বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪

শুধু বেগুন নয়, সব উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ খাদ্যের গবেষণা জরুরি

অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন। ছবি: দৈনিক বাংলা
অনিন্দ্য আরিফ
প্রকাশিত
অনিন্দ্য আরিফ
প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর, ২০২২ ০৯:০১
  • বিশেষ সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক জাকির হোসেন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে একদল গবেষক গবেষণা করে বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন। এ গবেষণাটি ইতিমধ্যে দেশে নানা কারণে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বেগুনের এই গবেষণা ও কৃষি খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে দৈনিক বাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন জাকির হোসেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন অনিন্দ্য আরিফ

দৈনিক বাংলা: সম্প্রতি বেগুন নিয়ে আপনার নেতৃত্বে একটি গবেষণা হয়েছে, যা একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। আপনারা এই গবেষণায় কেন উদ্যোগী হলেন?

জাকির হোসেন: বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছিল পুষ্টিগত খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর সেটি করার সঙ্গে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি চলে আসে। আমাদের দেশে বেগুন একটি জনপ্রিয় সবজি। সেই বিবেচনায় খাদ্য হিসেবে বেগুন খুবই জনপ্রিয়। তাই নিরাপদ খাদ্যের প্রেক্ষিতেই আমাদের বেগুনের ওপর গবেষণার আগ্রহ তৈরি হয়। আবার আমরা জানি যে বেগুনে বড় ধরনের পুষ্টিগুণ আছে। তাই আমরা এই সবজিতে পুষ্টিগুণ বজায় থাকছে কি না, সেটিও গবেষণা করে দেখতে চেয়েছি। এটি ছিল আমাদের গবেষণার আরেকটি উদ্দেশ্য। আমরা আরও গবেষণা করে দেখতে চেয়েছি যে এই সবজিতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি আছে কি না। থাকলে সেটি কী পরিমাণে আছে এবং তা মানবদেহের জন্য কতটুকু ক্ষতিকর। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমরা গবেষণা শুরু করেছিলাম।

আমরা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বা বিবিএসের তথ্য থেকে জানতে পেরেছিলাম, বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় ৬০ শতাংশ বেগুন উৎপাদিত হয় জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায়। এই এলাকার বেগুন দেখতে ভালো হয় ও এর পুষ্টিমান ভালো মানের বলে প্রচলিত আছে। তাই আমরা ওই অঞ্চলের বেগুনের ওপর গবেষণার সিদ্ধান্ত নিই। প্রায় দুই বছর ধরে আমরা ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার ১১টি কৃষিখামারে উৎপাদিত বেগুন সংগ্রহ করি। এরপর সেগুলো ওভেনে শুকিয়ে ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। এসব বেগুনে লেড, নিকেল, ক্যাডমিয়ামসহ একাধিক ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব উপাদান যে পরিমাণে থাকার কথা তার থেকে কয়েক গুণ বেশি পাওয়া গেছে। তবে এর বাইরে বেগুনে পুষ্টি উপাদান হিসেবে কপার, জিংক, আয়রন ও ম্যাঙ্গানিজের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বেগুন ও মাটির পরীক্ষা থেকে আমরা ধারণা করছি, ক্ষতিকর ধাতুগুলো খামারিদের ব্যবহার করা মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক কিংবা সেচের পানি থেকে এসেছে।

দৈনিক বাংলা: আপনারা কতজন এই গবেষণায় সম্পৃক্ত ছিলেন এবং কোনো আন্তর্জাতিক জার্নালে এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে?

জাকির হোসেন: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগ থেকে আমি এই গবেষণার নেতৃত্ব দিই। গবেষক দলে আরও ছিলেন এমএস (থিসিস) শিক্ষার্থী আনিকা বুশরা, একই বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী ফরহাদ কাদির, ড. মো. শাহিনুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক সুপ্তি মল্লিক। এ ছাড়া কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. হারুনুর রশিদ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির ড. শায়লা শারমিনসহ মোট সাতজন এই গবেষণায় সম্পৃক্ত ছিলেন। সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আমরা এই সরেজমিন গবেষণা শুরু করি।

এ গবেষণাটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডসভিত্তিক ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়, যা ‘ন্যাচার পোর্ট ফোলিও’র অন্তর্ভুক্ত একটি জার্নাল। আমাদের গবেষণার লক্ষ্য ছিল, এই বেগুন চাষের মাটিতে কতটা ভারী ধাতু রয়েছে। আর চাষ করা বেগুনে এই ভারী ধাতুর উপস্থিতি মানবদেহে কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে, গবেষণা করে সেটির ফলাফল পাওয়াও গবেষণার অন্যতম লক্ষ্য ছিল।

দৈনিক বাংলা: এই গবেষণার ফলাফলটি কি শুধু জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার বেগুন চাষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল? সারা দেশের বেগুন চাষের ওপর কি গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে?

জাকির হোসেন: এটি কিন্তু সারা দেশের বেগুন চাষের চিত্র নয়। এটিকে শুধু জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলায় চাষ করা বেগুনের ওপর চালানো একটি কেস-স্টাডি হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। তবে আমরা মনে করি, সারা দেশের বেগুন চাষের ওপর গবেষণা করা প্রয়োজন।

দৈনিক বাংলা: এর আগে তো বিটি বেগুন চাষ নিয়েও প্রবল আপত্তি উঠেছিল।

জাকির হোসেন: আমরা যে বেগুনের ওপর গবেষণা করেছি, সেটি কিন্ত বিটি বেগুন নয়। এটি এই এলাকার স্থানীয় জাতের একটি বেগুন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিটি বেগুনও আমাদের কৃষি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর। আবার দেশীয় প্রজাতির এই বেগুনও একই ধরনের হুমকি তৈরি করছে।

দৈনিক বাংলা: আপনারা তো শুধু চাষ করা বেগুনের ওপর গবেষণা করে ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছেন। রান্না করার পর বেগুনে এই ভারী ধাতুর উপস্থিতি কী পরিমাণ থাকবে?

জাকির হোসেন: আমরা রান্নার পর এই বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকবে কি না, সে বিষয়ে গবেষণা করিনি। কারণ আমরা জানি, বেগুন বা অন্য সবজিতে যে রাসায়নিক ধাতুর উপস্থিতি থাকে, রান্নার পর তার পরিমাণে খুব বেশি হেরফের হয় না। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল দ্বারা এটি প্রতিষ্ঠিত সত্যে পরিণত হয়েছে। বেগুন বা অন্য সবজি কিংবা শস্যতে যে জৈব উপাদান থাকে, তার পরিমাণ রান্নার পর পরিবর্তন হয়। কিন্তু ভারী ধাতু থাকলে তা রান্নার পরও পরিমাণে প্রায় একই থাকে। হেভি টক্সিক মেটালের এই বেগুন ক্রমাগত গ্রহণ করলে মানবদেহে ক্যানসার হতে পারে।

দৈনিক বাংলা: কৃষি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কি বেগুন ছাড়াও অন্য সবজি ও শস্যের ওপর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে?

জাকির হোসেন: কৃষি খাদ্যের পুষ্টিমান নিশ্চিতের সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শুধু বেগুন নয়, অন্যান্য সবজির পুষ্টিমানের ওপর গবেষণা প্রয়োজন। সব ধরনের সবজি, সব ধরনের শস্যদানার ভেতর ভারী ধাতু কতটুকু আছে, সেটি গবেষণার মাধ্যমে অনুসন্ধান করতে হবে। উদ্ভিজ্জ খাদ্যে বিষাক্ত উপাদানগুলোর প্রবেশকে দেশের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যেসব সবজি ও শস্যে বেগুনের চেয়েও দ্রুত হারে বিপজ্জনক ধাতুর দূষণ ঘটে থাকে, সেগুলোও পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা উচিত।

দৈনিক বাংলা: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন গবেষণার জন্য খ্যাতি অর্জন করেছে। ইতিমধ্যে আপনারা বেগুনে ভারী ধাতুর উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করলেন। আপনারা কি আরও সবজি, শস্য বা প্রাণিজ খাদ্য নিয়ে গবেষণা করছেন?

জাকির হোসেন: আমাদের এখনো বেশ কিছু সবজি ও শস্য নিয়ে গবেষণা চলমান আছে। আমরা আগে মাছের দুই-একটি প্রজাতি নিয়ে কাজ করেছি। দেশে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এমনিতেই অনেক কমে গিয়েছে। তার পরও নদী ও জলাশয়ে যেসব মাছের প্রজাতি আছে, প্রাকৃতিক পরিবর্তনে এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধাতু ও ক্ষতিকর উপাদান যুক্ত হচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে গবেষণা চলছে। এই গবেষণাটি আমরা ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছি। এ ছাড়া সবজি, বয়লার মুরগি ও মোটা চালের ওপর একটি গবেষণা আমরা শেষ করেছি। এসবের মধ্যেও আমরা ভারী ধাতুর উপস্থিতি পেয়েছি। এই গবেষণাটি স্প্রিনজার সায়েন্স অ্যান্ড বিজনেস মিডিয়ার ‘এক্সপোজার অ্যান্ড হেলথ’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

দৈনিক বাংলা: এর আগে প্রক্রিয়াজাত দুধে রাসায়নিকের উপস্থিতি পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। এখন আপনারা গবেষণার মাধ্যমে চাষের বেগুনেও ভারী ধাতুর উপস্থিতির প্রমাণ পেলেন। এই বিষয়গুলো খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে কাজ করছে না? সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?

জাকির হোসেন: আমি দুধে রাসায়নিক পাওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। তবে আমরা যে গবেষণা করেছি, তার মূল উদ্দেশ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পুষ্টিনিরাপত্তার মধ্য দিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে এসব গবেষণার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি দরকার পড়েছে পদক্ষেপ নেয়ার। বিষয়টি এমন নয় যে বেগুন চাষের মাটি থেকে ভারী ধাতুর পরিমাণ হ্রাস করা যাবে না। নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভারী ধাতুর পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য হয়তো লম্বা সময় লাগবে, কিন্তু তাতে পরিমাণ কমানো যাবে। আর যদি সেটি না করি, তাহলে ধাতুর পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। তাতে খাদ্যের পুষ্টিনিরাপত্তা তৈরি করা যাবে না। বরং সেটি গোটা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এ জন্য আমাদের এই ধরনের গবেষণাকে উৎসাহিত করা দরকার এবং ভবিষ্যতে আরও গবেষণা তৈরি করা প্রয়োজন। এই ধরনের গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে এবং গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।

মনে রাখতে হবে, কৃষি খাদ্যনিরাপত্তার জন্য ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়াটা একমাত্র হুমকি নয়। আরও শত শত কারণ থেকে যায়। তবে ভারী ধাতুর উপস্থিতি হ্রাস করার পদ্ধতি গ্রহণ করাটা খুব কঠিন নয়। পদক্ষেপ আর উদ্যোগ নেয়ার মধ্য দিয়ে এটির পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। তাই আমাদের প্রথমে দেখতে হবে শস্য ও সবজি উৎপাদনে ইনপুটগুলো কী কী। সেই ইনপুটগুলোতে ভারী ধাতুর উপস্থিতি আছে কি নেই, সেটি যাচাই করতে হবে। তারপর সেটিকে কমিয়ে আনতে হবে এবং শূন্য পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একেবারে আমরা শূন্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারব না, তবে সহনীয় মাত্রায় নিতে পারব। সেই লক্ষ্যে উদ্যোগ নিতে হবে। এই ভারী ধাতুগুলো যেন খাদ্যশৃঙ্খলে না ঢুকতে পারে কিংবা ঢুকলেও সহনীয় মাত্রায় থাকে, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তার অর্থ হলো খাদ্যে যেন স্বাস্থ্যঝুঁকি না থাকে, সেই প্রচেষ্টা নিতে হবে। এর মাধ্যমে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও সবল জীবন উপহার দিতে পারব।

দৈনিক বাংলা: অনেকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের জন্য জৈব কৃষিতে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন। আপনি এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

জাকির হোসেন: এখনই সমাধান হিসেবে আমরা জৈব কৃষির দিকে চলে যেতে পারব, সেটি আমি মনে করি না। আমরা যদি এখনই জৈব কৃষির দিকে চলে যাই, তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে। এতে উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং খাদ্য ঘাটতি তৈরি হতে পারে। তবে ক্রমান্বয়ে আমরা যদি জৈব কৃষির দিকে এগোতে পারি, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। কিন্তু হুট করে জৈব কৃষিতে রূপান্তরিত হওয়ার চেষ্টা করাটা ঠিক হবে না।

দৈনিক বাংলা: আপনাকে ধন্যবাদ।

জাকির হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ


বাঙালির মেলা কালচারে প্রকৃতি ও পরিবেশ

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ড. মো. হুমায়ুন কবীর

মেলা মানে উৎসব। ছোট্ট সোনামণিদের ছড়ার বইয়ে কবি আহসান হাবীবের ‘মেলা’ নামের একটি ছড়া আছে। সেটির দুটি চরণ হলো এরকম, ‘ফুলের মেলা পাখির মেলা/ সাত আকাশে তারার মেলা’...। সাধারণভাবে কোনো স্থানে যখন কোনো জিনিসের সমাবেশ ঘটানো হয় এবং সেই সমাবেশ উপভোগ করার জন্য যে গণজমায়েত জড়ো হয় সেটাকে মেলা বলে। আর বাংলাদেশে সারাবছরই কোনো না কোনো উপলক্ষে মেলা জমায়েতের প্রচলন থাকায় বিভিন্ন নামে সেই মেলা চলতেই থাকে।

প্রতিটি মেলাই বাঙালি কালচারের সঙ্গে মিশে গেছে বলেই সেটাকেই বাঙালির মেলা কালচার বলা হয়। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো বেইমেলা। প্রতি বছরের ভাষার মাস হিসেবে পরিচিত পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত হয় বাঙালি প্রাণের অন্যতম বইমেলা। এ বইমেলাকে কেন্দ্র করে যেমন পসরা বসে নতুন পুরাতন অনেক বইয়ের। আবার সেই বই কেনা ও দেখার জন্য অনেক দর্শক মেলায় জমায়েত। একুশের বইমেলাটি মূলত বাঙালির বৃদ্ধিবৃত্তিক একটি মিলনমেলাও বলা চলে।

তারপর সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় বছরের কোনো না কোনো সময়ে ঢাকা বইমেলা, বিভিন্ন জেলাভিত্তিক বইমেলা, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ব্যানারে বইমেলা, বিভিন্ন পেশাভিত্তিক বইমেলা, কবিতার বইমেলা, গল্পের বইমেলা, উপন্যাসের বইমেলা, প্রবন্ধের বইয়ের মেলা ইত্যাদি নানা নামে মেলাগুলো চলতে থাকে। তারপর বর্ষবরণের পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী বাঙালির গ্রাম-বাংলার মেলায় কতই না আনন্দ-ফূর্তি হয় সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে। আর বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার তো সেই পহেলা বৈশাখের মেলাকে আরও বেশি প্রাণবন্ত ও সাবলীল করার জন্য একে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। বর্তমানে সরকারি চাকুরেদের জন্য চালু থাকা বছরে দুটি বোনাসের পরিবর্তে বর্ষবরণের জন্য আরও একটি বোনাস দেওয়া শুরু করেছেন।

ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে ভালোবাসা মেলা। হয় ফাগুনের মেলা, চৈতালি মেলা, বসন্তবরণ উৎসবে বসন্তমেলা। আছে শরৎ মেলা। শরৎকাল প্রকৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সে সময় বর্ষা শেষে শীতের আমেজ শুরু হয়ে যায় প্রকৃতিতে। চারদিকে শুরু হয় রবিশস্য আবাদের ধুম। গ্রামীণ কৃষক ভোরবেলায় তার সবজি খেতে চাষ দিতে হাল নিয়ে গরুর দল তাড়িয়ে ঘুটে চলে তার মাঠের পানে। রাতের কুয়াশার শিশিরে সকালে ফসলের মাঠে, ঘাসের পাতায় তাই শীর্ষবিন্দু চোখে পড়ে। তাই তো মন চায় কবির ভাষায়, কবি নজরুলের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠি, ‘শারদ প্রাতে একলা জাগি, সাথে জাগার সাথী কই’...।

ঠিক সেভাবে কবি গুরুর ‘চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা, একধারে কাশবন, ফুলে ফুলে সাদা’ ছড়াটি পড়লেই মনে হয় নদীর ধারের চরে শরতের সেই সাদা সাদা কাশফুলের প্রাকৃতিক বাগান। আবার বসন্তকালের বাসন্তী মেলায় গৃহিণী-তরুণী সবাই বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে মেলা উপভোগ করে থাকে। ভাব জমিয়ে আড্ডা দেয় কপোত-কপোতি। নবান্নে শুরু হয় পিঠা উৎসব ও বাহারি রং ও পদের গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পিঠা মেলা। আর সে জন্য ষোলো আনা বাঙালিপনায় দীক্ষিত বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রতি বছরেই নতুন বছরের নবান্নে গণভবনে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

