বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন ২০২৪

পহেলা বৈশাখ: বাঙালির সর্বজনীন উৎসব 

আপডেটেড
১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ১২:৪৪
সৈয়দ আফজাল হোসেন 
প্রকাশিত
সৈয়দ আফজাল হোসেন 
প্রকাশিত : ১৬ এপ্রিল, ২০২৪ ১২:৪১

পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ হচ্ছে বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। পুরোনো বছরের যা কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, যা কিছু ব্যর্থতা, যা কিছু গ্লানি সব ভুলে গিয়ে মনে স্পন্দন জাগানিয়া নতুন আশা ও নতুন সম্ভাবনার রঙিন স্বপ্নকে আলিঙ্গনের নব প্রত্যয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় পুরো জাতি।

আগের দিন সন্ধ্যায় গেল বছরের শেষ সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর এ ধরায় যে আঁধার নেমে এসেছিল, তা কাটিয়ে পহেলা বৈশাখ ভোরে নতুন বছরের নতুন সূর্য নব নব আশার আলো নিয়ে পুবাকাশে উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনন্দে উদ্বেলিত বাঙালি জাতি সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গান, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বছরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক’।

কবিগুরুর কালজয়ী এ গানের কথার মতোই নতুন বছরের আগমনে শান্তি ও সাফল্যের প্রত্যাশা জাগ্রত হয় সবার মনে, নতুন আলোর ঝিলিক দ্যুতি ছড়ায় সকল প্রাণে। বুকভরা আশা, চোখভরা স্বপ্ন আর বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে তারা নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।

নতুন বছরে সকল শান্তিপ্রিয় মানুষের চাওয়া- মানবমনের আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজের সব অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য, শঠতা-অসততা, ঘুষ-দুর্নীতি, সম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার অবসান হোক। সুনীতি, সুশিক্ষা, সুশাসন, সুচিন্তা ও সুবুদ্ধি বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত হোক সর্বত্র। নতুন সূর্যের স্নিগ্ধ আলোয় স্নাত হয়ে সবার হৃদয়ে মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। বিশ্বব্যাপী দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বন্ধ হোক, বন্ধ হোক প্রাণঘাতী যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, মানবাত্মা মুক্তি পাক, বিশ্বমানবতার জয় হোক!

আমরা জানি, সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। কেননা ঘড়ির কাঁটা তার আপন নিয়মেই অনবরত ঘুরতে থাকে এবং সেই সঙ্গে কালের আবর্তে বিলীন হয়ে যায় একেকটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা। এমনি করেই দিন-মাস-বছর চলে যায়। আবার এই অতীতকে ছাপিয়ে ফিরে আসে নতুন দিন-মাস-বছর। এভাবে প্রকৃতির চিরায়ত নিয়মেই মানুষ এক সময় পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিদায় নিল একটি বছর, শুভাগমন ঘটল আরেকটি নতুন বছরের। বিদায় বাংলা ১৪৩০, সুস্বাগতম ১৪৩১!

ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি জাতীয়জীবনেও বিদায়ী বছরে রয়েছে যেমন অনেক অর্জন আর প্রাপ্তির সুখ, তেমনি আবার রয়েছে কিছু কিছু ব্যর্থতা-হতাশা আর অপ্রাপ্তির বেদনা। আর এই অতীতে ঘটে যাওয়া নানা অম্ল-মধুর ঘটনা মানুষের মনে বেদনাবিধুর কিংবা সুখজাগানিয়া স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। বিদায়ী বছরের সব দুঃখ-বেদনা, হতাশা-গ্লানি ভুলে প্রাণে নতুন নতুন স্বপ্ন-আশা নিয়ে শুরু হয় নতুন বছরে নতুন করে পথ চলা। অতীতকে মুছে ফেলে নয়, অতীত স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে নতুন দিন-ক্ষণ-সময়ের সঙ্গে পথ চলাই জীবনের নিয়ম।

পহেলা বৈশাখের উৎসবের উচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা বাঙালি জাতি সেদিন নতুন সূর্যের বিশুদ্ধ আলোয় আমোদে মেতে ওঠে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সের মানুষ নানা আনন্দ-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহাড়ম্বরের সঙ্গে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।

পহেলা বৈশাখ হচ্ছে বাঙালির সর্ববৃহৎ সর্বজনীন উৎসব। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ এ উৎসবে শামিল হয়ে এক সুরে গেয়ে ওঠে জীবনের জয়গান। যেখানে নেই কোনো ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ কিংবা ধনী-গরিবের বৈষম্য।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, ত্রিপুরাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রত্যেকটি বাঙালির কাছেই নববর্ষ একটি বিশেষ উদ্‌যাপনের দিন।

মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজনা বা রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে জমিতে ফসল উৎপাদনের ঋতুচক্রের ওপর ভিত্তি করে ইংরেজি ১৫৫৬ সালে বাংলা সালের প্রবর্তন করা হয়। তবে এর গণনাটা ১ সাল থেকে শুরু হয়নি। তৎকালীন ভারতবর্ষে হিজরি সালের ব্যাপক প্রচলন ছিল। ওই বছর ছিল হিজরি ৯৬৩ সাল। তাই হিজরি বছরটিকে ঠিক রেখেই অর্থাৎ হিজরি ৯৬৩ সালকে বাংলা ৯৬৩ সাল ধরেই প্রথমবারের মতো বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করা হয়। আর বৈশাখ নামটি নেওয়া হয় নক্ষত্র ‘বিশাখা’ থেকে। সম্রাটের নির্দেশে এ কাজটি সম্পন্ন করেন সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞ ফতেহউল্লাহ সিরাজী।

পহেলা বৈশাখের দিনে উৎসবের শুরুটাও হয় সম্রাট আকবরের আমলেই। তার পৃষ্ঠপোষকতায় খুবই জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপিত হতো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ দিন তিনি প্রজাদের সঙ্গে মিলিত হতেন। সবার শুভ কামনা করে চারদিকে মিষ্টি বিতরণ করা হতো।

দিবসটি উপলক্ষে এক সময়ে দেশের ব্যবসায়ী মহলে ‘হালখাতা’ অনুষ্ঠানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে নতুন একটি ‘লাল কভারের’ খাতায় হিসাব খুলে তারা নতুন উদ্যমে ব্যবসা শুরু করতেন। সেখানে অতীতের সব হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে হালখাতা থেকে নেওয়া হতো নতুন পরিকল্পনা।

বছরের শেষ দিনে বাকি/বকেয়া আদায় করে হালখাতা হালনাগাদ করা হতো। হালখাতার দিনে দোকানদাররা তাদের কাস্টমারদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এই প্রথাটি কমে গেলেও একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। বিশেষ করে মুদি ও স্বর্ণের দোকানে আজও এটি প্রচলিত আছে।

রাজধানীতে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে রমনার বটমূলে ছায়ানটের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। দেশের এই শীর্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠনটির শিল্পীরা সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে গান, কবিতাসহ নানা আয়োজনের মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।

উল্লেখ্য, তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে বিধিনিষেধ আরোপ এবং বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন নিষিদ্ধ করলে তার প্রতিবাদে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ, লালন ও চর্চা করার দৃপ্ত প্রত্যয়ে গড়ে ওঠা ‘ছায়ানট’ ১৯৬৭ সাল থেকে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে আসছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হওয়া ‘মঙ্গল শোভাযাত্রাও’ নববর্ষের একটি বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠান যেমন পরাধীনতার কালে এক দ্রোহ থেকে জন্ম নিয়েছিল, তেমনি ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রাও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিবাদ জানিয়ে শুরু হয়েছিল। ২০১৬ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা বা ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।

এ দিন রমনার বটমূল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলা একাডেমি, ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর এলাকাসহ রাজধানীজুড়েই সৃষ্টি হয় উৎসবের আমেজ। গান-কবিতায় মুখর হয়ে ওঠে এসব প্রাঙ্গণ।

এ ছাড়া প্রায় চার দশক ধরে পান্তা-ইলিশ পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষ উদ্‌যাপনের একটি বিশেষ অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যগত কোনো যোগসূত্র না থাকলেও সমসাময়িক সময়ে শহরের অধিকাংশ উচ্চবিত্ত/মধ্যবিত্ত মানুষ এটি বেশ সানন্দেই উপভোগ করছে।

প্রাণের টানে, নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির টানে বর্ষবরণে সর্বস্তরের মানুষ এমনকি বিলাসী নগরজীবনে অভ্যস্ত মানুষও বৈশাখের তীব্র দাবদাহ উপেক্ষা করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। নারীরা লাল-সাদা শাড়ি পরে বৈশাখী সাজে সেজে, পুরুষরা রং-বেরঙের পাঞ্জাবি-ফতুয়া পরে দল বেঁধে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করে। সমগ্র শহরময় মনে হয় প্রাণের জোয়ার নেমেছে। চারদিকে যেন উত্তাল-তরঙ্গের মতো তারুণ্যের উচ্ছ্বসিত বিচরণ।

রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি সব জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রামপর্যায় পর্যন্ত বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই নববর্ষ উদ্‌যাপন করা হয়। এক সময়ে গ্রামে গ্রামে মোরগ লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজনও করা হতো। যুগের পরিবর্তনে এগুলো এখন নেই বললেই চলে।

তবে গ্রাম-বাংলার মাঠে-ঘাটে-হাটে এখনো মেলার আয়োজন করা হয়। এসব গ্রাম্য মেলায় শিশু-কিশোররা নাগরদোলায় দোল খেয়ে, চরকিতে ঘুরে আনন্দ উপভোগ করে। এ ছাড়া বাঁশি বিক্রেতাদের বাঁশির সুরের মূর্ছনায় মুখরিত থাকে মেলা প্রাঙ্গণ।

বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে দেশজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, লোকগীতি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও বাউল গান পরিবেশিত হয়। এ ছাড়াও শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, গান, আবৃত্তি, সেমিনার, নাটক প্রদর্শনীসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক


কোরবানির পশুর হাট ও ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

মুসলিম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে রমজান এবং কোরবানি ঈদের মধ্যে কোরবানির ঈদকে বড় ঈদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কোরবানির ঈদকে বড় ঈদ হিসেবে আখ্যায়িত করার কিছু যৌক্তিক কারণও রয়েছে। এ সময়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অবশ্য পালনীয় পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি হিসেবে পবিত্র হজব্রত পালন করা হয়ে থাকে। ত্যাগের মহিমায় সবচেয়ে প্রিয় জীবকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করে কোরবানি করা হয়।

আর এই কোরবানির পশু প্রস্তুত করার জন্য গ্রাম-বাংলায় কৃষক-কৃষাণীরা বছরভরে যার যার সাধ্যমতো পশুকে প্রতিপালন করে থাকে। এর মধ্যে যারা একটু সচ্ছল প্রকৃতির তারা নিজের হাতের পশুকেই প্রতিপালনের মাধ্যমে তা ঈদে কোরবানি করে থাকে। অন্যদিকে আবার অনেকে কোরবানির ঈদে পশু বিক্রির উদ্দেশ্যে মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে বড় করে থাকে। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে তাই প্রত্যেক বাড়িতেই কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য একাধিক পশু প্রতিপালন করতে দেখা যায়।

এ পশুর তালিকায় রয়েছে কোরবানিযোগ্য গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি। তবে সে ক্ষেত্রে ষাঁড়-গরু কিংবা খাসি-ছাগলের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। পশুসম্পদ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে দেশে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৫৫ লাখ গরু-মহিষ কোরবানি করা হয়ে থাকে। আর ছাগল-ভেড়া কোরবানি হয় প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ। দেশের গরু-মহিষ-ছাগল ও ভেড়া মিলে পশু রয়েছে প্রায় ৫ কোটি। তার মধ্যে অর্ধেক বড় পশু অর্থাৎ গরু-মহিষ আর বাকি অর্ধেক ছোট পশু অর্থাৎ যা কি না ছাগল-ভেড়া। বর্তমানে দেশে কোরবানিযোগ্য গরু-মহিষ রয়েছে ৪৪ লাখ ২০ হাজার যা মোট চাহিদার তুলনায় মাত্র ৫ থেকে ১০ লাখ কম। অন্যদিকে ছাগল-ভেড়া রয়েছে মোট চাহিদার তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ বেশি।

কাজেই দেখা যাচ্ছে বড় পশু কোরবানি করার জন্য তার কিছুটা কমতি থাকলেও সম্প্রতি ভারত থেকে যে হারে পশু বৈধ ও অবৈধভাবে আমদানি করা হচ্ছে তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। আর আগে পশু আমদানির জন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতই একমাত্র দেশ ছিল; কিন্তু বর্তমানে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটান থেকেও প্রচুর পশু বৈধপথে আমদানি করা হচ্ছে। কিন্তু কোরবানির পশু আমদানির সঙ্গে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ খামারি ও ব্যবসায়ীদের লাভ-ক্ষতির হিসাবে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ যে বছর পশু বিদেশ থেকে কম আমদানি করা হয় সে বছর খামারিরা ভালো দাম পায়।

কিন্তু যে বছর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ পশু বাণিজ্যের জন্য সীমান্ত খুলে দেয় তখন ভারতীয় পশুর ভিড়ে দেশীয় খামারিদের পশুর দাম কমে যায়। ফলে ক্ষতির সম্মুখীন হয় খামারি, কৃষকসহ এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আর বৃহৎভাবে দেখতে গেলে সার্বিক অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সারা বছরই যে পশুর হাটগুলো বসে কোরবানির ঈদে বিশেষ বিশেষ স্থানে বিশেষ বিশেষ হাট বসে। যেমন- রাজধানী ঢাকা শহরে সারা বছরের জন্য স্থায়ী একটি পশুর হাট গাবতলীতে বসে; কিন্তু কোরবানির ঈদের সময় এলে এ সংখ্যা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

এ বছর কোরবানির ঈদে ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের জন্য একটি স্থায়ীসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হাট বসানো হয়েছে। তার মধ্যে আনুপাতিক হারে উত্তর সিটি করপোরেশনে এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আলাদা আলাদা পশুর হাট বসার অনুমতি দিয়েছে দুটি সিটি করপোরেশন। প্রায় দুই কোটি মানুষের ঢাকার শহরে ঈদের সময় অর্ধেক মানুষ তাদের গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদ্‌যাপন করতে চলে গেলেও আরও অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় এক কোটি মানুষ ঢাকা শহরে থেকে যায়। সে জন্য সারা দেশের মানুষের যেন একটি দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজধানীর মানুষের ভালোভাবে ঈদ উদ্‌যাপনের জন্য যারপরনাই সহযোগিতা করা।

সে জন্য সব কোরবানির পশুই বেশি দাম পাওয়ার আশায় তা রাজধানীতে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত বিভিন্ন পশুর হাটে নিয়ে আসে। এর জন্য সব সময় যে ভালো দাম পায় তাও নয়। অনেক সময় শেষ মুহূর্তে আমদানি এত বেশি হয়ে যায়, তখন শুধু পানির দামে বিক্রি করে আসতে পারলে যেন বাঁচে। কারণ ঢাকা শহরে পশু আনার জন্য ইতোমধ্যে পশু¯্রােত শুরু হয়ে গেছে, যা আমরা প্রতিদিনই গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারছি। দেখা যাচ্ছে, ট্রলিতে, ট্রাকে, ট্রলারে পিক-আপ ভ্যানে এমনকি রাস্তায় হাঁটিয়েও প্রচুর পরিমাণে পশু প্রতিদিন প্রতিক্ষণে ঢাকা শহরে স্থাপিত বিভিন্ন হাটে আসছে।

অথচ রাজধানীতে যারা হাটের ইজারা নিয়েছেন, সিটি করপোরেশনের তরফ থেকে ঈদের তিন দিন আগে থেকে হাটে গরু কেনা-বেচা করার জন্য সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু যদিও এখনো ঈদের প্রায় সপ্তাহখানেক বাকি তারপরও সেসব হাটে পশু জমায়েত করা শুরু হয়ে গিয়েছে। অথচ এখনো সেসব পশুরহাট পুরোদমে চালু হওয়ার মতো অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা তৈরি হয়নি। এ অবস্থা যে শুধু রাজধানী ঢাকা শহরে তাই নয়- এখন তা সারা দেশের নগর-মহানগর, শহর-বন্দর, এমনকি গ্রাম-গ্রামান্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে।

কারণ এখন সারা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যেভাবে সচ্ছলতার মুখ দেখেছে তাতে এসব উৎসবে গ্রাম-শহর পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এসব কোরবানির পশু যোগান দেওয়ার জন্য যেমন রয়েছে কিছুটা হলেও বিদেশি আমদানি নির্ভরতা, অন্যদিকে রয়েছে পাহাড়ি অঞ্চল, সীমান্ত অঞ্চলে গড়ে ওঠা বিভিন্ন পশু মোটাতাজকরণ খামার। তবে অনেক সময় অভিযোগ ওঠে যে এসব মোটাতাজাকরণ খামারে ভারতীয় অবৈধ অস্বাস্থ্যকর রেনামাইসিন ও স্টেরয়েড জাতীয় ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

