শুক্রবার, ৭ জুন ২০২৪

মুক্তিযুদ্ধের প্রান্তিক ইতিহাস: প্রেক্ষাপট পাগলা থানা

সোহেল মাজহার 
প্রকাশিত
সোহেল মাজহার 
প্রকাশিত : ২৮ মার্চ, ২০২৪ ১২:৩১

’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সব থেকে গৌরবময় অধ্যায়। ৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। যদিও মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্ন এখনো অধরা রয়ে গেছে। জাতি হিসাবে বাংলাদেশকে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের পথে হাঁটছে।

এই সময়ের ভিতর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের অজানা ঘটনা ও অনালোকিত অধ্যায় পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে। তারপরেও অনেক ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধের বহু গৌরবদীপ্ত স্মৃতি ও বীরগাঁথা আজও স্বীকৃতি পায়নি। অনেক অর্জন ও স্বীকৃতি বেহাত অথবা বেহাত হয়ে যাওয়ার পথে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ময়মনসিংহের পাগলা থানার গৌরব। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাগলা থানা স্বতন্ত্র কোনো পরিচয় ছিল না। পাগলা ছিল গফরগাঁও থানা অন্তর্গত দত্তের বাজার ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজার। তদুপরি অঞ্চলটি গফরগাঁও উপজেলার দক্ষিণের ৮টি ইউনিয়নের প্রায় মধ্যবিন্দু হওয়ার সব সময় এর একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। ২০১২ সালে পাগলা একটি নতুন থানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

শুধু ময়মনসিংহের মধ্যে নয়- বাংলাদেশের ভিতর পাগলা অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গৌরবজনক ঘটনা ঘটে; কিন্তু প্রশাসনিক পরিচয়ের কারণে পাগলা অঞ্চলে সংগঠিত সকল যুদ্ধ ও যুদ্ধ সম্পর্কিত সকল ঘটনা- গৌরবময় বীরগাঁথা গফরগাঁও-এর নামে প্রচারিত হয়েছে। এই অঞ্চলের সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধ পাগলা থানার ৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলে সংগঠিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার ঐতিহাসিক ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মূলত এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এই ঘোষণার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। একইভাবে তৎকালীন ঢাকা জেলা বর্তমান গাজীপুর জেলার কাওরাইদ কে এন উচ্চ বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং শুরু হয়। অঞ্চলটি গাজীপুর জেলার আওতাভুক্ত হলেও ময়মনসিংহ পাগলা থানার সীমান্তবর্তী অঞ্চল। এই ট্রেনিং সেন্টারের মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনজন নেতা। তন্মধ্যে সাইদুর রহমান সিরাজ তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগের ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাদের দুজনের বাড়ি বর্তমান পাগলা থানার পাইথল ও নিগুয়ারী ইউনিয়নে। অপরজন কাওরাইদ ইউনিয়নের মনির উদ্দিন ফকির ছিলেন শ্রীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। একইভাবে মশাখালী রেলস্টেশন সংলগ্ন চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা মাঠে আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল ও শাহাদাত হোসেন মাস্টার।

২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালায়। বঙ্গবন্ধু মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ২৫ মার্চের রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন- গয়েশপুর মাদ্রাসা মাঠে, মশাখালী চাইড়বাড়িয়া মাদ্রাসা, মাইজবাড়ি স্কুল মাঠ, দক্ষিণ হাড়িনা পার্বতীর মাঠ, দাওয়াদাইর প্রাইমারি স্কুল মাঠ, ছাপিলা মান্দারগড় প্রাইমারি স্কুল মাঠ, কুরচাই, তললী প্রাইমারি স্কুল মাঠ, অললী প্রাইমারি স্কুল মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক ট্রেনিং সেন্টার স্থাপিত হয়। এসব ট্রেনিং সেন্টারের নেতৃত্ব ও সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন গফরগাঁও থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি সাইদুর রহমান সিরাজ, গফরগাঁও থানা ও ময়মনসিংহ সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ, আরফান আলী চেয়ারম্যান, সাইদুর রহমান কামাল, শাহাদাত হোসেন মাস্টার, ইকবাল ই আলম কামাল এ কে এম নিজাম উদ্দিন মাস্টার প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মে-জুন মাসের দিকে সাইদুর রহমান সিরাজ, মফিজুল হক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ প্রমুখ কসবা সি অ্যান্ড বি ব্রিজ পার হয়ে আগরতলা হাঁপানিয়া যুব শিবিরে যান। সেখানে সাইদুর রহমান সিরাজ যমুনা যুব শিবিরে উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আবার সোনার বাংলা যুব শিবিরের চিফ ও ডেপুটি চিফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে- অধ্যাপক শামসুল হুদা এম এন এ ও অধ্যাপক শেখ রেয়াজ উদ্দিন আহমদ। মফিজুল হক ও গিয়াস উদ্দিন মাস্টার পলিটিকাল মটিভেটর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেনিং কার্যক্রম শেষ হলে ৩নং সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান মফিজুল হককে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন। তার ওপর ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি ও এম এ কাদির কোম্পানির দায়িত্ব ন্যস্ত করে গফরগাঁও ও ভালুকা অঞ্চলে পাঠিয়ে দেন। শুধু মফিজুল হক নয় তার সহোদর দুই ভাই বজলুল হক ও জহিরুল হক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে জহিরুল হক নভেম্বর মাসের ২০ তারিখ ভালুকা অঞ্চলের ৯নং বাঁধ এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে শহীদ হন। গফরগাঁও অঞ্চলের তিনজন কোম্পানি কমান্ডারের মতো চতুর্থ কোম্পানি কমান্ডার ইকবাল ই আলম কামালের বাড়িও পাগলা থানায়।

গফরগাঁও উপজেলার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সিংহভাগ মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান পাগলা থানার ৮ ইউনিয়নের বাসিন্দা। গফরগাঁও-এর অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে বর্তমান পাগলা থানার বিভিন্ন অঞ্চলে।

পাগলা থানা এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ১ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রাজাকার ক্যাম্প দখল করে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, বিস্ফোরক ও রসদ দখল করে। যুদ্ধে মাইজউদ্দীন ফকির নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেপ্টেম্বর মাসের ১১-১২ তারিখ ইকবাল ই আলম কামালের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাগেরগাঁও- বাকশীতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এই যুদ্ধে কয়েকজন পাকিস্তান বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিহত হন। এই যুদ্ধে আবদুল মজিদ, আবদুর রশিদ, আবদুস সাহিদ, মহর চাঁদ, মনিন্দ্র মোদক, আবদুল হাই, আফাজ, মফিজসহ ১১ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হন। ১৭ সেপ্টেম্বর ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি দক্ষিণ পাড়ায় একটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে মোবারক ও আলাউদ্দীন নামে দুজন শহীদ হন। ২৪-২৫ সেপ্টেম্বর সীমাখালীর দ্বিতীয় যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মাহতাব ও মান্নান শহীদ হোন। উস্থি- নয়াবাড়ির যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তান বাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত হন। পরবর্তীতে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানি পাকিস্তান বাহিনীর বারইগাঁও ক্যাম্পে আকাশ করে সাফল্য পায়। ৯ ডিসেম্বর মুক্ত গফরগাঁওয়ে ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উত্তোলন করেন।

অন্যদিকে গফরগাঁও থানা মুক্তিবাহিনীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মফিজুল হক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ফজলুল হক কোম্পানি ও হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ভারত থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করে মফিজুল হক, ফজলুল হক ও মো. সেলিমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি নিয়ে গফরগাঁও-পাগলা ও ভালুকায় পদার্পণ করেন। তন্মধ্যে দুটি সেকশন ভালুকার মেজর আফসার উদ্দিনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মফিজুল হক চেয়ারম্যান, ফজলুল হক ও এম এ সেলিম মূল বাহিনী নিয়ে প্রসাদপুর ওমর মেম্বারের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করেন। এই ঘাঁটি থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ফরচুঙ্গি - শিলার রেলব্রিজে ও মশাখালী স্টেশনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। মশাখালী রেলস্টেশনের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাছে ৬৫ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করেন। কিছুদিন পর অতর্কিতে পাকিস্তান বাহিনী ওমর মেম্বারের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তুললেও আক্রমণের তীব্রতায় একপর্যায়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে হেলাল নামে একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

ইব্রাহিম খান একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নিগুয়ারী গৈয়ারপাড়ের রয়ান বিল পর্যন্ত অগ্রসর হলে শিলানদীর তীরে গৈয়ারপাড়ে অবস্থান নিয়ে স্টেনগান দিয়ে গুলি করে পাকিস্তান বাহিনী অগ্রগতিকে রোধ করেন। ১৯ নভেম্বর পাকিস্তান বাহিনী কাওরাইদ থেকে রওনা হয়ে নান্দিয়াসাঙ্গন- নিগুয়ারী খান বাড়ি হয়ে ত্রিমোহনীতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী তললী চৌকিদার বাড়ির ঘাট হয়ে সুতারচাপরে আশ্রয় নেয়। সেখানেও পাকিস্তান বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এই যুদ্ধে আ. রাজ্জাক, সালাহউদ্দিন, সুলতান ও মান্নানসহ অন্তত ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ মানুষ শহীদ এবং নিহত হন। একই দিন পাকিস্তান বাহিনী নিগুয়ারীতে অপারেশন শেষ করে কাওরাইদ ফিরে যাওয়ার পথে হাবিবুল হক মন্টু কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধারা কেল্লারপাড়ে পাকিস্তান বাহিনীর অবস্থানের ওপর একটি সফল আক্রমণ পরিচালনা করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত ও আহত হয়।

নভেম্বর মাসে মোশাররফ হোসেন রতনের নেতৃত্বে শিলার বাজার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। একপর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় মুক্তিবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। মোশারফ হোসেন রতন একটি পুরাতন কবরে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচায়। যুদ্ধে আবদুল আওয়াল ঝানু, সিদ্দিকুর রহমান চানুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ২০ নভেম্বর ফটুয়ার টেকে পাকিস্তান বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে ফজলুল হক কোম্পানি, হাবিবুল হক মন্টু ও ইকবাল ই আলম কামাল কোম্পানির যৌথ নেতৃত্বে গয়েশপুর বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিজয় হলেও মহর আলী, আবদুস সাত্তার, আ. কাদের ও নিজাম উদ্দিনসহ মোট ১১ জন শহীদ হন।

স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের চারণভূমি পাগলা থানায় কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতি- উন্নয়ন সাধিত হয়নি। পাগলা থানার সমন্বিত উন্নয়নে নিম্নোক্ত সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব করছি-

(১) সর্বাগ্রে পাগলা থানাকে উপজেলায় উন্নীত করতে হবে। (২) কিশোরগঞ্জ হতে হোসেনপুর, পাকুন্দিয়া, পাগলা ও কাওরাইদ হয়ে টাঙ্গাইল পর্যন্ত নতুন রেললাইন স্থাপন করতে হবে। (৩) পাগলা বাজারে একটি সরকারি মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৪) দত্তের বাজার ও পাকুন্দিয়ার মধ্যে সংযোগ সৃষ্টির জন্য পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপর সড়ক সেতু নির্মাণ করতে হবে। (৫) পাগলা এলাকায় গ্যাস সংযোগসহ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (৬) পাগলা থানায় আইটি পার্ক নির্মাণ করতে হবে। (৭) পাগলা থানার অভ্যন্তরীণ নদী-খাল ও সড়কপথ সংস্কার করতে হবে।

উপরোক্ত দাবিসমূহ বাস্তবায়নের মধ্যে পাগলা থানার অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মুক্তি নিহিত। অন্যথায় এ অঞ্চলের গণমানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল পৌঁছাবে না। সব অর্জন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। এ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে নিহত গণমানুষ, নিপীড়িত মা-বোন প্রত্যেকের অতৃপ্ত আত্মা গুমরে গুমরে কেঁদে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন তাদের কাছে অর্থবহ না হয়ে ব্যর্থ বলে পরিগণিত হবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্বপ্নের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল ও জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা, উন্নয়ন বৈষম্য নিরসন করা ও সবার জন্য সমান সুযোগ অধিকার নিশ্চিত করা। পাগলায় এসব সূচকের কোনোটি পূরণ হয়নি। বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট সব মহলকে ভেবে দেখার অনুরোধ করছি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, পাগলা উপজেলা বাস্তবায়ন কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক


ঐতিহাসিক ছয় দফা-শহীদের রক্তে লেখা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তোফায়েল আহমেদ

প্রতি বছর সাতই জুন, ’ছয় দফা দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় আমরা পালন করি। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ছয় দফা ও সাতই জুন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। জাতীয় জীবনে ছয় দফা ও সাতই জুনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলার গণমানুষ ১৯৬৬-এর সাতই জুন স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী হরতাল পালন করেছিল। এই দিনে মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ অসংখ্য শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় ঐতিহাসিক ছয় দফা। পরবর্তীতে ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সূচনালগ্নে ছয় দফা দাড়ি-কমা-সেমিকোলনসমেত এগারো দফায় ধারিত হয়ে, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা এক দফা তথা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের অভিপ্রায় থেকেই তিনি জাতির উদ্দেশে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদান করেছিলেন। যে জন্য ছয় দফাকে বলা হয় জাতির মুক্তিসনদ। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের গভীরে সততই প্রবহমান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার বাইরে অন্য কোনো চিন্তা তার ছিল না। জেল-জুলম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সর্বধর্মের, সর্ববর্ণের, সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য তিনি আওয়ামী লীগের দরোজা উন্মুক্ত করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যার যার ধর্ম সেই সেই পালন করবে। কারও ধর্ম পালনে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এ দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। এর বিপরীতে বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সংবলিত বাঙালির ‘মুক্তিসনদ’ খ্যাত ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা দাবি’ উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ‘ছয় দফা দাবি’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘ছয় দফা’ দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়। ‘ছয় দফা’ ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গীসহ ’৬৬-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি, চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানের জনসভায় ‘ছয় দফা’কে ‘নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ’ হিসেবে উল্লেখ করে চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘এক দিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলার বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ে সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসী চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর দলের আসন্ন কাউন্সিল সামনে রেখে ‘ছয় দফা’র যৌক্তিকতা তুলে ধরতে তিনি একের পর এক জনসভা করেন। এরই অংশ হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি, নোয়াখালীর মাইজদী, ওই দিনই বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর ও ১৪ মার্চ সিলেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় জনতার দরবারে তার বক্তব্য পেশ করেন।

‘ছয় দফা’ প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট ‘উপ কমিটি’ গঠন এবং তারই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। একই বছরের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এ দিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। দলের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গীত হয়। বাঙালির বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’কে উপলক্ষ করে ’৬৬-এর মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সে দিনের সেই কাউন্সিল সভায় আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করা হয়। ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা পরবর্তীকালে ‘ছয় দফা’র চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল। ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ‘ছয় দফা’ এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাংলার প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। ‘ছয় দফা’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ বস্তুত, ‘ছয় দফা’ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর। কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ দিন অর্থাৎ ২০ মার্চ চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দলীয় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকারের এই বাণী লয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনে-শুনেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।’

আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন, যা ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, ‘ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়- এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।’ স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’ বঙ্গবন্ধু জানতেন, ‘ছয় দফা’ই কেবল বাঙালির স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত কর অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবিরা ‘ছয় দফা’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে- যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সফলভাবে সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু সারা দেশ চষে বেড়ান। ২৬ মার্চ সন্দ্বীপ এবং ২৭ মার্চ সাতকানিয়ার বিশাল জনসভায় ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করেন। এরপর উত্তরাঞ্চল সফরে যান ’৬৬-এর ৭ এপ্রিল। ওই দিন পাবনা ও নগরবাড়ির জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। একই মাসের ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ তারিখ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন। এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। বিপুল সংখ্যক জনতার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত লাগাতার জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ‘ছয় দফা’র সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্মম গ্রেপ্তার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্ট বলে লাগাতার গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ১৭ এপ্রিল রাত ৪টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণদান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারিকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ (৫) ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস হতে তিনি জামিন পান। সে দিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, পুনরায় জামিনের আবেদন এবং ২৩ তারিখ জামিন লাভ। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। ‘ছয় দফা’ প্রচারকালে তিন মাসে বঙ্গবন্ধুকে সর্বমোট ৮ বার গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই আইয়ুবের দমন নীতি অব্যাহত থাকে। একই বছরের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং পাটের মালায় ভূষিত করে। ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ ধারা বলে তাকেসহ তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ‘ছয় দফা’ দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালায়। সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ‘ছয় দফা’র প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। হাজার হাজার শ্রমিক এ দিন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমন নীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃবন্দের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘সাতই জুন’ সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়।

সাতই জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সে দিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, আদমজীতে মুজিবুল্লাহসহ এগারো জন শহীদ হন এবং প্রায় আটশ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। তেজগাঁ শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তারা সেখানে বক্তৃতা করেন। প্রকৃতপক্ষে সাতই জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু। আর আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল এ দিনটিতেই।

বায়ন্নের একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বর, ‘শিক্ষা আন্দোলন’; ‘৬৬-এর ৭ জুন, ‘ছয় দফা আন্দোলন’; ’৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়রি, ‘গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান’; ৯ ফেব্রুয়ারি, ১১-দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ‘শপথ দিবস’ পালন; স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি, লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান; অতঃপর ২২ ফেব্রুয়ারি, সব রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে ‘মুক্ত মানব শেখ মুজিব’কে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান। পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করেছে গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নিয়েছে বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। অতীতে আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতি বছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিধান মোতাবেক ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আ স ম আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে এক বছর পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২১ মার্চের মধ্যে সম্মেলন করে নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের কাছে নেতৃত্বের দায়িত্বভার অর্পণ করে আমাদের কমিটি বিদায় নিই এবং ২২ মার্চ হল ত্যাগ করে গ্রিন রোডে ‘চন্দ্রশীলা’ নামে একটি বাসা ভাড়া করে আমি এবং রাজ্জাক ভাই বসবাস শুরু করি। আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই স্মৃতির পাতায় দেখি, সে দিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায় তথা ‘মুজিব আদর্শ’ প্রতিষ্ঠার ভ্যানগার্ড। মূলত বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বই সে দিন সারা দেশে সাতই জুনের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে স্বাধিকারের পথে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। আর বাংলার মেহনতী মানুষ আত্মত্যাগের অপার মহিমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীসহ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ‘ছয় দফা’ই হচ্ছে বাঙালির জাতীয় মুক্তির একমাত্র পথ।