তার দেখাদেখি সে সময় আরও অনেক জায়গায় সেই পিঠা উৎসব সংঘটিত হয়েছিল। তার মধ্যে ময়মনসিংহের ত্রিশালে অনুষ্ঠিত পিঠা মেলা অন্যতম। মাছের হাট থাকে বাজার থাকে আমরা তা জানি; কিন্তু মাছ নিয়ে মেলা হতে পারে সেটিও দেখিয়ে দিয়েছে কোনো কোনো এলাকার মানুষ। দেশি মাছের অন্যতম এলাকা হিসেবে পরিচিত সিলেটের বিশ্বনাথে দেশি টাটকা মাছের মেলা। একইসঙ্গে শরৎকালে শীতের ঠিক আগে নদী-নালা, বিল-ঝিল, হাওর-বাঁওড়ের পানি কমে গেলে ঐতিহ্যবাহী হিসেবে পরিচিত হাঁকডাক দিয়ে এলাকাবাসী সবাই একত্রে মিলে পলো দিয়ে মাছ ধরার মেলা যা দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই সেসব এলাকার রীতি অনুযায়ী সংঘটিত হয়ে থাকে। তেমনি সম্প্রতি হবিগঞ্জে মাছ ধরার জন্য পলো মেলা হয়ে গেল।

ঠিক সেভাবে আয়োজন করা হয়ে থাকে বিভিন্ন জায়গায় নানা নামের মেলা। এর থেকে বাদ যায় না নজরুল মেলা, রবীন্দ্র মেলা, মধুসূধন মেলা, লালন মেলা, হাসন মেলা, সুলতান মেলা ইত্যাদিও। কারণ বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-প্রকৃতির সঙ্গে এসব সাংস্কৃতিক মেলা যে অনেক গুরুত্ব বহন করে। এলাকা ও ব্যক্তিভিত্তিক এসব মেলার অনেক বন্ধন রয়েছে সেসব এলাকার শেকড়ের সঙ্গে। মৌসুমভিত্তিক আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ মেলা আমাদের দেশকে মহিমান্বিত করেছে, তার মধ্যে রয়েছে- কৃষিপ্রযুক্তি মেলা, বৃক্ষমেলা, বাণিজ্য মেলা, কৃষি মেলা, দেশীয় ফল মেলা, রাসায়নিকমুক্ত নিরাপদ ফল মেলা, রাসায়নিক মুক্ত সবজি মেলা, দেশীয় সবজি মেলা, পাখি মেলা, পরিবেশ মেলা, শিল্পোদ্যোক্তা মেলা, গার্মেন্টস মেলা, পর্যটন মেলা, বিদেশ ভ্রমণ মেলা, দেশি-বিদেশি গাড়ি মেলা, মোবাইল মেলা, মোবাইলের সিমমেলা, মোবাইল সেট মেলা, ল্যাপটপ মেলা, কম্পিউটার মেলা, তথ্যপ্রযুক্তি মেলা, ব্যাংকিং মেলা, আয়কর মেলা ইত্যাদি। দুটি ঈদে হয় বিভিন্ন পণ্য মেলা, ফার্নিচার মেলা, আছে কোরবানি ঈদ এলে শুরু হয়ে যায় পশু মেলা।

কিছুদিন আগে অর্থাৎ ২০১৬ সালের ঈদুল ফিতরের সময় হয়ে গেল ভারতীয় ভিসার সহজীকরণ মেলা। এসব মেলার মাধ্যমে শুধু যে মানুষ আনন্দই উপভোগ করে তাই নয়- এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচার-প্রসার ও সম্প্রসারণ হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার্থে কাজ হয়ে থাকে। যেমন- বৃক্ষ মেলার মাধ্যমে দেশে বৃক্ষ রোপণের গুরুত্ব প্রদর্শণ করা হয়ে থাকে সারা দেশের মানুষের জন্য। সেখানে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী পরিবেশবাদী সংগঠন এবং ব্যক্তিপর্যায়ে বৃক্ষরোপণের ব্যবস্থা করে থাকে। সেইসঙ্গে এসব মেলায় বৃক্ষরোপণের সাহায্যে কীভাবে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব সেসব বিষয়ে লিফলেট, পাম্ফলেট, প্রচারপত্র ইত্যাদি বিলি-বণ্টন করে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়ে থাকে।

কোনো স্থানের পরিবেশ রক্ষার্থে ঠিক কত পরিমাণ বনভূমি বা গাছ-গাছড়া থাকার প্রয়োজন এবং সেটা কীভাবে অর্জন করা সম্ভব সে বিষয়ে গান-নাটকের মাধ্যমেও প্রচারের ব্যবস্থা থাকে মেলায়। এটাকে উপলক্ষ করে সারাবছর অনেক বৃক্ষপ্রেমী সে সময় গাছ ক্রয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যেমন প্রতি বছরে বৃক্ষমেলা উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রত্যেক নাগরিককে কমপক্ষে একটি করে ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা লাগানোর পরামর্শ প্রদান করে থাকেন। প্রতি বছর বর্ষাকালে অর্থাৎ গাছ লাগানোর মৌসুমের প্রথম দিকে এ মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

সেখানে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়টি খুবই কাজে এসেছে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রায় সাড়ে আট লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে গাছ লাগানোর ব্যাপক সাড়া পড়ে গেছে। বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বনবিভাগের যৌথ উদ্যোগে সেখানে এ মৌসুমে প্রায় ৩০ লাখ ফলজ ও বনজ গাছ লাগানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর শিক্ষার্থীরা খুবই আগ্রহের সঙ্গে প্রকৃতি রক্ষার সেই কাজ করছে। ঠিক সেরকমভাবে সরকারের কৃষি বিভাগের উদ্যোগে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কৃষিপ্রযুক্তি হস্তান্তর মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

দেশের আপামর কৃষকদের জন্য আয়োজিত এ মেলায় নতুন নতুন কৃষি উন্নয়ন প্রযুক্তির উৎকর্ষতা প্রদর্শন করা হয়ে থাকে। যেসব উন্নত নতুন ফসলের জাত আবিষ্কারের পর তার উৎপাদন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মাঠপর্যায়ে যে প্রদর্শনী করা হয় তার সাফল্যগাথা সবপর্যায়ের কৃষকদের জন্য একটি প্রশিক্ষণের কাজ করে থাকে এসব কৃষি মেলার মাধ্যমে। দেশ-বিদেশের পরিবেশের সাফল্য যেমনি করে ‘প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশনের’ চেয়ারম্যান মুকিত মজুমদার বাবুর পরিকল্পনা ও উপস্থাপনায় ‘প্রকৃতি ও জীবন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেসরকারি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল আই’-তে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পরিবেশন করা হয়, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নের জন্য কৃষকদের সরাসরি হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়ার অংশ হিসেবে দেশ-বিদেশের কৃষির বিভিন্ন সাফল্যগাথা কৃষি উন্নয়নে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সাইখ সিরাজের পরিকল্পনা ও উপস্থাপনায় সেই ‘চ্যানেল আই’-তেই ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচার করা হয়ে থাকে।

কাজেই প্রকৃতি ও পরিবেশের উন্নতি বিবেচনায় অন্যান্য মেলার চেয়ে বৃক্ষমেলা ও কৃষি মেলার গুরুত্ব অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এবারের বৃক্ষ, কৃষি ও ফল ইত্যাদি মেলায় মানুষের মধ্যে অনেক সচেতনতা তৈরি হয়েছে, ফলে পরিবেশের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন হয়েছে এবং হচ্ছে। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এমন কোনো জিনিস নেই যা নিয়ে বাংলাদেশে মেলা অনুষ্ঠানের উদাহরণ নেই। মেলাকে তাই আমাদের উপভোগের পাশাপাশি জনকল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। তাহলেই বাঙালির এ চিরায়ত কালচারের মাধ্যমে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের উপকারও নিশ্চিত হবে। আমাদের জন্য হবে সুন্দর ও সবার জন্য বাসযোগ্য একটি আগামী পৃথিবী।

লেখক: কৃষিবিদ ও রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

নতুন সরকার গঠনের পাঁচ মাসেও মেঘ কাটেনি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
শেখর দত্ত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠনের প্রায় ৫ মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে। নতুন সরকার ছিল পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারেরই ধারাবাহিকতা। এ সত্ত্বেও নতুন সরকার মানেই হচ্ছে নতুন অঙ্গীকার, নতুন উদ্যম, নতুন প্রত্যাশা। নতুন সরকার মানেই কিছু প্রাপ্তি। এ জন্য নতুন সরকারের ১০০ দিনকে ‘হানিমুন পিরিয়ড’ বলা হয়ে থাকে। এবারে নির্বাচনের পর এই শব্দটা দু’একজন মন্ত্রী এবং কোনো কোনো প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করলেও এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য হয়নি।

এমনটা না হওয়ার কারণ সুস্পষ্ট। এবারে নির্বাচনকালে দেশের দ্বিতীয় বড় দল বিএনপিসহ বেশ কতক দল অংশগ্রহণ না করায় রাজনৈতিক সংকট এবং করোনা দুর্যোগ, রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরাইল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে জাতীয়ভাবে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কারণে অর্থনৈতিক সংকট বিরাজমান ছিল। এর ওপর বোঝার ওপর শাকের আঁটির মতো ছিল আন্তর্জাতিক নানা চাপ, ষড়যন্ত্র-চক্রান্তও।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এই দুই সংকট এবং চাপ ও ষড়যন্ত্রের স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন নির্বাচনী ইশতাহারে জনগণের প্রতি আহ্বানের সবশেষে। তিনি ভয়হীনচিত্তে উচ্চারণ করেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার লাইন: ‘মেঘ দেখে কেউ করিস নে ভয়/ আড়ালে তার সূর্য হাসে,/ হারা শশীর হারা হাসি/অন্ধকারেই ফিরে আসে।’

নতুন সরকার ক্ষমতায় নেওয়ার প্রায় ৫ মাস অতিক্রান্ত হলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গন থেকে মেঘ বা অন্ধকার যা-ই বলা হোক না কেন তা দূর হয়নি। তবে সংকট ঘনীভূত হয়ে গেছে কিংবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক- দুই সংকট সমানভাবে একত্রে দানা বেঁধে দেশ অস্থিরতার মধ্যে চলে যাচ্ছে, এমনটা নয়। অবশ্য অর্থনৈতিক সংকট যদি ঘনীভূত হতে থাকে তবে রাজনৈতিক সংকটও দানা বেঁধে উঠতে পারে এবং তাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।

বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অবস্থা চলছে তা থেকে সুস্পষ্ট, সংবিধান সমুন্নত রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের উপায় সরকার বা সরকারি দলের হাতে নেই। এমতাবস্থায় বিএনপিকে প্রায় ৫ বছর বসে থাকতে হবে নতুবা গণআন্দোলন কিংবা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ভেতর দিয়ে সরকারকে উৎখাত করতে হবে। ৫ বছর তো বহু সময়। আর ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত্র কখনো পরিদৃষ্ট হয় না। তাই এ দুই নিয়ে আগাম কিছু অনুমান করা যাবে না।

গণআন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে অপসারণের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রথমেই বলতে হয়, এ ক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি দল রয়েছে সুবিধাজনক অবস্থায়। সংবিধান থেকে শুরু করে সরকারে থাকা প্রভৃতি আওয়ামী লীগের পক্ষে। আর আন্দোলনে নিষ্ফল বিএনপির অবস্থান ও নেতাদের বক্তৃতা বিবৃতি থেকে সুস্পষ্ট দলটি রয়েছে রাজনৈতিক দিক থেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকে বিভ্রান্ত এবং সাংগঠনিক দিক থেকে বিবাদ-বিভেদের মধ্যে।

ইতোমধ্যে পত্রিকা পাঠে জানা যায়, বিএনপি ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। এমন চাওয়াটা স্বাভাবিক। এই চাওয়ার ভেতর দিয়ে এটা সুস্পষ্ট, লন্ডনে পালিয়ে থাকা দলের প্রধান নেতা ‘ভাইয়া’র নির্দেশে বিএনপি ভুল ও উল্টোপথে অনেক দূর এগিয়েছিল। প্রশ্ন হলো- এতটা ভুল করার পর ঘুরে দাঁড়ানো আদৌ সম্ভব হবে কি? কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় করণীয় ঠিক করতে পারবে কি? নিজেদের পক্ষে করণীয় ঠিক করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই এখন সমমনা সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বিএনপি পথ অনুসন্ধানে তৎপর থাকছে। নির্বাচনী ট্রেন মিস করে সংসদ-পথ সব হারিয়ে পথ বের করা অনেকটাই অসম্ভব বৈ কি!

ইতোমধ্যে ১২ দলীয় জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, গণফোরাম (মন্টু) ও গণতান্ত্রিক মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। আলোচনার এই প্রক্রিয়া আরও চলবে। এই আলোচনা চলতে চলতে কোথায় পৌঁছাবে এবং কোন ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে, তাতে কতটুকু জমায়েত করতে পারবে, তাতে আন্দোলনে জোয়ার আসবে কি না প্রভৃতি সব প্রশ্নের মধ্যে বিএনপি এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। মূল নেতা পালিয়ে থাকা অবস্থায় এই পাক থেকে উদ্ধারের কাণ্ডারি কে হবেন কে জানে?

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ঠিক করার ক্ষেত্রে বিএনপি রয়েছে চরম বিভ্রান্তির মধ্যে। সাদামাঠা চোখেই বোঝা যায়, নির্বাচনী ডামাঢোলের প্রথম দিকে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে আমেরিকার অবস্থান ছিল সরকারের বিরুদ্ধে। বিএনপির হাবেভাবে মনে হয়েছিল পিটার হাসের পিঠে চড়েই ক্ষমতায় গিয়ে বসতে পারবে। নির্বাচন পর্বের শেষ দিকে দলটির মোহভঙ্গ হয়। সম্প্রতি সফরের সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে যৌথ ব্রিফিংয়ে ডোনাল্ড লু যখন বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চায় যুক্তরাষ্ট্র’ কিংবা তার সঙ্গে যখন বিএনপির বৈঠক হয় না তখন বিএনপি যে মোহভঙ্গ থেকে মনোভঙ্গ হয়েছে, তা সহজেই অনুমেয়।

প্রসঙ্গত, বিএনপি নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছে। নির্বাচনের পর বিএনপি ডিগবাজি দেয় এবং তাতে দলটির ভারতবিরোধী আসল চেহারা বের হয়ে আসে। দলটি ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। তা ফ্লপ হওয়ার পর টনক নড়ে। এখন জানা যাচ্ছে বিএনপি ওই কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে চাইছে। ডিগবাজি দেওয়া ও ডিগবাজি দিতে চেষ্টা করার ভেতর দিয়ে সুস্পষ্ট, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিএনপি এখন রয়েছে বিভ্রান্তি ও বিভক্তির মধ্যে।

সর্বোপরি সাংগঠনিক দিক থেকে বিএনপির রয়েছে সবচেয়ে বিপদে। কোনো রাজনৈতিক দলের শেষ বাঁশি বাজে পরস্পরের বিরুদ্ধে তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠলে। নামিদামি পত্রিকায় যদি হেডিং হয় ‘আন্দোলনের তহবিল আত্মসাৎ বিএনপির নেতাদের’ কিংবা ‘ঢাকা মহানগরেও বিএনপির আন্দোলনের তহবিল নয়ছয়’ তবে আর থাকে কি! তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠেছিল ২০১৮ সালে নির্বাচনের আগে প্রধান নেতা ‘ভাইয়া’র বিরুদ্ধে আর এবারে উঠেছে দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। ‘কারাবন্দি’ ও ‘নির্যাতিত’ নেতারা যদি ‘বরাদ্দ না পায়’ তবে দলের ভিত্তি নড়বড় হওয়ারই কথা। দলীয় কোন্দলে বিএনপি তাই বেহাল অবস্থায় রয়েছে।