আশার কথা, এ বিষয়টি বিগত কয়েক বছর ধরে গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার পর জনগণ সচেতন হওয়ায় এখন এর ভয়াবহতা আগের তুলনায় অনেকটাই কমে এসেছে। এভাবে চলতে থাকলে অবশ্যই এক সময় সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব হবে। সরকারের নির্দেশে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা এবার কোরবানির পশু বহনকারী যানবাহনকে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে পুলিশিসহ যেকোনো ধরনের চাঁদাবাজির আওতার বাইরে রাখার কথা ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ প্রশাসন।

অন্যদিকে পশুরহাটে জালটাকা শনাক্তকরণের জন্য মেশিন বসানো ও নজরদারি বৃদ্ধি করা, পশু ব্যবসায়ীদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি, ছিনতাই, যত্রতত্র চাঁদাবাজি প্রতিরোধে কড়াকড়ি আরোপ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কাজেই পরিশেষে বলা যায়, গৃহীত ব্যবস্থাগুলো কথার কথা না হয়ে সামান্যতম কার্যকর হলেও এতে শেষ বিচারে জনগণই উপকৃত হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়


শিক্ষকতা পেশার ঐশ্বর্য প্রশান্তি ও তৃপ্তি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
প্রফেসর ড. মো. নাছিম আখতার

বস্তুবাদী দুনিয়ায় সবকিছুকে বিচার করা হয় টাকা ও চাকচিক্যের মাপকাঠিতে। সরকারি কর্মকর্তার গাড়ি থাকে; কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের গাড়ির ব্যবস্থা করতে হয় তার নিজ উদ্যোগে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করে ধারণা হতেই পারে, শিক্ষক হয়ে ভুল কাজটি হয়তো করেই ফেলেছি। এর ফলে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার ক্ষেত্রে একটি নিরুৎসাহী পরিবেশ সৃষ্টি হতেই পারে। এমতাবস্থায় আমার বিচার-বিবেচনা ও বিশ্লেষণে শিক্ষকতা পেশার ঐশ্বর্য, প্রশান্তি ও তৃপ্তি তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আমার লেখাটি শিক্ষকতা পেশা গ্রহণকারীদের ভিন্নভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে।

আমি ২৩ বছর শিক্ষকতা করছি। জীবনে প্রাপ্তির ঝুলিতে প্রায় ২৩০০ ছাত্র আমার হাত ধরে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেছে। যারা কম-বেশি সবাই কর্মরত। ধরি, আমার একজন ছাত্র কর্মজীবনে ৪০ হাজার টাকা বেতন পায়। যদিও এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বেতন সীমা আমার জানামতে ৫ লাখ ও সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা। আমি গড়ে প্রত্যেকের বেতন ৪০ হাজার টাকা ধরছি। তাহলে আমার শিক্ষাদানে চাকরি পাওয়া শিক্ষার্থীরা প্রতিমাসে গড়ে ৯২ কোটি টাকা উপার্জন করে। এমন পরিসংখ্যানে আমি নিজেকে একজন ভ্রাম্যমাণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবতেই পারি। সমাজকে সুন্দর প্রক্রিয়ার মধ্যে শৃঙ্খলাবদ্ধ রেখে অর্থনীতির নীরব বিপ্লব ঘটে শিক্ষকের হাত ধরে।

এটা গেল শুধু অর্থনৈতিক দিকটির বিশ্লেষণ- এরপর রয়েছে মানবিক ও নৈতিক দিক। এ দিকগুলোকে সমাজের অক্সিজেন বলা হয়। অক্সিজেন না থাকলে যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, তেমনি মানবিকতা ও নৈতিকতা না থাকলে সমাজ মৃত হয়ে পড়ে। মানবীয় গুণগুলো মানুষ শেখে পিতামাতা ও শিক্ষাগুরুর কাছ থেকে। আব্রাহাম লিংকন তার ছেলের শিক্ষকের কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিটি এরূপ- ‘মাননীয় শিক্ষক মহোদয়, আমার পুত্রকে জ্ঞানার্জনের জন্য আপনার কাছে পাঠালাম। তাকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন এটাই আপনার কাছে আমার প্রত্যাশা। আমার পুত্রকে অবশ্যই শেখাবেন সব মানুষই ন্যায়পরায়ণ নয়, সব মানুষই সত্যনিষ্ঠ নয়। অনুগ্রহ করে তাকে এও শেখাবেন, প্রত্যেক বদমাইশের মধ্যেও একজন বীর থাকতে পারে, প্রত্যেক স্বার্থপর রাজনীতিকের মধ্যেও একজন নিঃস্বার্থ নেতা থাকেন। তাকে শেখাবেন, পাঁচটি ডলার কুড়িয়ে পাওয়ার চেয়ে একটি উপার্জিত ডলার অধিক মূল্যবান। তাকে এও শেখাবেন, কীভাবে পরাজয়কে মেনে নিতে হয় এবং কীভাবে বিজয়োল্লাস উপভোগ করতে হয়। হিংসা থেকে দূরে থাকার শিক্ষাও তাকে দেবেন। যদি পারেন নীরব হাসির গোপন সৌন্দর্য তাকে শেখাবেন। সে যেন আগে-ভাগে একথা বুঝতে শেখে, যারা পীড়নকারী তাদের নীরব হাসির গোপন সৌন্দর্য দিয়ে সহজেই কাবু করা যায়। বইয়ের মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে, তাও তাকে শেখাবেন। আমার পুত্রকে শেখাবেন, বিদ্যালয়ে নকল করে পাস করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানজনক। নিজের ওপর তার যেন পূর্ণ আস্থা থাকে, এমনকি সবাই যদি সেটাকে ভুলও মনে করে। তাকে শেখাবেন, ভালো মানুষের প্রতি ভদ্র আচরণ করতে, কঠোরদের প্রতি কঠোর হতে। আমার পুত্র যেন এ শক্তি পায়, হুজুগে মাতাল জনতার পদাঙ্ক অনুসরণ না করে। সে যেন সবার কথা শোনে এবং সত্যের পর্দায় ছেঁকে যেন শুধু ভালোটাই গ্রহণ করে এ শিক্ষাও তাকে দেবেন। সে যেন শেখে দুঃখের মাঝেও কীভাবে হাসতে হয়। আবার কান্নার মাঝে লজ্জা নেই, সে কথাও তাকে বুঝতে শেখাবেন। যারা নির্দয়, নির্মম তাদের সে যেন ঘৃণা করতে শেখে। আর অতিরিক্ত আরাম-আয়েশ থেকে সাবধান থাকে। অনুগ্রহ করে আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না, কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না হয়, থাকে যেন তার সাহসী হওয়ার ধৈর্য। তাকে এও শেখাবেন, নিজের প্রতি তার যেন সুমহান আস্থা থাকে আর তখনই তার সুমহান আস্থা থাকবে মানবজাতির প্রতি। ইতি, আপনার বিশ্বস্ত, আব্রাহাম লিংকন’। চিঠিটি আব্রাহাম লিংকন অন্য কোনো পেশার মানুষের কাছে লেখেননি। লিখেছেন সন্তানের শিক্ষকের কাছে। সুতরাং সুখীসমৃদ্ধ সুশীল সমাজ গড়তে সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই।

উন্নত জাতি ও দেশ গড়তে গবেষণামনস্ক জাতি গড়ে তুলতে হবে। গবেষণাই প্রকৃতির রহস্যভেদের একমাত্র পন্থা। গবেষণার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে সঠিক পথ দেখানোর কাজটি সম্পাদিত হয় শিক্ষকের হাত ধরে। শিক্ষকদের উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান জাতিকে দুর্বার গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জার্মান। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল তার এক বক্তব্যে বলেন, ‘শিক্ষকরা সাধারণ মানুষ নন, তাই যোগ্যতা ছাড়া শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করা কাম্য নয়। ওই দেশের বিচারক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা যখন সে দেশের সর্বোচ্চ বেতনভোগী শিক্ষকদের সমতুল্য বেতন প্রত্যাশা করে তা দেওয়ার অনুরোধ জানান, তখন মার্কেল তাদের বলেন, যারা আপনাদের শিক্ষাদান করেছেন, তাদের সঙ্গে কীভাবে আপনাদের তুলনা করি?’

আমার অন্য পেশার বন্ধুরা প্রায়ই বলেন, ‘তোমাদের তো আরাম আর আরাম। সপ্তাহে তিনটি ক্লাস তিন ঘণ্টা নিলেই আর কোনো কাজ থাকে না।’ এখানেই ভুল ধারণা রয়েছে- এ ক্ষেত্রে আমি বলব সপ্তাহে ৬ ঘণ্টা বা ৯ ঘণ্টা ক্লাস নিলেও ওই ক্লাসের প্রস্তুতি ও আনুষাঙ্গিকতা শেষ করতে সব সময় মাথাকে ব্যস্ত রাখতে হয়। আমরা অনেক সময় ভাবী প্রস্তুতি না নিয়ে গিয়ে কোনো রকমে ক্লাস শেষ করে এলেই শিক্ষার্থীরা আমার অপর্যাপ্ত প্রস্তুতির বিষয়টি ধরতে পারবে না। আসলে বিষয়টি ঠিক সেরকম নয়। ক্লাসে প্রস্তুতি নিয়ে গেছি কি না এ বিষয়টি শিক্ষার্থীরা খুব দ্রুত ধরে ফেলে। আর আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট হলে তো কথাই নেই। তাই শিক্ষক হতে হলে আত্মসম্মানবোধ ও নিজের কর্মের প্রতি সম্মান থাকলেই কেবল এই পেশায় আসা উচিত। প্রকৃত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের যে অকুণ্ঠ ভালোবাসা শ্রদ্ধা ও সম্মান পান তা আর কোনো পেশাতেই অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে আত্মনিবেদিত শিক্ষকের ঐশ্বর্য, প্রশান্তি ও তৃপ্তি তুলানাহীন বলে আমি মনে করি।

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


গ্রামীণ ঐতিহ্য, হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক 

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
আলমগীর খোরশেদ 

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল গ্রাম-বাংলায় যাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা, তাদের সহজ-সরল জীবনযাপন, একজন আরেকজনের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। পারিবারিকভাবে সম্পর্কের বন্ধন টিকে থাকে বা ধরে রাখে বয়স্করা। কারও সঙ্গে দুই পা হেঁটে গেলে, একটু কথা বললেই কি সম্পর্ক হয়ে যায়? মনে হয় না। সম্পর্ক বিষয়টা মনের। গ্রহণযোগ্যতা, মেনে নেওয়া, সাপোর্ট করা, একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ, টান, আবেগ নিয়েই শুরু হয় সম্পর্কের গোড়াপত্তন।

সম্পর্ক নিয়ে যত কিছুই বলা হোক না কেন, আত্মার বন্ধন ছাড়া সম্পর্ক অন্ধ, বোবা, বধির। সামাজিকভাবে রক্তের বন্ধনকে অধিক মূল্যায়ন করা হলেও স্বার্থের দ্বন্দ্বে রক্তের সম্পর্ক মুখ থুবড়ে পড়ে। পরিণত হয় চরম শত্রুতে।

আত্মার সম্পর্ক যার সঙ্গে, সে-ই আত্মীয়। ভালোলাগা, আবেগ, বেঁচে থাকতে একজন সঙ্গী, সাপোর্ট, কাঁকন পরা হাতের স্পর্শ মন আশা করতেই পারে। জীবন তো ছোট কোনো বিষয় নয়, তাতে জড়িয়ে থাকে মানুষের বেঁচে থাকার হাজারো গল্প। হিংসা বা ইগো মানুষের কোমল মনকে শেষ করে দেয়, অবিশ্বাসের পচন দিয়ে। বাস্তবে তেমন সুসম্পর্ক আদৌ আছে কি? রক্ত সম্পর্কের মানুষ অনেক ভয়ানক, ছাড় দেয় না ওরা। আত্মীয়, বন্ধু, স্বজন, রক্ত সম্পর্কের মানুষ যার কথাই বলিনা কেন, স্বার্থের কারণে চোখ একেবারে উল্টিয়ে দিলে সেখানে আর মনের টান, আবেগ, ভালোবাসা থাকে না। ইগো কাজ করে ভাবনায়। অর্থের জোর থাকলে তো কথাই নেই। কে কাকে পাত্তা দেয়? নিজে কতটুকু সমঝোতা করলে, অমায়িক ভেবে বারবার ঠকে গিয়েও ভদ্র হাসি হেসে নিজের অস্তিত্বকে নিলামে দিয়ে শেষ পেরেকটা মেনে নিতে হবে, তা ভাবতেই নিজেকে অপাঙক্তেয় মনে হয়।

সংসার, পরিবার, রক্ত সম্পর্কের লোকজন যখন কূটকৌশল করে, ঠকায়, ধ্বংস করে দিতে চায়, তখন বন্ধনটা ফিকে হতে হতে হারিয়ে যায়। সুতোর মতো ঝুলে থাকে তার ভারত্ব হারিয়ে।

মা-বাবার আদরে থেকে বড় হওয়া ছেলেটি যখন সংসার সমরাঙ্গনে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, তখন সে বুঝতে পারে জীবনের গদ্য কত জটিল। বাবা-মা দূর তারাদের দেশে হারিয়ে গেলে অসহায় সন্তান চারপাশের অবিশ্বাস, প্রতারণা, ঠকানো, স্বপ্নভঙ্গের ষড়যন্ত্রে সর্বস্বান্ত হয়ে নিজেকে খুঁজে পায় না কোনো বন্ধনে। যে দিকেই এগোতে চায়, ঠাঁই হয় না কোথাও। একটা দূরত্ব যেন চিরস্থায়ী রূপে গেঁথে থাকে। মনের সুকোমল প্রবৃত্তি ধরে রাখা মানুষ সমঝোতা আর ছাড় দিতে দিতে এক সময় নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। তখন কেউ থাকে না হাত বাড়িয়ে উঠিয়ে এনে অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার।

মানুষ তার নিজস্ব আবরণ থেকে কখনো বেরুতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে তার স্বরূপ সামনে চলে আসে, বাহ্যিকভাবে যতই লেবাসে নিজেকে ঢেকে রাখুক না কেন, এটাই জেনেটিক। বেলাশেষে মানুষের অর্জনের থলিতে কিছু থাকে কি? আপাতদৃষ্টিতে সঞ্চয় বলে যেটা মনে হয়, তা প্রাপ্তির সুখ দেয় না, কেবল হারানোর বেদনা পোক্ত হয়ে বসে মনে, হৃদয়ে ও অনুভূতির করিডোরে। দাবিয়ে রাখা, ছোট করা, অপদস্ত করা, অবমূল্যায়ন সবার অজান্তেই কষ্ট দেয়, যা অনুরোধের ঢেঁকি গেলার মতো। চারপাশে যারা আজ সুদিনে হাসছে, ওদের এতদূর আসতে কার অবদান, সেটা বেমালুম ভুলে যায়। একটু সহযোগিতা করলে সেটা বারবার মনে করিয়ে দেয়। এদের কোনো কাজে প্রয়োজনে পাওয়া যায় না। বিপদে পড়লে বা অর্থাভাবে বোঝা যায় প্রকৃত বন্ধু বা স্বজন কে? এমন স্বজন ও মিথ্যে সম্পর্ক থেকে একাকী থাকাই শ্রেয়। রক্ত সম্পর্কের মানুষই ঠকানোয় বেশি মজা পায়। চারপাশ থেকে ঠকাতে ঠকাতে মাথা উঠানোর আর জায়গা থাকে না। ক্যালকুলেটিভ হিসেবে অন্যকে ঠকাতে গিয়ে নিজেই ঠকে যায় মনের অজান্তেই।

বাড়ির সীমানার খুঁটি উঠিয়ে ভিতরে ঢোকানো, খুঁটি উপড়িয়ে ফেলে দিয়ে আরও ভিতরে ঢুকে গাছের চারা লাগিয়ে দখলে নিলে কতটুকু জায়গাই বা বেশি পাবে? রক্তের মানুষ এতই স্বার্থপর, এতই অমানবিক, যে ওরা কোনো শ্রেণিতেই পড়ে না। মাথা তুলে দাঁড়াবে দূরের কথা, নিজের সঙ্গে অন্যদেরও নিচে নামিয়ে সংসারে, সমাজে কারোরই কোনো স্থান থাকে না। সমাজে শূন্য হয়ে যায় তাদের অবস্থান। এটার উপলব্ধি কোনো দিনই ওদের স্পর্শ করে না, স্বার্থপরতায় ওরা অন্ধ হয়ে গেছে দেনা-পাওনার হিসেবে। চারপাশে ঘুরঘুর করা মানুষ কখনো সুবুদ্ধি দেয় না তাদের। আস্তে আস্তে ওরা সবাই নিজেকে সঁপে দেয় চোরাবালি সম্পর্কে। বাইরের মানুষের কাছে নিজের আত্মমর্যাদা জিরোতে গিয়ে ঠেকে। এভাবেই শেষ হয়ে যায় একটা পরিবার ও তার মানুষের সম্পর্ক।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক


শেখ হাসিনার কারামুক্তি ও গণতন্ত্রের মুক্তি দিবস

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তাপস হালদার

১১ জুন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস। ২০০৮ সালের এই দিনে দীর্ঘ ১০ মাস ২৫ দিন কারাভোগের পর তিনি সংসদ ভবনে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে থেকে মুক্তি পান। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সেনা সমর্থিত ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে সম্পূর্ণ অনৈতিকভাবে শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় বসে সংবিধানকে লঙ্ঘন করে নিজেদের পছন্দমতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে একতরফা নির্বাচন করার যাবতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। তখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করাই ছিল শেখ হাসিনার মূল উদ্দেশ্য। তিনি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্যই আন্দোলন করেছিলেন। জনগণের আন্দোলনে খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন। ১/১১ নামে পরিচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। তারা ছিল শেখ হাসিনার আন্দোলনের ফসল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়াই তাদের দায়িত্ব ছিল; কিন্তু তারা ক্ষমতার লোভে পড়ে নির্বাচন দিতে নানা ধরনের তালবাহানা শুরু করে। তখনই সাধারণ মানুষ নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। একদিকে জরুরি অবস্থার অজুহাত দেখিয়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ, অন্যদিকে পতিত আদর্শচ্যুত একশ্রেণির লোক দ্বারা নতুন নতুন দল গঠনের পাঁয়তারা শুরু করে। ‘দুদক’কে ব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননের অপচেষ্টা চালানো হয়। জনগণের কাছে রাজনীতিবিদদের বিতর্কিত করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে সরকার। শীর্ষ রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে একের পর এক হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।

‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার নামে শেখ হাসিনাকে প্রধান টার্গেট করে কুশীলবরা। তারা ভালো করে জানে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করতে পারলে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে আর কোনো বাধা থাকবে না। শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের প্রায় দেড় মাস পর খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ খালেদা জিয়া সংবিধান লঙ্ঘন করা নির্বাচন করার যে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল, সেটা প্রতিহত করতেই ১/১১ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। খালেদা জিয়া ছিলেন সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী। যিনি দেশটাকে দুর্নীতি, লুটপাট ও সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন। তখন টানা পাঁচবার দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকেই প্রথম গ্রেপ্তার করে।

দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য হাজির করা হয় ‘মাইনাস-টু’ তত্ত্বের ফর্মুলা। সরকার প্রথমে কথিত একজন ব্যবসায়ীকে দিয়ে তিন কোটি টাকার চাঁদাবাজির মিথ্যা মামলা করে। সরকার ভালো করেই জানত, শেখ হাসিনা কারও কাছ থেকে কোনো দিন চাঁদা নেননি। তিনি তার জীবনে কোনোদিন কারও কাছে কোনো টাকা চাননি। তারপরও মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে যাতে অংশ নিতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করার জন্যই যাকে-তাকে ধরে নিয়ে জোরপূর্বক মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হতো। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে রাজি না হলেই তাকে জেলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। একটা ভয়াবহ আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যাতে নেতা-কর্মীদের মনোবল ভেঙে যায়। সরকার জানত শেখ হাসিনা ডাক দিলে লাখ লাখ কর্মী মাঠে নেমে পড়বে। তখন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ক্ষমতা ধরে রাখা যাবে না।

দেশরত্ন শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষে দেশে ফিরে আসতে চাইলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারি নিষেধাজ্ঞা, যড়যন্ত্র ও মৃত্যু ভয় উপেক্ষা করে ২০০৭ সালের ৭ মে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার দুই মাস পর ১৬ জুলাই বিনা পরোয়ানায় নিজ বাসভবন সুধাসদন থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় সংসদ এলাকায় একটি অস্থায়ী কারাগারে তাকে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়।

গ্রেপ্তারের পর সংসদ ভবনে স্পেশাল ক্যাঙ্গারু কোর্ট বসানো হয়েছিল। তারপর একটার পর একটা মামলা দিয়ে হয়রানি করতে থাকে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেকোনো মূল্যে শেখ হাসিনাকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছিল। তাদের একমাত্র টার্গেট শেখ হাসিনাকে যেকোনোভাবে শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা। সে জন্য পরিকল্পনা মাফিক প্রথমে দেশের বাইরে রাখার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু সেটা যখন সফল হয়নি তারপরে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা, জনগণের কাছে দুর্নীতিবাজ সাজিয়ে জনগল থেকে দূরে রাখাসহ এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করেনি। এমনকি কারাগারে দেশরত্ন শেখ হাসিনার জীবননাশের ষড়যন্ত্র চলে। তিনি তখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের অভিযোগ তোলে স্লো-পয়জনিংয়ের মাধ্যমে নেত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তারের আগে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। প্রথমত, দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও পরিক্ষিত নেতা জিল্লুর রহমানের হাতে দলের দায়িত্ব অর্পণ। দ্বিতীয়ত, জাতির উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি। জিল্লুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দায়িত্ব দেওয়ার কারণে দলের ভাঙন হয়নি। আর জাতির উদ্দেশ্যে খোলা চিঠির কারণে লাখো কোটি নেতা-কর্মীদের মনে অফুরন্ত সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। যার কারণে নেতা-কর্মীরা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর ভয়ে কিংবা ব্যক্তি স্বার্থে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই নিশ্চুপ কিংবা ভিন্ন সুরেও কথা বলেছিলেন; কিন্তু সারা দেশের তৃণমূল নেতারা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য দেশ-বিদেশে থাকা লাখ লাখ নেতা-কর্মীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নেতা-কর্মীদের আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং শেখ হাসিনার মুক্তির কারণেই খালেদা জিয়াও মুক্তি পায়।

সমগ্র বাংলাদেশে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক বিশ্বের চাপে পড়ে যায় সরকার। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সব মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি জানায়। শত চেষ্টা করেও সরকার আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করতে পারেনি, বরং শেখ হাসিনার প্রশ্নে আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সব নেতা-কর্মী। চারদিকে আওয়াজ ওঠে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন নয়। তুমুল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। মুক্তি পেয়েই তিনি উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর দেশে ফিরে আসেন।

২৯ ডিসেম্বর, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে মহাজোট। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেই থেকে টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চমবারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশকে নিয়ে গেছেন উন্নত সমৃদ্ধ মর্যদাশীল দেশের কাতারে।

জনগণের মুক্তি আন্দোলনে শেখ হাসিনা অনেক জেল-জুলুম ও অত্যাচার সহ্য করেছেন। অসংখ্যবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য কখনো পিছপা হননি। শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নির্ভীক সৈনিকের মতো এগিয়ে গিয়েছেন এবং প্রতিবারই বিজয়ী হয়েছেন। সব বাধা-বিপত্তি জয় করে শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশেই নয়- আন্তর্জাতিক বিশ্বেও দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন।

১১ জুন, শুধু ব্যক্তি শেখ হাসিনাই মুক্তি পায়নি, যাত্রা শুরু হয়েছিল গণতন্ত্রের। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মুক্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ আবার গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পায়। শেখ হাসিনার কারামুক্তির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র মুক্ত হয়েছিল।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।


এলিজা কার্সন দি এভার গ্রেট

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

সঙ্গত কারণেই বর্তমানে মর্মস্পর্শী ও হৃদয় ছোঁয়া বিষয়কে ঘিরে এলিজা কার্সনকে নিয়ে লিখতে বসেছি। এ মেয়েটি আমাদের পৃথিবীর প্রথম অভিযাত্রী, যে ২০৩৩ সালে মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশ্যে রওনা হবে। সে ভালো করে জানে, হয়তো আর ফিরে আসবেনা এই প্রিয় জন্মভূমি পৃথিবীতে। আর মাত্র ৯ বছর পরে একমাত্র নিঃসঙ্গ মানুষ হিসেবে কোটি কোটি মাইল দূরের লোহার লালচে মরিচায় ঢাকা প্রচণ্ড শীতল নিষ্প্রাণ গ্রহের ক্ষীয়মাণ নীল নক্ষত্রের মধ্যে হারিয়ে যাবে। তবে তাতে ভীত নয় সে। ভাবতে অবাক লাগে, মানুষের স্বপ্ন কত বিশাল! এলিজা কার্সন নিজে সেই দুঃসাহসিক স্বপ্ন দেখে এবং একই সঙ্গে মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। সে বলে- ‘সর্ব সময় আপনার লালিত স্বপ্ন ভিত্তি করে চলুন এবং এমন কিছুকে প্রশ্রয় দেবেন না, আপনার স্বপ্ন থেকে হেলাতে পারে বা নষ্ট করে দিতে পারে।

আসলেই মা জননীবিহীন সিঙ্গেল প্যারেন্ট হিসেবে কেবল বাবা বার্ট কার্সনের আদরেই বড় হয়ে উঠেছে এলিজা। এই ছোট মেয়েটি হয়তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, এ পৃথিবীতে আগমন কেবল খাওয়া ও ঘুমানোর জন্য নয়। আরও অনেক কিছু মহৎ কাজ আছে, যা মানব কল্যাণকে ঘিরে করতে হয়। আর তাই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সামনে রেখে জীবন অতিবাহিত করে থাকেন মহামানবরা। অথচ সাধারণ মানুষ তা করে না। কারণ সাধারণ মানুষ আন্তঃকেন্দ্রিক এবং নিজেদের চাওয়া-পাওয়া ও ভোগবিলাসের মধ্যে ব্যতিব্যস্ত রাখে। সত্যি কথা বলতে কি, এ বিশ্বের সৃষ্টির গোড়া থেকে মানব কল্যাণার্থে এ ধরনের কতিপয় অধিমানব জীবন উৎসর্গ করে এগিয়ে এসেছেন বলেই আমরা আজ নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছি। অথচ দুঃখের বিষয় হলো, আমরা সাধারণ মানুষের খুব কম সংখ্যকই তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এবং কৃতজ্ঞতাভরে মনে করি। স্মরণকাল থেকে এ ধরনের এরকম অনেক অধিমানব বা মহামানব থাকলেও আমি অত্র প্রবন্ধের কলেবরের স্বার্থে নিম্নে কেবল জনাকয়েক অধিমানবের কথা তুলে ধরছি, যারা সৃষ্টি জগৎ তথা মানুষের জন্য জীবন বাজি রেখে তথা জীবন দিয়েও অবদান রেখে গেছেন।

প্রথমে যার কথা দিয়ে শুরু করছি। তিনি হলেন- গ্রিক পণ্ডিত আর্কিমিডিস। প্রাচীন গ্রিকের এই গাণিতিক ও বিজ্ঞানী জন্মেছিলেন ইতালির ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ সিসিলির সাইরাকিউস নামে একটি ছোট রাজ্যে। পাটিগণিত, জ্যামিতি এবং হাইড্রলিক্সে তার অবদানের জন্য আজও স্মরণীয়। অথচ গবেষণারত অবস্থায় তার করুণ মৃত্যু হয় মাথামোটা একজন রোমান সৈনিকের ধারাল তরবারির আঘাতে। দ্বিতীয়ত, যার কথা উঠে আসে, তিনি হলেন মহান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওদার্নো ব্রুনো। অতি সত্যি কথা বলায় তাকে হাত-পা বেঁধে রোমের রাজপথে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কি বলেছিলেন ব্রুনো? কি ছিল তার অপরাধ? তিনি বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এই পৃথিবী সৌরজগতের কেবল তুচ্ছ গ্রহ ছাড়া আলাদা কোনো গুরুত্ব নেই। আর পৃথিবী ও বিশ্বজগৎ চিরস্থায়ী নয়, এক দিন এসব ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ব্রুনোর সেই চিরসত্যর ওপরই ভিত্তি করে সূর্যের চারদিকে ঘূর্ণায়মান আমাদের সাধের পৃথিবী। তৃতীয়ত, যার কথা বলছি তিনি হলেন মধ্যযুগের জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও, যিনি আট বছর ধরে বন্দিদশায় অন্ধ হয়ে পড়েছিলেন এবং আশি বছর বয়সে দীর্ঘ সময় ধরে কারাগারে ধুঁকে ধুঁকে মারা যান। কী এমন দোষ করেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই বিজ্ঞানী? তিনি শুধু কোপার্নিকাসের মতবাদ প্রচার করেছিলেন এবং যুগপৎ বলেছিলেন, ব্রুনোকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে মূর্খ যাজকেরা। এ জন্য তাকে একবার মাফ চাইতে হয়েছিল। ওয়াদা করতে হয়েছিল, চার্চ ও বাইবেলবিরোধী কিছু বলবেন না; কিন্তু সে কথা রাখতে পারেননি গ্যালিলিও। জ্বলজ্বলে তারার মতো সত্যকে উপেক্ষা করে তিনি কীভাবে মিথ্যা বলবেন? কীভাবে অন্ধকারকে আলো বলে চালিয়ে দেবেন। আর তাই গ্যালিলিও সত্যের এ জয়গান করে গেয়েছিলেন আজীবন এবং বলেছিলেন যে সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। তারপর যার কথা উঠে আসে, তিনি ইতিহাসখ্যাত নারী বিজ্ঞানী ম্যারি কুরি, যে সময়টাতে সারা পৃথিবীতেই মেয়েরা ছিল অনেক পিছিয়ে। অথচ সে সময় ম্যারি কুরি বিশ্ববাসীকে এনে দিয়েছেন অসংখ্য অর্জন। পোলান্ডে জন্ম নেওয়া ম্যারি দুটি উপাদানের আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে প্রথমবার নোবেল পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানে (রেডিওঅ্যাক্টিভিটি বা তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণার জন্য) আর এর মাত্র ৮ বছরের মাথায় দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার পান রসায়নে। অথচ এই আবিষ্কার ছিল মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপজ্জনক। এই আবিষ্কারে ম্যারি কুরি এবং তার স্বামী পেয়েরি কুরি এতটাই স্বাস্থ্যগত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন, এই পৃথিবী থেকে অচিরেই বিদায় নিতে হয়েছিল। এ ছাড়া এ ধরনের অনেক প্রতিভাধর সৃষ্টিধর্মী ও উদ্যোগী মহৎপ্রাণ, এভাবে পৃথিবী থেকে অকালেই চির বিদায় নিয়েছেন। যারা হলেন রবার্ট ককিং, অটো লিলিয়েনথাল, অরেল ভিলাইকু, উইলিয়াম বুলোক, আলেকজান্ডার বগডানোভ, হেনরি থুআইল, ম্যাক্স ভ্যালিয়ার, প্রমুখ। এরা কেবল মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, এসব অধিমানব মানবজাতির মঙ্গলের জন্য আবিষ্কার করতে গিয়ে নির্দ্বিধায় জীবন দিয়েছেন। আশ্চর্যর বিষয় হলো, আমরা তাদের আবিষ্কারের ফল ভোগ করে চলেছি। অথচ তাদের কথা এতটুকু ভাবী না এবং মনেও রাখি না।

এবার আসুন আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয় এলিজা কার্সনের কথায় ফিরে আসি। এই ছোট মেয়েটি নাসার কনিষ্ঠতম সদস্য। ৭ বছর বয়সে বাবা তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আলবামার একটি স্পেস ক্যাম্পে। সেই ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা তাকে এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল যে তার ভাবনার জগৎটাই অন্য শিশুদের চেয়ে আলাদা হয়ে যায়। এদিকে এলিজার যখন ৯ বছর বয়স, তখন তার সঙ্গে দেখা হয় নাসার এক মহাকাশচারী সান্ড্রা ম্যাগনাসের সঙ্গে। এই নারী মহাকাশচারী তাকে জানিয়েছিলেন ছোটবেলাতেই তিনি মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন বলেই বর্তমানে এ অবস্থায় এসে পৌঁছেছেন। এই কথাটি ছোট্ট এলিজার মনে দাগ কেটে যায়। এতে মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্ন তার অন্তরে আরও শেকড় গেড়ে বসে। উল্লেখ্য, মাত্র ১২ বছর বয়সেই এলিজা আলবামা, কানাডার কুইবেক ও তুরস্কের ইজমিরে নাসার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্পেস ক্যাম্পে অংশ নেন। এর মধ্যে মহাকাশের বেসিক জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন মিশন কীভাবে পরিচালিত হয়, তা সে রপ্ত করে ফেলে। এ ক্ষেত্রে মহাকর্ষ-শূন্য স্থানে চলাচল করার পদ্ধতি, ভারহীন স্থানে থাকার উপায়, রবোটিক্স সম্পর্কে জ্ঞান এবং বিশেষ মুহূর্তে জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা ইত্যাদি অর্জন করে। মজার ব্যাপার হলো, তার এই অভাবনীয় কাজের জন্য নাসার পক্ষ থেকে তাকে একটি ‘কল নেম’ও দেওয়া হয়, যা হলো ‘ব্লুবেরি’।