‘ছয় দফা’কে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ‘ছয় দফা’র প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতিজ্ঞাবোধ তাকে জনমনে জনগণমন অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করে। ’৬৬-এর ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েও ‘ছয় দফা’ আন্দোলনকে যখন রোধ করা যাচ্ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে চিরতরে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা দেন। ‘ছয় দফা’ দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয় দফাকে এগারো দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলে এগারো দফা আন্দোলনের সপক্ষে সারা দেশে যে গণজোয়ার তৈরি হয় তাতে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। শাসকশ্রেণি গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আমাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিত্রিত করে। তাদের এই অপপ্রয়াসের সমুচিত জবাব দিতে ’৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শপথ দিবসের জনসমুদ্রে বলেছিলাম, ‘পূর্ব বাংলার মানুষ কোনোদিন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসীও নয়। কারণ তারা সংখ্যায় শতকরা ৫৬ জন। যদি কারও পূর্ব বাংলার সঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকে তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।’ নেতার এই নির্দেশ আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মেনে চলেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর আগ পর্যন্ত কোনোরকম উগ্রতাকে অতি বিপ্লবীপনাকে আমরা প্রশ্রয় দিইনি। নিয়মতন্ত্রের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে আমাদের কখনোই অভিযুক্ত করা যায়নি। আমরা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ন্যায্যতা প্রমাণ করে মুক্তি সংগ্রামী হিসেবেই এগিয়ে গেছি। আর এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে সাতই জুনের কর্মসূচি পালনকালে শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মদান। সাতই জুন ছিল এর সূচনাবিন্দু। আমাদের জাতীয় জীবনে শত শহীদের রক্তে লেখা এ দিনটি চেতনায় জাতীয় মুক্তির যে অগ্নিশিখার জন্ম দিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ’৭০-এর ২ জুন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এবং তারই নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করি।

আজ ৭ জুন, অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহে আমার জীবন ধন্য। সাতই জুনের চেতনাবহ এই দিনটি আমার জীবনে অম্লান হয়ে আছে। সাতই জুনে যে সকল শহীদ ভাইয়েরা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, বাংলার মানুষের মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে গিয়েছেন তাদেরকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। তাদের অমর প্রাণের বিনিময়ে সংগ্রাম পরম্পরায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক সাতই জুন ছিল আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চেতনার প্রারম্ভ বিন্দু। এই দিনটিতে সাতই জুনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কর্তব্য বলে মনে করি।

লেখক: উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ

বিষয়:

যানজট: সমাধানের প্রস্তাবনা

আপডেটেড ৬ জুন, ২০২৪ ১২:২৬
সৈয়দ এনাম-উল-আজিম

যানজট- বাংলাদেশের বহুল আলোচিত একটি শব্দ ও সমস্যা। আমাদের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনার এক যন্ত্রণাময় চিত্র। ঢাকাসহ দেশের বৃহত্তম নগরীগুলোয় যানজটে নাকাল হয়ে আমাদের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে যেমন কাজের গতি ও উন্নয়নকে করছে ব্যাহত তেমনি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককেও শিথিল করে তুলছে। যানজটে ক্লিষ্ট হওয়ার ভয়ে আমরা শারীরিকভাবে চলাফেরা কমিয়ে দিচ্ছি। বাধ্য হয়ে যারা রাস্তায় বা পরিবহনে উঠছি তারা সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি বায়ু ও শব্দদূষণের শিকার হয়ে শারীরিক-মানসিক অসুস্থতাকে নির্বাদে আলিঙ্গন করছি। এই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের যানজটের বাস্তবতা।

বাংলাদেশ- এক সময় জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী-নালা ও মাটির মেঠো পথের একটি দেশ ছিল। এখন সেই অনেক নদী-নালা শুকিয়ে আর মাটির মেঠো পথে ইট বিছিয়ে তৈরি হয়েছে গ্রামীণ সড়ক নেট ওয়ার্ক। গ্রামীণ সড়কের মর্যাদা নাগরিক সভ্যতাকে টেনে নিয়ে গেছে গ্রামের জনপদে। নৌকা বা হাঁটার স্থলে যান্ত্রিক পরিবহন গ্রামীণ জনজীবনকে গতিশীল ও আরামদায়ক করেছে সন্দেহ নেই। জীবনযাত্রারমান ও স্টাইলেও এসেছে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন। নতুন নতুন পরিবহন তথা অটো, পিকআপ, টেক্সি, লেগুনা, নসিমন, বাস অনুপ্রবেশ করেছে গ্রামের সড়কে। যোগাযোগ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি তাই সাধারণ বেকারদের হয়েছে কর্মসংস্থান, প্রসার ঘটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও। এক কথায় গ্রামীণ চিত্র পাল্টে গেছে উন্নয়নের ছোঁয়ায়।

সাম্প্রতিক গ্রামীণ ও শহরের সড়ক উন্নয়নকে যেমন স্বাীকার করতে হবে পাশাপাশি এর সমস্যা ও সম্ভাবনার হিসাবটিও আমাদের মাথায় রাখা দরকার। উন্নয়নকে অদম্য অগ্রযাত্রার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করার সময় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো চিহ্নিত ও পরিকল্পিত সমাধানের ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে সময় নেবে না। বলা যায়- লেজে-গোবরে এক হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। যেটা আমরা এখনই অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে লক্ষ্য করছি আমাদের সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়।

গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে গ্রামের ও মফস্বল শহরের জীবনযাত্রা ও উন্নতির বিপরীতে জেলা, মহানগর আর রাজধানী ঢাকার চিত্র ঠিক উল্টো। এখানে পাকা রাস্তা বাড়েনি, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে আর বাড়ানোর সুযোগও নেই। অথচ বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, পিকআপ, ট্রাক, মোটরসাইকেল, সরকারি-বেসরকারি পরিবহন সার্ভিস, যোগ হয়েছে অটোরিকশার লাগামহীন বহর। যার ফলে চিরায়ত, পুরোনো মাপের সড়কগুলো, গলির রাস্তাগুলো সব সময়ই অচল আর স্থির হয়ে থাকছে মাত্রাতিরিক্ত গাড়ির চাপে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকে যন্ত্রণায় ভোগা, মূল্যবান কর্মঘণ্টার অপচয় আর জ্বালানি পোড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সেই সঙ্গে গাড়ির জ্বালানি থেকে নির্গত ধোঁয়া আর হর্নের তির্যক শব্দ ঢাকাসহ মহানগরগুলোর পরিবেশকে যেভাবে দূষিত করছে তার ক্ষতি পোশানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো চোখে পড়ার মতো নয়।

২০১০ সালে ঢাকাসহ মহানগরগুলোর অভ্যন্তরীণ এবং মহানগরগুলোর সঙ্গে যুক্ত আন্তজেলা সড়কের পরিমাপ যা ছিল এখনো তাই আছে। হয়েছে সংস্কার, কোথাও কোথাও সরু সড়ক একটু চওড়া হয়েছে; কিন্তু বিআরটিএর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায়, গাড়ি চলার মতো উপযোগী সড়ক সেভাবে না বাড়লেও নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। কিছু উড়াল সড়ক এবং মেট্রোরেলের ব্যবস্থা সেই ঘাটতি পূরণে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। কারণ নিবন্ধিত গাড়িগুলো তো সড়ক ছাড়েনি। তাই যানজট মুক্ত হওয়ার কোনো সুলক্ষণ নগরবাসী দেখছে না। এ বিষয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার কিছু ৭টি প্রস্তাবনা নিম্নে তুলে ধরলাম-

০১। অনিবন্ধিত সব যানবাহনকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করাতে হবে।

০২। গাড়ির মান ও ধরন ভেদে সব গাড়ির মেয়াদকাল নির্ধারিত হওয়া দরকার। মেয়াদ শেষে সেই গাড়িগুলোকে ঢাকাসহ সব মহনগর ও জেলা শহরে চলাচল নিষিদ্ধ করে বিআরটিএর বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে মফস্বলে চলার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

০৩। প্রতি বছর যে পরিমাণ গাড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ হবে সরকারি কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার মতো তাদেরও সড়ক নগর-মহানগরের সড়ক থেকে বিদায় জানিয়ে সেই স্থলে নতুন গাড়ির নিবন্ধন প্রথা চালু করা যেতে পারে।

০৪। গাড়ি নিবন্ধনের আগে কোন এলাকায় গাড়িটি চলবে সেই সড়কের ধারণক্ষমতা আছে কি না যাচাই করা যেতে পারে।

০৫। এক ব্যক্তি বা তার পরিবারের জন্য একের অধিক ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধন দেওয়া নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে।

০৬। পরিকল্পিত নগরায়ণ ও সড়ক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সড়ক নির্মাণে মনোযোগী হতে হবে।

০৭। অগ্রাধিকার দিতে হবে সড়ক উন্নয়ন এবং মেট্রোরেল ও উড়াল সড়কের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজকে।

যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে সমাধানের উপায়গুলো নিয়ে কাজ করেন তাহলে আশা করা যায় আমাদের যানজট সমস্যা অনেকাংশে কমে গিয়ে একটি সুন্দর ও স্বস্থিকর সড়ক ব্যবস্থাপনা এ দেশেও আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারব। দেশ হবে যানজটের অপবাদ মুক্ত।

লেখক: কলামিস্ট


প্লাস্টিক ও পলিথিন পরিবেশ দূষণীয়

আপডেটেড ৬ জুন, ২০২৪ ১২:২৭
সৈয়দ শাকিল আহাদ

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য উপাদান হলো প্লাস্টিক ও পলিথিন যা প্রতিদিন ঘুমভাঙা থেকে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে।

এই প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য যা পোড়ালে বাতাস দূষিত হয়, মাটিতে ফেলে রাখলে মাটি নষ্ট হয়, নদীতে বা সাগরে ফেলে দিলে সেখানেও পানিদূষণ হয়। এগুলো কখনো পচেও না বা গলেও না অর্থাৎ অপচনশীল দ্রব্য। এ দেশের ফসলি জমি, শহরের ড্রেন, নদ-নদী, খাল-বিলের মাটি, পানি ও পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে এই প্লাস্টিক সুতরাং প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার যত দ্রুত সম্ভব ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এবং সবাইকে এর ভয়াবহতা বুঝতে হবে। এটা যে আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানবদেহের জন্য কতটা ক্ষতিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ তার বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। নদী কিংবা সমুদ্রগুলোতে অনেক বেশি প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলার কারণে তা পানির নিচে স্তূপাকারে জমা হচ্ছে। ফলে নদীর মাছ এই অপচনশীল দ্রব্য এবং সামুদ্রিক মাছও তা খায়। আমরা ওই মাছ খাওয়ার পর প্রায়ই নানারূপ শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে যা পরবর্তীতে টের পাই। প্রতি বছরে প্রায় ৯ লাখ টন প্লাস্টিক আমাদের সাগর কিংবা মহাসাগরে জমা হচ্ছে। এভাবে যদি জমার পরিমাণ বাড়তেই থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের দিকে তার সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টন, তা কতটা ভয়াবহ হবে, কেউ কি একবার তা ভেবে দেখেছেন? এখনি একটু ভাবতে হবে।

বাংলাদেশে এক সময় মৃৎশিল্পের বা মাটির তৈরি জিনিসের ব্যাপক প্রচলন ছিল। শহরে চিনামাটির ও কাচের অ্যালুমিনিয়ামের তামা, কাঁসা, পিতলের তৈজসপত্রের ব্যবহার ছিল কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশে কামার ও কুমারের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। মানুষ এখন মাটির তৈরি জিনিস শৌখিন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, ড্রয়িং রুমে সাজিয়ে রাখে কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় এটি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি পাট, কাঠ, বাঁশ, বেত ইত্যাদির তৈরি পণ্য ব্যবহার করতে পারি, তাহলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। সহজলভ্য হবে এবং আনন্দের বিষয় যে এসব পণ্য আবার পরিবেশবান্ধবও। এসব পণ্য আমরা আমাদের অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে সর্বত্র ব্যবহার করতে পারি। পানির বোতল, কাপ, প্লেট, চামচ ইত্যাদি অনেক পণ্যের বিকল্প কাগজের তৈরি পণ্যও রয়েছে। তবে আমরা হরহামেশাই ছোটখাটো সব কাজেই কমবেশি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করছি। পাটের তৈরি ব্যাগ পলিথিনের বিকল্প হতে পারে। অতীতে আমরা মাটির পাত্র, কাঁসার পাত্র, সিরামিক ও কাচের পাত্রের ব্যাপকহারে ব্যবহার করতাম; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা বরং কমে গেছে।

পলিথিনের মধ্য থেকে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না, বরং মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে পড়ে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে তাতে বায়ুদূষণ ঘটে। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

পলিথিন দামে সস্তা কিন্তু এর বিকল্প পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন হওয়া সত্ত্বেও শুধু সরকারি উদ্যোগ ও উদাসীনতার অভাবে পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্জ্য পদার্থ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত পলিথিন ব্যাগ শুধু খাদ্যসামগ্রীকেই বিষাক্ত করছে তা নয়, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শহরগুলোতে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। কেননা শহরের নর্দমা ও বর্জ্য নির্গমনের পথগুলো পলিথিন দ্বারা পূর্ণ। পলিথিনের কারণে পানি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। ব্যবহৃত পলিথিন গলিয়ে আবার ব্যবহার করায় এতে রয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, যা থেকে ক্যানসার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।

পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসার মতে, শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।

পরিবেশ দূষণের দায়ে কল-কারখানাকে জরিমানা কিংবা নদ-নদী ও জলাশয় দূষণ বা দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো হলেও পলিথিনের ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ তেমন নেই বললেই চলে। এ কারণে সর্বত্র নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও এ অপরাধ বন্ধে সচেতনতারই বেশি দরকার। তবু আইনের প্রয়োগও বাড়াতে হবে। না হলে এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। এ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবাধে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এ ছাড়া বর্তমানে পলিথিনের কাঁচামাল দিয়ে এক ধরনের টিস্যু পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদনকারীরা বলছে, এটা ‘পরিবেশবান্ধব’। কিন্তু বুয়েটের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, পলিথিনের মতোই টিস্যু পলিথিন পরিবেশের জন্য ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’। অথচ, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে নতুন উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব পাটের সোনালি ব্যাগ সহজেই ব্যবহার করা যায়, দরকার শুধু সকলের উদ্যোগ ও সদিচ্ছা।

পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার রোধে প্রশাসন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে অধিক সতর্ক হতে হবে এবং পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২টি দেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সব দেশই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে শাস্তির বিধান করলেও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কেনিয়া সরকার কারও হাতে পলিথিন দেখলেই গ্রেপ্তার করার বিধান জারি করেছিল। আয়ারল্যান্ড সরকার পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বাড়তি করারোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেনও এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উগান্ডার বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল, কিন্তু পলিথিনের বিকল্প জানা না থাকায় তা বেশি দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি।

পানিতে বর্জ্যের ৭০ শতাংশ পলিথিন ব্যাগ। এ কারণে ২০২০ সাল থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার আইন করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ইউরোপেই বছরে ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এসব দেশ পলিথিন ব্যাগ বন্ধে আইন করলেও বিকল্প জানা না থাকায় এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। প্রতি মাসে ৪ কোটি ১০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ তৈরি করে সাড়া ফেলার পর এখন বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারলে এটি দিয়েই দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিশ্ববাজার দখল করা সম্ভব।

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ বিশ্বজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন পাটের এই প্রাকৃতিক পলিব্যাগ বিশ্বের পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়তা করবে। দেশীয় চেইনশপগুলো এই সোনালি ব্যাগ ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ জন্য দরকার সরকারি উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি।

বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল পলিব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পাটের সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারলে তা যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে, তেমনি রক্ষা পাবে আমাদের পলিথিন ব্যাগে কলুষিত পরিবেশ।

এখন কাগজ ও পাটের ব্যাগের ব্যবহারই আমাদের পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে পারে। পাটের সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব ও দামে সাশ্রয়ী। পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাত বন্ধে সরকারের ব্যাপক নজরদারিসহ গণমাধ্যমগুলোতে (রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) ব্যাপক প্রচারণা দরকার। পাশাপাশি পাটের ও কাগজের ব্যাগের ইতিবাচক দিক, সাশ্রয়ী দাম ও সহজে প্রাপ্তির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া দরকার।

তাই নিজেদের স্বার্থে এবং পরিবেশের সুরক্ষায় ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারণ এগুলো অতিপ্রয়োজনীয় পানি এবং মাটি মারাত্মকভাবে দূষণ করছে। বিভিন্নভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যানসারের সৃষ্টি করছে। এর বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসার মতে, শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।

প্রায় ২৫ বছর আগে করা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ সালে সংশোধনী এনে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার এ ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬(ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে। শুধু প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলেই পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা সম্ভব। এজন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে অধিক সতর্ক হতে হবে এবং পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২টি দেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সব দেশই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে শাস্তির বিধান করলেও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কেনিয়া সরকার কারও হাতে পলিথিন দেখলেই গ্রেপ্তার করার বিধান জারি করেছিল। আয়ারল্যান্ড সরকার পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বাড়তি কর আরোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেনও এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উগান্ডার বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল, কিন্তু পলিথিনের বিকল্প জানা না থাকায় তা বেশি দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি।

পরিবেশ দূষণের দায়ে কল-কারখানাকে জরিমানা কিংবা নদ-নদী ও জলাশয় দূষণ বা দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো হলেও পলিথিনের ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ তেমন নেই বললেই চলে। এ কারণে সর্বত্র নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও এ অপরাধ বন্ধে সচেতনতারই বেশি দরকার। তবু আইনের প্রয়োগও বাড়াতে হবে। না হলে এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। এ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবাধে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এ ছাড়া বর্তমানে পলিথিনের কাঁচামাল দিয়ে এক ধরনের টিস্যু পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদনকারীরা বলছে, এটা ‘পরিবেশবান্ধব’। কিন্তু বুয়েটের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, পলিথিনের মতোই টিস্যু পলিথিন পরিবেশের জন্য ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’। অথচ, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে নতুন উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব পাটের সোনালি ব্যাগ সহজেই ব্যবহার করা যায়, দরকার শুধু সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ও ব্যবসায়ীসহ আপামর জনসাধারণদের সদিচ্ছা।