বিএনপির এই অবস্থায় আওয়ামী লীগ আরও সুবিধাজনক পর্যায়ে দলকে নিয়ে যেতে পারত। ভাবমূর্তি সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেওয়া অসম্ভব ছিল না; কিন্তু উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদিকে বিভক্তি-পাল্টাপাল্টি আর অন্যদিকে আত্মীয়-পরিজনের সাংগঠনিক ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এতে বাদ সাধছে। এখানে-ওখানে ছাত্রলীগে পাল্টাপাল্টি-মারধরও দলের ভাবমূর্তিকে ক্রমেই বেশি বেশি করে ক্ষুণ্ন করছে। প্রায় ৫ মাস হয়ে গেলেও মন্ত্রীরা মন্ত্রণালয়ভিত্তিক এমন কোনো উল্লেখ করার মতো জনবান্ধব কাজ জনগণের সামনে আনতে পারছেন না, প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তিতে এমন কোনো ছাপ রাখতে পারছেন না, যা সময়ের এক ফোঁড়কে দশ ফোঁড় করতে পারে, যাতে মানুষের মনে আশা-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অনন্য। মানুষ যেমন তার ওপর ভরসা রাখছে, তেমনি কোনো বিক্ষুব্ধতা বা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংকট দানা বেঁধে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও তিনি হস্তক্ষেপ করলে তার সমাধান হচ্ছে। বিএনপির অবস্থা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক সংকট আলাদাভাবে দানা বেঁধে ওঠার সম্ভাবনা তেমনভাবে নেই বলে অনুমিত হচ্ছে।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পুনঃপুনঃ নির্দেশ সত্ত্বেও অর্থনীতির কতক ক্ষেত্রে সংকট থেকে যাচ্ছে। এসব সংকট থেকে উত্তরণ কখন কতটুকু কীভাবে হবে তা বলে কেউ-ই জনগণকে আশ্বস্ত করতে পারছেন না। নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল ‘দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া’ হবে; কিন্তু নির্বাচনের প্রায় ৫ মাস চলে গেলেও তা হয়নি। বিআইডিএস বলছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ, তবে বিসিএস বলছে ১০.২২ শতাংশ। এই পার্থক্য নিয়ে বিতর্ক না করেও বলা যায়, তা বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতি এমনই যে, গত ১৪ মে গণভবনে আগামী বাজেট নিয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানার নির্দেশ দিয়েছেন।’

প্রসঙ্গত, নির্বাচনী ইশতেহারে বাজার ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রাস্ফীতি বিষয়ে যেসব অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তার কতটুকু কি করা হচ্ছে তা জনগণের কাছে যেমন- সুস্পষ্ট হচ্ছে না, তেমনি সুদের হার ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে বলে অনুমিত হচ্ছে। নির্বাচনী ইশতেহারে আরও একটি অঙ্গীকার ছিল, ‘নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ’ করা হবে। এ ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ পরিদৃষ্ট হচ্ছে না। দ্রব্যমূল্য ও স্বাস্থ্য খরচে মানুষ দিশেহারা ও পিষ্ট হচ্ছে। ভাতের অভাব নেই ঠিক, কিন্তু এ দুই থেকে মানুষ পরিত্রাণের পথ পাচ্ছে না।

সর্বোপরি নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কতক বিষয়ে কিছু করবে বলে জনগণ উন্মুখ হয়েছিল; কিন্তু এখন পর্যন্ত (ক) ঘুষখোর, ঋণ-কর- বিলখেলাপি ও দুর্নীতিবাজদের ‘বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে শাস্তি প্রদান এবং তাদের অবৈধ অর্থ ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত’; (খ) ‘শুল্কফাঁকি, বিদেশে অর্থ পাচার, হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন, মজুতদারি ও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং অতি মুনাফা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা’ গ্রহণ; (গ) ‘পুঁজি পাচার অপরাধীদের বিচারের অধীনে’ আনা এবং ‘সংশ্লিষ্ট দেশের সহযোগিতায় পাচার করা অর্থ-সম্পদ ফেরত আনার উদ্যোগ’ লক্ষণীয় হয়ে উঠছে না।

বাস্তবে মুদ্রাস্ফীতি হতে থাকায় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইস্পিত কাজগুলো দৃশ্যমান না হওয়ায় মানুষ আশাহত হচ্ছে, ক্ষুব্ধতা বাড়ছে। শঙ্কিত হচ্ছে এই ভেবে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে সংকট আরও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকট যদি ঘনীভূত হতে থাকে, তবে যেকোনো ইস্যুতে ক্ষুব্ধতার স্ফূরণ যেকোনো সময় হতে পারে।

১৯ মে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় মীরপুরে খেটে খাওয়া মানুষের জমায়েত সংবাদমাধ্যমে দেখে তেমনটা মনে হচ্ছে। বিএনপি কিন্তু সেই আশায়ই তীর্থের কাকের মতো বসে আসে। তেমন অবস্থায় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মিলেমিশে গেলে অস্থিরতা ও অরাজকতা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকবে। এমতাবস্থায় সরকারকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য অঙ্গীকার অনুযায়ী ব্যবস্থাগুলো কার্যকর ও দৃশ্যমান করা অতীব জরুরি।

লেখক: রাজনীতিক

বিষয়:

বাংলাদেশের পথ ধরে বেলুচদের পর এবার স্বাধীনতা চায় আজাদ কাশ্মীর

ছবি: সংগৃহীত
আপডেটেড ২২ মে, ২০২৪ ০০:০৩
ফারাজী আজমল হোসেন

২৩ বছরের বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক শাসনের জেরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা পায় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান। জন্ম নেয় নতুন দেশ বাংলাদেশ। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের বহু রাজনীতিক স্বীকার করছেন দেশটির তৎকালীন শাসকদের করে যাওয়া ভুল রাজনীতি ও নিজেদের নাগরিকদের ওপর বৈষম্য ও নিপীড়নের কারণেই এমনটি ঘটেছিল। যদিও বাংলাদেশ স্বাধীনের শেকড় ছিল আরও গভীরে। তবে সেই সব বিষয় নিয়ে কি আদৌ ভাবছে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী? এমন প্রশ্নের উত্তর হবে, ‘না’। সবচেয়ে বড় কথা, একটি ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়নি পাকিস্তান। তারা নিজেদের বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ফলে তাদের দেশের অভিজাত শ্রেণি ও ডিপ স্টেটের বাইরের সবাই এখনো নির্যাতিত। আর এটির সবচেয়ে বড় প্রমাণ এখনো জ্বলছে বেলুচিস্তান ও আজাদ কাশ্মীর। আর দুটি ভূখণ্ডই বাংলাদেশের পথ ধরে চাইছে স্বাধীনতা।

২০২০ সালে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের নির্বাসিত নেতা সর্দার শওকত আলী কাশ্মীরীর একটি বক্তব্য ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ওই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মানুষজনকে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ দেয়নি সে দেশের সরকার। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা চেয়েছিল। ওই বছর ২২ অক্টোবর কাশ্মীরে হামলা করে পাকিস্তান। তারপর থেকে সেখানে দখলদারিত্ব চলছে। এটি শুধু শওকত আলী কাশ্মীরীর কথা নয়। বরং ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ যেন এমন মননই ধারণ করেন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে উপমহাদেশের প্রায় সব অঞ্চল ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। তবে পার্শ্ববর্তী জম্মু-কাশ্মীরকে কোনো দেশের সঙ্গে যেমন যুক্ত করা হয়নি। এটিকে স্বাধীন কোনো দেশ বলেও ঘোষণা করা হয়নি। ওই বছরই পাকিস্তানি সৈন্যরা কাশ্মীরে প্রবেশ করে কাশ্মীর দখল করতে। তখন কাশ্মীরের রাজা আত্মরক্ষার্থে ভারতের সাহায্য চান। ভারত সাহায্যের শর্ত হিসেবে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব দেয়। কাশ্মীরের রাজা তাতে রাজি হন। এরপর ভারতীয় সৈন্যরা কাশ্মীরে ঢোকে সেখান থেকে পাকিস্তানিদের তাড়াতে। প্রায় বছর খানেক সময় যুদ্ধ করে ভারত জম্মু-কাশ্মীরের তিন ভাগের দুভাগ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। আর পাকিস্তানের ভাগ্যে জোটে তিন ভাগের এক ভাগ। পাকিস্তান সেই এক ভাগের নাম দেয় আজাদ কাশ্মীর বা স্বাধীন কাশ্মীর। পাকিস্তানিরা চায় এটিকে জোর করে দখলে রাখতে। কাশ্মীরে একটা যুদ্ধ অবস্থা জারি রেখে নিজেদের আখের গোছানোয় মত্ত তারা। তাই তারা সন্ত্রাসবাদকে পুঁজি করেছে, অনেক স্বাধীনতাপন্থি কাশ্মীরীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়েছে। ফলে কাশ্মীরীদের চাওয়া পূরণ হচ্ছে না। পাকিস্তানের সরকার বরাবরই কাশ্মীর আন্দোলন দমন করতে চেয়েছে কঠোর হস্তে।

ভারত ও পাকিস্তানের অধিকৃত উভয় কাশ্মীরেরই স্বাধীনতার দাবিতে কাজ করা জম্মু ও কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ) ২০১৯ সালে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলে অন্তত ৪০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয় রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। এ ছাড়া আজাদ কাশ্মীরে নিয়মিত লেগে আছে সহিংসতা। ২০২৩ সালে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হঠাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য গম, আটা এবং বিদ্যুতের দাম বেড়ে যায়। মূল্যবৃদ্ধির জেরে জীবনযাপনের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খায় মানুষ। একপর্যায়ে দাম কমানোর দাবিতে গত বছরের মে মাসে আন্দোলন শুরু করে আজাদ কাশ্মীরের জনগণ। তাদের নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় সংগঠন জম্মু-কাশ্মীর জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি (জেএএসি)। গত ১৪ মে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে পাকিস্তানি রেঞ্জার্সের গুলিতে নিহত হন তিন কাশ্মীরী।

মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার থেকে জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটির (জেএএসি) নেতৃত্বে আজাদ কাশ্মীরের হাজার হাজার বাসিন্দা প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে আসছেন। পাঁচ দিন ধরে চলা এ প্রতিবাদের মধ্যে এ পর্যন্ত চারজন নিহত হয়েছেন। সম্প্রতি গম-আটায় ভর্তুকি দেওয়া, বিদ্যুতের দাম কমিয়ে উৎপাদন খরচের সমান করা, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থা সমন্বয়ে উন্নতিসাধনসহ ১০ দফা দাবি সরকারের কাছে পেশ করেন আজাদ কাশ্মীরের বাসিন্দারা। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৯টি দাবিই পূরণের আশ্বাস দেয় পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীর সরকার। কিন্তু তার কোনো প্রতিফলন গত তিন মাসে দেখেনি উপত্যকার মানুষ। জেএএসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিদ্যুতের দাম কমানো ছাড়া বাকি ৯টি দাবি বাস্তবায়নে রাজি হয় সরকার। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হননি আন্দোলনকারীরা। এরই জেরে এ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে উত্তেজনা হঠাৎ বেড়ে যায়। জেএএসির নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মধ্যে সম্প্রতি তাদের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে ১০ মে ধর্মঘটের ডাক দেয় জেএএসি। পরদিন ১১ মে আঞ্চলিক রাজধানী মুজাফ্ফারাবাদ অভিমুখে লং মার্চ কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে অতিরিক্ত পুলিশের পাশাপাশি আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করে আঞ্চলিক সরকার। রাজধানী অভিমুখে লং মার্চ শুরুর প্রথম দিন আজাদ কাশ্মীরের বিভিন্ন শহরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে।

এসব ঘটনায় নাগরিক সমাজের ভাষ্য, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বরাবরের মতোই বৈষম্য ও নিপীড়নমূলক আচরণ দেখাচ্ছে নিজেদের নাগরিকদের ওপর। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমে সাম্প্রতিককালে এরই উদাহরণ হিসেবে ১৯৭১ সালের আগে পূর্ব পাকিস্তানে এভাবে একে একে নানা প্রতিবাদ গড়ে উঠছিল বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে, এসব প্রতিবাদ দমনে শাসকগোষ্ঠীর কঠোরতার কথা। ফলে ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে স্বাধীনতা আন্দোলন। সাম্প্রতিককালে সেই আন্দোলন জোরালো হচ্ছে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে স্বাধীনতা ও ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে বেলুচিস্তান, সিন্ধু এবং পাকিস্তানের দখল করা কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। আর এই দাবিকে প্রতিহত করতে সামরিক বাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী এবং জঙ্গিদের ব্যবহার করছে পাকিস্তান।

২০২১ সালে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে কোনো গণমাধ্যমই স্বাধীন নয় এবং সেখানে গুমের ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক তাহা সিদ্দিকি এক প্রতিবেদনে লিখেন, পাকিস্তানের দখলকৃত কাশ্মীরে কোনো রাজনৈতিক অধিকার নেই। এছাড়া জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের মতো যে সব দল আজাদ কাশ্মীরের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করছে তাদেরকেও দমিয়ে রেখেছে ইসলামাবাদ।

এছাড়া পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে কাশ্মীরের কোনো রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারে না। ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলই সেখানে শাসন চালায়। ২০২১ সালে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর আজাদ কাশ্মীর আন্দোলন আরও একবার বড় গতি পায়। ওই সময় আজাদ জম্মু-কাশ্মীরে যাওয়ার এক বিরল সুযোগ পান মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক। সরেজমিনে তিনি দেখতে পান, ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতাপন্থি আন্দোলন দমনে পাকিস্তানি নিরাপত্তাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। ওই সময় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এক সময় স্বাধীনতাপন্থি বিক্ষোভে অল্প কিছু মানুষ জড়ো হতো। কিন্তু এখন এসব বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন।

সাম্প্রতিককালে কাশ্মীরীরা সীমান্তের দিকে বিক্ষোভ করতে গিয়েছিলেন। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পাকিস্তানি নিরাপত্তাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। আজাদ কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতারা সীমান্তের দিকে মিছিল না নিয়ে যেতে আহ্বান জানানোর পরও কাশ্মীরীরা বিক্ষোভ করেন। কাশ্মীরের সাবেক এক সশস্ত্র স্বাধীনতাপন্থি পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কাশ্মীরীদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে কলঙ্কিত করেছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করানোর মাধ্যমে। লস্কর-ই-তৈয়বার মতো সংগঠনগুলো ভারতের পার্লামেন্ট ও মুম্বাইয়ে হামলা চালিয়েছে। ওই স্বাধীনতা সংগ্রামী বলেন, ‘আমরা ছিলাম মুক্তিযোদ্ধা, আমরা কাশ্মীরেরই মানুষ ছিলাম। কিন্তু পরে পাকিস্তান লস্কর-ই-তৈয়বাকে আমাদের আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করায়। মানুষ আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। মুজাফ্ফরাবাদে কাশ্মীরের স্বাধীনতাপন্থি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের কার্যালয় মে মাস থেকে বন্ধ করে দিয়েছে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ।

আজাদ কাশ্মীরের সাবেক প্রধান বিচারপতি মানুজর গিলানি বলেন, একসময় জিহাদ ছিল জীবনের অংশ। এখন সব টম, ডিক ও হ্যারি দাঁড়িয়ে যায় এবং বলে তারা জিহাদে যাবে। এখন জিহাদিদের সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে। একসময় তারা পাকিস্তানের স্বার্থে কাজ করত। কিন্তু এখন পাকিস্তান মনে করে এই পন্থা খারাপ। হিজবুল মুজাহিদিনের রাজনৈতিক শাখা মনে করা হয় জামাত-ই-ইসলামিকে। দলটির সাবেক প্রধান আব্দুল রশিদ তুরাবি দাবি করেন, তারা এখনো শান্তি চায়। সংলাপই সবার অগ্রাধিকারে রয়েছে। তিনি বলেন, সংকটের কূটনৈতিক সমাধানের সময় কমে যাচ্ছে এবং অনেকেই আর থেমে থাকতে রাজি না। একই অবস্থা আরেক প্রদেশ বেলুচিস্তানের। গত ৭০ বছর ধরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায় বেলুচিস্তান অবহেলিত।

১৯৪৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বেলুচিস্তানের পার্লামেন্ট পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রিতকরণের বিরোধিতা করে। কিন্তু ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রদেশটি জবরদখল করে। পাকিস্তানের সমগ্র ভূখণ্ডের ৪৬% বেলুচিস্তানে। সবচেয়ে বড় প্রদেশ হলেও এর জনসংখ্যা পাকিস্তানে সবচেয়ে কম। পাকিস্তানের ৪০% মানুষ পশতুন। সরকারি বিধি ব্যবস্থায় বৈষম্য এবং দারিদ্র্যের কারণে ক্ষুব্ধ বেলুচিস্তানের মানুষ। বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও বেলুচিস্তানের মানুষ খুবই দরিদ্র। মাত্র ২৫% মানুষ সেখানে শিক্ষিত। অথচ পাকিস্তানে শিক্ষার হার শতকরা ৪৭%। বেলুচিস্তানের বেকারত্বের হার ৩০%।

পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাসের মজুত বেলুচিস্তানে। কিন্তু অল্প কয়েকটি শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। বেলুচদের অভিযোগ, বেশির ভাগ পরমাণু পরীক্ষা বেলুচিস্তানে চালানো হয়। তাদের খনিজ সম্পদ ব্যবহৃত হচ্ছে পুরো পাকিস্তানের অগ্রগতিতে। এ বৈষম্যের সর্বশেষ নমুনা গোয়াদার বন্দর। প্রদেশটির হাজার হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, অথচ বালুচদের সেখানে সম্পৃক্ত করা হয়নি। প্রথম থেকেই বৈষম্য চলছে এই প্রদেশটির ব্যাপারে। শের মোহাম্মদ মারির নেতৃত্বে ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত আন্দোলন করে বেলুচিস্তানের কয়েকটি উপজাতি।

১৯৬৭ সাল থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে বেলুচ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন। সম্প্রতি বেলুচদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখানকার মাদ্রাসাগুলোতে ঢুকে পড়ছে তালেবান। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বেলুচিস্তানের ৪০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছে এবং ১০ হাজার মানুষ খুন হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর করাচিতে চীনের কনস্যুলেটে বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হামলা সারা দুনিয়ার মানুষের নজরে আসে। যদিও বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি বেলুচিস্তানের খনিজ সম্পদের ব্যাপারে চীনের কর্তৃপক্ষকে আগেই সতর্ক করেছে। কারণ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সেখানকার বিভিন্ন জায়গাকে টার্গেট করছে।

১৯৪৭ থেকে ’৭১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায় দুর্ভোগে রয়েছে বেলুচিস্তানের মানুষ। চীনের কনস্যুলেটে হামলা দুঃখজনক কিন্তু বেলুচিস্তানের মানুষের দুর্ভোগের অভিযোগকে সবসময় উপেক্ষা করা যায় না। এ থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বাধীনতার পথে কি এগোচ্ছে বেলুচিস্তান? আর বেলুচিস্তানের পথ ধরেই স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আজাদ কাশ্মীরও?