যেহেতু সে মঙ্গলে গেলে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। সোজা কথায় সে ফিরে আসতে চাইলেও আর আসতে পারবে না। তাই নাসার কাছে সে কোনো প্রকার যৌনতা, বিয়ে বা সন্তানধারণের নিষেধাজ্ঞাপত্রতে স্বাক্ষর করেছে। এদিকে অফিসিয়ালি নাসা ১৮ বছরের আগে কাউকে নভোচারী হিসেবে আবেদন করার সুযোগ দেয় না। তবে এলিজার ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়নি। ১১ বছর বয়সেই তাকে মনোনীত করা হয়েছে। প্রথম থেকেই প্রতিষ্ঠানটি এলিজাকে মানুষের ভবিষ্যতে মঙ্গলগ্রহে অভিযানের জন্য জোর সমর্থন করে তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০৩৩ সালে যখন মঙ্গলগ্রহে প্রথমবার মানুষ পাঠানোর অভিযান শুরু হবে, তখন এলিজার বয়স হবে ৩২, যা একজন নভোচারীর জন্য যথাযথ বয়স। অবশ্য এলিজার মঙ্গলগ্রহে অভিযান নিয়ে নেতিবাচক কথাও শোনা যাচ্ছে। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি, সত্যিই যদি ২০৩৩ সালে এলিজা মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশে রওনা হয় সে ক্ষেত্রে প্রায় ৮০০ কোটি পৃথিবীবাসীর পক্ষ থেকে আগাম মোবারকবাদ জানাচ্ছি। আর অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, সে হয়তো আর এই পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে না। তথাপিও পৃথিবীবাসীর জন্য যে উদ্দেশে যাচ্ছে, সেটা যেন পূরণ হয়। তা হলে তার আত্মা পরিপূর্ণতার শান্তিতে ভরে উঠবে।

লেখক: বিশিষ্ট গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক হিসেবে মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সম্মাননা ও পদকপ্রাপ্ত


স্মার্ট বাংলাদেশ: বাজেট, উচ্চশিক্ষা ও ইউজিসি প্রসঙ্গ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন

বাংলাদেশে বর্তমান সরকার টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় এসেছে। মন্ত্রিপরিষদে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী দুজনই নতুন এসেছেন এবং তাদের যথেষ্ট ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে, যা গত কিছুদিনের মধ্যেই তারা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের শেষের দিকে নতুন কারিকুলাম এসেছে। এই কারিকুলামকে বাস্তবায়ন করতে এখন দরকার যথাযথ পদক্ষেপ ও নীতিমালার। বিশেষ করে অবকাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-স্কেল এখন সময়ের দাবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভিশন ২০৪১’ ঘোষণা করেছেন, যা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-কে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরিত করবে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন বাস্তব; কিন্তু ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ যদি সময়মতো করতে চাই তাহলে অর্থ বরাদ্দ শুধু বাড়ালেই হবে না, সেই অর্থের যথাযথ ব্যয় ও দুর্নীতি সর্বাংশে দমন করতে হবে। নতুন শিক্ষামন্ত্রী শপথ নেওয়ার পরের দিনই দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন। এর সঙ্গে ইউজিসির সুপারিশ কার্যকর করতে হবে।

বর্তমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাজেটে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও, শতকরা হারে তা কমেছে। শিক্ষাব্যবস্থার দেখভালকারী শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন কার্যক্রমের জন্য এবার যে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা জাতীয় বাজেটের ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১২ শতাংশের মতো। অবশ্য শিক্ষার সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ যোগ করলে এই হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে অতীতের মতো এবারও দাবিটি পূরণ হয়নি, বরং বরাদ্দের হার কমে ২০ শতাংশ থেকে বেশ দূরেই আছে। উন্নত বিশ্বে এই বরাদ্দ ২০ শতাংশের আশপাশে। কোনো কোনো দেশে এর পরিমাণ আরও বেশি। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে। পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশ থেকে যারা উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে বা হওয়ার পথে; তাদের বেশির ভাগেরই শিক্ষা খাতের বরাদ্দ অনেক বেশি। এদিকে জাতিসংঘের মতে, কোনো দেশের বাজেটের ২০ শতাংশ বা জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা উচিত। বিপরীতে আমাদের দেশের শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

আশার কথা, ইতোমধ্যেই ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সময়ে ৩৫১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩৭১টি কলেজ জাতীয়করণ, সরকারি বিদ্যালয়বিহীন ৩১৫টি উপজেলা সদরে অবস্থিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে মডেল স্কুলে রূপান্তরণ, জেলা সদরে অবস্থিত সরকারি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজে ১৮০টি ভবন নির্মাণ করাসহ নানামুখী উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। আশা করা যায়, সরকারের নেওয়া চলমান উদ্যোগগুলো রূপকল্প ২০৪১ এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার চতুর্থ লক্ষ্য, ‘সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা’ অর্জনে সহায়ক হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষার মান অনেক উন্নত হয়েছে। শিক্ষার মান আরও উন্নত করে আমরা বিশ্বমানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চাই। এটা আমাদের লক্ষ্য এবং এটি অর্জনে আমাদের কাজ করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ, শিক্ষাকে বহুমাত্রিক করার অংশ হিসেবে প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, চারটি বিভাগীয় সদরে চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, ইসলামিক আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যারোস্পেস এবং এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সরকারকে কিছু ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতিতে চলতে হচ্ছে। তার মধ্যে শিক্ষাও একটি। কারণ বিশ্ববাজার অস্থির। সবার আগে দ্রব্যমূল্য ঠিক রাখতে হবে। সবকিছু আমাদের হাতেও নেই। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ইসরাইলে-ফিলিস্তিনির সঙ্গে আরব বিশ্বের বর্তমান অবস্থা। এই টালমাটাল সময়ে, যেখানে সারা বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই শিক্ষার্থীদের বিরাট একটি অংশ, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মানবিকতার জয়গান গাইছেন। সব ধরনের যুদ্ধ বন্ধের জন্য বিক্ষোভ করছেন। সেই সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষকের বিচার করতে হচ্ছে।

যৌন হয়রানির কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর আত্মহত্যা অসংখ্য যৌন হয়রানির ঘটনাকে সামনে এনেছে। এখন অনেক ছাত্রীই মুখ খুলছে। অনেকগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হলেও প্রশ্নটা হলো, যেসব শিক্ষক এর সঙ্গে জড়িত তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার কোনো যোগ্যতা রাখেন কী? সুষ্ঠু তদন্ত হলে এমন শত শত কেস সামনে এসে হাজির হবে। যদি ইউজিসির সুপারিশ কার্যকর করা হতো তবে এমন ঘটনা ঘটার সুযোগ কম থাকত। কারণ নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বুয়েটে রাজনীতি থাকবে নাকি থাকবে না? এই নিয়ে শুধু বুয়েট নয় বাংলাদেশের এ বিষয়ে খোঁজখবর যারা রাখেন তারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। পড়ার বদলে সেখানে আন্দোলন হচ্ছে। প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে রয়েছে ছাত্র রাজনীতি। বুয়েটে আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়েছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী এ ঘটনা ঘটিয়েছিল এটি নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। সেই থেকে সেখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ। পোকা ধরা ফলের জন্য কী গাছটাই কেটে ফেলতে হবে? বরং ছাত্র রাজনীতি না থাকার কারণে বুয়েট এখন মৌলবাদের আঁতুরঘরে পরিণত হয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের ঘটনা আপনাদের মনে আছে?

এবার একটু ইতিবাচক কথায় আসা যাক। আমাদের সমস্যা অনেক। এই সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে। ইউজিসির কথামতো যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগটা হতো তাহলে এ সমস্যাগুলোর বেশির ভাগই সমাধান হয়ে যেত। ছাত্র রাজনীতিকে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে মিশে যাওয়াটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ শিক্ষা থেকে শুরু করে সব বিষয়ের আধুনিক পরিবর্তন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্ক্ষিত ‘সোনার বাংলা’ করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। সংবিধানে স্পষ্টত উল্লেখ আছে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার কথা এবং সেই প্রয়োজন পূরণ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির কথা- যেখানে জড়িত রয়েছে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশে সময়ের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের পথ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলাতেই উচ্চশিক্ষা বিস্তারে অন্ততপক্ষে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী সব সময় বলে আসছেন এবং বাস্তবায়ন করছেন যা অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ ও আশাব্যঞ্জক। পৃথিবীর আর অন্যকোনো দেশে উচ্চশিক্ষার এমন প্রসার সহজেই চোখে পড়ে না। যার জন্য আমরা সব সময় গর্বিত। তবে একটি বিষয় আমাদের একটু খেয়াল রাখতে হবে এই বিপুল পরিমাণ উচ্চশিক্ষিত সমাজকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করা যায়, যা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার গুরুত্বকে অনুধাবন করেছিলেন। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১০-এর মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিধিবদ্ধ হয়। সেই সময়ে ইউজিসির কার্যক্রম ছিল তৎকালীন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা নিরূপণ। সময়ের সঙ্গে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার পরিধি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় (সাধারণ ক্যাটাগরির) প্রতিষ্ঠিত হয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৩), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০)। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮০)। বিশেষ ক্যাটাগরির দুটি বিশ্ববিদ্যালয় দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে প্রতিষ্ঠিত হয়: বর্তমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬১) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬২)। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৬। কিন্তু বিশাল জনবহুল দেশে এই সংখ্যাটা প্রয়োজনের তুলনায় কম। আর এ জন্যই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন পর্যন্ত দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১১৪। ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু না করতে পারলেও ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রেখে চলেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৭৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, যেখানে পুরুষ ৭৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং নারী ৭২ দশমিক ৪২ শতাংশ রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শিক্ষায় নারীরাও পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে নেই। ২০২৩ সালের গ্লোবাল ইনডেক্স অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। শিক্ষক সংখ্যা, শিক্ষার হার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাই হোক না কেন, শিক্ষার গুণগত মানই স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করতে পারে।

এই গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার অনকেগুলো সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত নতুন কারিকুলামের যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে। অবকাঠামো বৃদ্ধি করতে হবে। যথাযথভাবে জাতীয়করণ করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতনকাঠামো করতে হবে। যা সময়ের দাবিও। এই কারিকুলামের জন্য যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক আমাদের কমই আছে। যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকেও নিজ উদ্যোগে ইনহাউস প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্লাসরুম থেকে ল্যাবের সংখ্যার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। উপাচার্য নিয়োগে আরও দূরদর্শী হওয়া প্রয়োজন। উপাচার্য থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের নিয়োগে ইউজিসির সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সহায়ক গুণগত ও মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার দায়িত্ব রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় হলো নতুন নতুন জ্ঞান সৃজন ও বিতরণের কেন্দ্র। আমি মনে করি সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবন, প্রায়োগিক গবষেণা ও দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির মাধ্যমে ভিশন ২০৪১ সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কোনো ধরনের অপপ্রচার ও গুজবে কান না দিয়ে এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রেখে আমাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে বাংলাদেশ অচিরেই হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমাদের মেধাবী তরুণরাই হবে সোনার মানুষ। আর সেই সোনার মানুষ তৈরির সূতিকাগার হবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

লেখক: সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)


নিয়মিত হাঁটুন: স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ফিটনেস ধরে রাখুন

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

সারা বিশ্বে মানুষের মধ্যে কায়িক পরিশ্রমের প্রবণতা কমছে। আর রোগ-ব্যাধির প্রবণতা বাড়ছে। যেকোনো বয়সের মানুষের শরীর ঠিক রাখতে ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই। তবে সব ব্যায়াম সব বয়সের জন্য উপযোগী নয় এবং সব বয়সে সব ধরনের ব্যায়াম সম্ভবও নয়; কিন্তু হাঁটা এমন একটি ব্যায়াম, যা যেকোনো বয়সের নারী-পুরুষের জন্য সহজেই সম্ভব, মানানসই, উপযোগী এবং এর মতো সহজ, ভালো ব্যায়াম আর নেই। হাঁটার উপকারিতাও অনেক। উপযুক্ত পোশাক এবং এক জোড়া ভালো জুতা ছাড়া কোনো অতিরিক্ত খরচের প্রয়োজন পড়ে না, ঘরে-বাইরে যেকোনো জায়গায় করা যায়। ব্যক্তির শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী এর সময় এবং তীব্রতা বাড়ানো-কমানো যায়।
হাঁটা নিয়ে হয়েছে বিস্তর গবেষণা, যার ফলাফল চমকপ্রদ। যারা নিয়মিত হাঁটা-চলার মধ্যে থাকেন, তাদের আলাদা ব্যায়ামের দরকার হয় না, যদিও সম্ভব হলে অন্যান্য ব্যায়াম করা উচিত। যারা সারা দিন অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় বসে বসে কাজ করেন এবং অলস জীবনযাপন করেন, তাদের অবশ্যই কিছু সময় হলেও একটু একটু করে হাঁটা-চলা এবং ব্যায়াম করা দরকার। শীতকালে এটা আরও বেশি জরুরি। এতে শরীরের রক্ত চলাচল বাড়ে, উচ্চরক্তচাপ, শারীরিক স্থূলতা, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, এমনকি হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতেও সহায়তা করে, শরীর থাকে সচল আর মন-মেজাজ থাকে ফুরফুরে।

ডায়াবেটিস রোগীর উপকার: ডায়াবেটিস রোগীর ব্যায়ামের বিকল্প নেই। সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত হাঁটা-চলা, হাট-বাজারে বা অল্প দূরত্বে রিকশা বা গাড়ি ব্যবহার না করা, অল্প কয়েক তলার জন্য লিফট ব্যবহার না করে হেঁটে ওঠা বা নামা ইত্যাদির মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন বা সপ্তাহে মোট ১৫০ মিনিট হাঁটলে এবং শরীরের ওজন ৭ শতাংশ কমালে টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা কমে প্রায় শতকরা ৫৮ ভাগ। আর যদি ডায়াবেটিস হয়েই থাকে, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও হাঁটা বিশেষ কার্যকর। হাঁটাহাঁটি করলে শরীরের পেশিতে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে এবং রক্তের সুগার কমে, ওষুধ লাগে কম।

ওজন নিয়ন্ত্রণ: নিয়মিত হাঁটলে শরীরে জমে থাকা মেদ কমে, ওজন কমাতে সহায়ক হয়। অনেকেই শরীরের ওজন কমাতে শুধু ডায়েটিং করেন; কিন্তু হাঁটাহাঁটি না করে বা অলস জীবনযাপন করে শুধু ডায়েট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ওজন কমানো সম্ভব নয়, উচিতও নয়। দীর্ঘমেয়াদি ওজন নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মূল চাবিকাঠি স্বাস্থ্যকর, সুষম খাবার এবং নিয়মিত হাঁটা-চলা ও ব্যায়াম।

হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা: নিয়মিত হাঁটলে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ফলে স্বল্প চেষ্টায় শরীরে বেশি পরিমাণে রক্ত সরবরাহ করতে পারে এবং ধমনির ওপরও চাপ কম পড়ে। উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে কম। এ ছাড়া রক্তনালির দেয়ালে চর্বি জমে কম। ফলে রক্তনালি সরু হয় না, সহজে ব্লক হয় না, রক্তনালির দেয়াল শক্ত হয় না। তাই হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে প্রায় ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ। কমে যায় স্ট্রোকের ঝুঁকিও, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম চাবিকাঠি হচ্ছে নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটা। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হাঁটা-চলা অনেকটা উচ্চ রক্তচাপরোধী ওষুধের মতো কাজ করে। হাঁটার ফলে উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, আর আগে থেকেই থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

রক্তের চর্বি বা কোলেস্টেরল: নিয়মিত হাঁটার ফলে ভালো কোলেস্টেরল বা এইচডিএল বাড়ে। হাঁটা-চলা না করলে মন্দ কোলেস্টেরল বা এলডিএলের পরিমাণ বেড়ে, তা ধমনির গায়ে জমা হয়ে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। যারা সপ্তাহে অন্তত তিন ঘণ্টা অথবা দৈনিক আধা ঘণ্টা করে হাঁটেন, তাদের রক্তে এলডিএল কমে যায় এবং হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে।