পরিবেশের সৌন্দর্যবর্ধনে আমাদের ব্যক্তিপর্যায়ে প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কীভাবে রোধ করা যায়, তার পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন বাজার থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতেও প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে সবাইকে অনেক অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখা। প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখতে আপামর জনসাধারণসহ প্রশাসনের সর্বত্র সজাগ দৃষ্টি রাখতে সবাইকে অনুরোধ করেছেন। আমাদের সবার উচিত প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সর্বত্র যতটুকু সম্ভব প্লাস্টিক ও পলিথিন যা আমাদের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর তা পরিহার করা ও এটার মর্মার্থ অনুধাবন করা প্রতিটি নাগরিকের আবশ্যিক কর্তব্য পালন করা।

লেখক: পরিবেশবিষয়ক গবেষক


জামায়াত-কমিউনিস্ট পার্টির সাদৃশ্যকরণ বিভ্রান্তিকর

আপডেটেড ৬ জুন, ২০২৪ ১২:২৮
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২ জুন তারিখে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের এক স্মরণসভায় জামায়াতের রাজনীতির মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌশলের চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে সেটিকে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক চর্চার অনুকরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার এই দুই মেরুর দুই আদর্শের রাজনীতির চর্চার সাদৃশ্যকরণ নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু কিছু আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। তবে কোনো কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এ ধরনের তুলনাকরণ নিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবাদ গণমাধ্যমের কোথাও চোখে পড়েনি। বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যেই বেশ বিভ্রান্তি রয়েছে। দৃশ্যত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে যেমন বইপুস্তক পড়ার একটি নিয়ম রয়েছে, জামায়াতে ইসলামের মধ্যেও তেমনি তাদের আদর্শের বইপুস্তক পড়ার প্রচলন রয়েছে বলে শোনা যায়। এটি যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তারা মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে হয়তো মিল খুঁজে পাবেন; কিন্তু মির্জা ফখরুল একজন বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের মহাসচিব হয়ে নিজের দলের নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে কেন জামায়াত শিবিরের অনুসৃত ব্যবস্থার শুধু উদাহরণই দিলেন না, এটিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলেও ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এবং এটিকে কমিউনিস্ট পার্টির চর্চার সঙ্গে একাকার করে দেখলেন- তা বোঝা গেল না। রাজনীতিতে অবশ্যই নেতা-কর্মীদের পড়াশোনা করা দরকার আছে।

বিএনপির নেতা-কর্মীরা কি ধরনের বই পড়বেন বা চর্চা করবেন সেটি তাদের দলীয়নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের সঙ্গে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। জিয়াউর রহমানও তার জীবদ্দশায় যখন নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন তিনি বিএনপির একটি গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটি ১৯৭৮-৭৯ এর পর বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হতো। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের তখন এই গবেষণা সেলের প্রশিক্ষণ কোর্সে জিয়াউর রহমান সাহেবের বক্তৃতা শুনতে হতো এবং জিয়াউর রহমান সাহেব নেতাদের নানা ধরনের পরীক্ষা নিতেন, অনেকটা যেন হাতে-কলমে রাজনীতি শেখাতেন! জিয়াউর রহমান নিজে ছিলেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একজন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা। রাজনৈতিক দল কিংবা দলীয় রাজনীতি করার কোনো সুযোগ না থাকলেও গোটা আইয়ুব আমলে তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে বেশ দাপটের সঙ্গেই চাকরি করতেন। আইয়ুবের সামরিক শাসন তার চাকরিজীবনের সেই সময়ের দিনগুলোতেই কেটেছিল। সেখানে সেই সময়ে কর্মরত বেশ কয়েকজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্যতা কতটা ছিল তা জানা যায় তাদেরই লেখা বিভিন্ন স্মৃতিমূলক গ্রন্থে। এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে থাকার সুবাদে তিনি অংশ নিতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রধান সেনাপতি পদ লাভ করেন। পরে তিনি সামরিক শাসক থেকে ১৯৭৮ সালে রাজনীতিবিদ হিসেবে পদার্পণ করেন। জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত ‘রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্রে’ যেসব বক্তৃতা তিনি দিতেন সেগুলো ১৯৯২ সালে ‘জিয়াউর রহমান, আমার রাজনীতির রূপরেখা’ শিরোনামে এ কে এ ফিরোজ নুনের সম্পাদনায় সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি ১৯ দফা, জাতীয়তাবাদ, বাঙালি, বাংলাদেশি, ধর্মীয় মূল্যবোধ নানা বিষয়ে তার নিজের মতো করে কতগুলো বক্তৃতা দিয়েছেন। এসব বক্তৃতা অনেকটাই মেঠো বক্তৃতা ছিল। তাতে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনাই খুঁজে পাওয়া যায় না। যেহেতু তিনি দলের প্রধান তাই বি চৌধুরীসহ অনেকেই যা বক্তৃতা শুনতেন সেগুলোর ওপর নানা কুইজ পরীক্ষাও হতো। জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেব সেই সব পরীক্ষায় নম্বরও দিতেন। অতীতে ডান-বাম রাজনীতি করা পরিচিত অনেক নেতাই জিয়াউর রহমানের এসব প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন, তাদের প্রশ্ন-উত্তরে জিয়াউর রহমান সব সময় খুব একটা সদয় হতে পারেননি। সেটি সেই প্রশিক্ষণ পরীক্ষার নমুনাতে এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে। জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ফলাফল বিএনপিকে কি দিয়েছে বা বিএনপি কি লাভ করেছে তা বোধহয় সেই সময়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে নেওয়া যেতে পারে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সময় বাম রাজনীতি করতেন। বামদের সে রকম কিছু প্রশিক্ষণের নিয়ম বিভিন্ন সংগঠনে রয়েছে। এটিকে অনেকেই বলে থাকে লাল বই পাঠের চর্চা। সেগুলোতে চেয়ারম্যান মাও সে তুং, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনসহ আরও অনেক মার্কসবাদী নেতাদের লেখা কিংবা তাদের ওপর আলোচিত বই পাঠ করা হতো কিংবা কোনো কোনো নেতা আলোচনা করতেন। আমি এটিকে একেবারেই খারাপ কিছু বলি না। তবে এসব বই পড়ে কতজনই বা কমিউনিস্ট রাজনীতি ভালো করে বুঝেছেন। সেটি একটি ভিন্ন বিষয়, প্রশিক্ষণের দুই-চারটি বই পড়ে কিংবা লেকচার শুনে জটিল মার্কসবাদী লেনিনবাদী দর্শন, অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস জানা বা বোঝা মোটেও খুব সহজ ব্যাপার বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কমিউনিস্ট আন্দোলনে এসব বইয়ের লেখা তাত্ত্বিক আলোচনা বোঝা না বোঝা থেকেই অনেক বিভ্রান্তি, বিভক্তি কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল। সেখান থেকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, লেনিনবাদী, মাওবাদী, সর্বহারা ইত্যাদি অসংখ্য নামে শুধু পার্টিই নয়, দলের নেতারাও কেউ কেউ নিজেদের কর্মীদের মধ্যে সেভাবে উপস্থাপন করে, তাদের দেশীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তাত্ত্বিক বলেই খেতাব দেওয়া হতে থাকে। অনেকটাই পীরতন্ত্রের প্রভাব এতে দেখা যেত। কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ এবং তাত্ত্বিক তথাকথিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে যেসব দ্বন্দ্ব দেখা যেত তাতে দলীয় বহু নেতা-কর্মীরই জীবন বিপন্ন হতো, হত্যার শিকার হতেন, আদর্শের নামে অনেক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডও এতে চলত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- আদর্শের জন্য তারা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সেই আদর্শ বোঝা ও ধারণ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতো না। এত কম পড়াশোনা জেনে কমিউনিস্ট মতাদর্শকে বোঝা যে সম্ভব নয় সেটি যারা মানতে চান না। তারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলোর ব্যাখ্যা নিজেরাই দিতেন তাহলে কমিউনিস্ট আন্দোলন হয়তো উপকৃত হতো। কমিউনিস্ট আন্দোলন অবশ্যই অনেক মহৎ উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মকাণ্ডকে সামনে নিয়ে গড়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পৃথিবীর প্রায় কোনো দেশেই সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। লেনিনের মৃত্যুর পর স্টালিন যা করতে চাইলেন তাতে আর সমাজতন্ত্র আর মার্কসবাদী কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই প্রসঙ্গে আর বেশি কিছু বলার নেই। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি এখন অতি ক্ষুদ্র একটি দল; কিন্তু মার্কসবাদী বলে পরিচিত অনেকেই এখন বিভিন্ন দলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। বাম রাজনৈতিক দল বললে এক ধরনের সম্মান পাওয়া যায়; কিন্তু বাম রাজনীতি কেন জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি সেই ব্যাখ্যা বামরাও দিতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টি দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য বইপুস্তক পড়া, প্রশিক্ষণ নেওয়া ইত্যাদির যে ধারা চালু করেছিল সেটি প্রশংসনীয় হলেও তার সুফল রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলেছে সেটি হাজারও বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। সেই বিতর্কে নাই বা গেলাম।

অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতে ইসলামের কৌশলকে বৈজ্ঞানিক বলে যে সনদ প্রদান করেছেন সেটি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায় যে ছাত্র সংঘ, ছাত্র শিবির, জামায়াত যেসব বইপুস্তক পড়ে বা পাঠ করায় সেগুলো তাদের দলীয় নেতাদের লেখা বইপুস্তক। গোলাম আযমের লেখা বই পড়ে ছাত্রশিবিরের একজন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের নেতা বা কর্মী যদি নিজেকে রাজনৈতিক প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ভাবতে শুরু করেন এবং দুনিয়ার তাবৎ গবেষণা গ্রন্থকে মিথ্যা কিংবা বিভ্রান্তিকর বলে মনে করেন। তাহলে বলতে হবে এসব প্রশিক্ষণ কিংবা বইপুস্তক পাঠের ফলাফল মোটের ওপর মগজধোলাই ছাড়া আর কিছুই না। পুরোপুরি অন্ধবিশ্বাস তৈরির বেশি কিছু তাদের কথিত বইয়ে বা প্রশিক্ষণে পাওয়া যায় না। ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তার সহযোগী হওয়ার বেশি কিছু নিজেদের ভাবেনি, আল-বদর, আল-শামস হয়ে এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে। বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমিতে নিয়ে পশুর মতো জবাই করেছে। জিয়াউর রহমান সেই জামায়াতে ইসলামকে রাজনীতি করার অনুমোদন দিলে ছাত্রশিবির নামে তাদের ছাত্র সংগঠন মাঠে নামে। মির্জা ফখরুল সাহেবের স্মরণে কতটা আছে জানি না। ছাত্রশিবিরের কর্মীরাই নিজেদের সহপাঠীদের ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসের কারণে হত্যা করতে মোটেও দ্বিধা করেনি। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শাহাদাতকে গলা টিপে হত্যা করেছে তার সহপাঠী ছাত্রশিবিরের কর্মী। কারণ ছাত্রশিবিরের কর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তাদের আদর্শিক শত্রু হিসেবেই বিশ্বাস করতে শেখে, সেভাবেই শেখানো হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০-এর দশকে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা কীভাবে অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মী এমনকি শিক্ষককেও হত্যা করেছে সেটি মির্জা ফখরুলের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। গোটা ৮০-এর দশকে জামায়াত ইসলামের শিশু সংগঠন ফুল কুড়ি এবং ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির সারা দেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাতে নানা ধরনের পাঠচক্র গোপনে পরিচালিত করত। এই পাঠচক্রের ফসলই হচ্ছে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কিশোর, তরুণ শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করা। জামায়াতে ইসলাম যদিও পাকিস্তানের মওদুদি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামেরই অঙ্গসংগঠন কিন্তু এর মূলে রয়েছে মিসরে প্রতিষ্ঠিত ব্রাদারহুডের আদর্শ তথা সারাবিশ্বে ইসলামী বিপ্লব ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করা। সে আদর্শের বাইরে পৃথিবীর কোনো দর্শনচিন্তা, অর্থনৈতিক তত্ত্ব, বিজ্ঞানসহ আধুনিক জ্ঞানচর্চার কোনো রাজনীতি এই পাঠচক্রে মির্জা ফখরুল দেখাতে পারবেন না। বাংলাদেশে ছাত্রশিবির ও জামায়াত যেসব বইপুস্তক পাঠ করে তা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরির জন্য নয়, তাদের উদ্দেশ্য ‘একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা যা ইসলামী বিশ্বব্যবস্থা তৈরিতে ধাবিত হবে।’ সেই দর্শনই জামায়াতে ইসলামের পাঠচক্রের মূল বিষয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এটিকে একটি বিজ্ঞানসম্মত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন। মির্জা ফখরুলের অভিহিতকরণ তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে; কিন্তু যারা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি ইত্যাদির জটিল বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেন তাদের কাছে এগুলো কতটা মূল্যহীনই শুধু নয়- রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাও বুঝতে হলে আরও অনেক কিছু পড়াশোনা করতে হবে।

লেখক: ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


কোনো অবস্থাতেই কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত নয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. রহমত উল্লাহ্

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর শূন্য পদের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা অস্বাভাবিক কম হওয়ায় নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেকোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে যেখানে শূন্য আসনের তুলনায় অনেকগুণ বেশি আবেদন পড়ে সেখানে আবেদনের তুলনায় শূন্য আসন চারগুণের বেশি থাকাটা অবশ্যই একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ। ৯৬ হাজার শূন্য আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ২৪ হাজার। বিভিন্ন যুক্তিযুক্ত কারণে এর থেকেও বাদ পড়তে পারেন দুই-তিন হাজার প্রার্থী। অর্থাৎ আবেদনকারী প্রায় সবার চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। যারা আবেদন করেছেন তারা নিবন্ধন পরীক্ষায় যত কম নম্বরই পেয়ে থাকুক না কেন সবাই যোগ্য বিবেচিত হবেন। অথচ এই চিত্রটি যদি এমন হতো যে শূন্য পদের সংখ্যা ২৪ হাজার আর আবেদনকারীর সংখ্যা ৯৬ হাজার। তাহলে নিশ্চয়ই তুলনামূলক আরও অনেক বেশি নম্বর প্রাপ্তরা যোগ্য বিবেচিত হতেন, শিক্ষক হতেন। অর্থাৎ আমরা আরও অধিক যোগ্য শিক্ষক পেতাম; যারা আগামী প্রায় ২৫-৩০ বছর অগণিত অধিক যোগ্য নাগরিক তৈরি করতেন; কিন্তু তেমনটি হলো না কেন?

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেছেন, যাদের নিবন্ধন সনদের মেয়াদ ৩ বছরের বেশি হয়েছে এবং যাদের বয়স ৩৫ বছর এর বেশি হয়েছে তারা আবেদন করতে পারেননি বলে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর সংখ্যা অত্যন্ত কম হয়েছে। শুধু ১৬তম ও ১৭তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণরাই আবেদন করতে পেরেছেন। এরমধ্যে ১৬তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ বেশির ভাগ নিবন্ধনধারীর চাকরি চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে হয়ে গেছে। ফলে ১৭তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ২৩ হাজার ৯৮৫ জনের মধ্যে যারা আবেদনের যোগ্য ছিল তারাই পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছেন। তাই তিন-চতুর্থাংশ পদ আপাতত শূন্য থেকে যাবে! অত্যন্ত তথ্যবহুল এই বাস্তব চিত্রটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের পূর্বানুমান থাকাটাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় কেউ কেউ সরাসরি আবার কেউ কেউ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মতামত দিচ্ছেন, যেহেতু নতুন তথা যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের শূন্য পদ দ্রুত পূর্ণ করা আবশ্যক সেহেতু নিবন্ধন সনদের মেয়াদের ক্ষেত্রে ও প্রার্থীদের বয়সের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ দিয়ে এখনই আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া উচিত। আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে হয়তো এ দাবি আরও জোরাল হতো এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কেউ কেউ সক্রিয় হতেন। আমি মনে করি, তেমন ছাড় দেওয়ার উদাহরণ তৈরি করা মোটেও উচিত নয়। আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও তেমনটি করা উচিত হতো না। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সে ও যোগ্যতায় ছাড় দেওয়া মানেই আমাদের প্রায় ৯৭ শতাংশ সন্তানকে ঠকিয়ে দেওয়া। সাময়িক সুবিধা/অসুবিধা বিবেচনা করে কিংবা বিশেষ প্রার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তড়িঘড়ি করে তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া মানেই দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করা!