বই আর খবরের কাগজের বিকল্প কিছু নেই

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
লিয়াকত হোসেন খোকন 

আর আসে না কিশোরবেলা- আগে আমরা ছোটবেলায় ভাইবোনেরা কাড়াকাড়ি করে, হুমড়ি খেয়ে পড়তাম রূপকথার বই। আরও ছিল বাটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা। জনপ্রিয় কমিকসের জনপ্রিয়তার কথা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে আজও। একটু বড় হয়ে পড়েছি ঠাকুরমার ঝুলি, পাগলা দাশু, আবোল -তাবোল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে চিত্রালী আর চিত্রাকাশের হয়েছিলাম প্রেমিক।

ছোটবেলায় ছিল পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি- সেখান থেকে বা অন্য বন্ধুকে ধরে গ্রন্থাগারে গিয়ে কিংবা ধার করে বই পড়ার অভ্যাস। অভ্যাস বলব না, সে যেন এক নেশা। দেবদাস, মেজদিদি, কপালকুণ্ডলা নিয়েছিল মন কেড়ে। হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে জীর্ণ হয়ে যেত বই। এই ধারা অব্যাহত কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হোস্টেলেও। এখন এই রেওয়াজ কমে গেছে। আজকের বাচ্চারা পাঠ্যবইয়ের চাপেই বোধহয় হিমশিম।

বই পড়া একটি সংস্কৃতি- ছোটদের ভেতর তা চালিয়ে দেওয়া উচিত। বইমেলায় বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া উচিত অভিভাবকদের। আর দরকার বই কিনে উপহার দেওয়ার রেওয়াজটা বাঁচিয়ে রাখা। কেন জানি মনে হয়, দৈনিক কাগজগুলোতে সপ্তাহে অন্তত এক দিন ছোটদের পাতা থাকা উচিত। একবার সৈয়দ মুজতবা আলী কৌতুকের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন, আমরা বই পড়াটাকে কীভাবে নেহাত সময় ও অর্থের অপচয় হিসেবে দেখি।

বিমল মিত্রের একটি গল্পে পড়েছিলাম, ভাইঝির বিয়ে ঠিক করতে এক পণ্ডিতমশাই গিয়েছিলেন জমিদার বাড়িতে। তার সব পছন্দ, তবু বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। কারণ একটাই- এত বড় ঘর, এত বৈভব; কিন্তু কোথাও বইয়ের চিহ্ন নেই। ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষালাভ ও জ্ঞানার্জনের উৎস হলো বই। স্বাধীন চিন্তা, কল্পনাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো। বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ, নিকট থেকে দূরে, প্রান্ত থেকে অন্তে, যুগ থেকে যুগান্তরে আলো ছড়ায়।’ কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তার জীবনের দুঃখকষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।’ কিন্তু ঘটনা হলো- বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস দিন দিন কমে যাচ্ছে।

অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া শেষ হলে অনেকের জীবন থেকে বই চিরতরে হারিয়ে যায়। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে সারাক্ষণ হাতে মোবাইল ভুলিয়ে দিয়েছে বইয়ের টান। কিন্তু পুরোনো বই আলমারি থেকে নামিয়ে তার পাতাগুলো স্পর্শ করা সুখ, আঘ্রাণ নেওয়ার তৃপ্তি সত্যিই কি ভোলা যায়? ডিজিটাল ডিভাইসে বই পড়ার বিকল্প হতে পারে না।

বইয়ের পাশাপাশি ছোট কাগজ বড় আশা- অন্যতম প্রধান লিটল ম্যাগাজিন মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয় একাধিক পত্রপত্রিকা ও বই। বইমেলায় দেখতে পাওয়া যায় নামি-অনামি পত্রপত্রিকার বিপুল সমাবেশ। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সঙ্গে একগুচ্ছ নতুনদেরও কখনো কখনো স্থান পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটে।

বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি- এই কথা হজম করেই বলা যায়- বাংলা ভাষায় চার ও পাঁচের দশকে ছোট ছোট বই প্রকাশিত হতো। জ্ঞান-বিজ্ঞান চেতনা ও জীবনী গ্রন্থমালা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন প্রখ্যাত দার্শনিক ছিলেন তার সম্পাদক। সেখানে ‘সে-যুগে মায়েরা বড়ো’, ‘ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব’, ‘শোনো বলি মনের কথা’, ‘পৃথিবীর ইতিহাস’ এমন সব বই বেরিয়েছিল; কিন্তু তা আজ কোথায়? বাঙালি বেমালুম ভুলে গেছে, বাংলা সাহিত্যে সাময়িক পত্রের ভূমিকার সূচনা যে হয়েছিল ১৯১৮ সাল থেকে। তারপর বঙ্গদর্শন হয়ে আজ পর্যন্ত অসংখ্য সাময়িক পত্র, প্রবন্ধ, সাহিত্য ও বাংলা উপন্যাস, গল্প, কবিতার এক বিশাল ক্ষেত্র নির্মাণ হয়েছিল। আর লিটল ম্যাগাজিনকে তো বলা হয় বাংলা সাহিত্যের বীজতলা।

আবার এ-ও দেখা গেছে, এক সময়ের জনপ্রিয় লেখক-লেখিকারা মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান; কিন্তু কেন? যেমন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় প্রায় ২ দশক ধরে জনপ্রিয়তার চূড়ায় ছিলেন। আসল নাম তারাদাস মুখোপাধ্যায়। এই ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা- বহ্নিমান, হে মোর দুর্ভাগা দেশ, আকাশ বনানী জাগে, পথের ধুলো, আশার ছলনে ভুলি ইত্যাদি বই বেস্ট সেলার হয়েছিল এক সময়ে। ‘গুণধর ছেলে’ ও তার লেখা বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস; কিন্তু আজ সেসব বইয়ের নাম জানা তো দূরের কথা, লেখকের নামই কেউ জানেন না।

নদীর প্রবল স্রোতেও কে যে থেকে যাবেন, তা কেউ জানেন না। তবে বছর ঘুরে ঘুরে একুশে ফেব্রুয়ারি আসবে- বইমেলা হবে। অনেকে বলেন, সবাই একটি করে বই কিনুন।

কিন্তু একটি কেন?

যা যা ভালো লাগবে, যে যে বই ভালো লাগবে তাই কিনুন। বইয়ের বিকল্প কিছুই হতে পারে না। বর্তমান ডিজিট্যাল বাংলাদেশের যুগে কিশোর ও কিশোরীদের হাতে হাতেও সহজভাবেই ধরা দিচ্ছে মোবাইল ফোন। কখনো তারা মোবাইলে গেম খেলায় মত্ত হয়ে থাকছে তো কখনো বা আবার ভালো-মন্দ ভিডিও দেখতেও তারা ব্যস্ত থাকছে। বাবা-মারাও যে যার নিজের নিজের ক্যারিয়ার গোছাতে ব্যস্ত, আর তাই ছেলেমেয়েদের বায়না মেটাতে গিয়ে হাতে দিয়ে দেয় ফোন। আর এই ফোনের নেশাতেই মত্ত হয়ে কিশোর ও কিশোরীরা আজ কোথাও বই পড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কথায় বলে, ‘বইয়ের থেকে ভালো বন্ধু আর কিছু নেই।’ আর তাই অভিভাবকদের এই বিষয়ে একটু সচেতন থাকা উচিত। মোবাইলের বদলে হাতে দেওয়া হোক বই। যাতে জ্ঞানের আলো পৌঁছাক কিশোর ও কিশোরদের মধ্যে। মোবাইল নয়, বই ও দৈনিক পত্রিকা হয়ে উঠুক কিশোর-কিশোরী থেকে সববয়সি মানুষের প্রকৃত বন্ধু।


বাজেটে কর্মসংস্থান ও চিকিৎসার বরাদ্দ সুনিশ্চিত করতে হবে

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
রেজাউল করিম খোকন

আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করা হবে। আগামী অর্থ বছরের বাজেট ছোটই রাখা হচ্ছে। এর আকার হতে পারে ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেট ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা থেকে ৩৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা অর্থাৎ ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। অন্য বছরগুলোতে এ বৃদ্ধি হয় ১০ থেকে ১৩ শতাংশের মতো। আগামী বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হতে পারে। এ ছাড়া রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, চলতি অর্থ বছরে যা ছিল ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের আদায় লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি থাকলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আইএমএফের শর্ত অনুয়ায়ী আগামী অর্থ বছরে সরকারের ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আদায় করার কথা। চলতি অর্থ বছরের মতো আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেটকেও ব্যয় সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী বাজেটেও বিলাসপণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। প্রধানমন্ত্রী দেখতে চেয়েছিলেন, বর্তমান মেয়াদের প্রথম বাজেটে নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিফলন থাকছে কি না। অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেটের যে কাঠামো দাঁড় করিয়েছে, তাতে সেই প্রতিফলন থাকছে বলে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জন্য ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেটে অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং গ্রামীণ অবকাঠামো খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ থাকবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) বৃদ্ধি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, সতর্কতার সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ, বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। তবে গোটা বিশ্বেই এখন সংকোচনমূলক ব্যবস্থা চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ইত্যাদি উন্নত দেশ নীতিসুদহার বাড়িয়েছে। মার্কিন ডলার আগের তুলনায় দামি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্কলন করেছিল, গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি কমে যাবে। তবে কমেনি। এমন পরিস্থিতিও তৈরি করা যাবে না, যাতে আমদানি বেশি কমে যায়। আমদানি ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) বহুল ব্যবহার আশা করছেন। বেশি মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আদায়ের ব্যাপারে তার পরামর্শ হচ্ছেÑএ কাজে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগকে কাজে লাগানো। তিনি চাইছেন, আইসিটি বিভাগ এমন অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নেবে, যাতে মূসকের চালান (ইনভয়েস) নিতে মানুষ আগ্রহী হন। নিজের নির্বাচনী এলাকার উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার এলাকায় আয়কর দেওয়ার মতো সক্ষম ব্যক্তি অনেক আছেন; কিন্তু তারা করজালের বাইরে। আয়কর যারা দিচ্ছেন বা যারা করজালের মধ্যে আছেন, শুধু তাদের ওপর করের বোঝা না চাপিয়ে করের আওতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। আশা করা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে। আর বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে ডলারের দামও স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বাজেট প্রণয়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার অংশ হিসেবে কিছু ক্ষেত্রে করছাড় এবং অব্যাহতি কমানো হবে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার সঙ্গে আমরাও একমত। তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং তা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি বাজেটে থাকছে কি না, তা-ও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ যে হারে দক্ষ শ্রমিক পাঠিয়ে প্রবাসী আয় অর্জন করছে, বাংলাদেশকেও সে ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং বাজেটে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। ডলারের দাম একলাফে ৭ টাকা বৃদ্ধির মাধ্যমে টাকার বড় অবমূল্যায়ন হয়েছে। বাজেটের আকারের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। ঢাকায় এসে আইএমএফের দল আগামী বাজেট ছোট রাখার পরামর্শ দিয়েছেন। আগামী অর্থ বছরের বাজেট ছোটই রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থ বছরের মূল বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি থাকলেও সংশোধিত বাজেটে কমিয়ে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আইএমএফের শর্ত অনুয়ায়ী আগামী অর্থ বছরে সরকারের ৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার কর রাজস্ব আদায় করার কথা। সে হিসাবে সরকারের লক্ষ্য ও আইএমএফের লক্ষ্যর কাছাকাছিই থাকছে। চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় আইএমএফের পরামর্শ ছিল করছাড় কমানো। ২০২৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে তিন ধাপে সব ধরনের করছাড় বাতিলের শর্ত রয়েছে আইএমএফের। প্রথম দফায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি-সুবিধা বাতিল হতে পারে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন শিল্প খাতে যেসব মূসক অব্যাহতি রয়েছে, সেগুলোও প্রত্যাহারের দিকনির্দেশনা থাকবে আগামী বাজেটে। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা বর্তমানে যে সাড়ে তিন লাখ টাকা রয়েছে, এবার তা না-ও বাড়তে পারে। নারী করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ৪ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের করদাতাদের ৪ লাখ ৭৫ হাজার এবং গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা করদাতাদের করমুক্ত সীমা যে ৫ লাখ টাকা আছে, তাতেও কোনো পরিবর্তন আনা হবে না। সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এবং ডলার-সংকট নিরসন করা- অর্থনীতির এই তিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ব্যয় সংকোচনের বাজেট করা ছাড়া উপায় নেই। বাজেট বড় করলে তা হয়ে যাবে বিষাক্ত জিনিস। করোনা মহামারির কারণে দেশের শিক্ষা খাতে বড় ক্ষতি হয়েছে। আবার ওই মহামারির সময়ই স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছিল; কিন্তু এরপরও বাজেটে এই দুটি খাত প্রত্যাশিত মনোযোগ পাচ্ছে না। টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও বাজেট এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় এই দুই খাতে বরাদ্দ খুব একটা বাড়ছে না। কোভিডের আগের ধারাবাহিকতায় বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত অনেকটা অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। আগামী বাজেটেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার ইঙ্গিত নেই।