স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস: মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোকের অন্যতম একটি রিস্ক ফ্যাক্টর হচ্ছে অলস জীবনযাপন করা, স্থূলতা বা অতিরিক্ত মোটা হওয়া। হাঁটা-চলা বা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের মেদ কমে যায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে আসে। ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে আসে। দৈনিক এক ঘণ্টা করে সপ্তাহে পাঁচ দিন হাঁটার মাধ্যমে স্ট্রোকের ঝুঁকি শতকরা ৫০ ভাগ কমে যায়।

কর্মক্ষমতা: হাঁটার সময় হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি এবং রক্ত সরবরাহ বাড়ে, এগুলো বেশি কর্মক্ষম থাকে। হাঁটার ফলে পেশিতে রক্ত সরবরাহ বাড়ে এবং পেশির শক্তি বাড়ে। শরীরের ওজন কমে। শরীর থাকে ফিট। নিজেকে মনে হয় বেশি শক্তিশালী, মন থাকে প্রফুল্ল এবং সার্বিকভাবে বেড়ে যায় শরীরের কর্মক্ষমতা।

ক্যানসারের ঝুঁকি: কিছু কিছু ক্যানসারের ঝুঁকি হাঁটা-চলার মাধ্যমে কমানো সম্ভব বলে অনেক গবেষণায় দেখা গেছে। ব্রিটিশ জার্নাল অব ক্যানসার স্টাডিতে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাঁটার ফলে খাদ্যনালির নিম্নাংশের ক্যানসারের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ হ্রাস পায়, দীর্ঘমেয়াদি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়, কমে যায় কোলন বা বৃহদান্ত্রের ক্যানসারের আশঙ্কাও।

অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগ: বয়স্ক পুরুষদের এবং পোস্ট-মেনোপজাল বা মাসিক বন্ধের পর নারীদের সাধারণ রোগ হচ্ছে অস্টিওপোরোসিস বা হাড়ের ক্ষয়রোগ। এই রোগে হাড় দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। সামান্য আঘাত বা অল্প উচ্চতা থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে হাড়। নিয়মিত হাঁটা-চলা এ ক্ষেত্রে উপকারী ভূমিকা রাখতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পোস্ট-মেনোপজাল নারী প্রতিদিন অন্তত এক মাইল হাঁটেন, তাদের হাড়ের ঘনত্ব কম হাঁটা নারীদের তুলনায় বেশি। হাঁটার ফলে যেমন হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা হ্রাস পায়, তেমনি আর্থ্রাইটিসসহ হাড়ের নানা রোগ হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়।

মানসিক স্বাস্থ্য: হাঁটলে মস্তিষ্কে ভালো লাগার কিছু পদার্থ যেমন এনডর্ফিন, ডোপামিন, সেরোটোনিন নিঃসরণ হয়। ফলে মনমেজাজ থাকে ভালো। হাঁটার ফলে মনে ভালো লাগার অনুভূতি জাগে, মানসিক চাপ বোধ কম হয়। এনডর্ফিন নামক রাসায়নিকের ক্রিয়া বেড়ে গেলে ঘুম আরামদায়ক হয়। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ দিন হাঁটার ফলে বিষণ্নতার উপসর্গ ৪৭ শতাংশ হ্রাস পায়। অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে নারীরা সপ্তাহে অন্তত দেড় ঘণ্টা হাঁটেন, তাদের বোধশক্তি সপ্তাহে ৪০ মিনিটের কম হাঁটা নারীদের তুলনায় বেশি।

হাঁটার আরও কিছু উপকার:
(১) যারা সকালে হাঁটতে অভ্যস্ত, তাদের শরীর ঝরঝরে হয়ে যায়। সার্বিকভাবে শরীর থাকে ফিট, বেড়ে যায় শরীরের কর্মক্ষমতা।

(২) শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, সাধারণ অসুখ-বিসুখ কম হয়। অনেক সময় ইনফ্লেমেশন হলে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে।

(৩) হাঁটার সময় হৃদস্পন্দন আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে এ দুটি ভাইটাল অঙ্গের রক্ত সরবরাহ বাড়ায়।

(৪) হাঁটার ফলে পেশিতে রক্ত সরবরাহ বাড়ে, পেশির শক্তি বাড়ে, শরীরের ওজন থাকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে।

(৫) দুশ্চিন্তা কমায় ও মানসিক প্রশান্তি বাড়ায়, শরীর মন চাঙ্গা রাখে।

(৬) অসংক্রামক রোগ-প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

(৭) ফুসফুসের অক্সিজেন ধারণ সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

জেনে রাখা ভালো: হাঁটার উপকার পেতে প্রতিদিন, ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট ধরে হাঁটতে হবে। সম্ভব হলে হাঁটতে হবে যথেষ্ট দ্রুতগতিতে যেন শরীরটা একটু ঘামে। নিম্নে কিছু টিপস দেওয়া হলো :

(১) হাঁটা শুরু করার প্রথম ও শেষের ৫-১০ মিনিট আস্তে হেঁটে শরীরকে ওয়ার্মআপ এবং ওয়ার্ম ডাউন করা উচিত।

(২) হাঁটার আগে এবং পরে একটু পানি পান করুন।
(৩) খাওয়ার পর পরই হাঁটবেন না। ৪৫ মিনিট থেকে ৬০ মিনিট অপেক্ষা করুন।

(৪) দুপুরের ভরা রোদে হাঁটবেন না। সকাল বা বিকেলের একটি সময় বেছে নিন।

(৫) হাঁটা শেষ করে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে কিছু খেয়ে নিন।

(৬) অনেককে দেখা যায় অনেকক্ষণ হেঁটে বা ব্যায়াম করার পর ক্লান্ত হয়ে কোক, পেপসি, কেক বা মিষ্টিজাতীয় খাদ্য খেয়ে ফেলেন। এগুলো ওজন কমানোর সহায়ক কিছু হয় না।

কখন হাঁটবেন: সকালে হাঁটবেন, নাকি বিকেলে বা সন্ধ্যায়, এ নিয়ে কিছুটা বিতর্ক আছে। কেউ বলেন, সকালের চেয়ে বিকেলে হাঁটা হৃদযন্ত্রের জন্য ভালো। তবে কারও কারও মতে ভোরে খালি পেটে হাঁটা ওজন এবং রক্তে চর্বির মাত্রা কমাতে বেশি সহায়ক। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত, হাঁটার প্রকৃত সুফল পাওয়ার জন্য প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে পাঁচ দিন বা মোট ১৫০ মিনিট হাঁটতে হবে, তা সকালেই হোক বা বিকেলেই হোক। তবে নির্দিষ্ট করে প্রতিদিন একই সময় বেছে নিলেই ভালো।
হাঁটার উপকারিতা অনেক এবং যেকোনোভাবে হাঁটা-চলা করলে কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই হবে। তবে শারীরিক অসুস্থতা থাকলে কতটুকু হাঁটা যাবে, তা চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে জেনে নেওয়া উচিত। সমাজের সব মানুষের শারীরিক, মানসিক সুস্থতা ও রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, অসংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ এবং মাদক ও স্মার্টফোন আসক্তি থেকে দূরে রাখতে হাঁটার কোনো বিকল্প নেই। তাই সব বয়সের, নারী-পুরুষ সবাই কম-বেশি হাঁটুন, সুস্থ থাকুন।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


একজন শেখ হাসিনা, তারুণ্যের কলমে যিনি সফলতার গল্প লেখেন

তুষার মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত
আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তুষার মাহমুদ

তারুণ্যের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে মুক্তির বরাভয়, জাগরণের নব ইতিহাস। তরুণরা হলো চেতনা আর বিপ্লবের হংসদূত। সুপ্রাচীন কাল থেকে কৃষি এবং বাণিজ্যের উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত এই বাংলা দেখেছে বহু বিজাতি,বিভাষী, বিদেশিদের শাসন-শোষণ। লালসায় তুষ্ট বিদেশি বণিকদের দ্বারা শোষিত এই বাংলার ভূমি। সর্বশেষ ইংরেজ কর্তৃক নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে ১৯০ বছরের জন্য অস্তমিত করে রাখা হয়েছিল।

ইংরেজরা বিতাড়িত হওয়ার পর ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাঙালির বহু আশা,আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা আরও ম্লান হতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা। দিনের পর দিন শাসন,শোষণ আর লাঞ্ছনা,বঞ্চনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে বাঙালিকে। সবকিছু ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা যখন বাংলার মানুষের মুখের ভাষা ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তৎপর হয় এদেশের বিপ্লবী ছাত্রজনতা তখন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে অর্থাৎ সেদিন তরুণরা তাদের মায়ের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেয়নি। ১৯৫২ সালে সংগ্রাম আর অকুতোভয় দুঃসাহস আর বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করেছে।

১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এদেশের তরুণ প্রজন্ম তথা ছাত্রসমাজ রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে দেশের প্রয়োজনে, মাতৃভূমির প্রয়োজনে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সংকটকালীন সময়ে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন তারুণ্যের শক্তির কাছে সকল অপশক্তি ম্লান হয়ে যায়, বিনাশ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু তরুণ প্রজন্মকে দেশের প্রয়োজনে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দিয়ে ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন এবং সময়ের তাগিদে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় তরুণরা দেশমাতৃকার প্রয়োজনে পরাধীনতার শৃঙ্খল বেধ করতে সচেষ্ট থেকেছে। ১৯৭৫ সালে এদেশ গড়ার কারিগর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে দিয়ে বাঙালির ললাটে যে কালো টীকা এঁকে দেওয়া হয়েছিলো তার উদ্দেশ্য ছিল ঐ পরাজিত পাকিস্তানিদের একটি অন্যতম অ্যাজেন্ডা! পাকিস্তানিরা যা করতে পারেনি তাদের একটি বিপথগামী দালাল গোষ্ঠী সেটি করতে সক্ষম হয়েছে। দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এর থেকে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও যোগ হয়নি। স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ বাঙালিকে পুনরায় গণতন্ত্রের স্বাদ ফিরে দিতে ৯০ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এদের তরুণ প্রজন্ম তথা ছাত্রসমাজ।

তরুণদের হাত ধরেই রাষ্ট্রে ঘটেছে পরিবর্তন, উন্নয়ন। তারুণ্যের এই শক্তিকে যথাযথভাবে পরিচর্যা এবং তরুণদেরকে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করার জন্য সুগম পথ তৈরি পাশাপাশি তাদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরির ব্যাপারে ইতিবাচক নির্দেশনা দিয়েছেন বর্তমান বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠন,যেখানে মূলত তরুণদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্পের অনেকাংশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক সূচকে। এর পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে তরুণদের উদ্যম। এ কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তরুণদের কথা শুনতে চান, নিজের ভাবনার কথাও তাদের জানাতে চান।তরুণদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ‘লেটস টক’-এ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করেছেন। এটি বাস্তবায়নে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ রূপরেখার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও তরুণ প্রজন্মকে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার জন্য তিনি তার বর্তমানকে ত্যাগ করে চলেছেন এবং তিনি প্রায়ই বলে থাকেন আমার বর্তমানকে তরুণ প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আমি উৎসর্গ করেছি, তারাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়বে। যতক্ষণ ক্ষমতায় আছি পরিবর্তিত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপই গ্রহণ করব। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার পথকে গতিশীল এবং শিক্ষার মানকে বৃদ্ধি করার জন্য যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা, আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার,কারিগরি প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বৃদ্ধির লক্ষ্যে শেখ হাসিনা সরকার প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে প্রতিবছর। এছাড়া পড়াশোনা করে শুধু চাকরির পেছনে সময় ব্যয় না করে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের জন্য আয়ের পথ তৈরি করার ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। আর সেজন্য তরুণদের জন্য সহজলভ্য ঋণের ব্যবস্থা করেছেন তিনি।

একটি সময় এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে অস্ত্র থাকতো, খুনাখুনি, হানাহানি এসব ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে বই, খাতা-কলম তুলে দিয়েছেন,অস্ত্রের বদলে কলম চালানোর উপর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি নতুন করে শিখিয়েছেন ‘অসির চেয়ে মসি বড়’। আগামীর সুখী,সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্ভর করছে তারুণ্যের উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতার উপর। আর শেখ হাসিনা এই শক্তি ও সৃজনশীলতাই প্রত্যাশা করেন তরুণদের কাছে।। এজন্যই বলা হয় একজন শেখ হাসিনা,তারুণ্যের কলমে যিনি সফলতার গল্প লিখেন।

লেখক: ছাত্র রাজনৈতিক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়


ঐতিহাসিক ছয় দফা-শহীদের রক্তে লেখা

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
তোফায়েল আহমেদ

প্রতি বছর সাতই জুন, ’ছয় দফা দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় আমরা পালন করি। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ছয় দফা ও সাতই জুন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। জাতীয় জীবনে ছয় দফা ও সাতই জুনের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলার গণমানুষ ১৯৬৬-এর সাতই জুন স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী হরতাল পালন করেছিল। এই দিনে মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ অসংখ্য শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় ঐতিহাসিক ছয় দফা। পরবর্তীতে ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সূচনালগ্নে ছয় দফা দাড়ি-কমা-সেমিকোলনসমেত এগারো দফায় ধারিত হয়ে, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা এক দফা তথা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের অভিপ্রায় থেকেই তিনি জাতির উদ্দেশে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদান করেছিলেন। যে জন্য ছয় দফাকে বলা হয় জাতির মুক্তিসনদ। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের গভীরে সততই প্রবহমান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার বাইরে অন্য কোনো চিন্তা তার ছিল না। জেল-জুলম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সর্বধর্মের, সর্ববর্ণের, সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য তিনি আওয়ামী লীগের দরোজা উন্মুক্ত করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যার যার ধর্ম সেই সেই পালন করবে। কারও ধর্ম পালনে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এ দেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। এর বিপরীতে বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক কনভেনশনে বাংলার গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি সংবলিত বাঙালির ‘মুক্তিসনদ’ খ্যাত ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা দাবি’ উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ‘ছয় দফা দাবি’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘ছয় দফা’ দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়। ‘ছয় দফা’ ঘোষণার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তার সফরসঙ্গীসহ ’৬৬-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি, চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানের জনসভায় ‘ছয় দফা’কে ‘নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ’ হিসেবে উল্লেখ করে চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘এক দিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলার বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ে সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসী চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর দলের আসন্ন কাউন্সিল সামনে রেখে ‘ছয় দফা’র যৌক্তিকতা তুলে ধরতে তিনি একের পর এক জনসভা করেন। এরই অংশ হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি, নোয়াখালীর মাইজদী, ওই দিনই বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর ও ১৪ মার্চ সিলেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় জনতার দরবারে তার বক্তব্য পেশ করেন।

‘ছয় দফা’ প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট ‘উপ কমিটি’ গঠন এবং তারই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। একই বছরের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এ দিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। দলের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গীত হয়। বাঙালির বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’কে উপলক্ষ করে ’৬৬-এর মার্চে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সে দিনের সেই কাউন্সিল সভায় আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে। ‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করা হয়। ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয় তা পরবর্তীকালে ‘ছয় দফা’র চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল। ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ‘ছয় দফা’ এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাংলার প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে এই পুস্তিকা সযত্নে রক্ষিত হয়েছিল। ‘ছয় দফা’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ বস্তুত, ‘ছয় দফা’ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর। কাউন্সিল অধিবেশনের শেষ দিন অর্থাৎ ২০ মার্চ চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দলীয় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকারের এই বাণী লয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনে-শুনেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।’

আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন, যা ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল। কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব বলেছিলেন, ‘ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপস নেই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নেই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়- এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।’ স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’ বঙ্গবন্ধু জানতেন, ‘ছয় দফা’ই কেবল বাঙালির স্বাধিকার তথা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত কর অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ পাঞ্জাবিরা ‘ছয় দফা’ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংখ্যাগুরু বাঙালির রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ ঠেকাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে- যা পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। সফলভাবে সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু সারা দেশ চষে বেড়ান। ২৬ মার্চ সন্দ্বীপ এবং ২৭ মার্চ সাতকানিয়ার বিশাল জনসভায় ‘ছয় দফা কর্মসূচি’ ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করেন। এরপর উত্তরাঞ্চল সফরে যান ’৬৬-এর ৭ এপ্রিল। ওই দিন পাবনা ও নগরবাড়ির জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। একই মাসের ৮ তারিখ বগুড়া, ৯ তারিখ রংপুর, ১০ তারিখ দিনাজপুর, ১১ তারিখ রাজশাহী, ১৪ তারিখ ফরিদপুর, ১৫ তারিখ কুষ্টিয়া, ১৬ তারিখ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন। এভাবে সারা দেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। বিপুল সংখ্যক জনতার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত লাগাতার জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ‘ছয় দফা’র সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্মম গ্রেপ্তার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্ট বলে লাগাতার গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ১৭ এপ্রিল রাত ৪টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণদান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারিকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ (৫) ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস হতে তিনি জামিন পান। সে দিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, পুনরায় জামিনের আবেদন এবং ২৩ তারিখ জামিন লাভ। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। ‘ছয় দফা’ প্রচারকালে তিন মাসে বঙ্গবন্ধুকে সর্বমোট ৮ বার গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই আইয়ুবের দমন নীতি অব্যাহত থাকে। একই বছরের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে এবং পাটের মালায় ভূষিত করে। ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ ধারা বলে তাকেসহ তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ‘ছয় দফা’ দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালায়। সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ‘ছয় দফা’র প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। হাজার হাজার শ্রমিক এ দিন স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমন নীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নেতৃবন্দের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘সাতই জুন’ সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়।

