে থাকছে চরম হতাশা। এখান থেকেই মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার মতো মানসিক সমস্যা বেড়েই চলেছে। আবার এসব তরুণকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমাজের স্বার্থান্বেষী ও দুর্জন ব্যক্তিরা অপকর্মে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি জাতীয় পত্রিকার একটি খবরে দেখলাম শিক্ষিত এক তরুণকে ব্যবহার করা হয়েছে একজন রাজনীতিবিদকে খুন করার জন্য। বিনিময়ে তার আগের সব মামলা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ যত বাড়ানো যাবে এ ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা ততই কমবে। তরুণ প্রজন্মের জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা খুব একটা কঠিন নয়, দরকার কর্তৃপক্ষের প্রজ্ঞা ও শিক্ষিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষই দেশটির নাম জানেন। দেশটি ওসেনিয়ার অন্তর্গত একটি দেশ। নাম তার ‘পালাও’। ৪৬৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দেশটিতে ২২ হাজার লোকের বসবাস। যার মধ্যে ২ হাজার লোকই বাংলাদেশি। ২ হাজার লোকের কর্মসংস্থান সুপারি বাগানের সুপারি তোলা ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া বাঙালিরা সেখানে সমুদ্রে সার্ফিং এর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। দেশটির মাথাপিছু আয় ১৭ হাজার ৪৩৮ মার্কিন ডলার। এমন নাম না জানা দেশে মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগই বাঙালি। পৃথিবীতে এমন নাম না জানা বা কম পরিচিত অনেক দেশ আছে যেখানে আইন-শৃঙ্খলা, পরিস্থিতি, বসবাসের পরিবেশ আকর্ষণীয়। এসব দেশে বেঁচে থাকার মতো কর্মসংস্থান তৈরি করার উদ্যোগ, চেষ্টা ও প্রজ্ঞার সমন্বয় ঘটানো যেতে পারে। তাহলেই দূর হবে বেকার সমস্যা।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সবাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিন দেশে নিজেদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তৈরি করেছিল। উপনিবেশগুলো থেকে আহোরিত অর্থ জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ও শিল্পোৎপাদন ব্যবহার করে তারা উন্নত ও ধন সম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমে এসে একটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো ইউরোপ এবং আমেরিকার উন্নত দেশগুলি প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনে আফ্রিকার দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের চাহিদার বিরাট অংশ আসে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে। আফ্রিকানদেরকে মদ ও মাদকে আসক্ত রেখে গোত্রে গোত্রে যুদ্ধ, বিগ্রহে ব্যস্ত রেখে ইউরোপিয়ানরা নির্বিঘ্নে প্রাকৃতিক সম্পদ লুটে নিচ্ছে।

করোনা মহামারি একটি বিষয় আমাদের শিখিয়েছে তা হলো শুধু টাকা থাকলেই চলবে না। জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের মৌলিক প্রাকৃতিক রসদ দেশের মধ্যেই থাকতে হবে। করোনার সময় সিঙ্গাপুরে খাদ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। কারণ শিল্প ও ব্যবসায় উন্নত হলেও সিঙ্গাপুর তার মোট চাহিদার ১০ ভাগ খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করে। বাকি অংশের জন্য তারা বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। করোনায় সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হওয়ায় সেখানে খাদ্যাভাব হয়েছিল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সারা পৃথিবীতে তেল, গ্যাস খাদ্য দ্রব্যের মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এই যুদ্ধে ইউরোপের প্রাকৃতিক সম্পদের দেউলিয়াত্ব বিশ্ববাসীর কাছে ফুটে উঠেছে। তাই ইউরোপকে শুধু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে ধরলে আমাদের জন্য বোকামি হবে।

আফ্রিকার মহাদেশের কথা শুনলেই অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি মহাদেশের কথা মনে পড়ে। আফ্রিাকার দেশগুলোকে পৃথক পৃথকভাবে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখি তাহলে আমাদের আজন্মকাল লালিত ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটবে- আফ্রিকার শহরগুলোর অবকাঠামোগত সৌন্দর্য আমাদের আধুনিক ইউরোপের কথা মনে করিয়ে দেবে। ২০২১ সালের গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) সূচক অনুয়ায়ী আফ্রিকার ১০টি দেশ যথাক্রমে মরিশাস, বতসোয়ানা, ঘানা, জাম্বিয়া, সিয়েরা লিওন, সেনেগাল, তানজানিয়া, নামিবিয়া, লাইবেরিয়া ও মালাউই এর শান্তির সূচক যথাক্রমে ২৮,৪১,৩৮,৭১,৪৬,৫৪,৫৮,৬৫,৭৬ ও ৫৯। উল্লেখ্য, ২০২১ সালে একই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম। আফ্রিকার ধনী দেশের মধ্যে রয়েছে সিশেলস, মরিশাস, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, গ্যাবন, বতসোয়ানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মিশর। এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া অন্য নয়টি দেশেই জীবন ও জীবিকা অত্যন্ত নিরাপদ। গ্লোবাল ইকোনমি ফোরামের তথ্য মতে ২০৫০ সালের মধ্যে আফ্রিকার মোট জিডিপি হবে ২৯ ট্রিলিয়ন ডলার। সুতরাং সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই।