পৃথিবীর যে ১০টি দেশ অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ দেয়, বাংলাদেশ তার একটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পেতে একজন বাংলাদেশির বছরে ৮৮ ডলার খরচ করা প্রয়োজন; কিন্তু বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু খরচ হয় ৫৮ ডলার, যার বড় অংশই নাগরিকরা নিজেরা সংস্থান করেন। আগামী অর্থ বছরের শুধু শিক্ষা খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকবে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এসব বরাদ্দ সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে। গত পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময় শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাজেটের ১২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ৫ শতাংশের আশপাশে ছিল। অন্যদিকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতের শিক্ষা খাতের বরাদ্দ ২ শতাংশের মতো, আর স্বাস্থ্য খাতে তা ১ শতাংশের মতো। বাজেটের শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত একসঙ্গে দেখানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের শুধু শিক্ষা খাতে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। আর স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকবে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। এসব বরাদ্দ সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে। উন্নয়ন খাতের বরাদ্দে অবশ্য সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের চেয়ে রাস্তাঘাট, জ্বালানি খাতকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। আগামী অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) শীর্ষ তিনটি খাতের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নেই। বরাদ্দ পাওয়ার বিবেচনায় শীর্ষ তিন খাত হলো স্থানীয় সরকার বিভাগ; সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এবং বিদ্যুৎ বিভাগ। এই তিন খাতই এডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ বরাদ্দ পাচ্ছে। যেখানে বিনিয়োগ করলে লাভের ভাগ বেশি হবে, সেখানেই বিনিয়োগ করা দরকার। তাই বাজেটে প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত। শিক্ষায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে না পারায় বিদেশ থেকে জনবল আনতে হয়। শিক্ষিতদের মধ্যে বেকার বেশি। দেশে অনেক এমবিএ ডিগ্রিধারী আছেন; কিন্তু ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে। তারা বছরে ৬০০ কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের প্রবাসী আয়ের চার ভাগের এক ভাগের সমান। গত পাঁচ বছরের বাজেট বরাদ্দ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্কে বাড়লেও বাজেটের অনুপাতে তা ১২ শতাংশের আশপাশে আছে। এর মানে হলো, সরকার এই খাতের বিষয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে না। শিক্ষা খাতের দুর্বলতা আমরা জানি; কিন্তু বাজেট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার অজুহাতে শিক্ষা খাতকে পঙ্গু করে রাখতে পারি না। এ জন্য জিডিপির অনুপাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এ ছাড়া সামাজিক দায়বদ্ধতাও দরকার। আগামী বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দেও বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না। করোনার পর স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানোর বিষয়ে নানা আলোচনা হলেও বাস্তব অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাজেটের ৫ শতাংশ ও জিডিপির ১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে স্বাস্থ্য বাজেটের আকার ছিল ২৯ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, যা ছিল ওই বাজেটের ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। পরের কয়েক বছর কোভিডের ডামাডোল থাকলেও অগ্রাধিকারে তেমন পরিবর্তন আসেনি। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশেই ছিল। সর্বশেষ চলতি অর্থ বছরে ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থ বছরে তা বেড়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যবিষয়ক কার্যক্রম সক্রিয় করার জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য জনবল বাড়াতে বিনিয়োগ করতে হবে। দিতে হবে শূন্য পদে লোকবল; কিন্তু সরকার অবকাঠামো নির্মাণে বেশি আগ্রহী। কারণ, এখানে স্বার্থ আছে। সেবায় বিনিয়োগ নেই। উদ্বোধন করা হয় ভবন, সেবা উদ্বোধন করা হয় না।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এগুলো রাজনৈতিক সংকটও। এ জন্য বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন জরুরি। আসন্ন বাজেটে খাদ্য, কর্মসংস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থানের নিশ্চয়তার জন্য বরাদ্দ সুনিশ্চিত করতে হবে। ওই বরাদ্দ যাতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ছাড়াই খরচ হয়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার বাজেটের আগে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও বড়লোকদের সঙ্গে সংলাপ করে। যারা দেশের টাকা পাচার করছে, ব্যাংকের টাকা নিয়ে শোধ করে না, এসব সংলাপ তাদের সঙ্গেই হয়। অথচ দেশের অর্থনীতির চাকা যারা সচল রেখেছে, সেই শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সংলাপ হয় না। এবারের বাজেটে প্রধান দুটি সংকট হলো অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। ঋণখেলাপি ও টাকা পাচারকারীদের ক্ষমতা বর্তমানে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। পাচারের টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে কোনো আইনগত বাধা নেই। সে জন্য বাজেটে এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। শীর্ষ খেলাপিদের নাম প্রকাশ ও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। বাজেটের লক্ষ্য স্থির থাকছে না। তাতে আসল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এর মূল কারণ রাজনীতি ঠিক নেই। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও ডলার-সংকটের মতো সমস্যা এখন প্রকট। দেশে যথাযথভাবে ডলার আসে না। আবার দেশ থেকে ডলার চলে যায়। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়া সম্পদের লুটপাট ঠেকানো যাবে না। বাজেটে গরিবের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার পর যত ঋণ নেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে এই সরকার। সরকারের সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তারাই বলছে, জ্বালানি খাতে ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এর জন্য দায়ী কে? সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর নামে কয়েকটি খাতে বরাদ্দ দিয়ে দেশের মানুষের সংকট সমাধান করা যাবে না। সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মূল কথা হবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব বিষয়ে মানুষের দায়িত্ব নেওয়া। করের টাকা লুটপাট নয়, জনস্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। প্রকৃত কৃষক জমি চাষ করে না, বর্গাচাষিরাই কৃষি কাজ করেন। অথচ তারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে সরকারি কোনো প্রণোদনা পান না। ফসলের ন্যায্য দামও পান না। দিন দিন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, ঠিকমতো বিদ্যুৎ নেই। সারের দাম বাড়তি, ভালো মানের কীটনাশক ও কৃষি বিভাগ থেকে ঠিকমতো পরামর্শ পাওয়া যায় না। বাজেটে এসব নিশ্চিত করতে হবে। পোশাকশ্রমিকদের নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। তারা নাকি দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছেন; কিন্তু তারা যে বেতন পান, তা দিয়ে ঠিকমতো ভালো খাবার খেতে পারেন না। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে অনেকে। অথচ গ্রামাঞ্চলে ঋণ করার পর অনেক মানুষকে রিকশা চালিয়ে কিস্তি পরিশোধের জন্য ঢাকায় আসতে হচ্ছে। তাদের এ দেশের মানুষ মনে করলে বাজেটে দরিদ্রদের জন্য আলাদা বরাদ্দ দিতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট

বিষয়:

সঠিকতম ভাবনার বাস্তবায়নেই শিক্ষার সমৃদ্ধি

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার

একজন ভদ্র মহিলা একজন পরামর্শকের কাছে গেলেন বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে। পরামর্শক বিচ্ছেদের কারণ জিজ্ঞাসা করলে ওই মহিলা বলেন, ‘আমি সারাদিন বাসার কাজ, রান্না, খাওয়া শেষ করে যখনই হারমোনিয়াম নিয়ে বসি তখনই আমার স্বামী এসে আমাকে মারধর করে এবং গরম গরম খাবার চায়। স্যার, আপনিই বলেন এরকম স্বামীর সঙ্গে কীভাবে সংসার করা যায়’? পরামর্শক উত্তর দিলেন, ‘আপনি ঠিক বলেছেন’। তখন মহিলাটির স্বামী পরামর্শককে বললেন, ‘সারাদিন কষ্ট করে কাজ শেষ করে ক্ষুধার্ত হয়ে বাসায় ফেরার পর সে আমাকে খাবার না দিয়ে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। তাহলে তার সঙ্গে কীভাবে আমি সংসার করতে পারি’? পরামর্শক তাকেও উত্তর দিলেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন’। তখন সামনে বসা এক ব্যক্তি পরামর্শককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যার আপনি দুজনকে একই উত্তর দিলেন। কীভাবে একই সময়ে দুজনই সঠিক হতে পারে? একজন তো ভুল হবেই’। তখন পরামর্শক উত্তর দিলেন, ‘ আপনিও সঠিক বলেছেন’। এতগুলো সঠিকতার সমারোহে সঠিকতম ভাবনাটি অনুধাবন করা ভীষণ কষ্টসাধ্য নয় কি?

স্কুল, কলেজের পরীক্ষায় পাস নম্বর একশতে তেত্রিশ। কিন্তু কেন এই তেত্রিশ নম্বরকে পাস নম্বর ধরা হয় তা অনেকেই হয়তো অবগত নন। এর মূল কারণ আমাদের মধ্যে এখনো ব্রিটিশ উপনিবেশের প্রভাব থেকে যাওয়া। ১৮৫৮ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা চালু হয়; কিন্তু পাস নম্বর কত হবে তা নির্ধারণ নিয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ দ্বিধাগ্রস্ত হন এবং ব্রিটেনে পরামর্শের জন্য চিঠি লেখেন। তখন ব্রিটেনে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের পাশের জন্য পঁয়ষট্টি শতাংশ নম্বর পেতে হতো। সেই সময় ইংরেজরা মনে করত বুদ্ধি এবং দক্ষতায় ভারতবর্ষের মানুষ তাদের অর্ধেক। তাই পঁয়ষট্টির অর্ধেক হিসেবে পাস নম্বর ৩২.৫ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এতে নম্বর হিসেব করতে বেশ বেগ পেতে হতো। তাই ১৮৬২ সালে গণনার সুবিধার্থে তা বৃদ্ধি করে তেত্রিশে উন্নীত করা হয়। সেই থেকে এই তেত্রিশ নম্বরই পাস নম্বর হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারত এবং পাকিস্তানেও ব্রিটিশদের চালু করে দেওয়া এই সিস্টেমই চলছে।

আজ ১৬৬ বছর পর ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণ সম্পর্কে ব্রিটিশদের ধারণা কতটা কার্যকরী তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ২০২১ সালে ওয়াশিংটন বেইজড মাইগ্রেশন পলিসি ইনস্টিটিউটের (এমপিআই) গবেষণা মোতাবেক ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকার প্রতিবেদনে ভারতীয় আমেরিকান অভিবাসীদের শিক্ষার মান এবং আয় আমেরিকার নেটিভ সিটিজেনদের তুলনায় অনেক বেশি। আমেরিকায় একজন ভারতীয় অভিবাসীর বাৎসরিক গড় আয় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। যেখানে আমেরিকার নেটিভ সিটিজেনদের বাৎসরিক গড় আয় পঁচাত্তর হাজার ডলার দেখানো হয়েছে। শুধু আমেরিকা নয় কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলেও এমন চিত্রই পাওয়া যাবে। সেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের নাগরিকরা কর্মক্ষেত্রে সম্মানজনক অবস্থানে অধিষ্ঠিত রয়েছে। একটি পরিসংখ্যান মতে, আমেরিকায় ভারতীয় জনসংখ্যা তাদের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বপ্রযুক্তির রাজধানীখ্যাত সিলিকন ভ্যালির তিন ভাগের এক ভাগ প্রকৌশলী ভারতীয়। গুগল, অ্যাডোবি, মাইক্রোসফট, আইবিএম, টুইটারের মতো স্বনামধন্য কোম্পানির সিইও ভারতীয়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ কোম্পানির সিইওর আসন অলঙ্কৃত করে রেখেছে ভারতীয়রা। প্রতি বছর ব্যবসাক্ষেত্রে চরম সফল ৫০০ কোম্পানির তালিকা তৈরি করে ফরচুন ম্যাগাজিন। ‘ফরচুন ফাইভ হানড্রেড’ কোম্পানির ৩০ শতাংশ সিইও হলো ভারতীয়। তথ্য সংবলিত এই বিশ্লেষণ বলছে মেধা, মনন ও দক্ষতার বিচারে বর্তমানে হিসেবটা ঠিক উল্টো।

আমরা যখন প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়েছি তখন শিক্ষা পদ্ধতি ছিল একরকম। পাঠ্যবইয়েই অঙ্ক থাকত, তথ্য থাকত, সেখান থেকে প্রশ্ন হতো। ফলে আমরা বইগুলোকে খুব ভালোভাবে পড়ার চেষ্টা করতাম। এরপর শিক্ষা পদ্ধতিতে বহু নির্বাচনী প্রশ্ন এল এবং গ্রেডিং সিস্টেম চালু হলো। তারপর গ্রেডিং সিস্টেম চালু রেখেই সৃজনশীল শিক্ষাপদ্ধতি শুরু হলো। সৃজনশীল প্রশ্ন চালু থাকা অবস্থায় পাঠ্যবইগুলো গৌণ হয়ে গেল। চলল গাইড বইয়ের একচ্ছত্র রাজত্ব। আমার সন্তানদের বই পড়তে বললে বলত বই পড়ে প্রশ্ন কমন পাওয়া যায় না। তাই গাইড বই-ই আমাদের ভরসা। এখন যে শিক্ষাক্রম এসেছে সেটাও উন্নত দেশের আদলে নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, বর্তমান শিক্ষাক্রম যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তি। এর মাধ্যমে ১০ ধরনের দক্ষতা শেখানোর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে। দক্ষতার বিষয়বস্তুগুলো হলো- সূক্ষ্ম চিন্তা, সৃজনশীল চিন্তা, সমস্যার সমাধান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সহযোগিতা, যোগাযোগ, বিশ্ব নাগরিকত্ব, স্ব-ব্যবস্থাপনা, জীবিকায়ন, মৌলিক দক্ষতা। এই পাঠ্যক্রমেও ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, জীবন-জীবিকা বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে। এই শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত একমুখী শিক্ষার যে পরিকল্পনা তা প্রশংসনীয়। তবে গবেষণা বলছে, এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষা উপকরণ কিনতে শিক্ষার্থীদের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া স্মার্টফোন, কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সহায়তায় অ্যাসাইনমেন্ট সমাধান করার যে অপরিহার্যতা তা প্রান্তিক দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। প্রত্যেক সিস্টেমেই কিছু দুর্বলতা থাকে। তবে আমার মতে, আমার জীবদ্দশায় দেখা তিনটি শিক্ষাক্রমের প্রত্যেকটিই সমসাময়িক কর্তৃপক্ষের ভাবনায় সঠিক ছিল। তাই তো আমাদের শিশু, কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের ওপর এই শিক্ষাক্রমগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে।

মানুষের জীবনে প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে অর্জিত ভিত্তিজ্ঞান নিয়েই মানুষ তার উচ্চতর জ্ঞানের পরিসরকে বৃদ্ধি করে। একটি ভাবনা আমার মনকে সর্বদা আন্দোলিত করে, পশ্চিমারা যারা তাদের মেধা, মনন ও দক্ষতায় আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ ভাবত, তাদের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করে আমরা কি খুব উপকৃত হবো! তা ছাড়া পশ্চিমা যে দেশগুলোর শিক্ষাপদ্ধতি আমরা হুবহু অনুসরণ করতে চাই তাদের শিক্ষা খাতে ব্যয়ও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। ২০২০ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ১৪৩২১ ও ১৬০১৮ ডলার, যুক্তরাজ্যে ১২৫১৩ ও ১৩৬৯৫ ডলার, কানাডায় ১১৫৩৩ ও ১৫৫২০ ডলার এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১২৬৭৩ ও ১৫৪৩৭ ডলার। এই পরিসংখ্যানে আমি মোটেও আশাহত নই। কারণ স্বল্প বাজেটের পড়াশোনা হওয়া সত্ত্বেও বর্তমান যুগের জ্ঞাননির্ভর প্রযুক্তির দক্ষ জনবলের সিংহভাগই ভারতীয় উপমহাদেশের।

বাস্তবিক অর্থে, আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে শিক্ষার উন্নয়নের পরিকল্পনা জাতির জন্য অধিক ফলপ্রসূ হবে। শুধু অর্থ দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। মানব জীবনের পাঁচটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যে শিক্ষা পূর্ণতা পায়- জ্ঞান, প্রেম, ন্যায়, ধৈর্য ও সমর্পণ। কারণ ‘জ্ঞান’ বুদ্ধিকে স্থির রাখে, ‘প্রেম’ হৃদয়কে স্থির রাখে, ‘ন্যায়’ আত্মাকে স্থির রাখে, ‘ধৈর্য’ মনকে স্থির রাখে, আর ‘সমর্পণ’ শরীরের সব আবেগ শান্ত রাখে।

লেখক: উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয়:

সৌর বিদ্যুতের বিচিত্র প্রকল্প

আপডেটেড ২০ মে, ২০২৪ ১২:০২
প্রদীপ সাহা  

বিদ্যুৎ সমস্যা আমাদের দেশে প্রকট হলেও পশ্চিমা দেশগুলো সম্ভাব্য বিদ্যুৎ সংকট বা সমস্যা মোকাবিলায় বেশ তৎপর। তারা প্রকৃতির অপার উৎস সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি জার্মানির শতকরা ৮০ ভাগ জ্বালানিবিদ্যুৎ আসে বিদেশ থেকে। শুধু জার্মানিই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনেক দেশই তাদের জ্বালানিবিদ্যুতের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় জার্মানিতে বায়ুচালিত বিদ্যুৎ অত্যন্ত প্রচলিত। অন্যদিকে, স্পেন সৌরবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প ‘আন্দাসোল’ স্পেনেই অবস্থিত; কিন্তু ইউরোপের উত্তরাঞ্চলের দেশগুলোতে বছরের বেশির ভাগ সময় সূর্যের আলো তেমন তীব্র না হওয়ায় তারা এই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারছে না। সে জন্য ইইউর বিভিন্ন দেশ উত্তর আফ্রিকার সাহারা অঞ্চলে ‘ডেজারটেক’ নামে একটি বিশাল প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ডেজার্ট বা মরুভূমির প্রচণ্ড রোদকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করে সেই বিদ্যুৎ নিয়ে আসা হয় ইউরোপের নানা দেশে।

ডেজারটেক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সম্পর্কে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল জানান, এটি একটি ভিশন হলেও ভবিষ্যতে ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে এ প্রকল্প একটি চমৎকার বন্ধন হয়ে উঠতে পারে। ডেজারটেক প্রকল্পের উদ্যোক্তা জার্মানির গেরহার্ড কেনিস বলেন, এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো দিনের বেলায় সৌরবিদ্যুৎ জমিয়ে রাখার পাশাপাশি রাতেও উৎপাদিত তাপ থেকে বিদ্যুৎ শক্তি পাওয়া যাবে। আর এ প্রযুক্তির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি উৎপন্ন করতে পারবে এবং প্রয়োজনের চেয়ে ১০০ ভাগ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। সৌর প্যানেলগুলোর অর্ধেকেরও বেশি স্থাপন করা হবে উত্তর আফ্রিকার মরক্কো, মিশর এবং তিউনিসিয়ায়। তবে ডেজারটেক প্রকল্প নিয়ে এখনো ইউরোপীয় দেশগুলো এবং আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বিতর্ক। ডেজারটেক প্রকল্পের প্রধান কর্মকর্তা থার্মো গ্রুপ বলেন, উৎপাদিত বিদ্যুৎ কোথায় জমা রাখা হবে এবং কীভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হবে সেসব নিয়ে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কেবল ইউরোপই নয়, গোটা বিশ্বের কাছে এটি এক অভাবনীয় উদাহরণ হয়ে উঠবে।