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গত কত দিনে কতজন শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন ছিল এবং আগামী কত দিনে কতজন শিক্ষক অবসরে যাবেন, কতটি পদ শূন্য হবে, কতটি পদ নতুন তৈরি হতে পারে, কতজন শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন হবে এমন একটা সুনির্দিষ্ট ডেটা মেইন্টেন করা খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। মাউশি, বেনবেইস ও এনটিআরসিএ এই তিনটি কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ডেটা নিয়েই এটি করা সম্ভব। বিশেষ করে ইএমআইএস সেল থেকে শিক্ষকদের যোগদান, পদবি, জন্ম তারিখ ও অবসরের তারিখ সম্পর্কিত সব আপডেট তথ্য এবং এনটিআরসিএ থেকে নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল, নিবন্ধন সনদধারীদের সংখ্যা, বিভিন্ন সময় যোগদানকারী শিক্ষকদের সংখ্যা ও অবশিষ্ট নিবন্ধনধারীদের সংখ্যাসংক্রান্ত আপডেট তথ্য সমন্বয় করা হলেই শিক্ষক চাহিদা ও যোগ্য প্রার্থীর সম্ভাব্য সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব। তেমন পরিকল্পিতভাবে শিক্ষক নিবন্ধন/নিয়োগ পরীক্ষা নিয়মিত সম্পন্ন করা হলে বর্তমান শূন্যতা তৈরি হতো না, ভবিষ্যতেও হবে না।

অন্যদিকে লক্ষণীয় যে, বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ যখন কমিটির হাতে ছিল তখন শিক্ষকদের ন্যূনতম মান নিশ্চিত করার প্রয়োজনে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা প্রবর্তন করা হয়েছিল। সেটি তখন অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। এখন যখন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে, নিয়োগযোগ্য শিক্ষক বাছাই করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে, পদায়ন করা হয় প্রার্থীদের পছন্দ ক্রমানুসারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে; তখন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বিদ্যমান তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। একবার নিবন্ধন পরীক্ষা সম্পন্ন করা এবং আবার নিবন্ধিত শিক্ষকদের মধ্য থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রায় দ্বিগুণ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবে এ কারণেই শূন্য পদের তুলনায় চার ভাগের একভাগ আবেদন পাওয়ার উদাহরণ তৈরি হয়েছে! সরকারি স্কুল-কলেজে যেমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সি যোগ্য প্রার্থীদের আবেদন নিয়ে, সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে, অধিক যোগ্যদের বাছাই করে, সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়; ঠিক তেমনিভাবে বেসরকারি স্কুল-কলেজেও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব, করা উচিত। ফলে নিয়োগ কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে, দ্রুত শূন্য পদ পূর্ণ হবে, শিক্ষার্থীরা অধিক লাভবান হবে। যারা নিয়োগ পাবেন না তারা নিবন্ধনধারীদের মতো বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে আন্দোলনের সুযোগ পাবেন না। সে ক্ষেত্রে কোনোরূপ প্যানেল তৈরি করাও উচিত নয়। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের প্যানেলভুক্তদের বিভিন্ন সময় আন্দোলন করতে দেখা গেছে। এতে অধিক যোগ্য, ইয়ং ও এনার্জেটিক প্রার্থী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। আমাদের সন্তানদের বৃহত্তর স্বার্থেই যেকোনো মূল্যে সর্বাধিক যোগ্য, দক্ষ, কর্মঠ ও উদ্যমী শিক্ষক অত্যাবশ্যক। সর্বাধিক মূল্য দিয়েই আকৃষ্ট করতে হবে তাদের, নিয়োগ করতে হবে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে।

এনটিআরসিএর অতীত সব রেকর্ড ছাপিয়ে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন ২০২৪-এ প্রায় ১৮ লাখ ৬৫ হাজার আবেদন পড়েছিল। এদের মধ্য থেকে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন প্রাথমিক পরীক্ষা’র (প্রিলিমিনারি টেস্ট) ফলাফলে স্কুল ও কলেজপর্যায় মিলিয়ে পাস করেছেন ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ জন। গড় পাসের হার ৩৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। আবেদনকারীর সংখ্যা উৎসাহজনক হলেও উত্তীর্ণের সংখ্যা হতাশাজনক! এরা পরবর্তীতে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চূড়ান্তভাবে খুব বেশি সংখ্যায় যোগ্য বিবেচিত হবেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে না। ফলে পরবর্তী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও শূন্য পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা খুব বেশি থাকার সম্ভাবনা নেই। কেননা, বর্তমান শূন্য পদের সঙ্গে পরবর্তীতে আরও শূন্য পদ যুক্ত হবে। যতই দিন যাবে ততই শূন্য পদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই শিগগিরই আরও একটি নিয়োগ/নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত। আগামী জুলাই মাস নাগাদ আরও অনেক ছেলেমেয়ে আবেদনের জন্য একাডেমিক যোগ্যতা অর্জন করবে।

১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন ২০২৪-এ প্রায় ১৯ লাখ আবেদন পেয়ে এমন ভাবা উচিত নয়, অধিক যোগ্যরা অন্য চাকরি বাদ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বরং বিপুলসংখ্যক বেকার কোথাও চাকরি না পেয়ে বাধ্য হয়ে এখানে আবেদন করেছেন। এতে যোগ্যরা আপাতত শিক্ষকতায় আসার সম্ভাবনা দেখা গেলেও পরবর্তীতে অধিক যোগ্যরা শিক্ষকতায় থাকার কোনোই সম্ভাবনা নেই! অবশিষ্টরা অন্যান্য চাকরির চেষ্টা করতে করতে বয়স অতিক্রান্ত হলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে যেতে বাধ্য হলেও সন্তুষ্ট চিত্তে পাঠদান করার ও উত্তম শিক্ষক হয়ে ওঠার তেমন সম্ভাবনা নেই! কেননা, কর্মীর পূর্ণ জব স্যাটিসফেকশন না থাকলে উত্তম পেশাদারিত্ব অর্জিত হয় না। সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতনে একজন শিক্ষক কোনোভাবেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না বর্তমান দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, আমরা অত্যন্ত কম বেতনে তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য অধিক যোগ্য, অধিক উপার্জনক্ষম নাগরিক-কর্মী তৈরি করতে চাই! এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে এখনই বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। সর্বাধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্যই সর্বাধিক বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষকদের আর্থিক ও অনার্থিক সুবিধা। কোনো অবিশ্বাস্য আশ্বাস দিয়ে নয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলে নয়, সরাসরি দিতে হবে শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি সম্পর্কিত ঘোষণা। পরিষ্কার প্রকাশ করতে হবে সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের টাইমলাইন ও পরিকল্পনা। তারপর প্রকাশ করতে হবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। তবেই শিক্ষক হতে এগিয়ে আসবেন অধিক যোগ্যরা, শিক্ষকতায় থাকতে চাইবেন অধিক যোগ্যরা, শিক্ষকতা করতে চাইবেন অধিক মনোযোগ দিয়ে, অধিকাংশরাই হয়ে উঠবেন সফল শিক্ষক, সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম, তৈরি হবে কাঙ্ক্ষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উপযোগী মানুষ।

লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।


পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ জরুরি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
 ড. মো. আব্দুস সোবহান পিপিএম

বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা এক শান্তিময় দেশ। এ দেশের মৃত্তিকায় জন্ম নিয়েছে অনেক মহীয়সী নর-নারী, অনেক বীর ও বীরাঙ্গনা। আবার এ দেশের সম্পদের লোভে বিশেষ করে সেই গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, সমুদ্র, নদ-নদী, বিল, হাওর, বাঁওড়, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয়ভরা মাছ ও সম্পদের কারণে বিদেশিরা বিভিন্ন সময় এ দেশে আগ্রাসন চালিয়েছে এবং এ দেশ শাসন করেছে। তবে এ প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি আমাদের অবহেলা, অযত্ন, অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে পৃথিবীর সব সম্পদের বহুলাংশ অবনয়ন ও ক্ষতি হয়েছে। সেই সঙ্গে আমাদের সম্পদের যথাযথ ব্যবহারের অভাবে আমরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। প্রথমে আমাদের মৃত্তিকার স্বাস্থ্য সম্পর্কে আলোচনা করা যাক- একটা কথা বহুল প্রচলিত ও প্রচারিত আছে, এ দেশের মৃত্তিকা খুবই উর্বর এবং এ মৃত্তিকায় যেকোনো সবজি বা ফসলের বীজ বপন করলেই তা কোনো পরিচর্যা ছাড়াই দ্রুত বর্ধিত হয় এবং ফলন দেয়; কিন্তু এ মিথ বা প্রচলিত কথা এখন আর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

বাংলাদেশের মৃত্তিকার এক বড় অংশে জৈব পদার্থের সংকট রয়েছে। এক গবেষণা থেকে জানা যায় বাংলাদেশের প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ জমির জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ শতাংশের নিচে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জমিতে শতকরা ৩% থেকে ৬% জৈব পদার্থ থাকা প্রয়োজন। এর কারণ হিসেবে বলা যায় আমাদের রাসায়নিক সারের ওপর অতিশয় নির্ভরতা এবং জৈব সারের প্রয়োজনীয়তা এড়িয়ে বা বাদ দেওয়া বা আমলে না নেওয়া। রাসায়নিক সারের অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এবং উত্তরবঙ্গের অনেক ফসলি জমিতে এখন ফসল উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের ২০২২ সালের এক জরিপ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ বিশ্বে রাসায়নিক সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সর্বোচ্চপর্যায়ে আছে। আমার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সময় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইরস্টিটিউটের (এসআরডিআই) ভ্রাম্যমাণ পরীক্ষাগারের কাজের নিমিত্তে বছরে ২ বার দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন থানায় মৃত্তিকা পরীক্ষা ও ফার্টিলাইজার রিকমন্ডেশন দেওয়ার সময় দেখা গেছে কৃষকরা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকে। যা জলাশয়ের পানি, মৃত্তিকা, প্রাণী, মৎস্য ও অনুজীবের ক্ষতির কারণ। আমার এরূপ একজন কৃষকের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল। এটা ১৯৯৯ সালের ঘটনা ওই সময়ে আমি মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে রাজশাহী পরীক্ষাগারে নিয়োজিত ছিলাম। তো এক দিন একদল কৃষক আসবে জেনে আমার অফিসপ্রধান আমাকে বললেন, আপনি কৃষকদের একটা ক্লাস নেবেন। সে মোতাবেক যথারীতি আমি ক্লাস নিতে শুরু করলাম। ক্লাসের শেষ পর্বটা ছিল কৃষকদের জমি ও জমির ফসলের অবস্থা জানা। এরূপ মতবিনিময়ের সময় একজন কৃষক ভাই অশ্রুজল চোখে আমার কাছে এসে বললেন, আমার জমিতে এখন বেগুন চাষ করতে চাই; কিন্তু বেগুনগাছ আর বড় হচ্ছে না এবং বেগুনের ফুল ও ফল হচ্ছে না। তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম জমিতে কি কি সার ব্যবহার করেন? তিনি জবাবে জানান কেবলমাত্র রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন। তখন আমি তাকেসহ সব কৃষক ভাইদের বোঝালাম আপনাদের জমিতে জৈব সারের পরিমাণ অধিক মাত্রায় বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে গোবর সার, কম্পোস্ট, কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট), ছাই, বাড়ির গৃহস্থালির আবর্জনা, ধানের খড়, গাছের পাতা ইত্যাদি দ্বারা সার তৈরি করে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। একই ফসল বারবার চাষ করা যাবে না। বরং শস্যবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ একাধারে সবজি চাষ না করে ধান, পাট, গম, ভুট্টা, ডালজাতীয় ফসল ও ধৈঞ্চার মাধ্যমে সবুজ সার তৈরি করা যেতে পারে।

আমাদের দেশে সম্পদ নেই এ কথা সত্য নয়; আমাদের দেশে জৈব সার আছে, জৈব সার তৈরির উপাদানও রয়েছে; কিন্তু আমাদের সচেতনতা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ লক্ষ্যে দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় প্রকাশিত ড. মো. আবুল কাসেম ভাইয়ের লেখার একটু উদ্ধৃতি টানছি। চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা খালের তীরে ৫০০ ডেইরি ফার্ম আছে। ওইসব ডেইরি ফার্মের মহামূল্যবান জৈব পদার্থ গোবর ও অন্যান্য বর্জ্যগুলো সঠিক অব্যবস্থাপনার অভাবে এবং কর্ণফুলী খালের পানিতে ফেলার কারণে পানি দূষিত হচ্ছে এবং খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ওইসব ডেইরি ফার্মের মালিকরা ও কৃষকরা অনুনয়-বিনয় করেছেন, তারাও চান না এসব ডেইরি বর্জ্য খালে ফেলতে এবং এর একটা সুরাহা চান। যাহোক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ কর্ণফুলীর শিকলবাহা খালের পাড়ের ডেইরি ফার্মগুলোর বর্জ্যগুলো সারে রূপান্তরিত করতে প্রভৃতি সহায়তা করতে পারেন। তা ছাড়া কেঁচো কম্পোস্ট (ভার্মি কম্পোস্ট) তৈরি করলে তা জৈব সারের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে সদয় দৃষ্টি দেবেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ সমস্যা নিরসনে এগিয়ে আসতে পারে।

পানি দূষণ

বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে মিষ্টি পানির তীব্র অভাব রয়েছে। এ সংকট দিন দিন আরও তীব্রতর হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে ভূ-পৃষ্ঠের পানির দূষণ, অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক মাত্রায় উচ্চফলনশীল ফসল আবাদে প্রচুর পরিমাণ ভূ-পৃষ্ঠের পানি ও ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার ও পানির স্তর নেমে যাওয়া এবং ভারী ধাতু পানির সঙ্গে মিশে যাওয়া উল্লেখযোগ্য। সে জন্য আমাদের এখনই সতর্ক হতে হবে। বাসাবাড়িতে রান্না, গোসল ও টয়লেটে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী হওয়া, গৃহস্থালির আবর্জনা মিউনিসিপ্যালটির বর্জ্য ও কলকারখানার বর্জ্যগুলো সঠিকভাবে শোধন (ট্রিটমেন্ট) করে পানিতে ফেলার ওপর জোর দিতে হবে। ফসলের ক্ষেত্রে পোকা-মাকড় নিধনে কীটনাশক অতিমাত্রার ব্যবহার করা এবং সেগুলো বৃষ্টির পানি, সেচের পানি ও বন্যার পানির সঙ্গে মিশে পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী জলাশয়ের পানিতে মিশে এবং পানির দূষণ ঘটায়। পানি দূষণের ফলে পানিতে প্রয়োজনীয় দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যায় যা জলজ প্রাণীর জন্য অপরিহার্য। তাছাড়া BOD (Biochemical oxygen demand), COD (Chiemi oxygen demand) বেড়ে যায়। ঢাকার চারপাশের বিশেষ করে সাভারের ট্যানারির পার্শ্বস্থ নদীর পানিতে এরূপ প্যারামিটারগুলোর মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় মর্মে সূত্র থেকে জানা যায়। আবার সমুদ্রে ও নদীতে বিভিন্ন জলযান থেকে তেল নিঃসরণ ও বিভিন্ন বর্জ্য ডাম্পিং করার মাধ্যমেও পানিদূষণ হয়ে থাকে। ঋতুভিত্তিক ফসল চাষ এবং অপেক্ষাকৃত কম পানি গ্রহণকারী জাত উদ্ভাবন করতে হবে এবং সবাইকে অতিমাত্রায় সচেতন হতে হবে।

বায়ুদূষণ

বায়ুদূষণের কারণেই বর্তমান বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। বায়ুদূষণ হয়ে থাকে জীবশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, ইটের ভাটা, ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ (যেখানে না ঢেকেই সিমেন্ট, বালু, মাটি ব্যবহার করা হয়), গাড়ি ও কলকারখানার কালো ধোঁয়া, গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপাদন, পানিতে নিমজ্জিত ধান চাষ করা (Submerged rice cultivation), সিগারেটের ধোঁয়া, যুদ্ধের কারণে ব্যবহৃত বিস্ফোরক এবং বিস্ফোরণ ও বোমা, বন-বনানী ও বৃক্ষরাজিতে অগ্নিসংযোগ এবং উজাড় ও সামুদ্রিক শৈবালের বৃদ্ধি-ব্যাহত হওয়ার কারণে। প্রকৃতির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতা, বিশেষ করে বৃক্ষ নিধন দিন দিন সারা পৃথিবীব্যাপী বাড়ছে। এসব বিষয় দেখার জন্য যেন কেউ নেই। অথচ এ বিশ্বের সব মানুষকে অচিরেই এ জন্য অনেক মূল্য দিতে হবে। একটি সূত্র থেকে জানায়, ঢাকা নগরীর বাতাস দূষকের মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার থেকে পাঁচগুণ বেশি। ঢাকা নগরী পৃথিবীর দূষিত নগরীগুলোর অন্যতম। বায়ুদূষণ ফুসফুস শ্বাসপ্রশ্বাস, স্নায়ুতন্ত্রের রোগ, শিশুদের মানসিক রোগ এবং তাদের ব্যবহারে ও আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে। ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ধারণারও অতিরিক্ত বেড়েছে। যা থেকে জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। এগুলো দ্রুত থামাতে হবে। এক গবেষণার পরিসংখ্যানের তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর ২০০ শত মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ১৫০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে।

শব্দদূষণ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে শব্দ যদি ৬৫ ডেসিবলসের ওপরে থাকে তাহলেই তা শব্দ দূষণ হিসেবে পরিগণিত। গাড়ি, বিমান, কলকারখানার মেশিন, লাউডস্পিকার, রেডিও, টিভি, বোমাবাজি, হোটেল-রেস্তোরাঁর মিউজিক, ইঞ্জিন, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি থেকে উদ্ভূত শব্দের মাধ্যমে শব্দদূষণ হয়ে থাকে। শব্দদূষণ নগরবাসীর জীবনে বিরূপ-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এর সঙ্গে জীবের স্বাস্থ্য-সমস্যা সরাসরি জড়িত। শব্দদূষণের ফলে উচ্চ রক্তচাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উত্তেজনা, যোগাযোগের সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, হৃদরোগ, শিক্ষণে ব্যাঘাত, শ্রবণশক্তি হ্রাস পাওয়া, উৎপাদনশীলতা হারানো প্রভৃতি জাতির ক্ষতি হয়। আমরা শব্দদূষণ থেকে পরিত্রাণ পেতে যানবাহন ও মেশিনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, রেডিও, টেলিভিশন, মাইক, মিউজিক লো ভলিউমে শোনা, যন্ত্রপাতি যখন ব্যবহার হয় না, তখন সেগুলোকে বন্ধ করে রাখা, ইয়ার প্লাগ ব্যবহার, বেশি বেশি গাছ লাগানো ও সর্বোপরি সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারি। শব্দদূষণ কমানো ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শব্দের নেতিবাচক প্রভাব থেকে মানুষসহ অন্য প্রাণিকুল সুরক্ষা পেতে পারে।