সাতই জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আব্দুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সে দিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁয় শ্রমিক মনু মিয়া, আদমজীতে মুজিবুল্লাহসহ এগারো জন শহীদ হন এবং প্রায় আটশ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়। তেজগাঁ শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তারা সেখানে বক্তৃতা করেন। প্রকৃতপক্ষে সাতই জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু। আর আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল এ দিনটিতেই।

বায়ন্নের একুশে ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বর, ‘শিক্ষা আন্দোলন’; ‘৬৬-এর ৭ জুন, ‘ছয় দফা আন্দোলন’; ’৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়রি, ‘গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান’; ৯ ফেব্রুয়ারি, ১১-দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ‘শপথ দিবস’ পালন; স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ; আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি, লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম প্রদান; অতঃপর ২২ ফেব্রুয়ারি, সব রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে ‘মুক্ত মানব শেখ মুজিব’কে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান। পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করেছে গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করে নিয়েছে বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। অতীতে আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতি বছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। বিধান মোতাবেক ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর আমি ছাত্রলীগের সভাপতি এবং আ স ম আব্দুর রব সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে এক বছর পর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২১ মার্চের মধ্যে সম্মেলন করে নূরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজের কাছে নেতৃত্বের দায়িত্বভার অর্পণ করে আমাদের কমিটি বিদায় নিই এবং ২২ মার্চ হল ত্যাগ করে গ্রিন রোডে ‘চন্দ্রশীলা’ নামে একটি বাসা ভাড়া করে আমি এবং রাজ্জাক ভাই বসবাস শুরু করি। আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই স্মৃতির পাতায় দেখি, সে দিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায় তথা ‘মুজিব আদর্শ’ প্রতিষ্ঠার ভ্যানগার্ড। মূলত বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বই সে দিন সারা দেশে সাতই জুনের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে স্বাধিকারের পথে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। আর বাংলার মেহনতী মানুষ আত্মত্যাগের অপার মহিমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীসহ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ‘ছয় দফা’ই হচ্ছে বাঙালির জাতীয় মুক্তির একমাত্র পথ।

‘ছয় দফা’কে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ‘ছয় দফা’র প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতিজ্ঞাবোধ তাকে জনমনে জনগণমন অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করে। ’৬৬-এর ৮ মে বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নিক্ষেপ করে তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়েও ‘ছয় দফা’ আন্দোলনকে যখন রোধ করা যাচ্ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে চিরতরে তার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ মামলা দেন। ‘ছয় দফা’ দাবি আদায়ে এবং বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করতে বাংলার সর্বস্তরের মানুষসহ আমরা যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ’৬৯-এর ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয় দফাকে এগারো দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলে এগারো দফা আন্দোলনের সপক্ষে সারা দেশে যে গণজোয়ার তৈরি হয় তাতে দেশে বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। শাসকশ্রেণি গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আমাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিত্রিত করে। তাদের এই অপপ্রয়াসের সমুচিত জবাব দিতে ’৬৯-এর ৯ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শপথ দিবসের জনসমুদ্রে বলেছিলাম, ‘পূর্ব বাংলার মানুষ কোনোদিন বিচ্ছিন্নতাকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং বিচ্ছিন্নতায় বিশ্বাসীও নয়। কারণ তারা সংখ্যায় শতকরা ৫৬ জন। যদি কারও পূর্ব বাংলার সঙ্গে থাকতে আপত্তি থাকে তবে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।’ নেতার এই নির্দেশ আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মেনে চলেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর আগ পর্যন্ত কোনোরকম উগ্রতাকে অতি বিপ্লবীপনাকে আমরা প্রশ্রয় দিইনি। নিয়মতন্ত্রের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগে আমাদের কখনোই অভিযুক্ত করা যায়নি। আমরা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ন্যায্যতা প্রমাণ করে মুক্তি সংগ্রামী হিসেবেই এগিয়ে গেছি। আর এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে সাতই জুনের কর্মসূচি পালনকালে শহীদদের বীরত্বপূর্ণ আত্মদান। সাতই জুন ছিল এর সূচনাবিন্দু। আমাদের জাতীয় জীবনে শত শহীদের রক্তে লেখা এ দিনটি চেতনায় জাতীয় মুক্তির যে অগ্নিশিখার জন্ম দিয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ’৭০-এর ২ জুন, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এবং তারই নির্দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগদান করি।

আজ ৭ জুন, অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহে আমার জীবন ধন্য। সাতই জুনের চেতনাবহ এই দিনটি আমার জীবনে অম্লান হয়ে আছে। সাতই জুনে যে সকল শহীদ ভাইয়েরা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, বাংলার মানুষের মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে গিয়েছেন তাদেরকে পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। তাদের অমর প্রাণের বিনিময়ে সংগ্রাম পরম্পরায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঐতিহাসিক সাতই জুন ছিল আমাদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চেতনার প্রারম্ভ বিন্দু। এই দিনটিতে সাতই জুনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন কর্তব্য বলে মনে করি।

লেখক: উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ

বিষয়:

যানজট: সমাধানের প্রস্তাবনা

আপডেটেড ৬ জুন, ২০২৪ ১২:২৬
সৈয়দ এনাম-উল-আজিম

যানজট- বাংলাদেশের বহুল আলোচিত একটি শব্দ ও সমস্যা। আমাদের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনার এক যন্ত্রণাময় চিত্র। ঢাকাসহ দেশের বৃহত্তম নগরীগুলোয় যানজটে নাকাল হয়ে আমাদের মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে যেমন কাজের গতি ও উন্নয়নকে করছে ব্যাহত তেমনি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ককেও শিথিল করে তুলছে। যানজটে ক্লিষ্ট হওয়ার ভয়ে আমরা শারীরিকভাবে চলাফেরা কমিয়ে দিচ্ছি। বাধ্য হয়ে যারা রাস্তায় বা পরিবহনে উঠছি তারা সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি বায়ু ও শব্দদূষণের শিকার হয়ে শারীরিক-মানসিক অসুস্থতাকে নির্বাদে আলিঙ্গন করছি। এই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের যানজটের বাস্তবতা।

বাংলাদেশ- এক সময় জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদী-নালা ও মাটির মেঠো পথের একটি দেশ ছিল। এখন সেই অনেক নদী-নালা শুকিয়ে আর মাটির মেঠো পথে ইট বিছিয়ে তৈরি হয়েছে গ্রামীণ সড়ক নেট ওয়ার্ক। গ্রামীণ সড়কের মর্যাদা নাগরিক সভ্যতাকে টেনে নিয়ে গেছে গ্রামের জনপদে। নৌকা বা হাঁটার স্থলে যান্ত্রিক পরিবহন গ্রামীণ জনজীবনকে গতিশীল ও আরামদায়ক করেছে সন্দেহ নেই। জীবনযাত্রারমান ও স্টাইলেও এসেছে অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন। নতুন নতুন পরিবহন তথা অটো, পিকআপ, টেক্সি, লেগুনা, নসিমন, বাস অনুপ্রবেশ করেছে গ্রামের সড়কে। যোগাযোগ উন্নত হওয়ার পাশাপাশি তাই সাধারণ বেকারদের হয়েছে কর্মসংস্থান, প্রসার ঘটেছে ব্যবসা-বাণিজ্যেরও। এক কথায় গ্রামীণ চিত্র পাল্টে গেছে উন্নয়নের ছোঁয়ায়।

সাম্প্রতিক গ্রামীণ ও শহরের সড়ক উন্নয়নকে যেমন স্বাীকার করতে হবে পাশাপাশি এর সমস্যা ও সম্ভাবনার হিসাবটিও আমাদের মাথায় রাখা দরকার। উন্নয়নকে অদম্য অগ্রযাত্রার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করার সময় এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো চিহ্নিত ও পরিকল্পিত সমাধানের ব্যবস্থা না নিলে যেকোনো উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়তে সময় নেবে না। বলা যায়- লেজে-গোবরে এক হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। যেটা আমরা এখনই অত্যন্ত তিক্ততার সঙ্গে লক্ষ্য করছি আমাদের সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায়।

গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে গ্রামের ও মফস্বল শহরের জীবনযাত্রা ও উন্নতির বিপরীতে জেলা, মহানগর আর রাজধানী ঢাকার চিত্র ঠিক উল্টো। এখানে পাকা রাস্তা বাড়েনি, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে আর বাড়ানোর সুযোগও নেই। অথচ বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, পিকআপ, ট্রাক, মোটরসাইকেল, সরকারি-বেসরকারি পরিবহন সার্ভিস, যোগ হয়েছে অটোরিকশার লাগামহীন বহর। যার ফলে চিরায়ত, পুরোনো মাপের সড়কগুলো, গলির রাস্তাগুলো সব সময়ই অচল আর স্থির হয়ে থাকছে মাত্রাতিরিক্ত গাড়ির চাপে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থেকে যন্ত্রণায় ভোগা, মূল্যবান কর্মঘণ্টার অপচয় আর জ্বালানি পোড়ানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। সেই সঙ্গে গাড়ির জ্বালানি থেকে নির্গত ধোঁয়া আর হর্নের তির্যক শব্দ ঢাকাসহ মহানগরগুলোর পরিবেশকে যেভাবে দূষিত করছে তার ক্ষতি পোশানোর কোনো কার্যকর ব্যবস্থা এখনো চোখে পড়ার মতো নয়।

২০১০ সালে ঢাকাসহ মহানগরগুলোর অভ্যন্তরীণ এবং মহানগরগুলোর সঙ্গে যুক্ত আন্তজেলা সড়কের পরিমাপ যা ছিল এখনো তাই আছে। হয়েছে সংস্কার, কোথাও কোথাও সরু সড়ক একটু চওড়া হয়েছে; কিন্তু বিআরটিএর ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে দেখা যায়, গাড়ি চলার মতো উপযোগী সড়ক সেভাবে না বাড়লেও নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। কিছু উড়াল সড়ক এবং মেট্রোরেলের ব্যবস্থা সেই ঘাটতি পূরণে কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। কারণ নিবন্ধিত গাড়িগুলো তো সড়ক ছাড়েনি। তাই যানজট মুক্ত হওয়ার কোনো সুলক্ষণ নগরবাসী দেখছে না। এ বিষয়ে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমার কিছু ৭টি প্রস্তাবনা নিম্নে তুলে ধরলাম-

০১। অনিবন্ধিত সব যানবাহনকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করাতে হবে।

০২। গাড়ির মান ও ধরন ভেদে সব গাড়ির মেয়াদকাল নির্ধারিত হওয়া দরকার। মেয়াদ শেষে সেই গাড়িগুলোকে ঢাকাসহ সব মহনগর ও জেলা শহরে চলাচল নিষিদ্ধ করে বিআরটিএর বিশেষ অনুমোদন সাপেক্ষে মফস্বলে চলার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

০৩। প্রতি বছর যে পরিমাণ গাড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ হবে সরকারি কর্মচারীদের অবসরে যাওয়ার মতো তাদেরও সড়ক নগর-মহানগরের সড়ক থেকে বিদায় জানিয়ে সেই স্থলে নতুন গাড়ির নিবন্ধন প্রথা চালু করা যেতে পারে।

০৪। গাড়ি নিবন্ধনের আগে কোন এলাকায় গাড়িটি চলবে সেই সড়কের ধারণক্ষমতা আছে কি না যাচাই করা যেতে পারে।

০৫। এক ব্যক্তি বা তার পরিবারের জন্য একের অধিক ব্যক্তিগত গাড়ি নিবন্ধন দেওয়া নিরুৎসাহিত করা যেতে পারে।

০৬। পরিকল্পিত নগরায়ণ ও সড়ক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সড়ক নির্মাণে মনোযোগী হতে হবে।

০৭। অগ্রাধিকার দিতে হবে সড়ক উন্নয়ন এবং মেট্রোরেল ও উড়াল সড়কের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কাজকে।

যথাযথ কর্তৃপক্ষ যদি একটু গভীর মনোযোগ দিয়ে সমাধানের উপায়গুলো নিয়ে কাজ করেন তাহলে আশা করা যায় আমাদের যানজট সমস্যা অনেকাংশে কমে গিয়ে একটি সুন্দর ও স্বস্থিকর সড়ক ব্যবস্থাপনা এ দেশেও আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারব। দেশ হবে যানজটের অপবাদ মুক্ত।

লেখক: কলামিস্ট


প্লাস্টিক ও পলিথিন পরিবেশ দূষণীয়

আপডেটেড ৬ জুন, ২০২৪ ১২:২৭
সৈয়দ শাকিল আহাদ

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য উপাদান হলো প্লাস্টিক ও পলিথিন যা প্রতিদিন ঘুমভাঙা থেকে ঘুমুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে।

এই প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য যা পোড়ালে বাতাস দূষিত হয়, মাটিতে ফেলে রাখলে মাটি নষ্ট হয়, নদীতে বা সাগরে ফেলে দিলে সেখানেও পানিদূষণ হয়। এগুলো কখনো পচেও না বা গলেও না অর্থাৎ অপচনশীল দ্রব্য। এ দেশের ফসলি জমি, শহরের ড্রেন, নদ-নদী, খাল-বিলের মাটি, পানি ও পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে ক্রমাগত ঠেলে দিচ্ছে এই প্লাস্টিক সুতরাং প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার যত দ্রুত সম্ভব ক্রমান্বয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এবং সবাইকে এর ভয়াবহতা বুঝতে হবে। এটা যে আমাদের পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও মানবদেহের জন্য কতটা ক্ষতিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ তার বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। নদী কিংবা সমুদ্রগুলোতে অনেক বেশি প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলার কারণে তা পানির নিচে স্তূপাকারে জমা হচ্ছে। ফলে নদীর মাছ এই অপচনশীল দ্রব্য এবং সামুদ্রিক মাছও তা খায়। আমরা ওই মাছ খাওয়ার পর প্রায়ই নানারূপ শারীরিক সমস্যা হয়ে থাকে যা পরবর্তীতে টের পাই। প্রতি বছরে প্রায় ৯ লাখ টন প্লাস্টিক আমাদের সাগর কিংবা মহাসাগরে জমা হচ্ছে। এভাবে যদি জমার পরিমাণ বাড়তেই থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের দিকে তার সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টন, তা কতটা ভয়াবহ হবে, কেউ কি একবার তা ভেবে দেখেছেন? এখনি একটু ভাবতে হবে।

বাংলাদেশে এক সময় মৃৎশিল্পের বা মাটির তৈরি জিনিসের ব্যাপক প্রচলন ছিল। শহরে চিনামাটির ও কাচের অ্যালুমিনিয়ামের তামা, কাঁসা, পিতলের তৈজসপত্রের ব্যবহার ছিল কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসব শিল্প প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশে কামার ও কুমারের সংখ্যা অনেকটাই কমে গেছে। মানুষ এখন মাটির তৈরি জিনিস শৌখিন পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, ড্রয়িং রুমে সাজিয়ে রাখে কিন্তু আমাদের দৈনন্দিন জীবনচর্চায় এটি আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি পাট, কাঠ, বাঁশ, বেত ইত্যাদির তৈরি পণ্য ব্যবহার করতে পারি, তাহলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে। সহজলভ্য হবে এবং আনন্দের বিষয় যে এসব পণ্য আবার পরিবেশবান্ধবও। এসব পণ্য আমরা আমাদের অফিস-আদালত, বাসা-বাড়ি থেকে শুরু করে সর্বত্র ব্যবহার করতে পারি। পানির বোতল, কাপ, প্লেট, চামচ ইত্যাদি অনেক পণ্যের বিকল্প কাগজের তৈরি পণ্যও রয়েছে। তবে আমরা হরহামেশাই ছোটখাটো সব কাজেই কমবেশি পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করছি। পাটের তৈরি ব্যাগ পলিথিনের বিকল্প হতে পারে। অতীতে আমরা মাটির পাত্র, কাঁসার পাত্র, সিরামিক ও কাচের পাত্রের ব্যাপকহারে ব্যবহার করতাম; কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তা বরং কমে গেছে।