ডেজারটেক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিতে বসানো হয়েছে বিশাল আকারের বেশ কয়েকটি সৌর প্যানেল। আর এ প্যানেলগুলো একটি আরেকটির সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে দূর থেকে কিংবা অনেক ওপর থেকে মনে হবে, মরুভূমির মধ্যে সারি সারি বিশাল আকারের আয়না ফেলে রাখা হয়েছে। আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে প্রচণ্ড রোদ এসে যেন ঝলসে দিচ্ছে গোটা এলাকাকে। সোলার প্যানেল বা আয়না বাড়ির ছাদে থাকা প্রচলিত প্যানেলের মতো নয়। বিশাল আকারের সোলার প্যানেল বা আয়নাগুলো থেকে আসা তাপ প্রকাণ্ড আকারের পানির ট্যাঙ্কে একীভূত করা হয়েছে। প্রচণ্ড তাপে এই ট্যাঙ্কের পানি গরম হয়ে বাষ্পে পরিণত হয়। সেই বাষ্প গিয়ে চাপ তৈরি করে টারবাইনে এবং বাষ্পের চাপে টারবাইন ঘোরে। ফলে সহজেই তৈরি হয় বিদ্যুৎ। অর্থাৎ শুধু সৌরশক্তিকেই নয়- এই ডেজারটেক প্রকল্পে বিদ্যুৎ তৈরির কাজে পানি এবং বাষ্পশক্তিকেও ব্যবহার করা হয়। আর উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভবিষ্যতে রপ্তানির জন্য জমিয়ে রাখা হয়।

মজার ব্যাপার হলো, এই প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনই নয়, সমুদ্রের পানিকে লবণমুক্তও করা যাবে। শুধু তাই নয়, এ লবণমুক্ত পানি খাবার পানি হিসেবে আবার অন্যান্য দেশে রপ্তানিও করা যাবে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত গবেষকরা জানান, সৌর প্যানেল ব্যবহার করে প্রতি ঘণ্টায় চার মিলিয়ন লিটার সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা দূর করা সম্ভব। বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় ডেজারটেক প্রকল্পের সময়োপযোগী এবং বিচিত্র উদ্যোগ বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়েছে।

লেখক: বিজ্ঞানবিষয়ক প্রাবন্ধিক


মেডিটেশন করুন অর্জন করুন টোটাল ফিটনেস

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
অধ্যাপক ড. মো. মাসুদুল হক সিদ্দিকী

যেকোনো কিছু জয় করার জন্য প্রয়োজন টোটাল ফিটনেস। প্রয়োজন শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক জীবনের প্রতিটি দিকের সুন্দর সমন্বয়। নিউরো সায়েন্টিস্টদের ২৫ বছরের গবেষণার সারকথা হচ্ছে, মেডিটেশন বা ধ্যান হলো ব্রেনের ব্যায়াম। ধ্যান ব্রেনের কর্মকাঠামোকে সুবিন্যস্ত, সুসংহত, গতিময় ও প্রাণবন্ত করে। ব্রেনকে বেশি পরিমাণে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করার সামর্থ্য বাড়ায়।

মেডিটেশন রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং মনকে প্রশান্ত করে, অস্থিরতা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও হতাশা থেকে মুক্ত করে। অসহিষ্ণুতা রূঢ়তা ও অমানবিকতার পরিবর্তে আচরণে আনে বিনয় এবং সমমর্মিতা। শুধু তা-ই নয়- ধ্যান মানুষকে জীবনের পরম সত্য উপলব্ধি করার স্তরে নিয়ে যায়। সত্যটা তখন আপন হয়। অন্তরে যে সুপ্ত শক্তির ভাণ্ডার রয়েছে সে ভাণ্ডারের দ্বার উন্মোচন করে দেয় ধ্যান। জীবনকে আশাবাদে ভরিয়ে দেয়। বিশুদ্ধ সম্ভাবনার বলয়ের সঙ্গে আপনার সত্তাকে সংযুক্ত করে। সব মিলিয়ে ধ্যান বা মেডিটেশন টোটাল ফিটনেস অর্থাৎ শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেসের পথ উন্মোচন করে।

ছন্দময় জীবনের জন্য শারীরিক ফিটনেস

নির্দিষ্ট মাপ ওজন বা আকার নয়, শারীরিক ফিটনেস নির্ভর করে একজন মানুষ ক্লান্তিহীনভাবে কতক্ষণ কাজ করতে পারেন, তার ওপর। তাই দেহের আকার-ওজনের ফ্যান্টাসি থেকে মুক্ত হয়ে গুরুত্ব দিন আপনার এনার্জি লেভেল ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার দিকে। শারীরিক ফিটনেসের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো আহার অর্থাৎ কী খাবেন, কতটুকু খাবেন কিংবা কখন খাবেন সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।

কী খাবেন?

টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের পরিবর্তে প্রাকৃতিক খাবারে অভ্যস্ত হোন। খাবারে পর্যাপ্ত শাক-সবজি রাখুন। চিনির পরিবর্তে গুড় খান, খেজুর খান। মৌসুমি ফল খান। দুধ চায়ের পরিবর্তে বেছে নিন গ্রিন টি।

কতটুকু খাবেন?

পরিমিত খাবারই স্বাস্থ্যকর। নবীজীর (স.) সুন্নত অনুসারে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবার, এক-তৃতীয়াংশ পানি এবং এক-তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখুন।

কখন খাবেন?

দিনের শুরুতে ভরপেট খাবার, দুপুরে তার চেয়ে কম আর রাতে আরও কম খান।

হাঁটা, দৌড়ানো ও যোগব্যায়াম

প্রতিদিন ৩০ মিনিট সময় রাখুন হাঁটা ও দৌড়ানোর জন্য। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকবে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমবে। যোগব্যায়াম চর্চায় মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত প্রতিটি স্নায়ুপেশি শিথিল হয়। দেহে ভারসাম্য আসে। জন্স হপকি মেডিসিনের গবেষণা রিপোর্ট অনুসারে, যোগব্যায়াম ব্যাকপেইন ও আর্থ্রাইটিস নিরাময় ও প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা

দেহকে টক্সিনমুক্ত করতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো বিকল্প নেই। অগণিত ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচারও উপায় এটি। তাই দাঁত, চুল, নখ, চোখ, নাক, মুখ পরিষ্কার করুন। পরিচ্ছন্ন থাকুন। প্রতিদিন স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানিতে গোসল করুন। এ ছাড়া নিয়মিত দমচর্চা বা ব্রিদিং এক্সারসাইজ করুন। বাড়বে দেহ-মনের সুস্থতা।

মানসিক ফিটনেস

মানসিক ফিটনেসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনা। কারণ আমরা যা ভাবী আমরা তা-ই। ভাবনাকে যত বিশুদ্ধ ও নির্ভেজাল রাখা সম্ভব হবে, মানসিক ফিটনেস তত বাড়বে।

বারবার শুরু করার সামর্থ্য

যে মাটিতে মানুষ আছাড় খায়, সেই মাটি ধরেই আবার সে উঠে দাঁড়ায়। এই উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্যই মানসিক ফিটনেস। এ সামর্থ্য জন্মগত নয়, নিজের ভেতরে এর উন্মেষ ঘটানো সম্ভব। তাই ব্যর্থতাকে নিয়তি হিসেবে মেনে না নিয়ে বারবার চেষ্টা করুন। সব দ্বিধা ঝেড়ে আবার শুরু করুন। মনে রাখবেন, জীবন মানে বারবার শুরু করা।

ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ খুঁজে নেওয়া

মানসিক ফিটনেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হলো সুখের অনুভূতি। সব অর্জনের পরও যদি মনে শূন্যতার অনুভূতি হয় তবে সে মানুষটি আপাতদৃষ্টিতে সফল হতে পারে; কিন্তু সুখী নয়। আর পাহাড়সম মানসিক সামর্থ্যকে নিঃশেষ করে দিতে এই শূন্যতাবোধই যথেষ্ট।

প্রধান দুই মানদণ্ড

প্রথমত, নিন্দা ও প্রশংসাÑদুটোকেই আপনি সহজভাবে নিতে পারেন কি না। হাততালি বা কটাক্ষ-কটুকথা তা যদি আপনার কাজে কোনো প্রভাব বিস্তার না করে, তাহলে আপনি মানসিকভাবে ফিট।

দ্বিতীয়ত, যেকোনো পরিস্থিতিতে আপনি ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি না। প্রতিকূল সময়ে উত্তেজিত হয়ে রি-অ্যাক্ট করে ফেলেন নাকি সহজভাবে পরিস্থিতি সামলে নিতে পারেন?

বিরক্তিকে জয় করে করণীয় কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে পারাই মূলত মানসিক ফিটনেস। জীবনকে গভীরভাবে দেখতে শিখুন। যা আছে তার জন্য কৃতজ্ঞ হোন। ছোট ছোট বিষয় থেকে আনন্দ খুঁজে নিন। এই কৃতজ্ঞ ও পরিতৃপ্ত হৃদয়ই হবে ভবিষ্যৎ অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় শক্তি।

সামাজিক ফিটনেস

সোশ্যাল নিউরো সায়েন্সের প্রবক্তা ড. জন টি ক্যাসিওপ্পো। তিনি বলেন, দেহের পেশিগুলোর মতো প্রতিটি মানুষের অদৃশ্য একটি পেশি আছে। তা হলো- ‘সোশ্যাল মাসল’। এই মাসল আমরা যত কাজে লাগাব, আমাদের সুখের পরিমাণ তত বাড়বে। শুধু একতরফাভাবে নেওয়ার মধ্যে কারও বিকাশ ঘটে না। মানুষ সবচেয়ে সুন্দরভাবে বিকশিত হয় যখন একই সঙ্গে ভালোবাসা ও মমতা দেয় এবং নেয়। একাকিত্ব মানে শুধু পাওয়ার পথ বন্ধ হওয়া নয়, একাকী জীবনের অর্থ হলো অন্যকে দেওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে যাওয়া। আর এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের সুখ ও সামগ্রিক ভালো থাকাকে ব্যাহত করে।

মানুষ আপনাকে দেখলে কতটা তটস্থ থাকে, সালাম দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ায়Ñ এটা আপনার সোশ্যাল ফিটনেস নয়। তারা আপনাকে কতটা আপন মনে করে, আপনার উপস্থিতি তাদের কতটা তৃপ্তি দেয় এটাই আপনার সোশ্যাল ফিটনেসের ব্যারোমিটার।

আত্মিক ফিটনেস

‘একটি প্রদীপ যেমন আগুন ছাড়া প্রজ্বলিত হতে পারে না, তেমনি আত্মিক শূন্যতা নিয়ে কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না’-Ñকথাটি হাজার বছর আগে বলে গেছেন মহামতি বুদ্ধ। পণ্য পদমর্যাদা প্রাচুর্য প্রতিটি প্রত্যাশা পূরণের পরও যে শূন্যতা আর হাহাকার, সেটি দূর করতেই প্রয়োজন আত্মিক উন্নয়ন।

আত্মিক উন্নয়নের অন্যতম ভিত্তিই হলো আত্মকেন্দ্রিক না হয়ে সমাজকেন্দ্রিক হওয়া। শুধু নিজের জন্য নয়, চারপাশে সবার জন্য বাঁচা, সবার কথা ভাবা।

একজন ধার্মিকের জীবন এবং ধর্ম সম্পর্কে উদাসী ব্যক্তির তুলনা হতে পারে দুটি গাছের সঙ্গে। একটি গাছ শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত বলে তা সজীব, সতেজ ও অপার্থিব আনন্দের উৎস। অন্যটি শিকড় বিচ্ছিন্ন বলে শুষ্ক, রুক্ষ ও বেদনার্ত। তাই আত্মিকভাবে ফিট হতে শাশ্বত ধর্মের সত্যিকার জ্ঞানে জ্ঞানী হোন এবং তা অনুসরণ করুন।

যিনি সহজে অন্যকে ক্ষমা করতে পারেন, অন্যের ব্যথায় সমব্যথী, মানবতার কল্যাণে নিজের মেধাকে সেবায় রূপান্তরিত করেন, তিনিই আত্মিকভাবে ফিট। আসছে ২১ মে বিশ্ব মেডিটেশন দিবস। সবাইকে অগ্রিম শুভেচ্ছা। ধ্যান করুন। অটুট রাখুন ভাবনার শক্তিকে। অর্জন করুন টোটাল ফিটনেস।

লেখক: অধ্যক্ষ, গোদাগাড়ী সরকারি কলেজ, রাজশাহী


উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে ভুল ধারণা ও করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চ রক্তচাপ, যা প্রায়ই একটি স্থায়ী রোগ হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ খুবই জরুরি। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা। তাই এ সম্পর্কে সচেতন থাকার বিকল্প নেই। যদি কারও রক্তচাপ নরমাল মাত্রার চেয়ে বেশি হয় এবং অধিকাংশ সময় এমনকি বিশ্রামকালেও বেশি থাকে, তবে ধরে নিতে হবে তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো-

(১) কোনো এক সময় একবার উচ্চ রক্তচাপ হলেই কি রোগী হিসেবে বিবেচনা করা হবে?

উত্তর: না, কেউ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে তা বলার আগে বেশ কিছু বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। যেমন অন্তত তিন দিন ভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার রক্তচাপ মাপতে হবে। এরপর যদি দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্তচাপ বেশি, তবেই বলা যাবে তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। অবশ্যই বসে রক্তচাপ মাপা উচিত, শরীর ও মন যেন শান্ত অবস্থায় থাকে, এমন সময় রক্তচাপ মাপতে হবে।

(২) কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ তো নেই, কেন চিকিৎসা নেব বা ওষুধ খেতে হবে?

উত্তর: অনেকেই মনে করেন, উচ্চ রক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না বা প্রয়োজন মনে করেন না। তাদের ধারণা ভালোই তো আছি, ওষুধের কি দরকার। এই ধারণাগুলো সম্পূর্ণ ভুল। অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। এটাই উচ্চ রক্তচাপের সবচেয়ে খারাপ দিক। নিয়ন্ত্রণ করা না হলে উচ্চ রক্তচাপ ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। যদিও অনেক সময় উচ্চ রক্তচাপের রোগীর বেলায় কোনো লক্ষণ থাকে না, তবুও নীরবে উচ্চ রক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক’। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৎপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে পারে না এবং এই অবস্থাকে বলা হয় হার্ট ফেইলিওর। রক্তনালি সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাক বা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে কার্যকারিতা হারাতে পারে। এ ছাড়া মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক হয়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে এবং চোখের রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ব বরণ করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি এবং বড় ধরনের জটিলতা এড়াতেই ওষুধ দেওয়া হয়।’

(৩) উচ্চ রক্তচাপ হলে কি চিকিৎসা করাতেই হবে? ওষুধ সেবন কি খুবই জরুরি?

উত্তর: অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত জানার পরেও ওষুধ খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা খেতে চান না। কারও কারও ধারণা একবার ওষুধ শুরু করলে তা আর বন্ধ করা যাবে না। সারা জীবন খেতে হবে। তাই ওষুধ শুরু না করাই ভালো। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, এ চিন্তাও বিপজ্জনক। মনে রাখতে হবে, উচ্চ রক্তচাপ সারে না, একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর জন্য নিয়মিত ওষুধপত্র সেবন করতে হবে।

(৪) রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ কি বন্ধ করা যাবে?

উত্তর: অনেক রোগী কিছুদিন ওষুধ ব্যবহার করার পর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলে ওষুধ বন্ধ করে দেন, মনে করেন রক্তচাপ ভালো হয়ে গেছে, কাজেই ওষুধ খাওয়ার দরকার কি? এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই ধরনের রোগীরাই হঠাৎ করে হৃদরোগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে। কোনোক্রমেই ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া ওষুধ সেবন বন্ধ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদের অবশ্যই ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে, নিয়মিত সারা জীবন ওষুধ সেবন করতে হবে এবং নিয়মিত চেক করাতে হবে।

(৫) উচ্চ রক্তচাপ কি শুধু বয়স্কদেরই হয়?

উত্তর: শুধু বয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপ হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। যেকোনো বয়সেই উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, বয়স হলে রক্তচাপ একটু বেশিই থাকে, এ জন্য চিন্তার কিছু নেই, এমন ধারণাও সঠিক নয়। উচ্চ রক্তচাপ যে বয়সেই ধরা পড়ুক, তাকে উচ্চ রক্তচাপ হিসেবেই গণ্য করা উচিত। উচ্চ রক্তচাপকে স্বাভাবিক না ভেবে নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং চিকিৎসা নিলে জটিলতা এড়ানো সহজ হয়।

(৬) তরুণ বয়সে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে কি?