২০২১ সালে গ্লোবাল পিস ইনডেক্স (জিপিআই) র‌্যাংকিংয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলির মধ্যে প্রথম থেকে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে উরুগুয়ে, চিলি, আর্জেটিনা, প্যারাগুয়ে ও পেরু। এখানে উল্লেখ্য উরুগুয়ের জিপিআই সূচক যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে বড় দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ গায়ানা। যা বিট্রিশ কলোনি ছিল এবং এখানকার মাতৃভাষা ইংরেজি। এর জনসংখ্যা প্রায় ৭ লাখ এবং সাম্প্রতিক কালে তেল উত্তোলিত হচ্ছে। তেলনির্ভর এই দেশটি বাংলাদেশিদের কর্মক্ষেত্র হতে পারে। এর পাশেই রয়েছে সুরিনাম নামে আরও একটি বাংলাদেশের সম আয়তনের দেশ যা হল্যান্ড শাসিত ছিল। লোকসংখ্যা ৫ লক্ষ ৭৫ হাজার। এ দেশটিও শিক্ষিত বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের নতুন গন্তব্য হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘অর্থনৈতিক কূটনীতিতে গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি বলেন ‘আজকের বিশ্বে কূটনৈতিক মিশনগুলোর দায়িত্ব পরিবতর্তিত হয়েছে। এখন রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতি অবলম্বন করতে হবে, যাতে আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদার করতে পারি ও বিশ্বের সবার সঙ্গে একত্র হয়ে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারি।’ আমিও মনে করি, সচেতন মানুষ যাদের কর্মকাণ্ড দেশের সার্বিক পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারে তাদের স্লোগান হওয়া উচিত- ‘দূরদর্শী পরিকল্পনা করি, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ি।’