পাখি, মৎস্য ও প্রাণীর সুরক্ষা

আইইউসিএনের সর্বশেষ লাল তালিকা মোতাবেক আজ বাংলাদেশের অনেক প্রজাতি ভয়াবহ জেনেটিক ক্ষতির মুখে পৌঁছেছে। এ ধরনের প্রজাতির বিস্তারিত তথ্য অনেক সময় পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে সমস্যাগুলোর মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের ৩০৫টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৯ প্রজাতির পাখি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ছিল ১৯৭৫ সালে ৩৫০টি (হেনরিচ, ১৯৭৫), ১৯৯৮ সালে ছিল ৩৬২টি (জলিল, ১৯৯৮), ২০০৪ সালে ৪৪০টি (ইউএনডিপি, ২০০৪); কিন্তু সর্বশেষ আইইউসিএনের ক্যামেরা ট্রাপ জরিপ থেকে এ সংখ্যা পাওয়া গেছে ১০৫টি (আইইউসিএন, ২০১৫)। এ ছাড়া সুন্দরবনের চিত্রা হরিণের সংখ্যা ছিল ১৯৭৫ সালে ৮০,০০০টি (হেনরিচ, ১৯৭৫), ২০০৭ সালে ৮৩,০০০টি (দে, ২০০৭) এবং বর্তমানে সুন্দরবনের হরিণের সংখ্যা বেড়েছে মর্মে জানা যায়। অন্যদিকে, নিঝুম দ্বীপে ২০০৬ সালে হরিণ ছিল ১৪,০০০টি, যা ২০১৫ সালে ২০০০-এর কমে চলে আসে (ফিরোজ এবং উদ্দিন, ২০১৫)। সাইক্লোন রেমালের আঘাতে সুন্দরবনে ৩০টি হরিণের মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া বনরক্ষীরা আরও ১৫টি আহত হরিণ উদ্ধার করেছে। পূর্বে সুন্দরবনে বানরের সংখ্যা ছিল ১,৫২,৪৪৪টি যা কমে হয়েছে ১,২৬,২২০টি। উপরন্তু, ২০১৯ সালের মৎস্য সপ্তাহের বুলেটিন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশ থেকে ৩০ প্রজাতির সাধু-পানির মৎস্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং ৯টি প্রজাতির মৎস্য বিলুপ্তির পথে। তা ছাড়া এশিয়ার দেশগুলোতে বন্যপ্রাণী হত্যা, নির্যাতন ও পাচার হয়ে থাকে। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। পাখি, মৎস্য, প্রাণী ও উদ্ভিদ রক্ষার্থে অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, সামাজিক সচেতন বৃদ্ধি, সামাজিক আন্দোলন ও প্রয়োজনে আইনানুগ শক্তি প্রয়োগের নিমিত্তে পরিবেশ পুলিশ গঠন করা যেতে পারে।

বন-বনানী ও বৃক্ষরাজির সুরক্ষা

সূত্র থেকে জানা যায় বিগত ১০০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জাতি সংঘ ও FAO-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে শতকরা ১১.১ ভাগ বন-বনানী রয়েছে। সে জন্য আমাদের নতুন করে বনায়ন শুরু করতে হবে। পারিবারিক বনায়ন, সামাজিক বনায়ন, সরকারি উদ্যোগে বনায়ন, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে নতুন চারা গাছ লাগানো কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। পাশাপাশি ব্যাপকভাবে বৃক্ষ নিধন এবং বৃক্ষে অগ্নিসংযোগ বন্ধকরণে র‌্যালি, লিফলেট, পথসভা, নাটক, আলোচনা সভা ও বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করতে হবে। মানুষের অবিবেচনা এবং অপরিণামদর্শী কার্যক্রমের কারণে বিশ্বের প্রাণীকুল, উদ্ভিদ রাজি, অনুজীবগুলো এবং জীব-বৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত বিলুপ্ত হচ্ছে এবং মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে এবং সাইক্লোন রেমাল, মোখা, সিডোর, আইলা ইত্যাদি তাপপ্রবাহ, ভূমিধস, বন্যা, ক্ষরা, অতিমাত্রার শীত ও শৈত্যপ্রবাহ বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়া এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের দূষণের পেছনে মানুষই মূলত দায়ী। আমাদের পরিবেশদূষণ বন্ধ থামাতে হবে এবং সব কাজের ক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশকে প্রাধিকার দিতে হবে। আর পরিবেশের উপাদানগুলোর যথাযথ পরিচর্যা, সুরক্ষা ও উন্নয়ন সাধনের মাধ্যমেই পরিবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাহলেই বাংলাদেশ এবং বিশ্বমানবতা ও আধুনিক সভ্যতা বড় আকারের বিপদ থেকে মুক্তি পাবে।

লেখক: কমান্ড্যান্ট (এডিশনাল ডিআইজি) পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙামাটি


বহুমাত্রিক সংকটে দেশের উপকূলের মানুষ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মোতাহার হোসেন

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বহুমাত্রিক সংকটে পড়ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, খাদ্য, বসতি, বিশুদ্ধ পানীয় জল, যাতায়াত এবং নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হতে হচ্ছে তাদের। দেশের সমুদ্র উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর, ভোলা, কক্সবাজার জেলার মানুষকে চরম সংকটে ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে। এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে সদ্য সমাপ্ত ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ দেশের উপকূলীয় উপকূলে আঘাতে সম্পদ ও বাড়িঘর, পশুপাখি, মাছসহ তাদের মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি। আবার এসব অঞ্চলের নদীসমূহ অতিমাত্রায় জোয়ার-ভাটার কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এসব নদীতে সাগর থেকে জোয়ারের পানি আসে এবং ভাটায় ফিরে যায়। এ নদীগুলোর সঙ্গে পদ্মাপ্রবাহের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে সমগ্র এলাকা হচ্ছে জোয়ার-ভাটার প্লাবনভূমি।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। সমুদ্রের অতিমাত্রায় জোয়ার -ভাটা এবং জলোচ্ছ্বাসে একদিকে নদীভাঙন অন্যদিকে সমুদ্রের পানির অতিমাত্রায় লবণাক্তায় এসব অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। লবণাক্ত পানি পান করে নারী, শিশুসহ প্রায় সব বয়সি মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের লাখো মানুষের। অন্যদিকে খুলনা বাগেরহাট, সাতক্ষীরা প্লাবনভূমির নিম্নাংশে অবস্থিত জগৎখ্যাত সুন্দরবন। সুন্দরবন থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টন গাছের পাতা এ অঞ্চলের গভীর জোয়ারের পানি নদীতে পড়ে এবং তা ধীরে ধীরে জলজ প্রাণীর খাদ্যকণায় রূপান্তরিত হয়। তাই এ অঞ্চলের জৈবিক উৎপাদনশীলতা পৃথিবীর যেকোনো এলাকার তুলনায় অনেক বেশি।

উপকূলীয় বাঁধ হওয়ার আগে জোয়ারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জলরাশি নদীগুলোর দুকূল ছাপিয়ে প্লাবনভূমিতে উঠে আসত এবং জোয়ারবাহিত পলি প্লাবনভূমিতে পড়ে তীব্র স্রোতে ভাটায় তা ফিরে যেত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন জোয়ার-ভাটার নদীগুলোর নাব্য বজায় থাকত, তেমনি ভূমির গঠন প্রক্রিয়া সমানতালে চলত। তা ছাড়া এখানকার কৃষকরা প্লাবনভূমির চারদিকে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে সাময়িক বাঁধ দিয়ে আমন ধান রোপণ করত এবং পৌষ মাসে বাঁধ ভেঙে প্লাবনভূমিতে জোয়ারবাহিত পলির কারণে সুযোগ করে দিয়ে ভূমি গঠন ও জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করত। ফলে নদীর নাব্য থাকত। এ কারণে এখানকার নদী, প্রকৃতি, পরিবেশ ও কৃষিব্যবস্থা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী; দেশের অন্যান্য উপকূল থেকে তা ভিন্নতর; কিন্তু এখানকার প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে বিবেচনায় না নিয়ে ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ৩৯টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়, এর আওতায় ১ হাজার ৫৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ ও ২৮২টি স্লুইসগেট নির্মিত হয়। এ কারণে এই নদীগুলো স্থায়ীভাবে প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যার ফলে জোয়ারবাহিত পলি প্লাবনভূমিতে পতিত হতে না পেরে নদীতে অবক্ষেপিত হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে বহু নদী মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। অবশিষ্ট জোয়ার-ভাটার নদীগুলো পলি দ্বারা ভরাট হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে বিগত শতকের আশির দশকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা এবং ধীরে ধীরে তা হয়ে উঠেছে প্রলয়ঙ্করী ও বিধ্বংসী।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবে উপকূলীয় মানুষের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করা ২২.৪৮ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে। এ ছাড়া ৪৩.৯৫ শতাংশ মানুষের ভালো ঘুম হয় না। সম্প্রতি রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।

সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ, সিভিল সোসাইটি প্ল্যাটফরমের এই যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ুর প্রভাব শীর্ষক’ গবেষণায় গুরুতর দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ, মানসিক বৈকল্য এবং ঘুম না হওয়ার মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা উঠে এসেছে। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৩.৯৫ শতাংশ মানুষের ভালো ঘুম হয় না বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, খুলনার শ্যামনগর এলাকায় এই সমীক্ষা চালানো হয়।

বাংলাদেশ একটি নিম্নভূমি হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়, উপকূলীয় বন্যা এবং উপকূলীয় ক্ষয়ক্ষতির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে বিগত নব্বইয়ের দশকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা সংস্থা সিইজিআইএস একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় নদী বাঁচানোর মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য নদীতে অবাধ জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। এর পর নদী অববাহিকায় বিশেষ করে খুকশিয়া বিলে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে এই অববাহিকার পাঁচ-সাতটি উপজেলা জলাবদ্ধতামুক্ত থাকে; কিন্তু কৃষকদের অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত জটিলতার কারণে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হলে নদী রক্ষা কার্যকারণ বন্ধ হয়। ফলে হরি, শ্রী ও ভদ্রা নদীগুলো আবারও ভরাট হয়ে গেছে এবং জলাবদ্ধতার তীব্রতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

অন্যদিকে ২০১৫ সালে সাতক্ষীরা জেলার কপোতাক্ষ নদ অববাহিকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য পাখিমারা বিলে টিআরএম কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি কপোতাক্ষ অববাহিকায় আর কোনো জলাবদ্ধতা দেখা দেয়নি। তবে বর্তমানে টিআরএম কার্যক্রম বন্ধ রাখার ফলে নদীর নাব্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু জনগণের দৃষ্টিতে তার কোনোটিই প্রকৃতি, নদী ও পরিবেশসম্মত নয় এবং সেই কারণে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও নদীর নাব্য রক্ষায় এসব প্রকল্প সফল ভূমিকা রাখতে পারেনি। একই নদী বারবার খননের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে; কিন্তু তা এক-দুই বছরের মধ্যে ফের পলি দ্বারা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের জনবসতি ও সভ্যতা রক্ষার জন্য এ অঞ্চলের নদীকে বাঁচিয়ে রাখা বা নদীর নাব্য রক্ষার জন্য জোয়ারের পানিতে আসা পলি নদীর প্লাবনভূমিতে ফেলার ব্যবস্থা নিতে হবে।

গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ অনুযায়ী উপকূলের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার বিধান বাড়ানো, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা, কাউন্সেলিং ইউনিট স্থাপন করা এবং ন্যাশনাল আডাপ্টেশন প্ল্যান (ন্যাপ) জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযোজন পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত করা। আরও সুপারিশের মধ্যে রয়েছে দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, নীতি এবং আইনি কাঠামোর পরিবর্তন এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা বিধানগুলো উন্নত করা। সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের আরও প্রভাব জানতে উপকূলের পরিবারগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা দরকার।’

সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ডা. ড্যানিয়েল নোভাক জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিপজ্জনক। সুইডেনে মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ প্রভাব জেনে তাদের বাচ্চাদের হত্যা করার মতো উদাহরণও রয়েছে। খরায় জেগে উঠল ৩০০ বছরের পুরোনো শহর। কৃত্রিম হ্রদের নিচে তলিয়ে গিয়েছিল ফিলিপাইনের প্রাচীন শহর পান্তাবঙ্গন। ১৯৭০-এর দশকে কৃত্রিম হ্রদের জন্য জলাধার নির্মাণের পর ডুবে যায় শহরটির ধ্বংসাবশেষ। তীব্র খরার কারণে বাঁধের ভেতরের কিছু অংশ শুকিয়ে যাওয়ায় জেগে উঠেছে শহরের চিহ্ন পান্তাবঙ্গ।

বাংলাদেশে গত এক মাস ধরে রছে প্রচণ্ড দাবদাহ। ইতোমধ্যে এ কারণে মারা গেছে প্রায় ২৪ জন। তীব্র গরমের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অফিসের কার্যক্রমও বাড়ি থেকে করার সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে বলে ফিলিপাইনের আবহাওয়া দপ্তরের বিশেষজ্ঞ বেনিসন এস্তারেজা বলেছেন। তিনি বলেছেন ‘ফিলিপাইনে জলবায়ু পরিবর্তনের সাধারণ প্রভাব হলো উষ্ণ তাপমাত্রা। আমরা যে তাপ অনুভব করছি, তা আগামী দিনে ক্রমাগত বাড়তে পারে।’ ফিলিপাইনে এখন উষ্ণ ও শুষ্ক ঋতুর মাঝামাঝি সময়। বিশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতি ‘এলনিনো’র (প্রশান্ত মহাসাগরের সাগরপৃষ্ঠের পানির অস্বাভাবিক উষ্ণতা) প্রভাবে দেশটিতে গরমের তীব্রতা আরও বেড়েছে। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় মানুষকে রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম


বাজেটে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় আনতে হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মিহির কুমার রায়

আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট সমাগত এবং এরই মধ্যে বিভিন্ন সেমিনার, কর্মশালা ও সংলাপ শুরু হয়ে গেছে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যা একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে এবারের বাস্তবতা ভিন্ন যেমন- চলমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃচ্ছ্রতাসাধন ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ সহায়তার শর্তপূরণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। ফলে এবারের বাজেটের আকার আশানুরূপ বাড়ছে না। আগামী বাজেটের প্রস্তাবিত সম্ভাব্য আকার হচ্ছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির গড় হার ৬ দশমিক ৫০ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা হবে। বিগত ৪ এপ্রিল, ২০২৪ অনুষ্ঠিত আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল এবং ‘বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে আগামী বাজেটের এ খসড়া রূপরেখা উপস্থাপন করা। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এই সভায় সভাপতিত্ব করেন।

জানা গেছে, চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের মূল বাজেটের আকার ধরা হয়েছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং আগামী অর্থ বছরে বাজেটের প্রস্তাবিত সম্ভাব্য আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে এবারের বাজেটের আকার আশানুরূপ বাড়ছে না। সে হিসাবে বাজেটের আকার বাড়ছে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে বাজেটের আকার বাড়ছে মাত্র ৩৫ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরে মূল বাজেটের আকার এর আগের অর্থ বছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ সূত্রমতে, প্রতি বছর বাজেটের প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে ১২ শতাংশ ধরেই প্রাক্কলন করা হয়। এবার সেটি ৫ শতাংশের নিচে বাড়বে। কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ রাজস্ব আদায় না হওয়া, প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং আমদানি ও রপ্তানি পরিস্থিতি আশানুরূপ ভালো না হওয়ায় বাজেটের আকার তেমন বাড়ছে না। আসন্ন বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক নীতির সঙ্গে রাজস্ব নীতির সমন্বয়। জানা যায়, নতুন বাজেটে সম্ভাব্য মোট আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা (জিডিপির ৪.৬%)। ঘাটতি পূরণে বিদেশি সহায়তা আর ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। বাকিটা অভ্যন্তরীণ উৎস (ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য) থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হবে।

সূত্রমতে, আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়বে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হতে পারে। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। তবে সংশোধিত বাজেটে ১৮ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে এডিপির আকার ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রতাসাধনে চলতি বাজেটে গাড়ি কেনা, ভূমি অধিগ্রহণ, ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এটি আগামী অর্থ বছরেও অব্যাহত থাকবে। চাহিদার দিক থেকে অনেক কিছু হ্রাস করা হচ্ছে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ ঠিক রাখতে গিয়ে টিসিবি ও ওএমএস কর্মসূচির মাধ্যমে পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি, বাজার মনিটরিং জোরদার করা হতে পারে।

নির্বাচনের পর নতুন সরকারের মাত্র কয়েকদিন অতিবাহিত হয়েছে। বাজেটে সংস্কার আনার জন্য এই সময়টাই সবচেয়ে উপযুক্ত। দেশের অর্থনীতি নানা প্রতিকূলতা ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় অনন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে গুণগতমানের সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা জরুরি। সেই সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় রাজস্ব আহরণ বাড়ানো ও ব্যাংক খাতে দুরবস্থা দূর করার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে। চলমান বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে বাজেটে সংস্কার আনা জরুরি। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) আয়োজিত আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এসব কথা বলেন বক্তারা। বাজেট ও সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, আগামী বাজেটের আকার হতে পারে ৮ লাখ কোটি টাকার আশপাশে। নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে। প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিকীসহ অন্যান্য পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ হিসেবে বাড়ানো হয়েছে সুদহার। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা প্রকৃত অর্থে মুক্ত অর্থনীতির অনুসারী না, কল্যাণকর অর্থনীতির অনুসারী। আসন্ন বাজেটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিফলন ঘটবে। সরকারের আরও কিছু বিষয় আছে, সেগুলো মাথায় রেখে বাজেট করা হচ্ছে। বাজেটে কী হচ্ছে, না হচ্ছে এসব বিষয় সাধারণ মানুষ জানতে চায় না। তারা চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসুক। আগামী বাজেটে এ বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে বাজেটে যা করার আছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থানে নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, ইউনিয়নপর্যায়ে ভূমির খাজনা আদায়ে তহসিল অফিস আছে। আর জেলাপর্যায়ে পর্যন্ত কর কর্মকর্তা আছেন। উপজেলাপর্যায়েও মানুষের আয় বেড়েছে; কিন্তু করদাতা বাড়েনি। কর খেলাপিদের বা দুর্নীতিগ্রস্তদের বাড়তি সুযোগ দেওয়ায় সাধারণ করদাতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র‌্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ। তিনি বলেন, দেশে এখনো পরোক্ষ কর অনেক বেশি। অথচ উন্নত বিশ্বে প্রত্যক্ষ কর বেশি। এত দিন এসব জায়গায় সংস্কার আনা যায়নি। এখন সংস্কার করার সুযোগ রয়েছে। বছরের শেষ সময়ে তড়িঘড়ি না করে বছরজুড়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান বাজেট তৈরি করা হচ্ছে, পাস হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে বাজেটে অনেক বেশি সংস্কার প্রয়োজন। বাজেট প্রণয়নে সংসদীয় কমিটির সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এনবিআরের কর আদায় প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনলাইন করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সব প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে এনফোর্সমেন্ট বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে থাকা ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির ডায়াবেটিস বলে মনে করেন তিনি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান। উচ্চ প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা অর্জনের টানা বাজেট ঘাটতি মেটাতে এতদিন সক্ষম হয়েছে সরকার। তবে আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানো ও সরকারি ব্যয় কমানো মুখোমুখি অবস্থানে থাকবে বলে মনে করেন র‌্যাপিড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘আগামী বাজেটে সম্প্রসারণমূলক নীতি থাকলে মূল্যস্ফীতি কমানো চ্যালেঞ্জ হবে। আগামী বাজেটে বড় সংস্কার প্রয়োজন। নির্বাচনের আগে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল। তবে নির্বাচনের পরে এখন সংস্কার করার উপযুক্ত সময়। যেন বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সহজ হয়। বাজেট প্রণয়নে সংখ্যার বাইরে বেরিয়ে গুণগতমানের দিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে যাতে বাজেট ব্যয় বাড়ানো যায়। বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বাজেট ব্যয় ব্যবস্থাপনা আরও বাড়ানোর জন্য সংস্কারের প্রস্তাব দেন এই অর্থনীতিবিদ।’