উত্তর: অনেকে ভাবেন, উচ্চ রক্তচাপ বয়স্কদের রোগ। আসলে তা নয়। অল্প বয়সেও উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের বংশগত ধারাবাহিকতা আছে, যদি বাবা-মায়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমনকি নিকটাত্মীয়ের উচ্চ রক্তচাপ থাকলেও অন্যদের রক্তচাপের ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া অন্যান্য কারণ হতে পারে, যেমন-
অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ফাস্ট ফুড, অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, প্রক্রিয়াজাত খাবার ইত্যাদি। অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা, খেলাধুলা, ব্যায়াম বা কায়িক শ্রমের অভাবে অল্প বয়সিদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়ছে।

কিছু কিছু অঙ্গে আক্রান্ত রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। যেমন কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনির বংশগত রোগ,
গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি অ্যাকলাম্পসিয়া হলে, অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েড গ্রহণ এবং ব্যথা নিরামক কিছু কিছু ওষুধ সেবন করলে।

(৭) উচ্চ রক্তচাপ হলে ঘাড় ব্যথা হয় কি?

উত্তর: ঘাড়ে ব্যথা হলে কেউ কেউ মনে করেন, নিশ্চয়ই রক্তচাপ বেড়েছে। এই ধারণা অমূলক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রক্তচাপ বৃদ্ধির কোনো উপসর্গ বোঝা যায় না।

(৮) লবণ ভেজে খাওয়া যাবে কি?

উত্তর: উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে খাবারে বাড়তি লবণের ব্যবহারে বারণ। শুধু তরকারিতে যতটুকু লবণ দেওয়া হয় তা খাওয়া যাবে। অনেকের ধারণা কাঁচা লবণ নিষেধ; কিন্তু লবণ ভেজে খাওয়া যাবে। এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। কাঁচা বা ভেজে খাওয়া লবণে কোনো পার্থক্য হবে না।

(৯) মাংস, ডিম, দুধ খাওয়া নিষেধ কি?

উত্তর: অনেকের ধারণা, উচ্চ রক্তচাপ হলে মাংস, ডিম, দুধ খাওয়া নিষেধ। এসব খাবার খেলে রক্তচাপ বাড়ে। এটা ঠিক নয়। পরিমাণ মতো এগুলো খাওয়া যাবে, তবে গরু বা খাসির মাংসের চর্বি পরিহার করতে হবে।

(১০) তেঁতুল গুলে খেলে বা টক খেলে রক্তচাপ কমে কি?

উত্তর: অনেকে মনে করেন রক্তচাপ বাড়লে পানিতে তেঁতুল গুলে খেলে বা টক খেলে রক্তচাপ কমবে। আসলে মনে রাখতে হবে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল, তেঁতুল বা টক খাওয়ার সঙ্গে রক্তচাপ কমার কোনো সম্পর্ক নেই।

(১১) উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাই স্যালাইন খাওয়া যাবে না?

উত্তর: ডায়রিয়া, বমি, পানিশূন্যতা বা লবণশূন্যতা হলে খাওয়ার স্যালাইন খেতে হয়; কিন্তু উচ্চ রক্তচাপের রোগী ভাবেন, তার স্যালাইন খাওয়া নিষেধ; কিন্তু এসব জরুরি পরিস্থিতিতে পানি ও লবণশূন্যতা পূরণ করা আগে জরুরি। তাই দরকারে স্যালাইন খেতে নিষেধ নেই।

উপসংহার: মনে রাখতে হবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, অতিরিক্ত ওজন, ধূমপান, মদ্যপান, তেল-চর্বিজাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। জীবনাচরণ পরিবর্তন করে রক্তচাপ বাড়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। আর ওষুধ সেবনের বেলায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেকেই ফার্মেসিতে গিয়ে দোকানির কাছ থেকে অথবা নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খেয়ে থাকেন। যেকোনো অসুখের ক্ষেত্রেই এটি বিপজ্জনক।’ মনে রাখতে হবে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য জীবনযাপন পদ্ধতির সঠিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিয়মিত ওষুধ সেবন অত্যন্ত জরুরি। যারা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদের অবশ্যই ডাক্তারদের পরামর্শ নিতে হবে এবং নিয়মিত চেক করাতে হবে।

লেখক: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক


বাজেট অগ্রাধিকারে থাকুক ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কর্মসংস্থান’

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১৪:৩৪
মোতাহার হোসেন

আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের কাজ প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজস্ব বোর্ড পরামর্শের জন্য ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, নাগরিক সমাজসহ সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করেছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তর অধিদপ্তর থেকেও তাদের চাহিদা, সম্ভাব্য পরামর্শ নিয়েছে; কিন্তু বিগত যেকোনো সময়ের তুলনায় এবারের বাজেট প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং দেশের মানুষের চাহিদাপূরণে সরকারকে বিরাট চ্যালেঞ্জে পড়তে হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে- করোনাপরবর্তী রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের সঙ্গে নতুন করে ইরানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন. ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সম্ভাব্য সংকট মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতে।

মূলত বাংলাদেশের মতো বিকাশমান বা উন্নয়নশীল দেশে দিনের শেষে বাজেট হচ্ছে সরকারের আয়-ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব। এতে কিছুটা উন্নয়ন অর্থায়নের পরিকল্পনা, সাধারণ জনগণকে কিছুটা আশ্বস্ত আর কিছুটা সহায়তা করার পরিকল্পনাও থাকে। বাজেট প্রণয়ন, বিশেষ করে গুণগতমান বজায় রেখে বাজেট বাস্তবায়ন বেশ কঠিন হলেও উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টায় বাজেট বাস্তবায়ন করা হয়। তবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মাঠপর্যায়ে তহবিল বা বরাদ্দ ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট অগ্রগতি হচ্ছে।

প্রসঙ্গত বর্তমানে জাতীয় অর্থনীতি একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়ালেও করোনাপরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব এবং চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্য সংকটের মধ্যেও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতির উন্নয়নের গতিধারাকে এগিয়ে নিতে হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশকে আরও সুদৃঢ় ও জোরদার এবং চলমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, দেশের বিনিয়োগ ও উৎপাদনশীল খাতকে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করতে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব বাজেট প্রণয়নের প্রত্যাশা করেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। রাজস্ব বোর্ড এবং এফবিসিসিআইর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে এই প্রত্যাশার কথা জানান এফবিসিসিআই।

প্রধানমন্ত্রীর দিক-নির্দেশনা, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ পরিকল্পনা এবং আন্তরিক প্রয়াস দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সুদৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট উন্নত বাংলাদেশে উন্নীত পথে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে জনমুখী ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রণয়নে প্রয়োজন করের বোঝা কমানো, আমদানিকৃত কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত এআইটি, আগাম কর প্রভৃতি প্রত্যাহার করা। ব্যাংক ঋণের সুদহার হ্রাসসহ আমদানি পণ্যের শুল্কায়নে ও পণ্য খালাসের জটিলতা দূর করার বিষয় গুরুত্বসহ দেখা দরকার। একই সঙ্গে কর কমিয়ে আয়কর ও মূসকের আওতা সম্প্রসারণের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং সক্ষম ব্যক্তিদের করের আওতায় আনা দরকার। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিতকরণে ব্যাংকিং কমিশন গঠন, দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না করার প্রস্তাবও আসে বৈঠকে। মানুষের প্রকৃত আয় বিবেচনায় রেখে- আগামী জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দেন তিনি।

বাজেট প্রণয়নে যুক্ত কর্মকর্তাদের মনে রাখা উচিত বিশ্ব পরিস্থিতি এখন টালমাটাল। এমনি অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বাজার মনিটরিং, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্সপ্রবাহ, রপ্তানি বৃদ্ধি, বহুমুখীকরণ, সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সন্ধান, মানব সম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কার্যক্রম জোরদার করা দরকার। বিদ্যমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রাগুলোর আলোকে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ব্যবসায়িক খরচ কমিয়ে আনা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রা ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা, শিপিং খরচসহ সব ধরণের পরিবহন খরচ হ্রাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তার পাশাপাশি কর আদায়ে হয়রানি ও জটিলতা নিরসন দরকার। কর্মসংস্থানের স্বার্থে বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবাখাতে করের যৌক্তিক নির্ধারণ দরকার। পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ও ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে। রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প সুবিধা নিশ্চিত করা এবং বিকল্প সহায়তা হিসেবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহন খাতে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- বিশেষ করে চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্য তেল, চিনিসহ সকল প্রকার কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যকে উৎসে কর কর্তনের আওতা বহির্ভূত রাখার বিষয়ে ভাবতে হবে।

ইতোপূর্বে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘সবাই বলেছেন আমরা সঠিক পথে আছি। কী কী সমস্যা আছে, তা সবাই জানেন। তারপরও তারা তাদের মতো করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো ঠিক আছে বলে মত দিয়েছেন।’ আগামী বাজেটে নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার যে সমস্যা চলমান আছে, সেটা দূর করতে হবে। অবশ্য সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পাশাপাশি করের আওতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছি। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধিকারগুলো যেন যথাযথভাবে নির্ধারণ করা হয়, সেটি বলেছি। খেলাপি ঋণ কমানো, বিদেশি ঋণ কম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ছাড়া সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে বৈঠকে।’ তিনি ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশেরও পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ‘বর্তমানে দেশে আয়বৈষম্য উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। আয়বৈষম্য কমাতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছি আমি। এ ক্ষেত্রে ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর আদায় করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক কর্মসূচিসহ যেসব খাত থেকে প্রান্তিক মানুষ উপকৃত হবে, সেসব খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এবং আগামী বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।’

আগামী অর্থবছরের বাজেটে বড় প্রকল্প কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, যে প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশি সময় লাগে এবং ফল আসতে দেরি হয়, সে ধরনের প্রকল্প যেন কমিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীতে দেশ ও মানুষের উন্নয়নের জন্য পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইন্টারনেট অব থিংস, রোবোটিকস, ক্লাউড কম্পিউটিং, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, সেন্সর, অটোমেশন, থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, জিন ও প্রকৌশল প্রযুক্তির সমন্বয়ে আজকের বিশ্বে দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বিশ্বায়নের এই প্রশস্ত আঙিনায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে করণীয়, ভবিষ্যৎ-সম্ভাবনা, পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল তৈরির উপায়, সমস্যার সমাধান ইত্যাদি বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাজেটে এসব অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব পদক্ষেপের সঙ্গে সাধারণ জনগণকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা ও তাদের প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দক্ষ করে তোলার প্রয়াস সফল হলেই অর্থনীতিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

বর্তমান ও ভবিষ্যৎ-বিবেচনায় প্রাধান্যের ভিত্তিতে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে যেসব মানুষ পারদর্শী ও পেশাদার, তাদের কদর পৃথিবীব্যাপী বেড়েই চলেছে। তাই পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির বিষয়টি সামনে রেখে দেশে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবলের সমন্বয়ে স্মার্ট ইকোনমির ধারণা বর্তমানে একটি পরিজ্ঞাত বিষয়। বর্তমানে দেশে ৩ লাখ মানুষ সক্রিয়ভাবে আইসিটি খাতে কর্মরত রয়েছেন। এ ছাড়া ৫ লাখ রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার আইসিটি বিষয়ে কাজ করছেন। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে জনবহুল বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থানের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে প্রযুক্তির মাধ্যমেই। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি প্রয়োজন। মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ব্যাংকিং, অনলাইনে মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ফোনের এসএমএসের মাধ্যমে এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন প্রভৃতি এখন বেশ জনপ্রিয়। জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণসহ এসব বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নই জনপ্রত্যাশা।

লেখক: সাংবাদিক

বিষয়:

নেটওয়ার্ক ও টেলিটক সিম

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১২:৩৪
আহমেদ কবির রিপন

বর্তমান দৈনন্দিন জীবন বা সময়ের সমষ্টি অতিবাহিত হচ্ছে মোবাইল বা সেলফোনের দ্বারা। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণে সেলফোনের যুগে টেলিটক বিশেষ অবদান রাখছে তাই কিছু কথা লেখার তাগিদ অনুভব করছি। এ যুগে এখন প্রতিটি পরিবারে একাধিক সংখ্যক মোবাইল বা সেলফোন রয়েছে যা তিন-চার দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল। বর্তমানে লক্ষণীয় যে কোনো কোনো পরিবারে এক ব্যক্তির জন্য ২-৩টি মোবাইল ফোনও আছে।

স্কুল-কলেজে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের হাতেও মোবাইল থাকা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা এখন অনলাইনে মোবাইল ফোন বা সেলফোনের দ্বারা ক্লাস করে থাকেন। ব্যবসায়িক কাজে ও মোবাইল বা সেলফোনের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য, চাকরিজীবীদের সেলফোন ছাড়া চলেই না এ ছাড়া বিভিন্ন পেশাজীবীদেরও এখন মোবাইল লাগে, উচ্চশ্রেণি ছাড়াও এমনকি নিম্নশ্রেণি পেশার জনগণকে, রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, গার্মেন্টশ্রমিকরাও সেলফোন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন তা ছাড়া বিশেষ করে প্রবাসীদের প্রতিটি পরিবারের কাছে মোবাইলের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক পরিবারের সদস্যরা সুখ-দুঃখের খবরাখবর মোবাইল বা সেলফোনের মাধ্যমে নিয়ে থাকেন। একজন কৃষক খেত-খামারে থেকে মোবাইলের মাধ্যমে তার দূরবর্তী অবস্থানরত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে নিতে পারেন। এ দেশে মোবাইল বা সেলফোন নেই এমন লোকের সংখ্যা খুবই কম।

যেসব এলাকায় নেটওয়ার্ক কম বা অস্পষ্ট ওইসব এলাকায় মোবাইল থেকেও ব্যবহারকারীদের খুব একটা লাভ হচ্ছে না। তাৎক্ষণিকভাবে কথাবার্তা, প্রয়োজনীয় খবরাখবর দ্রুত আদান-প্রদানে জনগণ খুবই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বিটিসিএলের মাধ্যমে বা সরকারি ব্যবস্থাপনায় অধিক পরিমাণে সরকারি সিম বা টেলিটক কোম্পানির সিম, বাজারজাতকরণের জরুরি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

এই সিম ব্যবহারের ফলে দেশের একাংশের অবহেলিত দরিদ্র জনগণের সমস্যার কথা তারা একে অপরের কাছে ও বৃহৎ পরিষরে তুলে ধরতে পারবে।

শিক্ষার্থীরাও বাড়িতে বসেই অনলাইনে সহজে ক্লাস করতে পারবে এবং দেশ গড়ার ক্ষেত্রে দক্ষ সৈনিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে।

ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশাজীবীদের কাজের গতি আরও বাড়বে। গ্রাম-গঞ্জের খবরাখবর আদান-প্রদানে অনেক সহায়ক হবে। বিশেষ করে হাওর ও পাহাড়িয়া দুর্গম অঞ্চলের জনগণ অনেক উপকৃত হবে, যেমন- ‘হাকালুকি’ হাওরতীরবর্তী বিশাল জনগোষ্ঠীর অসুবিধা লাঘবে প্রয়োজনীয় স্থানে অধিকসংখ্যক টাওয়ার স্থাপন করে মোবাইল যোগাযোগের সুবিধা বর্ধিতকরণ দরকার। তাহলে ওই এলাকার জনসাধারণের জীবনমানের সহজে উন্নতি ঘটবে এবং প্রধানমন্ত্রীর মহতী উদ্যোগ গ্রামের উন্নয়ন, কৃষকের উন্নয়ন সর্বোপরি দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং সরকারও সঠিক পদ্ধতিতে কর সংগ্রহে সফলতা অর্জন করবে। গ্রাহকদের অযাচিত ভোগান্তি দূর হবে।

আমরা লক্ষ্য করছি, বর্তমান প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ডাকঘরগুলোতে বিভাগীয় সেবার পরিমাণ অনেকটা বেড়েছে তাও সম্প্রতি বর্তমান সরকারের উন্নয়নমূলক কিছু সিদ্ধান্ত ও প্রকল্প গ্রহণের ফলে, সেই সঙ্গে ডাক বিভাগের নিয়োজিত জনবলকে আরও উন্নত প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেলিটক সিম বিপণন ও নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার উন্নয়ন আরও বৃদ্ধি করে গ্রাহকদের সহজে বেশি পরিমাণ উন্নত সেবা প্রদান করা সম্ভব। জরুরি এবং প্রতিযোগিতামূলক প্রকল্প গ্রহণ করার মাধ্যমে ডাক বিভাগের টেলিটক সিম বিপণন ও অন্যান্য সেবা প্রদান, ডাক জীবন বীমা সেবা, সঞ্চয়পত্র বিপণনসহ ডাক বিভাগের আওতাভুক্ত পার্সেল সেবা, বুকপোস্ট, রেজিস্টার্ড সংবাদপত্র, মানি ওর্ডার সেবা, এপ্রেস সেবা, জিইপি ও ইএমএস সেবা, ই-পোস্ট এবং ইন্টেল পোস্ট সেবাসহ সব পরিসেবাগুলো গ্রামগঞ্জের মানুষ যাতে সহজে ভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে বর্তমান নীতি-নির্ধারকরা ও বাজেট প্রণয়নকারীরা এদিকে বিশেষ নজর ও বরাদ্দ বৃদ্ধি করে সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জের মানুষের নেটওয়ার্ক সমস্যা লাঘবের জন্য টেলিটক কোম্পানির বিভিন্ন জায়গায় অধিক পরিমাণ টাওয়ার নির্মাণ ও দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধান করা সহজ হবে, তাতে দেশের টাকা দেশে থাকবে, উন্নত সেবা নিশ্চিত হবে। জনস্বার্থে অতীব প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলোর সমাধানে সম্মিলিতভাবে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে সরকারের সঙ্গে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে সবাইকেই যার যার জায়গায় আরও বেশি গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