পলিথিনের মধ্য থেকে বিষফেনোল নামক বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না, বরং মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে। ডাস্টবিনে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে পড়ে। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। পলিথিন নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদীর তলদেশ ভরাট করে ফেলে। পলিথিন পোড়ালে তাতে বায়ুদূষণ ঘটে। বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন শুরু হয়। পলিথিনের অতি ব্যবহারের কারণে ১৯৯৮ সালে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

পলিথিন দামে সস্তা কিন্তু এর বিকল্প পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ উদ্ভাবন হওয়া সত্ত্বেও শুধু সরকারি উদ্যোগ ও উদাসীনতার অভাবে পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্জ্য পদার্থ রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত পলিথিন ব্যাগ শুধু খাদ্যসামগ্রীকেই বিষাক্ত করছে তা নয়, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে শহরগুলোতে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার। কেননা শহরের নর্দমা ও বর্জ্য নির্গমনের পথগুলো পলিথিন দ্বারা পূর্ণ। পলিথিনের কারণে পানি আটকে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। ব্যবহৃত পলিথিন গলিয়ে আবার ব্যবহার করায় এতে রয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, যা থেকে ক্যানসার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজসহ জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।

পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসার মতে, শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।

পরিবেশ দূষণের দায়ে কল-কারখানাকে জরিমানা কিংবা নদ-নদী ও জলাশয় দূষণ বা দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো হলেও পলিথিনের ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ তেমন নেই বললেই চলে। এ কারণে সর্বত্র নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও এ অপরাধ বন্ধে সচেতনতারই বেশি দরকার। তবু আইনের প্রয়োগও বাড়াতে হবে। না হলে এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। এ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবাধে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এ ছাড়া বর্তমানে পলিথিনের কাঁচামাল দিয়ে এক ধরনের টিস্যু পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদনকারীরা বলছে, এটা ‘পরিবেশবান্ধব’। কিন্তু বুয়েটের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, পলিথিনের মতোই টিস্যু পলিথিন পরিবেশের জন্য ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’। অথচ, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে নতুন উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব পাটের সোনালি ব্যাগ সহজেই ব্যবহার করা যায়, দরকার শুধু সকলের উদ্যোগ ও সদিচ্ছা।

পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার রোধে প্রশাসন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে অধিক সতর্ক হতে হবে এবং পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২টি দেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সব দেশই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে শাস্তির বিধান করলেও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কেনিয়া সরকার কারও হাতে পলিথিন দেখলেই গ্রেপ্তার করার বিধান জারি করেছিল। আয়ারল্যান্ড সরকার পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বাড়তি করারোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেনও এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উগান্ডার বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল, কিন্তু পলিথিনের বিকল্প জানা না থাকায় তা বেশি দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি।

পানিতে বর্জ্যের ৭০ শতাংশ পলিথিন ব্যাগ। এ কারণে ২০২০ সাল থেকে ইউরোপের দেশগুলোতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার আইন করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। ইউরোপেই বছরে ১০০ বিলিয়ন (১০ হাজার কোটি) পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। এসব দেশ পলিথিন ব্যাগ বন্ধে আইন করলেও বিকল্প জানা না থাকায় এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। প্রতি মাসে ৪ কোটি ১০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে পলিথিনের বিকল্প সোনালি ব্যাগ তৈরি করে সাড়া ফেলার পর এখন বৃহৎ পরিসরে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারলে এটি দিয়েই দেশীয় বাজারের পাশাপাশি বিশ্ববাজার দখল করা সম্ভব।

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ বিশ্বজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন পাটের এই প্রাকৃতিক পলিব্যাগ বিশ্বের পরিবেশ দূষণ কমাতে সহায়তা করবে। দেশীয় চেইনশপগুলো এই সোনালি ব্যাগ ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ জন্য দরকার সরকারি উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি।

বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল পলিব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পাটের সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারলে তা যেমন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে, তেমনি রক্ষা পাবে আমাদের পলিথিন ব্যাগে কলুষিত পরিবেশ।

এখন কাগজ ও পাটের ব্যাগের ব্যবহারই আমাদের পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে পরিবেশকে সুরক্ষা দিতে পারে। পাটের সোনালি ব্যাগ পরিবেশবান্ধব ও দামে সাশ্রয়ী। পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাত বন্ধে সরকারের ব্যাপক নজরদারিসহ গণমাধ্যমগুলোতে (রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) ব্যাপক প্রচারণা দরকার। পাশাপাশি পাটের ও কাগজের ব্যাগের ইতিবাচক দিক, সাশ্রয়ী দাম ও সহজে প্রাপ্তির বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষায় পলিথিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়া দরকার।

তাই নিজেদের স্বার্থে এবং পরিবেশের সুরক্ষায় ক্ষতিকর পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কারণ এগুলো অতিপ্রয়োজনীয় পানি এবং মাটি মারাত্মকভাবে দূষণ করছে। বিভিন্নভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ক্যানসারের সৃষ্টি করছে। এর বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার তৈরি হয় পেট্রোলিয়াম থেকে। এই বিপুল পরিমাণ পলিথিন ব্যাগ তৈরিতে প্রতি বছর পৃথিবীজুড়ে মোট খনিজ তেলের ৪ শতাংশ ব্যবহৃত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পাট থেকে তৈরি থলে বা বস্তা পোড়ালে বাতাসে ২ গিগা জুল তাপ এবং ১৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাইঅক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১৩৪০ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা ওয়াসার মতে, শুধু ঢাকায় ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ ভূপৃষ্ঠের নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে মাটির নিচেও সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে জমির শস্য উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করছে। একই সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যে রয়েছে পলিথিনের অবদান, যা থেকে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনা ঘটছে। এসব ক্ষতির বিবেচনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাদ্যশস্য ও চিনি মোড়কীকরণ করার জন্য পরিবেশবান্ধব পাটের বস্তা বা থলে ব্যবহারের সুপারিশ করেছে।

প্রায় ২৫ বছর আগে করা পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ২০০২ সালে সংশোধনী এনে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। সরকার এ ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ৬(ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে। শুধু প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলেই পলিথিনের ব্যবহার রোধ করা সম্ভব। এজন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরকে অধিক সতর্ক হতে হবে এবং পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধকরণ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৭২টি দেশ পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। সব দেশই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে শাস্তির বিধান করলেও ব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। কেনিয়া সরকার কারও হাতে পলিথিন দেখলেই গ্রেপ্তার করার বিধান জারি করেছিল। আয়ারল্যান্ড সরকার পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমাতে বাড়তি কর আরোপ করেছে। পর্তুগাল, স্পেনও এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। উগান্ডার বিমানবন্দরে পলিথিনসহ কাউকে পেলে তাকে গ্রেপ্তার করার বিধান রাখা হয়েছিল, কিন্তু পলিথিনের বিকল্প জানা না থাকায় তা বেশি দিন বাস্তবায়ন করা যায়নি।

পরিবেশ দূষণের দায়ে কল-কারখানাকে জরিমানা কিংবা নদ-নদী ও জলাশয় দূষণ বা দখলকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ভূমিকা চোখে পড়ার মতো হলেও পলিথিনের ব্যবহার রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ তেমন নেই বললেই চলে। এ কারণে সর্বত্র নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। যদিও এ অপরাধ বন্ধে সচেতনতারই বেশি দরকার। তবু আইনের প্রয়োগও বাড়াতে হবে। না হলে এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। এ আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা অবাধে নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। এ ছাড়া বর্তমানে পলিথিনের কাঁচামাল দিয়ে এক ধরনের টিস্যু পলিথিন উৎপাদন করা হচ্ছে। উৎপাদনকারীরা বলছে, এটা ‘পরিবেশবান্ধব’। কিন্তু বুয়েটের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, পলিথিনের মতোই টিস্যু পলিথিন পরিবেশের জন্য ‘মারাত্মক ক্ষতিকর’। অথচ, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে নতুন উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব পাটের সোনালি ব্যাগ সহজেই ব্যবহার করা যায়, দরকার শুধু সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ও ব্যবসায়ীসহ আপামর জনসাধারণদের সদিচ্ছা।

পরিবেশের সৌন্দর্যবর্ধনে আমাদের ব্যক্তিপর্যায়ে প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কীভাবে রোধ করা যায়, তার পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন বাজার থেকে শুরু করে বাসাবাড়িতেও প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে। সুতরাং এ বিষয়ে সবাইকে অনেক অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পাশাপাশি যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখা। প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য বজায় রাখতে আপামর জনসাধারণসহ প্রশাসনের সর্বত্র সজাগ দৃষ্টি রাখতে সবাইকে অনুরোধ করেছেন। আমাদের সবার উচিত প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের সর্বত্র যতটুকু সম্ভব প্লাস্টিক ও পলিথিন যা আমাদের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর তা পরিহার করা ও এটার মর্মার্থ অনুধাবন করা প্রতিটি নাগরিকের আবশ্যিক কর্তব্য পালন করা।

লেখক: পরিবেশবিষয়ক গবেষক


জামায়াত-কমিউনিস্ট পার্টির সাদৃশ্যকরণ বিভ্রান্তিকর

আপডেটেড ৬ জুন, ২০২৪ ১২:২৮
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২ জুন তারিখে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের এক স্মরণসভায় জামায়াতের রাজনীতির মধ্যে বৈজ্ঞানিক কৌশলের চর্চার ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে সেটিকে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক চর্চার অনুকরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তার এই দুই মেরুর দুই আদর্শের রাজনীতির চর্চার সাদৃশ্যকরণ নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু কিছু আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। তবে কোনো কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এ ধরনের তুলনাকরণ নিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবাদ গণমাধ্যমের কোথাও চোখে পড়েনি। বিষয়টি নিয়ে অনেকের মধ্যেই বেশ বিভ্রান্তি রয়েছে। দৃশ্যত কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে যেমন বইপুস্তক পড়ার একটি নিয়ম রয়েছে, জামায়াতে ইসলামের মধ্যেও তেমনি তাদের আদর্শের বইপুস্তক পড়ার প্রচলন রয়েছে বলে শোনা যায়। এটি যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তারা মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে হয়তো মিল খুঁজে পাবেন; কিন্তু মির্জা ফখরুল একজন বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের মহাসচিব হয়ে নিজের দলের নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক পড়াশোনার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে কেন জামায়াত শিবিরের অনুসৃত ব্যবস্থার শুধু উদাহরণই দিলেন না, এটিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলেও ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এবং এটিকে কমিউনিস্ট পার্টির চর্চার সঙ্গে একাকার করে দেখলেন- তা বোঝা গেল না। রাজনীতিতে অবশ্যই নেতা-কর্মীদের পড়াশোনা করা দরকার আছে।

বিএনপির নেতা-কর্মীরা কি ধরনের বই পড়বেন বা চর্চা করবেন সেটি তাদের দলীয়নীতি আদর্শ বাস্তবায়নের সঙ্গে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। জিয়াউর রহমানও তার জীবদ্দশায় যখন নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন তিনি বিএনপির একটি গবেষণা সেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেটি ১৯৭৮-৭৯ এর পর বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হতো। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের তখন এই গবেষণা সেলের প্রশিক্ষণ কোর্সে জিয়াউর রহমান সাহেবের বক্তৃতা শুনতে হতো এবং জিয়াউর রহমান সাহেব নেতাদের নানা ধরনের পরীক্ষা নিতেন, অনেকটা যেন হাতে-কলমে রাজনীতি শেখাতেন! জিয়াউর রহমান নিজে ছিলেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর একজন ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কর্মকর্তা। রাজনৈতিক দল কিংবা দলীয় রাজনীতি করার কোনো সুযোগ না থাকলেও গোটা আইয়ুব আমলে তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে বেশ দাপটের সঙ্গেই চাকরি করতেন। আইয়ুবের সামরিক শাসন তার চাকরিজীবনের সেই সময়ের দিনগুলোতেই কেটেছিল। সেখানে সেই সময়ে কর্মরত বেশ কয়েকজন বাঙালি সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্যতা কতটা ছিল তা জানা যায় তাদেরই লেখা বিভিন্ন স্মৃতিমূলক গ্রন্থে। এরপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে থাকার সুবাদে তিনি অংশ নিতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনী তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রধান সেনাপতি পদ লাভ করেন। পরে তিনি সামরিক শাসক থেকে ১৯৭৮ সালে রাজনীতিবিদ হিসেবে পদার্পণ করেন। জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত ‘রাজনীতি ও সমাজ বিজ্ঞান শিক্ষা কেন্দ্রে’ যেসব বক্তৃতা তিনি দিতেন সেগুলো ১৯৯২ সালে ‘জিয়াউর রহমান, আমার রাজনীতির রূপরেখা’ শিরোনামে এ কে এ ফিরোজ নুনের সম্পাদনায় সংকলন আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি ১৯ দফা, জাতীয়তাবাদ, বাঙালি, বাংলাদেশি, ধর্মীয় মূল্যবোধ নানা বিষয়ে তার নিজের মতো করে কতগুলো বক্তৃতা দিয়েছেন। এসব বক্তৃতা অনেকটাই মেঠো বক্তৃতা ছিল। তাতে রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের কোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোচনাই খুঁজে পাওয়া যায় না। যেহেতু তিনি দলের প্রধান তাই বি চৌধুরীসহ অনেকেই যা বক্তৃতা শুনতেন সেগুলোর ওপর নানা কুইজ পরীক্ষাও হতো। জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেব সেই সব পরীক্ষায় নম্বরও দিতেন। অতীতে ডান-বাম রাজনীতি করা পরিচিত অনেক নেতাই জিয়াউর রহমানের এসব প্রশিক্ষণে অংশ নিতেন, তাদের প্রশ্ন-উত্তরে জিয়াউর রহমান সব সময় খুব একটা সদয় হতে পারেননি। সেটি সেই প্রশিক্ষণ পরীক্ষার নমুনাতে এখনো খুঁজলে পাওয়া যাবে। জিয়াউর রহমানের প্রবর্তিত রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ফলাফল বিএনপিকে কি দিয়েছে বা বিএনপি কি লাভ করেছে তা বোধহয় সেই সময়ের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে নেওয়া যেতে পারে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সময় বাম রাজনীতি করতেন। বামদের সে রকম কিছু প্রশিক্ষণের নিয়ম বিভিন্ন সংগঠনে রয়েছে। এটিকে অনেকেই বলে থাকে লাল বই পাঠের চর্চা। সেগুলোতে চেয়ারম্যান মাও সে তুং, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনসহ আরও অনেক মার্কসবাদী নেতাদের লেখা কিংবা তাদের ওপর আলোচিত বই পাঠ করা হতো কিংবা কোনো কোনো নেতা আলোচনা করতেন। আমি এটিকে একেবারেই খারাপ কিছু বলি না। তবে এসব বই পড়ে কতজনই বা কমিউনিস্ট রাজনীতি ভালো করে বুঝেছেন। সেটি একটি ভিন্ন বিষয়, প্রশিক্ষণের দুই-চারটি বই পড়ে কিংবা লেকচার শুনে জটিল মার্কসবাদী লেনিনবাদী দর্শন, অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস জানা বা বোঝা মোটেও খুব সহজ ব্যাপার বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। কমিউনিস্ট আন্দোলনে এসব বইয়ের লেখা তাত্ত্বিক আলোচনা বোঝা না বোঝা থেকেই অনেক বিভ্রান্তি, বিভক্তি কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেই জন্ম নিয়েছিল। সেখান থেকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি, লেনিনবাদী, মাওবাদী, সর্বহারা ইত্যাদি অসংখ্য নামে শুধু পার্টিই নয়, দলের নেতারাও কেউ কেউ নিজেদের কর্মীদের মধ্যে সেভাবে উপস্থাপন করে, তাদের দেশীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তাত্ত্বিক বলেই খেতাব দেওয়া হতে থাকে। অনেকটাই পীরতন্ত্রের প্রভাব এতে দেখা যেত। কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ এবং তাত্ত্বিক তথাকথিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ নিয়ে যেসব দ্বন্দ্ব দেখা যেত তাতে দলীয় বহু নেতা-কর্মীরই জীবন বিপন্ন হতো, হত্যার শিকার হতেন, আদর্শের নামে অনেক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডও এতে চলত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে- আদর্শের জন্য তারা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সেই আদর্শ বোঝা ও ধারণ করা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতো না। এত কম পড়াশোনা জেনে কমিউনিস্ট মতাদর্শকে বোঝা যে সম্ভব নয় সেটি যারা মানতে চান না। তারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণগুলোর ব্যাখ্যা নিজেরাই দিতেন তাহলে কমিউনিস্ট আন্দোলন হয়তো উপকৃত হতো। কমিউনিস্ট আন্দোলন অবশ্যই অনেক মহৎ উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মকাণ্ডকে সামনে নিয়ে গড়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পৃথিবীর প্রায় কোনো দেশেই সেই আদর্শ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। লেনিনের মৃত্যুর পর স্টালিন যা করতে চাইলেন তাতে আর সমাজতন্ত্র আর মার্কসবাদী কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই প্রসঙ্গে আর বেশি কিছু বলার নেই। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টি এখন অতি ক্ষুদ্র একটি দল; কিন্তু মার্কসবাদী বলে পরিচিত অনেকেই এখন বিভিন্ন দলে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। বাম রাজনৈতিক দল বললে এক ধরনের সম্মান পাওয়া যায়; কিন্তু বাম রাজনীতি কেন জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি সেই ব্যাখ্যা বামরাও দিতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টি দলীয় নেতা-কর্মীদের জন্য বইপুস্তক পড়া, প্রশিক্ষণ নেওয়া ইত্যাদির যে ধারা চালু করেছিল সেটি প্রশংসনীয় হলেও তার সুফল রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলেছে সেটি হাজারও বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। সেই বিতর্কে নাই বা গেলাম।