আলোচনার শিরোপায় রয়েছে- রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বিদেশি ঋণ, সুদ ও ভর্তুকির মতো ব্যয় মেটাতে রাজস্ব খাতের চাপ কাটছে না। ব্যয় আরও বৃদ্ধির কারণে চাপ আগামী অর্থ বছরেও অব্যাহত থাকছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সম্প্রসারণমূলক হওয়ার কথা; কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। আগামী অর্থ বছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য খুব বেশি বাড়ছে না। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে। ফলে জিডিপির প্রবৃদ্ধি না বাড়লে রাজস্ব আয়ও বাড়বে না। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার দেখা যাচ্ছে না। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক ও আইনি কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। বিশেষ করে কাগজবিহীন ও স্বচ্ছ কর পদ্ধতি চালু করা দরকার। এনবিআরকে অর্থ প্রতিমন্ত্রীর অধীনে রাখা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর নামে দুটি বোর্ড তৈরি করা প্রয়োজন। রাজস্ব খাত নিয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনার জন্য পৃথক উইং থাকতে হবে। এসব খাতে সংস্কার আনা হলে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাবে।

‘আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে আগামী অর্থ বছরে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে ১০ লাখ বা এর বেশি মূসক (ভ্যাট) পরিশোধের ক্ষেত্রে ই-পেমেন্ট বা এ-চালান বাধ্যতামূলক করা হবে। বর্তমান ই-পেমেন্ট বা এ-চালান শুধু ৫০ লাখ টাকা বা তার বেশি ভ্যাট পরিশোধে ব্যবহারের বিধান আছে। সেটি কমিয়ে আনলে এ খাত থেকে অনিময় দূর হবে এবং রাজস্ব আহরণ বাড়বে। এ ছাড়া ইলেকট্রনিকস টেক্স ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফরম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি, সেবার মানোন্নয়ন ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে আয়কর আইন-২০২৩ প্রয়োগ করা হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে অনেক আয়করদাতা আছেন কিন্তু তারা কর দিচ্ছেন না। তাদের করজালের আওতায় আনতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইডিএফ মেশিন স্থাপনের জন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। খুব শিগগিরই বহু প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় আনা হবে। এ ছাড়া নতুন করদাতাদের করজালে আনতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন, ডিপিডিসির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংশ্লিষ্টদের মতে চলতি অর্থ বছরে প্রথম ৮ মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এই সময়ে নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে কমানোর পরও ১৮ হাজার ২২১ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। যদিও এই সময়ে প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশ হয়েছে। রমজানকে কেন্দ্র করে আমদানি বৃদ্ধির কারণে ফেব্রুয়ারিতে এ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অর্থ বিভাগের বাজেট নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত কয়েক বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। ওই সময় অর্থনীতির স্বাভাবিক পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে একটি বিশেষ সময়ের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। ঊর্ধ্বমুখীভাব বিরাজ করছে মূল্যস্ফীতির হারে। ব্যবসাবাণিজ্য খুব ভালো হচ্ছে না। ফলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশয় আছে। চলতি অর্থ বছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রাথমিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিলে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে গত বছরের আদায়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হতে হবে প্রায় ৩০ শতাংশ। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এত বেশি হারে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি কোনো বছরই হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে লক্ষ্যমাত্রা ২০ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এই অর্থ বছরের প্রথম ৮ মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। বাকি ৪ মাসে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকার বেশি।

২০২৪ সালে সরকারের সামনে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে যা হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিনিময় হার এবং রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। মূল্যস্ফীতি গরিবের শত্রু, মধ্যবিত্তের পকেট কাটে বিধায় এটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ডলারের বিনিময় হার এবং অনিয়ন্ত্রিত ডলারের মূল্য। এ জন্য বিনিময় হার একটি বান্ডেলের মধ্যে আনতে হবে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি। দুটি কারণে প্রবাসী আয় আনা যাচ্ছে না- তা হলো দক্ষ শ্রমিক পাঠানো অক্ষমতা ও প্রবাসী আয়ের ডলারের মূল্য ও প্রণোদনার স্বল্পতা। এই বিষয়গুলো যেন আগামী বাজেটে বিবেচনায় আসে সে জন্য প্রস্তাব রইল।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

বিষয়:

মৌসুমি আম নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রাণভরে খান

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
কৃষিবিদ মো. বশিরুল ইসলাম

জ্যৈষ্ঠ মাস। এ মাসে শহর কিংবা গ্রামের বাজারগুলোতে দেখা যায় নানা রকম ফলের সমারোহ। চারদিকে নানা রকম ফলের সুবাস। গ্রাম-বাংলার এসব ফলে ছেয়ে গেছে শহরের অলিগলি ও বাজার। বছরের আর কোনো মাসে এত ফলের আগমন ঘটে না। তাই তো ভুল করে অনেকে জ্যৈষ্ঠ মাসকেই ‘মধুমাস’ বলে ফেলেন। আমরাও অপেক্ষায় থাকি কখন জ্যৈষ্ঠ মাস আসবে। কারণ এ সময়েই আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুলসহ নানা জাতের ফল পাকতে শুরু করে। গাছ থেকে সদ্য পেড়ে আনা তাজা ফলের পরশ অসাধারণ এক অনুভূতির জন্ম দেয়। এই ফলের কথা ভেবে নস্টালজিক হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক।

ফলের রাজা আম। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। বর্তমান সরকার আমগাছকে দিয়েছে জাতীয় গাছের মর্যাদা। যদিও কাঁঠাল জাতীয় ফল, জনপ্রিয়তায় আম সবার ওপরে। মধ্য মে থেকে উন্নত জাতের আমের মৌসুম শুরু হয়। চলে সেই প্রায় আগস্ট মাস পর্যন্ত। এর মধ্যে জুন ও জুলাই মাস আমের বাজার থাকে রমরমা। এ সময় ধনী থেকে গরিব সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে দেখা যায় ফল কেনার উৎসব। দামও থাকে সাধ্যের মধ্যে। ফলের পসরা সাজিয়ে বসে ক্ষুদ্র থেকে বড় ফল ব্যবসায়ীরা।

বছর কয়েক আগেও ফল খাওয়া নিয়ে মানুষের এত নেতিবাচক ধারণা ছিল না। গ্রাম ও শহরের মানুষ সবাই মিলে দেশীয় ফল, বিশেষ করে জুন-জুলাই মাসে আম-কাঁঠালের স্বাদ নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকত। আর এখন পাকা আম বাজারে এলেই নানা প্রশ্ন চলে আসে। অনেকের মধ্যেই ভয় বা বিভ্রান্তি কাজ করে। ভয়ের কারণ এগুলো খাঁটি আম তো? মানে ফরমালিন, ক্যালসিয়াম কার্বাইড রাসায়নিক দিয়ে আম পাকানো হয়েছে কি না? এ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। কোথাও যেন স্বস্তি নেই।

একবার ভাবুন তো সারা বছর বিদেশ থেকে এত আপেল, কমলা, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, প্যাসন ফ্রুট, ড্রাগন ফ্রুট, আঙ্গুর, খেজুর আসে যেগুলো মাসের পর মাস পচে না। তারা কি কোনো কিছুই দেয় না? আর আমাদের দেশের চাষিদের আম কিনতে গেলে সব বিষে ভরা! আসলে, এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল আমে কেমিক্যাল ও ফরমালিন রয়েছে এমন অপপ্রচার করে আমকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া চেষ্টা করে চলছে। এতে দেশীয় আমচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

রমজান মাসে আমাদের দেশি ফল কম থাকায় বিদেশি ফলের দাম অস্বাভাবিক ছিল। ওই সময় আপেল, কমলা ও মাল্টার মতো আমদানি করা ফলের দাম কেজিতে বেড়েছিল ২০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। দাম বাড়ার জন্য বাড়তি দরে শুল্কায়ন ও ডলার সংকটকে দায়ী করেন ব্যবসায়ীরা। এখন রমজানের চেয়েও

ডলারের দাম বেশি। শুল্ক-করও এর মধ্যে কমানো হয়নি; কিন্তু ফলে ভরপুর এই মৌসুমে বাজারে আধিপত্য কমেছে বিদেশি ফলের। চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি ফলের দামও কমেছে বাজারে। এর থেকেই অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। আর, অভিযোগ রয়েছে- আম পাকার পর তা যেন পচে না যায়, এ জন্য নিয়মিত স্প্রে করা হয় ফরমালিন। আমাদের যে ধারণা দেশি ফলমূল এবং বিদেশ থেকে আনা ফলে ফরমালিন দেওয়া হয়, এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।

আমের ফরমালিন ব্যাপারে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা জানান, প্রাকৃতিকভাবেই প্রত্যেক ফলমূল ও শাকসবজিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় (গড়ে ৩-৬০ মিলিগ্রাম/কেজি মাত্রায়) ফরমালডিহাইড থাকে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। মনে আছে, ২০১৪ সালে আমে ফরমালিনের কথা বলে হাজার হাজার মণ আম বিনষ্ট করা হয়েছিল। শুধু আম নয়- অন্যান্য মৌসুমি ফলও করা হয় ধ্বংস। অথচ গবেষণায় জানা গেল শুধু আম নয়, ফলমূল শাকসবজিতেও ফরমালিনের কোনো ক্ষতিকর ভূমিকা নেই। যে যন্ত্র দিয়ে ফরমালিন মাপা হতো সেটাও কার্যকর ছিল না।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এরপর ফরমালিন বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে বলা হয়- ফলমূল ও শাকসবজি হচ্ছে তন্তু (ফাইবার) জাতীয় খাবার, যেখানে প্রোটিনের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। ফরমালিন হচ্ছে ৩৭ শতাংশ ফরমালডিহাইডের জলীয় দ্রবণ এবং অতি উদ্বায়ী একটি রাসায়নিক যৌগ যা মূলত প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে। তাই ফলমূল, শাকসবজি সংরক্ষণে ফরমালিনের কোনো ভূমিকা নেই। কেউ যদি না বুঝে দেয়ও, তাহলেও কোনো কাজে আসবে না। সংরক্ষণে কোনো ভূমিকা রাখবে না। কারণ এখানে কোনো প্রোটিন নেই।

আবার কয়েক বছর আগে যখন কার্বাইড, ইথোফেনের নামে আম ধ্বংস করা শুরু হলো তখন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের তৎকালীন চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন- ইথোফেন অথবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আম নিরাপদ। তখন অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। আসলে, ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড ও ইথোফেন ব্যবহার করা হয়, যা সারা বিশ্বে নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কার্বাইড ফলের মধ্যে প্রবেশ করে না, কার্বাইড হিট উৎপন্ন করে, যা আম অথবা অন্য ফলকে পাকাতে সাহায্য করে। আর ইথোফেন কিংবা কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের স্বাদ কিছুটা তারতম্য মনে হলেও এর পুষ্টি উপাদানে খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। আর ইথোফেন প্রয়োগ করা হলেও সেটা ২৪ ঘণ্টা কম সময়ের মধ্যেই নির্ধারিত মাত্রার নিচে চলে আসে। তবে যেকোনো ফল খাওয়ার আগে বেসিনের পানিতে কয়েক মিনিট ছেড়ে রাখলে কেমিক্যাল ধুয়ে চলে যায়, ফলে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে।

এবার আসুন, যুক্তি দিয়ে দেখি- আমচাষিরা ভরা মৌসুমে আসলে কেমিক্যাল ব্যবহার করে কি না? আর দিলেও কেন দেবে? আমার ধারণা, আমচাষিরা এই ধরনের কেমিক্যাল অন্তত ভরা মৌসুমে দেয় না। কারণ হচ্ছে ভরা মৌসুমে আম এমনিতেই পরিপক্ব থাকে এবং আম আধা পাকা অবস্থায় গাছ থেকে পাড়া হয়। এ সময় আম রেখে দিলে বা আমগাছ থেকে পাড়ার পর ট্রান্সপোর্টের সময়টুকুতে আম এমনিতেই পেকে যায়। তাই ভরা মৌসুমে টাকা খরচ করে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকানোর কোনো প্রয়োজনই দেখি না।

আর ভরা মৌসুমে প্রচুর আম বিক্রি হয়, দোকানে স্টক থাকে না। প্রচুর আম আসে, তেমনি প্রচুর আম বিক্রিও হয়ে যায়। এ সময় টাকা খরচ করে কেন কেউ ফরমালিন দেবে? তবে কথা হচ্ছে, মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে আম পাকাতে পারে। কারণ তখন অপরিপক্ব আম তাড়াতাড়ি পাকিয়ে বাজারে ছাড়লে বেশি দাম পাওয়া যায়।

অতিমুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে এ সময় আম পাকানোর সুযোগ নিতে পারে। আর মৌসুমের শেষে যখন বাজারে আম খুব কম পাওয়া যায়। কিছুদিন আমকে ধরে রাখতে পারলে ব্যবসায়ীরা বেশি দামে তা বিক্রি করতে পারে। ঠিক সে সময় ব্যবসায়ীরা আমে ফরমালিন দিতে পারে। তাই, পুষ্টিকর ভালো আম খেতে হলে ফলের মৌসুমেই খেতে হবে।

পরিপক্ব আম বাজারজাতে সূচি ঘোষণা করে আসছে স্থানীয় প্রশাসন। সূচি অনুযায়ী আম কিনলে কোনো ভয়ের কারণ নেই। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলের গোবিন্দভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। ১০ জুন আসবে আম্রপালি আম। আমের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রাজশাহী অঞ্চলের গুটি আম, গোপালভোগ, রানিপছন্দ, ক্ষীরশাপাতি, লক্ষ্মণভোগ-লখনা আম বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ১০ জুন থেকে ল্যাংড়া-ব্যানানা ম্যাংগো, ১৫ জুন থেকে আম্রপালি, ১৫ জুন থেকে ফজলি, ৫ জুলাই থেকে বারি-৪, ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা, ১৫ জুলাই থেকে গৌড়মতী, ২০ আগস্ট থেকে ইলামতী এবং কাটিমন ও বারি-১১ সারা বছর সংগ্রহ করা যাবে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলতি মৌসুমে থাকছে না ম্যাংগো ক্যালেন্ডার বা আম পাড়ার সময়সীমা। আম পরিপক্ব হলেই গাছ থেকে পেড়ে বাজারজাত করতে পারবেন আমচাষিরা। আর একমাত্র আশবিহীন রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম পাওয়া যাবে জুন মাস থেকে।

তাই আসুন ইথোফেন, ইথিলিন ও ফরমালিনের বিষয়টি ভালোভাবে জানি এবং আম না কেনা বা ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকি। তবে আমচাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করেন এবং তা কেবল পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করেন, সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

তবে কার্বাইড শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। যার কারণে নানারকম রোগ হতে পারে। যেমন- ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকারের ব্যাপক সচেতনতামূলক প্রচারণার আর ভেজালবিরোধী নানান অভিযানের ফলে কার্বাইডের ব্যবহার অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও কিছু কাজ আমরা করতে পারি। যেমন- স্থানীয় এলাকায় মাইকিং করা, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করা, আমচাষি এবং আড়তদার নিয়ে সচেতনতামূলক মিটিং করে এ ক্ষতিকারক দিকগুলো তুলে ধরতে হবে।

আম এখন সারা দেশের ফল, যা বাণিজ্যিক কৃষির কাতারে পৌঁছে গেছে। এখন উপকূলীয় লবণাক্ত ভূমিতেও মিষ্টি আমের চাষ হচ্ছে। পার্বত্য জেলার জুমচাষ এলাকায়ও উন্নত জাতের আম ফলছে। বাংলাদেশের আমের সুনাম আছে বিশ্বে। বিশ্ববাজারে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশে যখন আম পাকে, তখন বিশ্ববাজারে অন্য কোনো দেশের আম আসে না। আম উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। প্রতি বছর বাংলাদেশে ১.৫ মিলিয়ন টন আম উৎপাদন হয়। সম্প্রতি ডেটা স্ট্যাটিস্টিকা এ তথ্য জানিয়েছে। দেশে প্রতি বছরই আমের উৎপাদন বাড়ছে। তাই দেশের মানুষের পুষ্টির অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আম।

এ দেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা এবং আশ্বিনা জাতের আম যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমানে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ জানিয়েছেন, চীন, রাশিয়া ও বেলারুশ রাজশাহীর আম নিতে আগ্রহী। দ্রুতই চীনের একটি প্রতিনিধি দল রাজশাহীর আম দেখতে আসবে। তাই এ দলটির সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলে আমের সঠিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আম, সবজি প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য দেশের ৮টি বিভাগে ৮টি বহুমুখী হিমাগার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।

তাই আসুন আমরা সবাই একটু সচেতন হই, ভালোভাবে বুঝে, সঠিকভাবে শুনে মন্তব্য করি। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে আমাদের এই সম্ভাবনাময় শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