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আবুল কাসেম ভূঁইয়া

প্রকৃতি বাংলাদেশকে অপরূপ সৌন্দর্য দান করেছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক বেশি। তাই তো অতীতকাল থেকেই বিদেশি পর্যটকদের আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আকৃষ্ট করে আসছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। দেশের পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় এবং মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৭৫ সালের দিকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত পর্যটন করপোরেশন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অত্যন্ত সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে পর্যটন করপোরেশন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে অসংখ্য মোটেল, হোটেল, রেস্ট হাউস গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশে পর্যটন মৌসুম শুরু হয় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত। এ সময় দেশের পর্যটন স্পটগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। বাংলাদেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত। এখানে সারা বছর ধরে পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকে। বিশেষ করে শীত মৌসুম পর্যটকদের ভিড় বেড়ে যায়। পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কক্সবাজারকে আকর্ষণীয় সাজে সজ্জিত করা হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে মানোন্নত রেল যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে মানোন্নত রেলযোগাযোগ চালু করা হচ্ছে। এই রেল যোগাযোগ চালু হলে পর্যটননগরী কক্সবাজারের আকর্ষণ অনেকটা বেড়ে যাবে। সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার রেল সার্ভিস চালু হলে পর্যটকরা সস্তিতে যাতায়াত করতে পারবে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রুটে সরাসরি বিমান সার্ভিস চালু আছে। সড়ক পথে আন্তর্জাতিক মানসম্মত বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। পর্যটনশিল্পনির্ভর খাবার হোটেলসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখানে রয়েছে। কক্সবাজার পর্যটনশিল্পের সঙ্গে হাজার হাজার লোক সম্পৃক্ত রয়েছে। কক্সবাজার ছাড়া এখানে রয়েছে হিমছড়ি, ইনানী এবং টেকনাফ সমুদ্রসৈকত। কক্সবাজারের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। কাপ্তাই রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িতে রয়েছে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। কাপ্তাইয়ে রয়েছে আকর্ষণীয় লেক, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র, রাঙামাটিতে রয়েছে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থান, বান্দরবানে রয়েছে মেঘলা, নীলাচল, নীলগিরি পর্যটন স্পট। বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ঘেরা মনোরম দৃশ্য পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে থাকে। বান্দরবানে রয়েছে অসংখ্য উন্নতমানের হোটেল এবং রিসোর্ট। খাগড়াছড়িতে রয়েছে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র সাজেক। যাকে বাংলাদেশের সুইজারল্যান্ড বলা হয়। সাজেকে রয়েছে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা। তবে যাতায়াতব্যবস্থা এত উন্নত নয়। চট্টগ্রামেও রয়েছে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, ফয়েজলেক, বাটালী হিল, ওয়ার সেমিট্রি, চেরাগীর, পাহাড়, ভাটিয়ারী গলফ, কর্ণফুলী নদীর তীর পার্কি বিচ, সিআরবি, স্বাধীনতা পার্কসহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান। এসব স্থানে সবসময় পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। মিরসরাইয়ে রয়েছে মহামায়া লেক, সীতাকুণ্ডে রয়েছে সীতাপাহাড়। কুমিল্লায় রয়েছে ময়নামতি বৌদ্ধবিহার, বার্ড, লালমাই পাহাড়, ময়নামতি ওয়ার সেমিট্রি, ধর্মসাগর, রানীদীঘি, নানুয়াদীঘিসহ আরও নতুন নতুন পর্যটন স্পট। প্রাকৃতিকভাবে অপরূপ সাজে সজ্জিত সিলেটে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন স্পট। এগুলোর মধ্যে রয়েছে জাফলং, রাতারকুল, বিছানাকান্দি, লালাখাল, চাবাগানসহ আরও অনেক পর্যটন স্পট। এসব পর্যটন স্পটে সবসময় পর্যটকরা আসেন। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। এ ছাড়া পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, মহাস্থানগড়, কুয়াকাটাসহ আরও অনেক পর্যটন স্পট বাংলাদেশে রয়েছে। দেশের এসব পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করলেও এসব স্থানে বিরাজ করছে বিভিন্ন সমস্যা। যা নাকি পর্যটকদের দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে দেয়। বিশেষ করে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে পর্যটকরা চরম দুর্ভোগ পোহান। প্রায়ই পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের জন্য টয়েলেটে, রেস্ট হাউস, উন্নতমানের খাবার হোটেল, নামাজের স্থান নিরাপত্তাব্যবস্থাসহ আরও অনেক সমস্যা। দেশের পর্যটনশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এই শিল্পকে যদি এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে এই শিল্প থেকে সরকার প্রচুর রাজস্ব আয় করতে পারবে। পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে সরকারকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের বিভিন্নস্থানে অবস্থিত পর্যটন স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় এবং উন্নতমানের করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে বিরাজমান সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের আকর্ষণীয় পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে ডকুমেন্টারি ফ্লিম বা অ্যাড নির্মাণ করে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, টিভি ইত্যাদি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার এবং পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রিন্টিং মিডিয়ায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোর প্রচারের জন্য তরুণদের নিয়োগ দিতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে তুলে ধরার লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচারণা চালাতে হবে। পর্যটকদের এদেশে আসার জন্য ভিসার সহজ ব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি পর্যটকরা যাতে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন সে জন্য তাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা করতে হবে। বিদেশি পর্যটকদের জন্য ট্রেন, বাস, বিমানে বিশেষ সুযোগ রাখতে হবে। পর্যটন স্পটগুলোতে বিদেশি পর্যটকদের জন্য উন্নত খাবার এবং বিনোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটনশিল্পকে কেন্দ্র করে অর্থ আয়ের ব্যবস্থা করছে। আমাদের পার্শবর্তী রাষ্ট্র ভারতের পর্যটনশিল্প অনেক সমৃদ্ধশালী। প্রতি বছর ভারতে লাখ লাখ বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে। এই বিদেশি পর্যটকদের দ্বারা ভারত সরকারের বিশাল আয়ের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। ভারত সরকার তাদের পর্যটনশিল্পকে দিন দিন আকর্ষণীয় করে তুলছে। ভারত ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, নেপাল, দুবাই এখন পর্যটনশিল্পনির্ভর হয়ে পড়েছে। এসব দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা আসেন। আমাদের দেশের পর্যটনশিল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। দেশের পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্ততাদের এগিয়ে আসতে হবে। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা থাকলে দেশের পর্যটনশিল্প অনেক এগিয়ে যাবে। পর্যটনশিল্পের প্রকৃত উন্নয়ন আশা করছি।

লেখক: অর্থনীতিবিষয়ক প্রাবন্ধিক


banner close