লেখক: পরিবেশকর্মী


গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র

আপডেটেড ১৯ মে, ২০২৪ ১২:৩৫
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর স্বাধীন ও নিরেপক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রথম ধাপে দেশের ১৫২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৮ মে। পাশাপাশি দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। সে ক্ষেত্রে আগামী ২১ মে এসব উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ভোট দিয়ে পুনরায় নির্বাচিত করেছে। ফলে পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ঈর্ষান্বিত স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যরা। গণতন্ত্র ও জনগণের কাছে পরাজিত হলেও গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থামিয়ে দেয়নি। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংঘটিত বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কমাতে এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি কুচক্রীমহলের তৎপরতা এখনো বিদ্যমান। বাংলাদেশের আসন্ন উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনকে ঘিরে তা বানচাল এবং তাতে ভোটার উপস্থিতি কমানোর লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র থেমে নেই।

উল্লেখ্য, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বানচাল করে অবৈধভাবে সরকারের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনের পূর্ব থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করেছে বিএনপি ও তাদের বিদেশি মিত্ররা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি কমাতে বিএনপি কঠিন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পথ অবলম্বন করেও তাতে সফল হতে পারেনি। বিএনপির সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করে সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করেছে।

নির্বাচন বানচালে সব অপপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এখন তাদের নতুন কৌশল হচ্ছে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত যেকোনো নির্বাচনকে যে করেই হোক প্রশ্নবিদ্ধ করা। দেশি-বিদেশি সব পর্যবেক্ষক যেখানে বলেছে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সেখানে বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ আসন্ন উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচনেও ষড়যন্ত্র করে ভোটার উপস্থিতি কমিয়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে নতুন করে অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ হিসেবে বিএনপি প্রথমে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা তাই করেছিল। তারা ভেবেছিল যে যদি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে তাহলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে বাতিল হবে; কিন্তু সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপি ছাড়া অন্যান্য যত গণতান্ত্রিক দল ছিল তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অবাধ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত হয়েছে এবং ষড়যন্ত্রকারী বিএনপির সব ধরনের ব্যর্থতায় রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে। তারপর থেকে তারা বাংলাদেশবিরোধী আন্তর্জাতিক চক্রের প্ররোচনায় পড়ে মিথ্যাচার করেছে। বাংলাদেশবিরোধী বিদেশি অপশক্তিগুলোর সাথে আঁতাত করে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে করা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় আসন্ন উপজেলা নির্বাচনও বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে অপপ্রচার চালিয়ে সরকার ও দেশকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে। দেশের উন্নয়নে অংশীদার না হয়ে দেশ ও সরকারের অর্জনকে বিতর্কিত ও ম্লান করার জন্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সদ্য অতীত ইতিহাস বলছে শুধু নির্বাচন বর্জন করেই থেমে যায়নি বিএনপি। নির্বাচনের আগে থেকে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনী ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম রাখার লক্ষ্যে বাস, ট্রেন, ভ্যান, ট্রাক, রিকশা এবং মোটরসাইকেলে আগুনসন্ত্রাস তথা জ্বালাও-পোড়াওয়ের মতো সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে জনমনে ভীতির সৃষ্টি করে নির্বাচন বানচালের অপপ্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। নির্বাচনের দিন ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর চালিয়েছে। নির্বাচনের আগের দিন থেকে শুরু করে একটানা তিন দিন সহিংসতা চালিয়ে গিয়েছে; কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- বিএনপির আগুনসন্ত্রাসকে এ দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ একদমই তোয়াক্কা করেনি। বিএনপি কর্তৃক পরিচালিত সব ধরনের আগুন ও সহিংসতাকে উপেক্ষা করে এ দেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ ভোট দিয়ে বিপুল ভোটে পুনরায় নির্বাচিত করে জনগণের সমর্থন ও শক্তিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগকে। বিএনপির ভুলে গেলে চলবেনা যে বাঙালিরা বীরের জাতি। আগুনসন্ত্রাসী করে তাদের দমিয়ে রাখা যায় না। বিএনপি চেয়েছিল জ্বালাও-পোড়াও করে বাঙালি জনগণকে ভোটের দিন ঘরের ভিতর আটকে রেখে নির্বাচন বানচাল করতে; কিন্তু তা আর হলো কই, গণতন্ত্রমনা সাহসী বাঙালি জনগণ সব ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে উপেক্ষা করে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি হরতাল-অবরোধের নামে দেশের অচলাবস্থা সৃষ্টির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বিএনপির। সেই লক্ষ্যেই মূলত ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে ৬ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। ৬ জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে বিএনপি কর্মসূচি দিয়েছিল। এভাবে হরতাল-অবরোধের নামে দলটি দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে গিয়েছে। নির্বিঘ্নে কর্মসূচি পালনের সুযোগও নিতে চাচ্ছে না দলটি। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন কর্মসূচি জনসম্পৃক্ত করে তুলতে না পারা এবং আন্দোলনের জন্য নতুন ইস্যু সৃষ্টির ব্যর্থতায় এমন সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে দলটি। এখন দলের কর্মসূচিও আসে অজ্ঞাত স্থান থেকে। মাঠেও দেখা যায় না দলীয় কোনো নেতা-কর্মীকে। রাজনৈতিকভাবে পরাজিত বিএনপির সন্ত্রাসী নেতা-কর্মীরা অজ্ঞাত স্থান থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনায় সব ধরনের সহিংস কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনকে বানচাল এবং প্রশ্নবিদ্ধ করতে।

অতীতের মতো এখন আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরেও বিএনপির প্রস্তুতি অপরিবর্তনীয়। তারা ইতোমধ্যে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। এখন থেকে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বাকি সময়টুকু তারা কীভাবে অতীতের মতো আগুনসন্ত্রাস করে বাঙালি জনগণের মনে ভীতির সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমিয়ে নির্বাচনকে বানচাল করা যায় সেই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নীলনকশা আঁকছে বিদেশি অপশক্তিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে তারা এ ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী অপকর্ম করে সফল হতে না পারলেও নষ্ট করে দেশীয় অনেক সম্পদ এবং কেড়ে নেয় বাংলাদেশের সাধারণ এবং খেটে-খাওয়া মানুষের তাজা প্রাণ। নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি-জামায়াতের মতো গণতন্ত্রবিরোধী অপকর্ম অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল।

বিএনপির ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অপরাজনীতি শুধু ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কমানোর ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়- তাদের ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা পর্যন্ত বিস্তৃত। আর সেই লক্ষ্যেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে বিএনপি ষড়যন্ত্র করে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ইতিহাসের জঘন্যতম এবং ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ঘটিয়েছিল। ১৯ বছরের আগের এ দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্যতম দিন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার জঘন্য অপচেষ্টার দিন। দেশের মানুষ আজও কেঁপে ওঠেন শনিবার ওইদিনটির কথা ভেবে। কতশত মানুষ মনের অজান্তে কেঁদে ফেলেন। স্বজন হারানোরা খুঁজে ফেরেন প্রিয় মানুষের স্মৃতি। সেদিন যদি ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত ট্রাকে বিস্ফোরিত হতো- আজ হয়তো বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে থাকতেন না। মারা পড়তেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারাও। মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই এমন পৈশাচিক হামলা চালায় ঘাতকরা। এ ছাড়া ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জনসমর্থন নিয়ে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসার পরপরই বিএনপি ষড়যন্ত্র করে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহ ঘটায়, যেন আওয়ামী লীগের জয়কে বানচাল করে দিয়ে তাদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা যায়। এমন ন্যক্কারজনক ঘটনায় প্রাণ হারায় হাজার হাজার বাঙালি শ্রেষ্ঠ সন্তান বিডিআরের বিভিন্ন উচ্চ পদের কর্মকর্তারা।

সুতরাং, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মূলত ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তনির্ভর একটি রাজনৈতিক দল। তাদের রাজনৈতিক আদর্শের মূলে রয়েছে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। তাদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের বিস্তার শুধু নির্বাচন ঘিরেই নয় বরং আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষও তার আওতাভুক্ত। আওয়ামী লীগ যেখানে জনগণের সমর্থন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিএনপি সেখানে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ সেখানে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে সংঘটিত করতে নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়ে গণতন্ত্রের বিজয় নিশ্চিত করতে যাচ্ছে। সেখানে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও বিএনপি ভোটারদের কম উপস্থিতি নিশ্চিত করতে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে ও চক্রান্তে লিপ্ত আছে। স্বাধীন ও নিরেপক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংঘটিত বিভিন্ন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক বিজয় বিএনপির রাজনৈতিক পরাজয়কে নিশ্চিত করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে বিজয়ের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারবে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা জনগণ সব ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে।

লেখক: উপাচার্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়


শিশুশ্রম রোধে আমাদের করণীয়

আপডেটেড ১ জানুয়ারি, ১৯৭০ ০৬:০০
সোমা মুৎসুদ্দী

শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজ যারা ছোট শিশু তারাই আগামী দিনের দেশ পরিচালনায় গুরুদায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু নানা কারণে আমাদের দেশের শিশুরা আজ উপযুক্ত পরিচর্যা থেকে বঞ্চিত ও অবহেলিত। জীবন-জীবিকার তাগিদে তারা বাধ্য হচ্ছে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে এবং তাদের বাধ্য করা হচ্ছে হাড়ভাঙা খাটুনিতে। তাই শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে জাতিসংঘ ও নানা সংস্থা আছে বিভিন্ন কর্মসূচি পালনে। নানা কারণে শিশুশ্রম সমাজ ও দেশে শিকড় গেড়ে বসেছে। এখনো আমাদের দেশে দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ। এরা অভাব-অনটন ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে ও জ্বালায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের সন্তানদের শিশুশ্রমে বাধ্য করানো হচ্ছে। এ ছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম-আর্থিক বণ্টনের প্রতিক্রিয়ার ফলে শিশু শ্রমিকের সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। আমাদের দেশে পিতৃমাতৃহীন শিশুরাই অধিক হারে শিশুশ্রমে জড়িত। বেঁচে থাকার জন্য নিরুপায় হয়ে তারা এপথে পা বাড়ায়। বিদ্যালয়ের প্রতি অনীহাও শিশুশ্রমের অন্যতম একটি কারণ। আন্তর্জাতিক, শ্রমসংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় বিভাগীয় শহরাঞ্চলে প্রায় ৩০১, পুরাতন জেলা শহরে ২০১, নতুন জেলা শহরে ১৮৭, থানা সদরে ১৩৩, পার্বত্য এলাকাগুলোতে ২৩ এবং পল্লি এলাকায় ৯৪ ধরনের কাজে শিশুরা শ্রম দিচ্ছে। এসব কাজের মধ্যে আছে- কুলি, হকার, রিকশা শ্রমিক, ফুল-বিক্রেতা, আবর্জনা সংগ্রাহক, ইটপাথর ভাঙা, হোটেল শ্রমিক, বুনন কর্মী, মাদক বাহক, বিড়ি শ্রমিক, ঝালাই কারখানার শ্রমিক, বেডিং স্টোরের শ্রমিক ও গৃহকর্মীর পেশা। তা ছাড়া ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম’ শীর্ষক আরেক সমীক্ষায় দেখা যায়, কিছু বিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও শিশুরা নিয়োজিত রয়েছে। যেমন- ইলেকট্রিশিয়ান, রাসায়নিকদ্রব্য তৈরির কারখানায় কাজ, মাদকদ্রব্য বিক্রি ও বহন। সমুদ্রবন্দর এলাকায় শিশুদের জোর করে মাফিয়া চক্রে যুক্ত করানো। এই উদ্দেশে অনেক শিশুকে অপহরণ করে পাশের দেশসহ নানা দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। চুরি, ছিনতাই, ভিক্ষাবৃত্তিসহ নানা কাজে এদের লাগিয়ে এক শ্রেণির দেশ ও সমাজবিরোধী লোক প্রচুর অর্থ উপার্জন করে। তা ছাড়া পোশাকশিল্প কারখানাতেও হাড়ভাঙা খাটুনিতে শিশুদের নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া শহরবাসী ভদ্রলোকদের বাসার কাজে শিশুরা প্রধান শ্রমিক হিসেবে কাজ পায়। শিশুদের শ্রমবৃত্তিতে নিয়োগ প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বর্তমানে সভ্য দেশগুলোতে মানুষ যেখানে বিবেকশক্তি ও স্বাধীনতাবোধের বড়াই করে সেখানেও রয়েছে শিশুশ্রমের মতো ভয়ংকর পেশা। মানবতা আজ বড়ই বিপন্ন। বিশ্বের সব শিশুই, শিশু শ্রমিকরা মালিকের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকার বঞ্চিত শিশুরা, তাদের শ্রমকর্তা কর্তৃক শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই নির্যাতিত হয়ে থাকে। দিনভর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেও তারা দুবেলা পেট ভরে খেতে পায় না। অদক্ষ শ্রমিক বলে তাদের নেই নির্দিষ্ট মজুরি, অথচ আছে কথায়, কথায় জুলুম আর নিপীড়ন। সামান্যতম অমনোযোগিতার অভিযোগ এনে, গায়ে লাথি ও বেতের বারি সহ্য করতে হয় তাদের। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশের শহরাঞ্চলে বড়লোকদের ঘরে শিশু নির্যাতনের হার বেড়ে গেছে। এদের ঘরে কাজের মেয়ে হিসেবে যারা কাজ করে তাদের সামান্য অপরাধের জন্য বাড়ির গৃহিণী অমানবিক শাস্তি দিয়ে থাকে। গায়ে আগুনের ছেঁকা দেওয়াসহ, খেতে না দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো পত্রিকার পাতায় এসব নৃশংস ঘটনা খবরের কাগজে প্রকাশ পাচ্ছে। এ ছাড়া কল-কারখানায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন শিশু শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। শিশুশ্রম একটি মানবতাবিরোধী ও জঘন্য কাজ। শুধু বাংলাদেশেই নয় যেকোনো দেশের জন্য এর পরিণতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কারণ যে শিশুরা জাতির কর্ণধার ও ভবিষ্যৎ, শিশুশ্রমের কারণে তারা হয়ে উঠছে অযোগ্য ও অকর্মণ্য। শিক্ষা ও সুন্দর পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা হয়ে যাচ্ছে সামাজিকভাবে পঙ্গু। অতিরিক্ত শ্রমদানের ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য নষ্ট হয়, তারা নানা অপুষ্টিতে রোগে ভোগে। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘাটতি পূরণ হয় না ও জীবনীশক্তি ক্ষয় পেতে থাকে। তাদের ভাঙা স্বাস্থ্য আর উদ্ধার হয় না, ফলে শিশুরা অভিশপ্ত জীবন নিয়ে সমাজে বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ শিশু ও নারী নির্যাতন আইন বলবৎ থাকলেও এর মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। কেবল আইন দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য চাই জনসচেতনতা। উপযুক্ত শিক্ষার প্রসার ও দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, যারা শিশু শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে, বিভিন্ন বিদেশি এনজিও ও সরকারকে নিতে হবে শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব। এক কথায় যেভাবেই হোক, আমাদের দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুশ্রম রোধ করতে হবে। না হয় জাতির ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার ও অভিশাপগ্রস্ত। তবে আশার কথা হলো এই কাজের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ইতোমধ্যে অনেক দরিদ্র পিতামাতাই তাদের সন্তানদের কাজে দেওয়ার পরিবর্তে বিদ্যালয়ে পাঠাতে শুরু করেছে। মানবতার বিকাশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে শিশুশ্রম রোধে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বস্তি এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে বিদ্যালয় খুলে তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্ব শিশু দিবসে শিশুর অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও শিশুশ্রম বন্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে ও শিশুশ্রমের প্রতি নিন্দা জানাতে হবে। এই সমস্যা সমাধানে প্রতিটি রাষ্ট্রের সরকার সচেতন হলেও কিছু মানুষের অসহযোগিতার কারণে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাচ্ছে না ও সরকারি নানা উদ্যোগ অনেক সময় মুখ থুবড়ে পড়ছে। তবুও চাই আমরা সরকারের পাশাপাশি যে যার অবস্থান থেকে শিশুশ্রমকে না বলব ও শিশুশ্রম বন্ধে কাজ করে যাব জয় হোক মানবতার।

লেখক: বাচিকশিল্পী ও কবি

বিষয়:

banner close