লেখক: উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়


স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাজেট ভাবনা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ-২০৪১’ কর্মসূচির মাধ্যমে সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট ইকোনমি এই চারটি স্তম্ভ সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দিকে লক্ষ্য রেখে পথ চলছে আওয়ামী লীগ সরকার। প্রতি বছর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সেই লক্ষ্যকে কেন্দ্র করেই স্মার্ট বাজেট ঘোষণা করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আগামী জুনে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণে দ্বিতীয় বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে।

তথ্য বলছে, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে জাতীয় সংসদের বাজেটের আকার বেড়েছে। যা চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে সংশোধিত বাজেটের থেকে প্রায় ২৩ কোটি টাকা বেশি। সম্প্রতি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত সংসদ সচিবালয় কমিশনের বৈঠকে সংসদের পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে ৩৪৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা প্রস্তাবিত বাজেট অনুমোদন করেছে সংসদ সচিবালয় কমিশন। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটে পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে ৩২৪ কোটি ৬৭ লাখ ২১ হাজার টাকা বরাদ্দের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগামী ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জাতীয় বাজেট মহান জাতীয় সংসদে পেশ করবেন। এটি বাংলাদেশের ৫৩তম বাজেট হলেও বর্তমান সরকারের ২৫তম এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বাজেট ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অনুমোদিত এই সুষম বাজেট নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সুষম এই বাজেটের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ভিশন ও মিশন একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে সুষম বাজেট নিয়ে আমাদের কিছু প্রত্যাশা ও ভাবনার সুযোগ রয়েছে।

বাজেট নিয়ে ভাবনার শুরুতে বলতে গেলে, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই মুহূর্তে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটানোর কোনো বিকল্প নেই। এ সেক্টরে বাংলাদেশ যত বেশি সমৃদ্ধ হবে স্মার্ট বাংলাদেশের পথচলা তত বেশি এগিয়ে যাবে। উল্লেখ্য, সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপরেখা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বৈপ্লবিক ভূমিকা রেখেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের পর আমরা এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ রূপান্তরের পথে। আর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে তথ্যপ্রযুক্তি খাত। কোনোভাবে এই খাতে করারোপ করা হলে সেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এমন বিবেচনায় স্থানীয় সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবার প্রসার এবং সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ বৃদ্ধি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায়, আসন্ন বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে এই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করবে বলে প্রত্যাশা করছি।

পাশাপাশি, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দক্ষ জনশক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। যে দেশে জনশক্তি বেশি দক্ষ সে দেশ তত বেশি স্মার্ট। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের দক্ষ জনশক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। তাই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির বিষয়টি সামনে রেখে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে স্মার্ট ইকোনমির ধারণা বর্তমানে একটি পরিজ্ঞাত বিষয়। তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জনবহুল বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে প্রযুক্তির মাধ্যমেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইনে মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন প্রভৃতি এখন বেশ জনপ্রিয়। আসন্ন বাজেটে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিষয়টি অধিক গুরুত্ব পাবে বলে মনে করছি।

এ ছাড়া এমন এক পরিস্থিতিতে এই বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে যখন সারা বিশ্বই এক ধরনের মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে খাদ্যসংকটের মতো পরিস্থিতি চলছে। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা আমাদের দেশেও আঘাত করেছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও ভালো নয়। তবে বেকারত্ব এবং এর থেকে সৃষ্ট সমস্যাসমূহ বিদ্যমান। অর্থনৈতিক ক্ষতি, সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা এবং এর পরপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে দ্রব্যমূল্যের বাজারে উত্তাপ এবং এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। এর সঙ্গে রয়েছে বেকারত্ব দূরীকরণের উদ্যোগ হিসেবে চাকরির বাজার সৃষ্টি, শিক্ষায় অগ্রগতি বিশেষত নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা, ইত্যাদি। তার সঙ্গে রয়েছে আইএমএফের শর্ত মেনে চলা, রিজার্ভ শক্তিশালী করা এবং ডলার সংকটের বিষয়গুলো। মানুষের জীবিকায় ফেলেছে মারাত্মক প্রভাব। শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য বারবার স্থবির হয়েছে। শিক্ষিত বেকারদের জন্য কর্ম পরিকল্পনা এবং বরাদ্দ প্রয়োজন। সুতরাং এই ক্ষেত্রে এবারের বাজেট গতবারের থেকেও চ্যালেঞ্জিং। একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গে দেশের অর্থনীতি উন্নয়নের গতি ধরে রাখা এবং জীবনযাত্রার ওপর ব্যয়ের চাপ কমানো নিঃসন্দেহে আসন্ন বাজেটের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ হবে। কেননা মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষকে মুদ্রাস্ফীতির থাবা থেকে মুক্ত করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আসন্ন বাজেটে মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।

পাশাপাশি আশা করা যাচ্ছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবারের মতো এবারও একটা বড় চমক থাকতে যাচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ভূমিকা অপরিসীম। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গত ১৫ বছরে সারা দেশে হাজার নতুন রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু এবং হাইওয়ের নির্মাণ কাজ হওয়ার মাধ্যমে ব্যাপক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। আশা করা হচ্ছে- ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের এই ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আসন্ন বাজেটে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট নাগরিকদের নিয়ে একটি ক্ষুধামুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চায়। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে বাজেটে তাদের জন্য বরাদ্দ আরও বাড়াবে বলে প্রত্যাশা করছি।

আসন্ন বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করবেন বলে আশা করছি। বাংলাদেশের ৫৩তম আসন্ন এই বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে তাতে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ। তবে এখন আমাদের কাঙ্ক্ষিত সৃজনশীল জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল অর্থনীতির প্রাথমিক বিকাশ ঘটাতে সুষম এই বাজেটের সুষমও ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং উচ্চশিক্ষার পাঠ্যক্রম-পাঠদানসহ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী করতে বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকা ও তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কারণ স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করতে হবে আগে। আসন্ন বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রেখে ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করে বিদেশে পাঠাতে পারলে প্রচুর ফরেন কারেন্সিও পাওয়া যাবে।

উল্লেখ্য, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সাফল্যের ওপর ভর করেই দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিল সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘোষণা। ঠিক একইভাবে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণাও ইতোমধ্যে মানুষের মনে শুধু আলোড়ন সৃষ্টিই করেনি বরং সঙ্গে নব আশার সঞ্চার করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ কতটা আধুনিক একটি কর্মসূচি তা এর চার স্তম্ভের লক্ষ্য থেকেই বোঝা যায়। সম্পূর্ণ পরিকল্পনা শর্টটার্ম, মিডটার্ম এবং লংটার্ম টাইমফ্রেমে সাজানো হয়েছে। স্মার্ট সিটিজেন হবেন বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক এবং সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী মানসিকতাসম্পন্ন নাগরিক। প্রত্যেক নাগরিকের প্রযুক্তিতে অভিযোজন ও অভিগম্যতা নিশ্চিত করা হবে। স্মার্ট ইকোনমিতে গড়ে উঠবে ক্যাশলেস, সার্কুলার (বৃত্তাকার), উদ্যোক্তামুখী, গবেষণা ও উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি। আর্থিক লেনদেন হবে নগদবিহীন। পণ্যের পুনঃব্যবহার করে বৃত্তাকার অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে। ফলে শূন্য বর্জ্য উৎপাদন হবে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই), রোবটিক্স, ব্লকচেইন, ড্রোনসহ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অগ্রসর প্রযুক্তিনির্ভর গবেষণা ও উদ্ভাবনী সমাধান হবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি। স্মার্ট গভর্নমেন্ট হবে নাগরিককেন্দ্রিক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক। কাগজবিহীন, উপাত্তনির্ভর, আন্তঃসংযুক্ত, আন্তঃচালিত, সমন্বিত, স্বয়ংক্রিয়। যোগাযোগে কাগজের ব্যবহার হবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে। অগ্রসর প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহন, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, বিচারব্যবস্থার মতো জরুরি খাতগুলো পরিচালিত হবে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে। স্মার্ট সোসাইটি নিশ্চিত করবে বৈষম্যমুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক এক সমাজব্যবস্থা। সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ সহনশীল সমাজ, যা হবে নিরাপদ ও টেকসই। আর্থিকসহ সব ধরনের সেবায় নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা হবে। এ সবকিছুর মূল চালিকাশক্তি হবে বাংলাদেশের এই আসন্ন বাজেট। এই বাজেট যত স্মার্টলি ডিজাইন করা হবে, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ ততই ত্বরান্বিত হবে। ফলে অচিরেই বাস্তবায়িত হবে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা।

লেখক:উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

ট্রিলিয়নিয়ার এবং বৈষম্যের হট চেয়ার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সুধীর সাহা

অষ্টাদশ-উনবিংশ শতকের জন জেকব অ্যাস্টর পশম, ভূসম্পত্তি এবং আফিম পাচারকারী এক জার্মান-আমেরিকান ব্যবসায়ী হয়েছিলেন আমেরিকার প্রথম মিলিয়নিয়ার বা দশ লাখ ডলারের মালিক। এক শতাব্দী পর ১৯১৬ সালে পৃথিবীর প্রথম বিলিয়নিয়ার অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের মালিক হয়েছিলেন আমেরিকার জন ডি রকফেলার। এরও ৮৩ বছর পর আমেরিকার বিল গেটস মালিক হন ১০০ বিলিয়ন ডলারের। ২০২৩ সালের ফোবর্সের তালিকায় পৃথিবীতে মোট বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৪০ জন। ২০২৪ সালে এসে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৮১ জনে। এখন বিলিয়নিয়ারদের মধ্যে লড়াই হচ্ছে- কে হবেন আগামী পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার। ১-এর পিঠে মোট ১২টা শূন্য বসাতে হয় এক ট্রিলিয়ন অর্থাৎ এক লাখ কোটি ডলার লিখতে। কে হবেন ট্রিলিয়নিয়ার- হট সিটে বসবেন কোন ট্রিলিয়নিয়ার আগামীর গেম শোতে? শুরু হয়ে গিয়েছে প্রতিযোগিতার গেম শো। এখন শুধু অপেক্ষার পালা- এ গ্রহের প্রথম লাখো কোটিপতি দেখার।

পৃথিবীর মাত্র ১৯টা দেশের জিডিপি এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাকি সব দেশের জিডিপি এক ট্রিলিয়ন ডলারের নিচে। ভাবতে পারেন, তা কত টাকা? হাজার ডলারের নোটের পাঁজা সাজিয়ে দিলে এক ট্রিলিয়ন থেকে ৬৭ মাইল উঁচু হবে সেই পাঁজা। কে হবেন সেই ভাগ্যবান। পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার অর্থাৎ লাখো কোটিপতি? সাম্প্রতিককালের অতি ধনীদের অনেকেই অমিত সম্পদশালী হয়েছেন জ্ঞান, ধারণা, অনুমান, ঝুঁকি এবং বিনিয়োগকে সম্বল করে। ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সৃজনশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপ্লব এবং এআই-এর বিজয়কেতন। গোড়ায় অনেকেরই ধারণা ছিল, পৃথিবীর প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হবেন বিল গেটস। পরবর্তীতে সেই জায়গা করে নিলেন অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস। তারপর আসরে প্রবলভাবে অবতীর্ণ হন টেসলার সিইও ইলন মাস্ক। ২০১৯ সাল থেকে ইলন মাস্কের নিজস্ব সম্পদ বেড়েছে গড়ে বছরে ১৬২ ভাগ। ট্রিলিয়নিয়ার কে হবেন- এ নিয়ে গবেষণা চলছে এবং কেউ কেউ ভবিষ্যদ্বাণীও করে রেখেছেন। ২০১৭ সালে আমেরিকান বিলিয়নিয়ার মার্ক কিউবান ভবিষ্যদ্বাণী করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা কোনো উদ্যোগপতিই হবেন দুনিয়ার প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার। ২০২১ সালে মর্গান স্ট্যানলির বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, ইতিহাসের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হতে চলেছেন ইলন মাস্ক। ‘ট্রিপল টি অ্যাপ্রুভ’ নামক সংস্থার ২০২২-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়, দুনিয়ার যে ২১ জনের ট্রিলিয়নিয়ার ক্লাবের সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাদের মধ্যে অগ্রণী হলেন ইলন মাস্ক। তাদের সমীক্ষা অনুযায়ী, সম্ভাব্য তালিকার এই ২১ জনের মধ্যে আমাদের পাশের দেশ ভারতের গৌতম আদানি, মুকেশ আম্বানি এবং চীনের ঝ্যাং ইয়িমিংয়ের নামও বিদ্যমান। অক্সফামের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট অনুমান করেছে, অতি ধনীদের আলিবাবার রত্নগুহা ফুলে-ফেঁপে ওঠার হার যদি এভাবে অক্ষুণ্ন থাকে, তবে এক দশকের মধ্যেই তৈরি হবে পৃথিবীর আগামী ট্রিলিয়নিয়ার।

ধনীদের এহেন গল্পের হাত ধরেই দুনিয়ার অসাম্য বাড়ছে। ধনীদের গেম শোতে খেলতে থাকা এই খেলোয়ারদের নিশ্চিতভাবে রয়েছে কয়েকখানা ‘লাইফলাইন’Ñ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অতিমারি, যুদ্ধÑযা অতি ধনীদের সঙ্গে বাকিদের ফারাক বাড়াতেই থাকছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতের অসাম্যের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে অর্থনীতিবিদ তোমা পিকেটি এবং তার সহগবেষক নীতিন ভারতী, লুকাস চ্যান্সেল এবং আনমোল সোমাঞ্চির সাম্প্রতিক গবেষণাপত্র থেকে। তারা দেখিয়েছেন, ২০২২-২৩ সালে আয়ের নিরিখে জনসংখ্যার ধনীতম এক শতাংশ মোট আয়ের ২৩% অর্জন করেছেন। বিত্তের হিসাবে ধনীতম এক শতাংশ দেশের মোট সম্পদের ৪০%-এর মালিক। চিত্রটি শুধু ভারতের একার নয়। একই চিত্র দেখা যাবে পৃথিবীর অন্য দেশেরও; এমনকি বাংলাদেশের জন্যও চিত্রটি একই হবে। গবেষণার অভাবে এমন চিত্র প্রকাশ না হলেও প্রকৃত অর্থে অসাম্যের মাত্রা বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সর্বাধিক। অসাম্যের বিতর্কে সাধারণভাবে তিন ধারাকে চিহ্নিত করা হয়- নীতিগত, চরিত্রগত এবং ব্যবহারিক কৌশলগত। অসাম্য কি রাষ্ট্র মেনে নেবে- অবাঞ্চিত করবে, না আংশিকভাবে সহনীয় করে তুলবে? এটিই নীতিগত বড় প্রশ্ন রাষ্ট্রের সামনে। এরপর প্রশ্ন উঠতে পারে অসাম্যের চরিত্র নিয়ে। অসাম্য কি সুযোগের, না ফলাফলের? প্রশ্ন থাকে, রাজনৈতিকভাবে যারা সুযোগ পাচ্ছেন, তারাই কি সবচেয়ে যোগ্য, সবচেয়ে দক্ষ, সবচেয়ে প্রতিভাবান? দারিদ্র্যের কারণে কি কারও মেধা বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে যায়? অথবা গুণহীন কেউ বিত্তবান হওয়ার কারণে কোনো পেশা বা ক্ষমতাশীল আসনের সর্বোচ্চ স্তরে উঠে যায়? যদি মেনেও নিই, খানিকটা অসাম্য অনিবার্য অথবা অসাম্যের সমস্যাটি গুরুত্বপূর্ণ, তাহলেও এ নিয়ে কী করা যায় সেটাই ব্যবহারিক কৌশলের প্রশ্ন। তবে এ নিয়ে বিতর্ক থেকেই যায়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য হ্রাসের সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্যদিকে, এর ফলে অসাম্যের প্রসারও বৃদ্ধি পায়। কেননা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক সুযোগের যে প্রসার হয়, তার সদ্ব্যবহার করার ক্ষমতা বিত্তবান শ্রেণির বেশি। তাই বৃদ্ধির হাত ধরে অসাম্যও ঘরে ঢুকে বসে। সেখানেই প্রশ্ন থাকবে বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার ওপর। বৃদ্ধির প্রক্রিয়া যদি সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে (যাকে চিহ্নিত করা যায় সর্বজনীন বৃদ্ধি হিসাবে), তাহলে অসাম্যের ধারাল ছুরির আঘাত থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।

ধনীরা সব দেশেই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং নানাভাবে সরকারি নীতির ওপর নিজেদের সুবিধার্থে প্রত্যক্ষ প্রভাব বিস্তার করেন। ধনীদের অস্বীকার করা কিংবা উপেক্ষা করা কোনো দেশের সরকারেরই সম্ভব হয়ে ওঠে না, তা সে আমেরিকাই হোক কিংবা বাংলাদেশই হোক।

লেখক: কলামস্টি


বাজেট যখন জীবন ও জীবিকার

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সবাই উদ্গ্রীব এখন জাতীয় বাজেটের জন্য। প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকার বাজেট জাতীয় বাজেটের থেকে আলাদা কিছু কি না। এ প্রশ্ন ওঠাও স্বাভাবিক যে জাতীয় বাজেটের মধ্যে করোনা মোকাবিলার মতো, অর্থনীতি গণস্বাস্থ্য জন-শিক্ষা পুনরুদ্ধারের মতো জরুরি বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে কি না, প্রশ্ন এ কারণেও উঠতে পারে যে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রয়োজনীয় খাতে (এ মুহূর্তে যেমন জীবন ও জীবিকা) যথাযথ (ব্যয় সাশ্রয়ী, অর্থায়ন আয় বৃদ্ধি ও কৃচ্ছ্রসাধন অর্থে ব্যয় সংকোচন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, সরকারি-বেসরকারি খাত দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায়) ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, নতুন বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সবাই পরামর্শ দেন, সুপারিশ করেন দাবি তোলেন; কিন্তু সেই বরাদ্দের বিপরীতে অর্থায়ন ও লক্ষ্যভেদি বাস্তবায়নের পরিস্থিতি, সেই ব্যয়ের তাৎক্ষণিক, স্বল্প মধ্য দীর্ঘমেয়াদি ইমপ্যাক্ট ও অভিঘাত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার অবকাশ বরাবরই হালে পানি পায় না। সাধারণ সময়ে সেই অবকাশ কমবেশি দেরিতে মিললেও করোনা মোকাবিলার মতো জরুরি সময়ে বরাদ্দ ব্যবহার এবং কর্মপরিকল্পনা প্রয়োগও জরুরি এ কারণে যে ‘রোগী মারা যাবার পর চিকিৎসকের উপস্থিতির’ মতো পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না হয়।