অন্যদিকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জামায়াতে ইসলামের কৌশলকে বৈজ্ঞানিক বলে যে সনদ প্রদান করেছেন সেটি সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা যায় যে ছাত্র সংঘ, ছাত্র শিবির, জামায়াত যেসব বইপুস্তক পড়ে বা পাঠ করায় সেগুলো তাদের দলীয় নেতাদের লেখা বইপুস্তক। গোলাম আযমের লেখা বই পড়ে ছাত্রশিবিরের একজন স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়পর্যায়ের নেতা বা কর্মী যদি নিজেকে রাজনৈতিক প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ভাবতে শুরু করেন এবং দুনিয়ার তাবৎ গবেষণা গ্রন্থকে মিথ্যা কিংবা বিভ্রান্তিকর বলে মনে করেন। তাহলে বলতে হবে এসব প্রশিক্ষণ কিংবা বইপুস্তক পাঠের ফলাফল মোটের ওপর মগজধোলাই ছাড়া আর কিছুই না। পুরোপুরি অন্ধবিশ্বাস তৈরির বেশি কিছু তাদের কথিত বইয়ে বা প্রশিক্ষণে পাওয়া যায় না। ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীরা রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা নিয়ে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি জান্তার সহযোগী হওয়ার বেশি কিছু নিজেদের ভাবেনি, আল-বদর, আল-শামস হয়ে এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে। বুদ্ধিজীবীদের বধ্যভূমিতে নিয়ে পশুর মতো জবাই করেছে। জিয়াউর রহমান সেই জামায়াতে ইসলামকে রাজনীতি করার অনুমোদন দিলে ছাত্রশিবির নামে তাদের ছাত্র সংগঠন মাঠে নামে। মির্জা ফখরুল সাহেবের স্মরণে কতটা আছে জানি না। ছাত্রশিবিরের কর্মীরাই নিজেদের সহপাঠীদের ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসের কারণে হত্যা করতে মোটেও দ্বিধা করেনি। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শাহাদাতকে গলা টিপে হত্যা করেছে তার সহপাঠী ছাত্রশিবিরের কর্মী। কারণ ছাত্রশিবিরের কর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের তাদের আদর্শিক শত্রু হিসেবেই বিশ্বাস করতে শেখে, সেভাবেই শেখানো হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০-এর দশকে ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা কীভাবে অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মী এমনকি শিক্ষককেও হত্যা করেছে সেটি মির্জা ফখরুলের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। গোটা ৮০-এর দশকে জামায়াত ইসলামের শিশু সংগঠন ফুল কুড়ি এবং ছাত্র সংগঠন ছাত্রশিবির সারা দেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাতে নানা ধরনের পাঠচক্র গোপনে পরিচালিত করত। এই পাঠচক্রের ফসলই হচ্ছে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কিশোর, তরুণ শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই করা। জামায়াতে ইসলাম যদিও পাকিস্তানের মওদুদি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামেরই অঙ্গসংগঠন কিন্তু এর মূলে রয়েছে মিসরে প্রতিষ্ঠিত ব্রাদারহুডের আদর্শ তথা সারাবিশ্বে ইসলামী বিপ্লব ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করা। সে আদর্শের বাইরে পৃথিবীর কোনো দর্শনচিন্তা, অর্থনৈতিক তত্ত্ব, বিজ্ঞানসহ আধুনিক জ্ঞানচর্চার কোনো রাজনীতি এই পাঠচক্রে মির্জা ফখরুল দেখাতে পারবেন না। বাংলাদেশে ছাত্রশিবির ও জামায়াত যেসব বইপুস্তক পাঠ করে তা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরির জন্য নয়, তাদের উদ্দেশ্য ‘একটি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা যা ইসলামী বিশ্বব্যবস্থা তৈরিতে ধাবিত হবে।’ সেই দর্শনই জামায়াতে ইসলামের পাঠচক্রের মূল বিষয়। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এটিকে একটি বিজ্ঞানসম্মত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন। মির্জা ফখরুলের অভিহিতকরণ তাকে সন্তুষ্ট করতে পারে; কিন্তু যারা আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি ইত্যাদির জটিল বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেন তাদের কাছে এগুলো কতটা মূল্যহীনই শুধু নয়- রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর, তাও বুঝতে হলে আরও অনেক কিছু পড়াশোনা করতে হবে।

লেখক: ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক


কোনো অবস্থাতেই কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত নয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
মো. রহমত উল্লাহ্

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর শূন্য পদের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা অস্বাভাবিক কম হওয়ায় নানা রকম কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেকোনো চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে যেখানে শূন্য আসনের তুলনায় অনেকগুণ বেশি আবেদন পড়ে সেখানে আবেদনের তুলনায় শূন্য আসন চারগুণের বেশি থাকাটা অবশ্যই একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ। ৯৬ হাজার শূন্য আসনের বিপরীতে আবেদন জমা পড়েছে মাত্র ২৪ হাজার। বিভিন্ন যুক্তিযুক্ত কারণে এর থেকেও বাদ পড়তে পারেন দুই-তিন হাজার প্রার্থী। অর্থাৎ আবেদনকারী প্রায় সবার চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। যারা আবেদন করেছেন তারা নিবন্ধন পরীক্ষায় যত কম নম্বরই পেয়ে থাকুক না কেন সবাই যোগ্য বিবেচিত হবেন। অথচ এই চিত্রটি যদি এমন হতো যে শূন্য পদের সংখ্যা ২৪ হাজার আর আবেদনকারীর সংখ্যা ৯৬ হাজার। তাহলে নিশ্চয়ই তুলনামূলক আরও অনেক বেশি নম্বর প্রাপ্তরা যোগ্য বিবেচিত হতেন, শিক্ষক হতেন। অর্থাৎ আমরা আরও অধিক যোগ্য শিক্ষক পেতাম; যারা আগামী প্রায় ২৫-৩০ বছর অগণিত অধিক যোগ্য নাগরিক তৈরি করতেন; কিন্তু তেমনটি হলো না কেন?

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেছেন, যাদের নিবন্ধন সনদের মেয়াদ ৩ বছরের বেশি হয়েছে এবং যাদের বয়স ৩৫ বছর এর বেশি হয়েছে তারা আবেদন করতে পারেননি বলে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর সংখ্যা অত্যন্ত কম হয়েছে। শুধু ১৬তম ও ১৭তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণরাই আবেদন করতে পেরেছেন। এরমধ্যে ১৬তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ বেশির ভাগ নিবন্ধনধারীর চাকরি চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে হয়ে গেছে। ফলে ১৭তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ২৩ হাজার ৯৮৫ জনের মধ্যে যারা আবেদনের যোগ্য ছিল তারাই পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছেন। তাই তিন-চতুর্থাংশ পদ আপাতত শূন্য থেকে যাবে! অত্যন্ত তথ্যবহুল এই বাস্তব চিত্রটি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের পূর্বানুমান থাকাটাই স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় কেউ কেউ সরাসরি আবার কেউ কেউ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মতামত দিচ্ছেন, যেহেতু নতুন তথা যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের শূন্য পদ দ্রুত পূর্ণ করা আবশ্যক সেহেতু নিবন্ধন সনদের মেয়াদের ক্ষেত্রে ও প্রার্থীদের বয়সের ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদনের সুযোগ দিয়ে এখনই আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া উচিত। আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকলে হয়তো এ দাবি আরও জোরাল হতো এবং তা বাস্তবায়নের জন্য কেউ কেউ সক্রিয় হতেন। আমি মনে করি, তেমন ছাড় দেওয়ার উদাহরণ তৈরি করা মোটেও উচিত নয়। আদালতের নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও তেমনটি করা উচিত হতো না। বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সে ও যোগ্যতায় ছাড় দেওয়া মানেই আমাদের প্রায় ৯৭ শতাংশ সন্তানকে ঠকিয়ে দেওয়া। সাময়িক সুবিধা/অসুবিধা বিবেচনা করে কিংবা বিশেষ প্রার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তড়িঘড়ি করে তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া মানেই দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করা!

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে গত কত দিনে কতজন শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন ছিল এবং আগামী কত দিনে কতজন শিক্ষক অবসরে যাবেন, কতটি পদ শূন্য হবে, কতটি পদ নতুন তৈরি হতে পারে, কতজন শিক্ষক নিয়োগ করা প্রয়োজন হবে এমন একটা সুনির্দিষ্ট ডেটা মেইন্টেন করা খুব একটা কঠিন হওয়ার কথা নয়। মাউশি, বেনবেইস ও এনটিআরসিএ এই তিনটি কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে ডেটা নিয়েই এটি করা সম্ভব। বিশেষ করে ইএমআইএস সেল থেকে শিক্ষকদের যোগদান, পদবি, জন্ম তারিখ ও অবসরের তারিখ সম্পর্কিত সব আপডেট তথ্য এবং এনটিআরসিএ থেকে নিবন্ধন পরীক্ষার ফলাফল, নিবন্ধন সনদধারীদের সংখ্যা, বিভিন্ন সময় যোগদানকারী শিক্ষকদের সংখ্যা ও অবশিষ্ট নিবন্ধনধারীদের সংখ্যাসংক্রান্ত আপডেট তথ্য সমন্বয় করা হলেই শিক্ষক চাহিদা ও যোগ্য প্রার্থীর সম্ভাব্য সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব। তেমন পরিকল্পিতভাবে শিক্ষক নিবন্ধন/নিয়োগ পরীক্ষা নিয়মিত সম্পন্ন করা হলে বর্তমান শূন্যতা তৈরি হতো না, ভবিষ্যতেও হবে না।

অন্যদিকে লক্ষণীয় যে, বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়োগ যখন কমিটির হাতে ছিল তখন শিক্ষকদের ন্যূনতম মান নিশ্চিত করার প্রয়োজনে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা প্রবর্তন করা হয়েছিল। সেটি তখন অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। এখন যখন শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে, নিয়োগযোগ্য শিক্ষক বাছাই করা হয় কেন্দ্রীয়ভাবে, পদায়ন করা হয় প্রার্থীদের পছন্দ ক্রমানুসারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে; তখন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু বিদ্যমান তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। একবার নিবন্ধন পরীক্ষা সম্পন্ন করা এবং আবার নিবন্ধিত শিক্ষকদের মধ্য থেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা প্রায় দ্বিগুণ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবে এ কারণেই শূন্য পদের তুলনায় চার ভাগের একভাগ আবেদন পাওয়ার উদাহরণ তৈরি হয়েছে! সরকারি স্কুল-কলেজে যেমন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে, অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সি যোগ্য প্রার্থীদের আবেদন নিয়ে, সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে, অধিক যোগ্যদের বাছাই করে, সরাসরি নিয়োগ দেওয়া হয়; ঠিক তেমনিভাবে বেসরকারি স্কুল-কলেজেও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব, করা উচিত। ফলে নিয়োগ কার্যক্রম ত্বরান্বিত হবে, দ্রুত শূন্য পদ পূর্ণ হবে, শিক্ষার্থীরা অধিক লাভবান হবে। যারা নিয়োগ পাবেন না তারা নিবন্ধনধারীদের মতো বিভিন্ন দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে আন্দোলনের সুযোগ পাবেন না। সে ক্ষেত্রে কোনোরূপ প্যানেল তৈরি করাও উচিত নয়। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের প্যানেলভুক্তদের বিভিন্ন সময় আন্দোলন করতে দেখা গেছে। এতে অধিক যোগ্য, ইয়ং ও এনার্জেটিক প্রার্থী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। আমাদের সন্তানদের বৃহত্তর স্বার্থেই যেকোনো মূল্যে সর্বাধিক যোগ্য, দক্ষ, কর্মঠ ও উদ্যমী শিক্ষক অত্যাবশ্যক। সর্বাধিক মূল্য দিয়েই আকৃষ্ট করতে হবে তাদের, নিয়োগ করতে হবে অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবে।

এনটিআরসিএর অতীত সব রেকর্ড ছাপিয়ে ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন ২০২৪-এ প্রায় ১৮ লাখ ৬৫ হাজার আবেদন পড়েছিল। এদের মধ্য থেকে ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন প্রাথমিক পরীক্ষা’র (প্রিলিমিনারি টেস্ট) ফলাফলে স্কুল ও কলেজপর্যায় মিলিয়ে পাস করেছেন ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৯৮১ জন। গড় পাসের হার ৩৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। আবেদনকারীর সংখ্যা উৎসাহজনক হলেও উত্তীর্ণের সংখ্যা হতাশাজনক! এরা পরবর্তীতে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে চূড়ান্তভাবে খুব বেশি সংখ্যায় যোগ্য বিবেচিত হবেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে না। ফলে পরবর্তী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেও শূন্য পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা খুব বেশি থাকার সম্ভাবনা নেই। কেননা, বর্তমান শূন্য পদের সঙ্গে পরবর্তীতে আরও শূন্য পদ যুক্ত হবে। যতই দিন যাবে ততই শূন্য পদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই শিগগিরই আরও একটি নিয়োগ/নিবন্ধন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা উচিত। আগামী জুলাই মাস নাগাদ আরও অনেক ছেলেমেয়ে আবেদনের জন্য একাডেমিক যোগ্যতা অর্জন করবে।

১৮তম শিক্ষক নিবন্ধন ২০২৪-এ প্রায় ১৯ লাখ আবেদন পেয়ে এমন ভাবা উচিত নয়, অধিক যোগ্যরা অন্য চাকরি বাদ দিয়ে বেসরকারি শিক্ষক হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বরং বিপুলসংখ্যক বেকার কোথাও চাকরি না পেয়ে বাধ্য হয়ে এখানে আবেদন করেছেন। এতে যোগ্যরা আপাতত শিক্ষকতায় আসার সম্ভাবনা দেখা গেলেও পরবর্তীতে অধিক যোগ্যরা শিক্ষকতায় থাকার কোনোই সম্ভাবনা নেই! অবশিষ্টরা অন্যান্য চাকরির চেষ্টা করতে করতে বয়স অতিক্রান্ত হলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে যেতে বাধ্য হলেও সন্তুষ্ট চিত্তে পাঠদান করার ও উত্তম শিক্ষক হয়ে ওঠার তেমন সম্ভাবনা নেই! কেননা, কর্মীর পূর্ণ জব স্যাটিসফেকশন না থাকলে উত্তম পেশাদারিত্ব অর্জিত হয় না। সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতনে একজন শিক্ষক কোনোভাবেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না বর্তমান দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতিতে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, আমরা অত্যন্ত কম বেতনে তুলনামূলক কম যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে অন্যান্য ক্ষেত্রের জন্য অধিক যোগ্য, অধিক উপার্জনক্ষম নাগরিক-কর্মী তৈরি করতে চাই! এ ভ্রান্ত ধারণা থেকে এখনই বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের। সর্বাধিক যোগ্যদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্যই সর্বাধিক বৃদ্ধি করতে হবে শিক্ষকদের আর্থিক ও অনার্থিক সুবিধা। কোনো অবিশ্বাস্য আশ্বাস দিয়ে নয়, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কথা বলে নয়, সরাসরি দিতে হবে শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি সম্পর্কিত ঘোষণা। পরিষ্কার প্রকাশ করতে হবে সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের টাইমলাইন ও পরিকল্পনা। তারপর প্রকাশ করতে হবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। তবেই শিক্ষক হতে এগিয়ে আসবেন অধিক যোগ্যরা, শিক্ষকতায় থাকতে চাইবেন অধিক যোগ্যরা, শিক্ষকতা করতে চাইবেন অধিক মনোযোগ দিয়ে, অধিকাংশরাই হয়ে উঠবেন সফল শিক্ষক, সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম, তৈরি হবে কাঙ্ক্ষিত স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার উপযোগী মানুষ।

লেখক: সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।


banner close