জীবন ও জীবিকার জন্য বাজেটকে জাতীয় বাজেট থেকে আলাদা অলিন্দে নয়, একীভূত হিসেবে দেখাই জরুরি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি খাতে অগ্রাধিকার ঘোষণা এবং বরাদ্দ বাড়ালেই বাজেট জনগণের বাজেট বা ইতিবাচক হয় না, স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ালেই মহামারি মোকাবিলা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা অটোমেটিক্যালি বাড়ে না, যদি এই খাতের ব্যয়ের সক্ষমতা ও সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন বহাল থাকে, দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা-অপারগতায় আকীর্ণ থাকে এবং তা নিরসন নিয়ন্ত্রণে তথা জবাবদিহিকরণে ‘কথায় নয় কাজে’ অগ্রগতি না থাকে। বাজেটে বরাদ্দ বড় কথা নয়, অর্থনীতিতে সেই বরাদ্দের দ্বারা কতটা সম্পদ ও সেবা সৃষ্টি হলো, প্রভাব ফেলতে পারল সেটিই বড় কথা ।

করোনা সংকটে বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার মতো খাতগুলোকে অগ্রাধিকার প্রাপ্য। গত বছর (এখনো পর্যন্ত চলতি বাজেটবর্ষে) করোনা ও বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতির প্রভাবে বাজেট প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের গুরুত্ব আলোচিত হলেও, সেখানে বরাদ্দ নমিনাল টার্মে আপেক্ষিকভাবে কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও দেখা যায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষা, দক্ষ জনসম্পদ তৈরি, ফর্মাল ও ইনফর্মাল সেক্টরে কর্মসৃজনমূলক শিল্পোদ্যোগে কার্যকর পদক্ষেপের, বাস্তবায়নের খাতে বরাদ্দ সে হারে আরও বাড়ানো প্রয়োজন ছিল, যেভাবে বা হারে অন্য অনেক অগৌণ খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছিল সেভাবে বা হারে করোনা যে আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতি সাধন করেছে তা পুনরুদ্ধারে পরিপূরক ও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারত সেসব খাত যেমন- স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসংস্থান, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাড়েনি। তথাপি এবং তদুপরি সেই বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টন ও ব্যবহার বা বাস্তবায়নের হিসাব মেলানোর সুযোগ সীমিত। করোনাকালে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ শিক্ষাকার্যক্রমবিহীন (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। বিদ্যমান ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে মহানগর ও শহরে বিকল্প (অনলাইনভিত্তিক) শিক্ষা কার্যক্রম কিছুটা চললেও, ব্যাপক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের পাঠবিমুখ করা হয়েছে। টেবিল-চেয়ার পাহারা আর দায়-দায়িত্ব কর্মহীন শিক্ষকের পিছনে এবং বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণে ব্যবহৃত হয়েছে সিংহভাগ বরাদ্দ। অগৌণে শিক্ষা খাতের দিকে দৃষ্টি না দিলে শিক্ষায় বা সমাজে যে ক্ষরণ ও ক্ষত সৃষ্টি হবে তা হবে করোনার সেরা অভিঘাত। জাতীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন ক্ষেত্রে এ ধরনের বৈষম্য যত বাড়বে তত জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস মাঠে মারা যাবে। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা কিংবা বিকল্প শিক্ষা কার্যক্রম স্থানীয়ভাবেই সাময়িকভাবে হলেও চালু রাখার যৌক্তিকতাকে মাথায় নিতে হবে। ‘অটো’ পাশের মতো আত্মঘাতী পদক্ষেপে যাওয়া থেকে দূরে থাকা হবে জাতীয় কাণ্ডজ্ঞানে দায়িত্বশীলতার পরিচয়। জীবন-জীবিকার বাজেটে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ অর্থনীতির প্রাণ বায়ু কৃষি খাতে কৃষির উৎপাদন কৃষি তথা সামগ্রিকভাবে কৃষি খাতের উন্নতি একটি সম্মিলিত প্রয়াস। যেখানে কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষক ও কৃষি উপকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রাইভেট সেক্টর, আমিষ, শর্করা সরবরাহকারীরাও সরাসরি জড়িত। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি/প্রণোদনা যেন যথাযথভাবে এবং যথাসময়ে সত্যিকার প্রান্তিক চাষিরা, খামারিরা পান। নতুন নতুন উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে বাংলাদেশে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান কম নয়। সে জন্য পাবলিক সেক্টরের পাশাপাশি প্রাইভেট সেক্টরেও বাজেট বরাদ্দ থাকা উচিত। রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈবসারে মাটির স্বাস্থ্য ভালো করে বিধায় রাসায়নিক সারের মতো বাজেটে জৈবসার উৎপাদনে ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। প্রান্তিক চাষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তা,খামারি, মাছ চাষির কাছে স্টিমুলাস প্যাকেজের টাকা পৌঁছায়নি। ব্যাংক বা আর্থিক খাতে বিশাল ব্যাধির সুচিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। ধনী আরও ধনী হওয়ার সহজ সুযোগে আয়-বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অন্তর্ভুক্তির নামে বিচ্ছিন্নতাই বাড়তে থাকলে ‘কাউকে পেছনে ফেলা যাবেনা’ এস ডিজি গোল অর্জনের এ মর্মবাণী সকরুণ ব্যর্থতার বিবরে উন্নয়নশীল অর্থনীতির কপোলে কালো তিলক আঁকতেই থাকবে।

এই মুহূর্তে করোনা মোকাবিলায় দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে চলমান ও টেকসই রাখতে সুপরিকল্পিত ও সম্প্রসারণধর্মী বাজেটের কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার, বাজেট বাস্তবায়নে যথাযথ পরিবীক্ষণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ধর্মী যোগাযোগ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমঝোতা বৃদ্ধি, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি, সবার সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করতে পারলে করোনাকালেও দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বৈকি। করোনাকাল সহসা চলে যাবে এমন ধারণায় চলতি বাজেট করা হয়েছিল, করোনা এখনো যায়নি, জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ দ্বিতীয় ধাক্কা আসার আগে নিজের থেকে ছোটাছুটি করছে এটাকে স্বস্তির ও আত্মতৃপ্তির বিষয় ভাবা সমীচীন হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ২০২১ সালেও করোনার অভিঘাত অব্যাহত থাকবে এটা মনে রেখে বাজেটে পরিকল্পনা আটতে হবে। ব্যয় কৃচ্ছ্রসাধনে ঢিলেমি কিংবা যেকোনো প্রসঙ্গ পলায়নি মনোভাব, দোষারোপ হবে অবিবেচকের কাজ।

এখন জ্বলন্ত ইস্যু হচ্ছে করোনাভাইরাস। জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন প্রথম, দ্বিতীয় ইস্যু হচ্ছে জীবিকা। তৃতীয় এবং অন্যতম ইস্যু সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত দুর্নীতি দমন। অভ্যন্তরীণ বাজার ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। এটা এখন এক নতুন বাংলাদেশ। আগের অবস্থা আর ফিরে আসবে না। নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমস্যা, নতুন সম্ভাবনা। অর্থনীতির কাঠামো পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। মোদ্দা কথা, অর্থনীতিতে রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার এবং মানবদেহে ইমিউন পাওয়ার বাড়াতে হবে। সামনের চ্যালেঞ্জগুলো যেমন- ব্যয়ের বাজেটে অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ (রাজস্ব আয়) সম্পদের অপ্রতুলতা, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে দৃশ্যত স্থবিরতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অনুপস্থিতির আড়ালে, দুর্নীতিগ্রস্ততায় অর্থনীতিতে ক্ষরণ, কস্ট অব ডুয়িং বিজিনেসের ঊর্ধ্বগামিতা, মেগা প্রকল্পে ব্যয় সাশ্রয়ী হওয়ার পরিবর্তে ব্যয় বৃদ্ধি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ সূত্রতা, করোনাকালে কিংবা করোনা-উত্তর অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রসাধন ও ব্যয় সংকোচনের দারি ও যৌক্তিকতা অনুসরণে অপারগ পরিস্থিতি ও পরিবেশ, বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, প্রবাসীদের দেশে ফেরা, রপ্তানি বাজার সংকুচিত হওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন হেতু বন্যা, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ে কৃষি উৎপাদন ও জানমালের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বহির্মুখীন খাত ও ক্ষেত্রগুলো সংকুচিত হওয়া।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আপাতত রাজস্ব আহরণ খাতে চলমান সংস্কার ও অনলাইনিকরণ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত ও সময়সূচিভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা। বিদ্যমান আইনের সংস্কার এবং অনলাইনিকরণ ব্যতিরেকে বিদ্যমান কর্মকাঠামো ও লোকবল দিয়ে রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতি ও পরিবেশের উন্নয়ন সাধন সম্ভব ও সমীচীন হবে না। করদাতা এবং কর আহরণকারী দপ্তরের মধ্যে রাজস্ব আহরণবিষয়ক জটিলতা সমস্যা আপিল আবেদন নিষ্পত্তি উপরিদর্শনের মাধ্যমে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কর ন্যায়পাল অফিস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অচল অর্থনীতিকে সচল রাখার, বেকার ও ক্ষুধা রোখার, করোনায় ক্ষতি পুনরুদ্ধার ও পুনর্বাসন, করোনা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি সৃষ্ট মন্দা মোকাবিলা এবং সম্ভাব্য সুযোগের (কৃষি, স্বাস্থ্যখাত, আইটি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার খাতে অধিক মনোযোগ ও দক্ষ জনবল সৃষ্টিসহ বিদেশফেরত বিদেশি বিনিয়োগ ঘরে আনা) সদ্ব্যবহার ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি মোকাবিলার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ, কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দিক-নির্দেশনা ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে বাজেটে আয়-ব্যয় বণ্টনে, কৌশল নির্ধারণে তার প্রতিফলন থাকতে হবে।

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, এন বি আরের সাবেক চেয়ারম্যান

বিষয়:

মূল্যস্ফীতির চাপে অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রজত রায়

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর সারা বিশ্বে যখন মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল, তখন প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকই সুদহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। এতে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই সফল হয়। তবে বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির দেখা মিললেও বাংলাদেশ ব্যাংক তখন কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। প্রায় সব দেশ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেতে শুরু করে, তখনো বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষায় আমদানি সীমিত করে আনে। এতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘ সময় ধরে বহাল রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি হলো দামের ধারাবাহিক বৃদ্ধি। কোনো একটি বা দুটি পণ্যের নয়, একজন গড় ক্রেতার প্রয়োজন, এমন সব পণ্যের সম্মিলিত ‘বাস্কেট’-এর দামের বৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতি সমস্যা তৈরি করে। মূল্যস্ফীতির ফলে প্রতিদিনের কেনাকাটার খরচ বাড়ে। সাধারণত বাজারে মূল্যস্ফীতি ঘটলে চাকরিদাতা সংস্থা কর্মীদের বেতন বাড়ায়, যাতে এই বাড়তি দামের কারণে বেড়ে যাওয়া খরচ সামলানো যায়; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বেতন যতটুকু আর যতটুকু বাড়ল, তা মূল্যস্ফীতির বোঝা সামলানোর জন্য যথেষ্ট নয়। অনেকের ক্ষেত্রে তো বেতন আদৌ বাড়ে না- দুর্ভাগ্যক্রমে, দরিদ্রতম শ্রমিকরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই দলে থাকেন। ফলে মূল্যস্ফীতি হলে গরিব মানুষের পক্ষে খাবারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনাও কঠিনতর হয়। অন্য ভাষায় বললে, মূল্যস্ফীতি নীরবে গরিব মানুষের টাকা লুট করে। তাই মূল্যস্ফীতিকে প্রায়ই একটি কর হিসাবে দেখা হয়।

মূল্যস্ফীতির ফলে কি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিপাকে পড়ে? হ্যাঁ, মূল্যস্ফীতির ফলে ব্যবসাও সমস্যায় পড়ে। ধরা যাক, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ঘটল কাজেই, খাবার কিনতে হলে একটা মাঝারি আর্থিক সামর্থ্যসম্পন্ন পরিবারকে অন্য কোনো খাতে খরচ কমাতে হবে। আবার বেশি অপরিহার্য নয়, এমন জিনিস কেনাকাটায় কাঁটছাট করতে হয়। যেমন- প্রসাধনী সামগ্রীগুলো শ্যাম্পু বা সাবান ফলে, এজাতীয় কোম্পানিগুলো বিপাকে পড়ে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) তথ্য মোতাবেক, এপ্রিল-২০২৪ গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ বলতে বোঝায় ২০২৩ সালের এপ্রিলে যে পণ্য ১০০ টাকায় কেনা সম্ভব হয়েছিল ২০২৪ সালের এপ্রিলে তা কিনতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সায়।

সূত্র মতে, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। তবে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা তার ধারে-কাছেও রাখা সম্ভব হচ্ছে না। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। গত এপ্রিল মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ উঠেছে। তবে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষ বেশি চাপে আছে। একই সঙ্গে যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেভাবে মানুষের আয় বাড়েনি। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ঘটে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক ও মূল্য হ্রাসের কারণে অনেক দেশে পর্যায়ক্রমে নেমে আসে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি উল্টো আরও বাড়তে থাকে।

আমাদের মূল্যস্ফীতি তা হলে কিসের ওপর নির্ভর করে? আমাদের মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে আংশিক আন্তর্জাতিক মূল্যও আংশিক অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর। গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে, ওই সময় দেশেও বেড়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক কমলেও আমাদের মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। ফলে বিশ্ববাজারে দাম কমলেই দেশে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মূল্যস্ফীতি কমবে সেটি ধরে নেওয়া যায় না। এখন আমরা কতটা পণ্য আমদানি করতে পারছি, ডলারের মজুত কেমন, ঘাটতি বাজেটের জন্য কতটা টাকা প্রয়োজন, মুদ্রানীতি সংকোচন না সম্প্রসারণ দেওয়া হচ্ছে রাজস্বনীতি এসবের ওপর নির্ভর করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

মূল্যস্ফীতির ফলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা কঠিনতর হয়। এটা শুধু যে গৃহস্থালির ক্ষেত্রে সত্যি তা নয়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সত্যি। ধরা যাক, কোনো পরিবার তাদের মাসিক আয় থেকে পরিকল্পনামাফিক টাকা জমাচ্ছেন, যাতে চাকরি অবসরের পর সংসার চালানোর জন্য হাতে যথেষ্ট টাকা থাকে। যেকোনো পরিবার এ ধরনের সঞ্চয় করে থাকতে পারে এবং তারা এটাও বোঝেন, আজ সংসার চালাতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হচ্ছে ১০ বা ১৫ বছর পর জীবনযাত্রার চলমান মান বজায় রাখতে হলে অনেক বেশি টাকার প্রয়োজন হবে। ফলে তারা মূল্যস্ফীতির একটি নির্দিষ্ট হার ধরে নিয়েই টাকা জমানোর পরিকল্পনা করেন; কিন্তু খুব বেশি হারে মূল্যস্ফীতি ঘটতে থাকলে হিসাব গুলিয়ে যায়। ফলে অবসর গ্রহণের সময় তিনি যদি একটি বাড়ি বা গাড়ি কেনার কথা ভাবেন তখন এই অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির ফলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। ঠিক তেমনিভাবে কোনো সংস্থা যদি আজ একটি কারখানা বা বিমানবন্দর তৈরি করার কথা ভাবে তাহলে তাদের হিসাব করতে হয়, আগামী এক-দুই দশকে সেই বিনিয়োগ থেকে কী রকম টাকা আয় করা যেতে পারে এবং কত খরচ হতে পারে। মূল্যস্ফীতির হার যদি স্থিতিশীল না হয়, তবে সেই হিসাব করা মুশকিল হবে। যদি চড়া হারে বা এলোপাতাড়ি মূল্যস্ফীতি ঘটতে থাকে, তবে কোনো সংস্থার পক্ষে এই হিসাব করা কঠিন হবে। ফলে তারা সাবধান হয়ে বিনিয়োগ থেকে হাত গুটিয়ে নিতে পারে। তেমনটা হলে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষতি হয়।

গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়ায় তা বাড়ছে। এটা মূল্যস্ফীতি কমাতে ভূমিকা রাখবে, তবে তা সময় সাপেক্ষ। একদিকে সুদের হার যদি বাড়ে, আরেক দিকে মার্কিন ডলারের দামও বাড়তে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে না। কারণ ডলারের দাম বাড়লে পণ্য ও কাঁচামালের আমদানি ব্যয় বাড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভোক্তার চাহিদা হ্রাসের লক্ষ্যে নীতিসুদহার বাড়ানো ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সুদের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে ৯ শতাংশ সুদহারের ক্যাপ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে ব্যাংকের তারল্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করেছে। ফলে বাজারে ভোক্তার চাহিদা হ্রাস পাবে এবং মূল্যস্ফীতি কমাতে সহায়ক হবে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আওতায় সরকারের উন্নয়ন খাতে ঋণ বন্ধ রেখেছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংকগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করছে। মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার অন্য কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের চড়া দাম। চীনের নির্মাণ ক্ষেত্র ফের চাঙ্গা হয়েছে এবং এর ফলে অপরিশোধিত তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। পশ্চিম এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক সংকটের ফলে তা আরও বাড়ার আশঙ্কা।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ শুধু সুদহার বাড়ানোই নয়, নিত্যপণ্যের বাজারে অব্যাহত নজরদারি রাখা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ। দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুগান্তকারী উদাহরণ তৈরি করেছিল শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মূল্যস্ফীতি যখন ৮০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, তখন সুদহার বাড়িয়েই বসে থাকেনি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। খুচরা বাজার থেকে শুরু করে পাইকারি বাজারের প্রত্যেকটি পণ্যে নজরদারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। প্রতিদিনের পণ্যমূল্যের তথ্য শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা হতো।

মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯-২০২১ সাল পর্যন্ত দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ; কিন্তু চলতি বছরে প্রতি মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে বিরাজ করছে। কোভিড মহামারির পর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকলে এর প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অর্থনৈতিক কারণগুলো রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক


banner close